লালবিন্দু
— বাবা!
— কি বাবা?
— ওগুলো কি?
— কোনগুলো বাবা?
— ওই যে রাস্তায় লাল লাল
ফোঁটা পড়ে আছে?
মাংসের দোকানের সামনেটায়
রক্তের ফোঁটাগুলো ধুলোর মধ্যে জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে গেছে। লাল রং ঈষৎ কালচে হয়েছে,
তবে বোঝা যাচ্ছে যে ওটা লালই। ওগুলোই দেখিয়ে প্রশ্নটা করে রক্তিম।
— ওগুলো দেখো না বাবা।
— কেন বাবা?
— ওগুলো খারাপ। বড় হলে তখন
বুঝবে।
রক্তিম চুপ করে যায়। আমরা গালুডি
ষ্টেশনের দিক থেকে হেঁটে হেঁটে বাজার ছাড়িয়ে চলেছি গালুডি ড্যামের দিকে। রোদ কমে এসেছে। একটু শীত শীত করছে। এখানে নভেম্বর মাসে
দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম, কিন্তু যেই সূর্য পশ্চিমে হেলবে ওমনি ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে পড়তে
শুরু করবে। সূর্য অস্ত যাবে ড্যামের ওপারে, দলমা রেঞ্জের ছোট পাহাড়ের পিছনে। সে এক
অপরূপ দৃশ্য! সেই সূর্যাস্ত সুবর্ণরেখার এপারে বসে আমি আর রক্তিম
দেখব। রক্তিমের এটাই প্রথম প্রকৃত সূর্যাস্ত দেখা হবে। কলকাতায় কংক্রিটের জঙ্গলে সূর্য
অস্ত যাচ্ছে, এটুকুই শুধু বোঝা যায়, তার বেশি কিছু নয়।
আমি চাই রক্তিমের মধ্যে
যতটা সম্ভব আমার ভিতরের প্রকৃতি প্রেমটা চাড়িয়ে দিতে। আর্টিফিশিয়াল লাইফ-স্টাইলে
হাঁপিয়ে উঠলে খানিকটা শান্তি খুঁজে নিতে পারবে তাহলে। রক্তিমও ভালোবাসে প্রকৃতি।
আমি খেয়াল করেছি। তাই দু’দিনের ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়ি
আমরা। কোথাও না কোথাও। এমনকি শতরূপা না আসতে পারলেও আমি আর চার বছরের রক্তিম চলে
আসি ঘুরতে। এবারেও তাই হয়েছে। শতরূপা আসতে পারেনি, আমরা দুজনেই এসেছি। বাবা-ছেলে।
রক্তিম লাফিয়ে লাফিয়ে নদীর
ধারে নেমে যায়। ফ্লাডগেট অর্ধেক খোলা, তাই জলের গর্জন ও স্রোত বেশ ভালোই। নদীর
ধারে সিঁড়িতে বসে পড়ে রক্তিম। ড্যাম পেরিয়ে দূরে সূর্য অনেকটা ঢলে পড়েছে পাহাড়ের
মাথায়। জলের ধারে ভালো ঠাণ্ডা লাগছে এবার। সূর্য এবার আসতে আসতে একটা বড় লাল
বিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই হারিয়ে যাবে পাহাড়ের পিছনে। এ এক চোখ-জুড়ানো
দৃশ্য। হঠাৎ রক্তিম মুখ ঘুড়িয়ে নেয় ওদিক থেকে। তারপর আমাকে বলে—
—
বাবা ওদিকে দেখতে নেই, তাই না?
আমি
অবাক হয়ে যাই। এতটা দূরে আসা তো সূর্যাস্তের ওই অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য দেখারই
জন্যে!
—
কেন রে? দেখতে নেই কে বলল? দেখ দেখ, দু’চোখ
ভরে দেখ প্রকৃতির দৃশ্য!
—
তুমিই তো বলেছিলে দেখতে নেই!
—
আমি বলেছিলাম! কখন বললাম?
—
কেন! ঐ যে বললে তখন! রাস্তার ধারে লাল লাল বিন্দুগুলোর দিকে দেখতে নেই। ওসব বাজে জিনিস। আমি বড় হলে
বুঝব। এটা তো আরও বড় লালবিন্দু একটা। আরও বড় বাজে জিনিস হবে নিশ্চয়।
ততক্ষণে
সূর্য লুকিয়ে পড়েছে পাহাড়ের আড়ালে। কিন্তু আকাশটা লাল হয়ে রয়েছে। রক্তিম। আমার
ছেলে। আমি যা পারিনি ও তাই পারবে। আমি পারিনি সত্যিকারের প্রকৃতিপ্রেমী হতে।
কিন্তু ও পারবে। পারবেই।
Valo legeche
উত্তরমুছুন