x=0=y
বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়ে ভাবছিলাম। “x=0 এবং y=0 বা x=0=y বা x=y / শূন্য 0 থেকে প্রাণী x ও y সৃষ্টি হলো / এইভাবে বিশ্ব
সৃষ্টি শুরু হয়েছিল”। প্রাণীরা শূন্য থেকে সৃষ্টির পর কখনো কি শূন্য
গড়িয়ে পড়ে প্রাণীর ওপর?
আমার বারান্দা থেকে দামোদর নদী বেশি দূরে নয়। দামোদরের পাশে শ্মশানের দূরত্বও বেশি নয়। বারান্দায় চেয়ারে বসে ওইদিকে তাকিয়ে
পাখি ওড়া দেখি। চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই নদীর বুকের মাঝে শ্বেতপদ্ম আর শরবন। দেখতে পাই
ছাইস্তুপ। আগুনে পোড়া মৃতদেহের কর্পূর গন্ধ উড়ে আসে না আমার
বারান্দা পর্যন্ত। বারান্দায় বসে ভাবছিলাম, সদ্য গজানো তুলসি গাছের চারার সংখ্যা অনেক কম লাগছে। আজকাল বড় পায়রার উৎপাত হয়েছে। চারাগাছগুলো সব খুঁটে খেয়ে ফেলছে। টবের মাটি আঁচড়ানো। মাটি নরম
হলে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এই গরমে রোজ হালকা জল না দিলে আবার গাছের অঙ্কুরোদ্গম
হবে না।
এবছর ভালোই গরম
পড়েছে। রাস্তায় বের হলে পুড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি। এবছর অনেক মৃতদেহ শ্মশানের সামনে লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকে। বারান্দা থেকে
দেখলাম ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ বলতে বলতে আর একটা মৃতদেহ চলছে। খই আর পয়সা ছিটিয়ে যাচ্ছে কেউ। একজন মারা গেলে বাকি পৃথিবীর ভালো হোক। তাদের জন্য
থাকল অন্ন ও কাঞ্চন। শুনলাম শ্মশানের একটা ডোম মারা গেছে গরম আর আগুনের তাপ সহ্য
করতে না পেরে। মৃত্যুর আগুন উস্কে আরও মৃত্যু।
মলয় রায়চৌধুরীর লেখা তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরীর টুকরো স্মৃতি স্ক্রিনে ভেসে উঠল। ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ শুনে
তাঁরা ছোটবেলায় ছুটতেন। তামার পয়সা কুড়োনোর জন্য। সেই পয়সা দিয়ে সমীর রায়চৌধুরী
আলুকাবলি কিনে খেতেন। আলুকাবলি আর তামার পয়সা দুটোই গোল আকৃতির। ছোট ছোট করে
ভেঙে আলুকাবলি খুঁটে খেতে আমারও ভালো লাগত।
জয়দেবকাকা ছোটবেলায় একবার আমাকে আলুকাবলি
খাবার জন্যে দশ পয়সা দিয়েছিলেন। পয়সাটা রাস্তাতে পড়ে ছিল। তখন দশ পয়সা
পুরো গোল ছিল না। পরিধি বরাবর অনেক
ঢেউ ছিল। মা শুনে খুব বকেছিলেন। সেই জয়দেবকাকাই প্রথম মানুষ যাঁকে আমি মৃত দেখলাম। লালপাড় শাড়ি, লাল আলতায় রাঙানো পা কাকিকে দেখলাম।
আশ্চর্য লাগে, তারপর কাকিকে দেখিনি। কোথায় চলে গেছে, আজকের
আগে ভাবনাতেও আসেনি। জয়দেবকাকার টিবি হয়েছিল। চাষের সময়ে একহাঁটু কাদা নিয়ে ফিরতেন। অন্যসময়ে
হুঁকো টানতে দেখেছি, কাজ করতে দেখিনি।
কাজই ছিল না। দুপুরে
বাচ্চাটাকে কিছু রান্না করে খাওয়াতেন। কাকি কপালে একাটা লাল সিঁদুরের ফোঁটা লাগিয়ে বেরিয়ে যেতেন ভোরের ঝি-স্পেশাল ধরে। মৃত্যুর দিন কাকির কাজ বন্ধ
ছিল।
আমার ভয় লাগছিল। নাকে কানে তুলো গোঁজা।
চোখে তুলসি পাতা। কেউ আমাকে বলেছিল, ভয়ের কী আছে?
একটু মাটি দাও পায়ের কাছে।
আমি একটুকরো মাটি চোখ বন্ধ করে কোনও রকমে
ছুঁড়ে দিয়েছিলাম বাঁশের খাটিয়ার ওপর।
মাটির ঢেলাটা অনেকটা শূন্য আকৃতির।
ঠিক একইরকম একটা মাটির ঢেলা দিয়েছিলাম
কলিগের ছেলের কবরে। আর দুদিন পর ওর অন্নপ্রাশন হওয়ার কথা ছিল। নিউমোনিয়াতে হঠাৎ
জ্বর। সদ্য মা বোঝেনি জ্বর কতটা সহ্য হয়। বাচ্চাটা শেষ
মুহূর্ত পর্যন্ত সতেজ, টানটান, হাসিহাসি মুখ। মাকে বোঝানো যায়নি ও মারা গেছে। ও ঘুমোচ্ছে,
এখনি হাত পা নেড়ে ও খেলতে শুরু করবে। ওকে একবার দুধ খাওয়াতে দাও। ওকে কোথাও নিয়ে
যাবে না।
বাচ্চাটা X–এর মতো হাত পা ছড়িয়ে শুয়েছিল। আমরা সবাই শান্ত, চুপচাপ। বুকের মধ্যে শূন্যতা। মনে হচ্ছিল
একটু জল দিলে হয়তো ও আবার জেগে উঠবে। আমার হাত
থেকে কাঁপতে কাঁপতে একটা ঢেলা সেই গর্তে পড়েছিল। সেটাও শূন্য আকৃতির।
সমীর রায়চৌধুরীকে মাটি দেওয়া হয় নি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন