এক... একা... অনেক... অন্য... অনন্য : সচিন
রমেশ তেন্ডুলকার আর ক্রিকেটের স্বপ্নপূরণ
ব্যাট হাতে নামার সময় একা। আগের জন আউট হয়ে ফিরে আসছে। সেও একা। প্যাভেলিয়নে ফেরার সময় তার কাঁধের পাশে কাঁধ রেখে মাঠে ঢুকছে নতুন ব্যাটসম্যান, আউট হওয়া ব্যাটসম্যানের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে, হয়তো সে সেঞ্চুরি করেছে, কিম্বা শূন্য, হয়তো কোনোটাই নয়, মাঝারি! নতুন ব্যাটসম্যান তাকে বাহবা দিচ্ছে অথবা সান্ত্বনা। একজন ব্যাটসম্যান আউট হয়ে ফেরার সময় তার মুখের এক্সপ্রেশন থেকে তার অবস্থা, দলের অবস্থা এবং ম্যাচের অবস্থারও একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। তীরে এসে তরী ডোবার হতাশা থেকে জয়ের হাতছানি কত কিছু বলে যাচ্ছে ঘাম, ধুলো, ভুরু, চোখ, নাক, মুখ জোড়া মাংসের অক্ষরবিন্যাস। মাঠে নামা আর মাঠ থেকে বেরোনোর সময় দুজন ব্যাটসম্যানের মধ্যে ওই ক্ষণিক সমাপতনের মুহূর্ত, তখন ক্রিকেট একাও নয়, আবার অনেকও নয়, সে তখন দোকা, যেমন দোকা দুজন ফিল্ডারের কলিশনে কিম্বা বোলার আর উইকেটকিপারের পারস্পরিক অভিনন্দনে, কিম্বা ক্যাপ্টেন আর বোলারের পরামর্শে ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্রিকেটের 'একা', 'দোকা' এবং 'অনেক' নামক এই তিনটি মুহূর্ত, বোলিং ব্যাটিং আর ফিল্ডিং-এর আশেপাশে আর ভেতরে বাইরে। নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে পার্টনার থাকলেও তুমি যখন ব্যাট করছো, তুমি এক্কেবারে একা। যে বল করছে বা ফিল্ডিং করছে, তার মতোই। কিন্তু এই একারাই খেলার আঁকে বাঁকে দোকা তেকা এবং অনেকের মুহূর্ত তৈরি করছে যদিও খেলাটির তিনটি বেসিক টাস্ক: ব্যাটিং বোলিং এবং ফিল্ডিং আসলে কিন্তু সকলে প্রত্যেকে একা। ব্যাট হাতে নামার সময় একা। ব্যাট হাতে ফেরার সময় একা। ব্যাটসম্যানের হাতে বেধড়ক মার খাবার সময় একা। নিপুণ ইয়র্কারে তার মিডল স্ট্যাম্প ছিটকে দেবার সময় একা। ক্যাচ ধরা বা ফ্যালা বা ড্রাইভ দিয়ে বাউন্ডারি বাঁচাবার সময়ও একা। আর এই একা একা মুহূর্তগুলোই টিভিতে বা ইন্টারনেটে কত কত মানুষকে অনেকের সাথে জুড়ে দিচ্ছে। মাঠ জুড়ে দর্শকদের সমস্বরও তেমনি অনেকের এক হয়ে ওঠার মুহূর্ত। একদিকে এক দুই হয়ে অনেক আর অন্যদিকে অনেকের এক হয়ে ওঠা। কিন্তু অনেকের মধ্যে দিয়ে হয়ে ওঠা ওই একও কি একা? ব্যাটসম্যান আউট হতেই থিতিয়ে পড়া হইচইয়ের ভেতর তার মাথা খানিক নিচু করে হেলমেট খুলে হেলমেটের ভেতর গ্লাভসগুলো ফেলতে ফেলতে হেঁটে যাবার সময় দর্শকের ওই এককত্ব কি আবার একাকিত্বের দিকে ঘুরে যায়? কিন্তু নতুন ব্যাটসম্যান মানেই নতুন আশা, আবার নতুন করে এক হয়ে ওঠার শুরু। ক্রিকেট এভাবেই ভাঙতে থাকে গড়তে থাকে এক, দুই একা আর অনেকের মুহূর্তগুলোকে, সেলাই করতে থাকে সেলাই ছিঁড়ে যাওয়া অব্দি, তারপরে হয়তো আবার প্রথম থেকে ।
আজকাল আমাদের ম্যাচ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। মাঠে না গিয়ে টিভিতে দেখলে তো বটেই, মাঠে গিয়ে দেখলেও জায়েন্ট স্ক্রিন বিজ্ঞাপন ধরে আনে ব্যাটসম্যান আউট হতে না হতেই। টিভিতে আজকাল আর দেখাই যায় না একা-দোকার ওই মুহূর্তদের। ওভার শেষ হতে না হতেই বিজ্ঞাপন, ব্যাটসম্যান আউট হতে না হতেই বিজ্ঞাপন। ক্যাচ ধরতে না ধরতেই বিজ্ঞাপন। কেউ আউট হলে দলের অনেকের একসাথে উদযাপন, ওভার শেষে দুই ব্যাটসম্যানের পরামর্শ, ফিল্ডিং টিমের প্ল্যানিং কিম্বা বাউন্ডারির কাছাকাছি আউট হয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যানের সাথে নতুন ব্যাটসম্যানের স্বল্প বিনিময়ের বাঙ্ময়তা -- এইসব মুহূর্তগুলো যেখানে ক্রিকেট একটা 'অনেক' হয়ে উঠতে থাকে সেগুলো আজকাল বিজ্ঞাপন এসে চুরি করে নিয়ে যায়। তাও থেকেই যায় কিছু কিছু ঝলক : দর্শকদের উল্লাস, বাউন্ডারির কাছে দুজন ফিল্ডারের চমৎকার রিলে ফিল্ডিং। বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যাবার আগে মুহূর্তের ওই ঝলকগুলোকে তো আর কেড়ে নিতে পারে না!
এই যে এইসব ছাইপাশ লিখে চলেছি আর আপনি বা আপনারাও পড়ে চলেছেন এও তো এক থেকে দুই আর দুই থেকে সম্ভাব্য অনেকের পাঠ-সম্ভাবনা! কিন্তু এইসব লেখার উদ্দেশ্য? পরিপ্রেক্ষিত?
আসলে এই লেখায় আমি যে প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করতে চাইছি, তারা সকলেই ছোটবেলায় যবে থেকে ক্রিকেট খেলা দেখতে শুরু করেছে, তবে থেকে সচিন রমেশ তেন্ডুলকারকেও দেখে চলেছে। ভারতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে ২৪ বছর যাবৎ এক এবং অভিন্ন হয়ে ওঠা এই নামটা একজন ব্যক্তি-ক্রিকেটারের: একা একটা মানুষের একা নাম যাকে মেলে ধরলে তার ভেতর তার বাবার নামটাও মেলে। কিন্তু আমাদের ছোটবেলা থেকে গোটা নব্বই দশক জুড়ে এই একা লোকের দোকা নাম সচিন রমেশ জুটি শাসন করে এসেছে ভারতীয় ক্রিকেট নামক এই অনেকটিকে, টিমকে এবং দর্শকদের। ৯০এর দশক জুড়ে কত দর্শক মাঠ ছেড়েছেন সচিন আউট হতেই, আরো কতজন টিভি বন্ধ করে দিয়েছেন সেই মুহূর্তে! 'ওয়ান ম্যান টিম'এর এই অসম্মানজনক অভিধা বহন করেছে ভারতীয় দল, বহন করেছেন তেন্ডুলকারও। অনেক সময়ই একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে, তিনি কি নিজের জন্য খেলেন, না দলের জন্য? টাফ ম্যাচে আন্ডার প্রেশার কটা ম্যাচ জিতিয়েছেন? তিনি কি ওভার-রেটেড? আমিও কখনো কখনো এমন অভিযোগে গলা মিলিয়েছি। রাহুল দ্রাবিড় নামের অসামান্য এক ক্রিকেটার তাঁর গোটা কেরিয়ার জুড়ে আন্ডার-রেটেড থেকে গ্যাছেন বলে কখনো কখনো বোকার মতো রাগ করেছি সচিনের ওপর, কিন্তু সে রাগ ততটা সচিনের ওপর নয়, যতটা তাঁকে যা বানানো হয়েছে তার ওপর।
মনে আছে ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার ৩৬০ রানের পাহাড় তাড়া করতে নেমে সচিন যখন ফার্স্ট ওভারে ম্যাকগ্রার শিকার হয়েছেন, আমারও মনে হয়েছে, এই তো বিশ্বকাপের ফাইনালে বিশাল রান তাড়া করতে নেমে একা টিমকে জেতানোর সুযোগ হারালেন ভারতের সর্বকালের সেরা এবং হয়তো পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই খেলোয়াড়টি। মনে হয়েছে, যারা বলেন উনি কঠিন পরিস্থিতি থেকে একা ম্যাচ জেতাতে পারেন না, আবার তাদের উত্তর দেবার সুযোগ হাতছাড়া করলেন! স্বভাবসিদ্ধ ভারতীয় কায়দায় সচিন হয়ে উঠেছেন আমাদের 'ভগবান' আর তাঁর থেকে সম্ভব-অসম্ভব সব চেয়ে গিয়েছি আমরা, চাওয়ার শেষ হয়নি কখনো। আজ যখন এই লেখা লিখছি, তখন অবশেষে সেই চাওয়া শেষ হয়েছে সচিন রমেশ তেন্ডুলকারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের মধ্য দিয়ে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, 'all good things should come to an end', কিন্তু এখানেই তো সমস্যা, আমাদের প্রজন্মের কাছে তেন্ডুলকার এমন এক একা 'এক' যে টিম এবং দর্শকদের 'অনেক'টিকে ধারণ করেছিলেন ২৪ বছর ধরে, এতোটাই যে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যতদিন ক্রিকেট খেলা চলবে ততদিন সচিনও খেলে যাবেন যেন। অবাস্তব এই কষ্টকল্পনার অবসান যেন ঈশ্বরের মৃত্যুর মতোই, তাই সারা দেশ জুড়ে সাশ্রু নয়ন, হতাশা এবং অবসাদ। আর প্রবাসের পরবাসে সিডনিতে বসে ইউটিউবে তাঁর ফেয়ারওয়েল স্পিচ শুনে কিম্বা শেষ বার আউট হবার পর তিনি যখন প্যাভেলিয়নে ফিরছেন, সেই অমোঘ দৃশ্য দেখতে দেখতে আমার ২৮ বছরের জন্মদিনের প্রাক্কালে বড়ই বয়ঃবৃদ্ধ লাগছিলো নিজেকে। ভারতীয় ক্রিকেটের সাথে, আমাদের ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে গড়ে ওঠা ক্রিকেটিং মেমরির সাথে এই একা একটা নাম এতই ওতপ্রোত হয়ে উঠেছিল যে, একার এই নক্ষত্রপতন যেন অনেকের ছবিগুলোকে ম্লান করে অ-ক্রিকেটীয় হয়ে উঠছিল।
ইউটিউবে শেষবার যখন আউট হয়ে ফিরে যেতে দেখছিলাম তেন্ডুলকারকে, তখন মনে হচ্ছিল কতদিন পর ক্রিকেট খেলার একান্ত নিঃসঙ্গ এই মুহূর্তটা দেখছি। বিজ্ঞাপনের দাপটে তো আজকাল দেখাই হয় না এই মুহূর্তটা। শেষ টেস্ট ইনিংসে সচিন সেঞ্চুরি করতে পারলেন না বলে যারা দুঃখ পেলেন, স্যরি, আমি তাদের দলে নেই। সচিন তেন্ডুলকার 'ভগবান' নন, তিনি অসম্ভব প্রতিভাবান এবংপরিশ্রমী একজন মানুষ যিনি তাঁর জীবনের ৪০টা বছর ক্রিকেট অন্তপ্রাণ হয়ে কাটিয়েছেন। থাক না তাঁর ঐটুকু মনুষ্যত্ব, যেমন ছিলো ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের, যিনি ১০০ রানের অভ্যারেজে পৌঁছতে পারেননি শেষ ইনিংসে শূন্য রানে আউট হবার জন্য। ব্রায়ান চার্লস লারাকেও তো খেলতে হয়েছিল একটি তৃতীয় শ্রেণীর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান টিমে তাঁর কেরিয়ারের সিংহভাগ জুড়ে। ক্রিকেটের গ্রেটদের আশেপাশে এইসব আয়রনির হয়তো প্রয়োজন রয়েছে যাতে আমরা তাদের 'ভগবান' বানাতে না পারি! সচিনের একা আউট হয়ে ফেরার ওই মুহূর্ত কিম্বা ম্যাচ শেষে একার অনেককে করা ওই আবেগময় বিদায়ী সম্ভাষণ, সবই কিন্তু বড় মানবিক। যেন একটি মানুষ তাঁর নশ্বরতার দাবি রাখছেন চোখের জলে, যাকে আমরা এত বছর ধরে ভগবান বানিয়ে আসছি, প্রশ্ন করে আসছি কেন তিনি সব পারেন না? কেন পারলেন না শেষ ইনিংসে সেঞ্চুরি করতে? কেন পারেননি টেস্ট ট্রিপল সেঞ্চুরি করতে? কই শেহবাগ তো পেরেছেন? আরো কতজন! সমসময়ের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লারা তো টেস্টে ৪০০ রান করেছেন, তাহলে সচিন পারেননি কেন? আমি পরিসংখ্যানবিদ নই, ক্রিকেটগবেষকও নই, তাই সেই দিক থেকে আমি এই প্রশ্নগুলোকে দেখব না। আমার কাছে দেখার মতো ব্যাপার হলো, সচিনকে কেন্দ্র করে আমাদের এই অনন্ত দাবিদাওয়া যেখানে জনমননে তিনি ক্রিকেট নামক অনেকের খেলার সর্বেসর্বা 'এক' হয়ে উঠছেন আর সচিনের নিজের পারা-না-পারাগুলো যা বারবার তাকে মানুষ করে রাখছে, মানুষ, ভগবান নয়!
শেষ ইনিংসে আউট হয়ে যখন ফিরে যাচ্ছেন সচিন, আমার মনে পড়ছে পাকিস্তানের বিরূদ্ধে সেই ১৯৯৯এ সিরিজের প্রথম টেস্ট ম্যাচ। একা খেলে ম্যাচ জেতাচ্ছেন তিনি, উল্টোদিকে বিশেষ কোনো সাপোর্ট নেই, অনেকগুলো উইকেট পড়ে গেছে, উনি আউট হলেই ম্যাচ পাকিস্তানের, এমন অবস্থা। সচিনের পিঠে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে, ব্যাট করতে পারছেন না আর! অল্প কিছু রান বাকি, ব্যথায় কাতর সচিন তাড়াতাড়ি মেরে খেলা শেষ করতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন সেদিন, যার পর বাকি উইকেটগুলো তাসের ঘরের মতো ছড়কুটে পড়ে এবং ভারত ম্যাচটা হেরে যায়। আমার আজও মনে আছে, পিঠের ব্যথায় কাতর সচিনের প্যাভেলিয়নে ফেরা, যেন ভগবান মানুষ হয়ে ফিরছেন ড্রেসিংরুমে। চোখে মুখে লেখা হচ্ছে নশ্বর শরীরের কষ্ট আর তার সাথে গিয়ে মিশেছে তীব্র মনোকষ্ট : ম্যাচটা জেতাতে পারলাম না। কান্নায় ভাঙতে থাকা ওই মুখমন্ডল আমার অবান্তর স্মৃতির মধ্যে ফিরে ফিরে আসে আজো! অসামান্য এক খেলোয়াড়ের ব্যতিক্রমী এক মনুষ্যত্ব একা ওই হেঁটে যাওয়ায়; যেখানে থেমে গেছে সচিন সচিন ওই কলরব, সেখানেই তিনি মানুষ হয়ে ঘরে ফিরছেন যেন, আমার ছোটবেলায় তখনও কিছুটা বিলম্বিত ছিল বিজ্ঞাপনের আক্রমণ, তাই স্মরণীয় ওই দৃশ্যটা মিস করিনি।
অবশেষে ঘটে গেছে অবিশ্বাস্য সেই ঘটনা! সচিন রমেশ তেন্ডুলকার এখন অতীত! গোটা দেশকে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একত্রিত করার বিপ্লবী ক্ষমতা রাখতো যে এক-একা-অনেক লোকটা, সে আর কোনোদিন নামবে না ক্রিকেট মাঠে, হাতে তুলে নেবে না ক্রিকেট ব্যাট! সচিন নিজেও তার বিদায়ী সম্ভাষণে বলছিলেন এই অবিশ্বাস্যতার কথা। কিন্তু এখন যখন এই অবিশ্বাস্যতাকে বিশ্বাস করার সময় হয়েছে আমরা আরেকটু ফিরে দেখি এক একা এই লোকটার অনেকের কাছে যাবার পথের আরো কয়েকটা মাইলফলক।
১৯৯৮য়ের শারজায় ভারতকে যখন ফাইনালে উঠতে গেলে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৫০ ওভারের আগেই ম্যাচ জিততে হবে এবং আস্কিং রেট ক্রমশ অধরা হয়ে উঠছে; সচিনের সাথে ক্রিজে তখন অনভিজ্ঞ ভি ভি এস লক্ষ্মণ। আমরা ধরেই নিয়েছি ভারতের ফাইনালে যাওয়া দুষ্কর, তখন বালির ঝড় শুরু হয় স্টেডিয়ামে। খেলা থেমে যায় বেশ কিছুক্ষণের জন্য। দর্শকরা সবাই অপেক্ষা করছেন তাও, আমরাও টিভির সামনে। সচিন এখনো ব্যাট করছেন যে! এখনো সম্ভব ওই অসম্ভব যদি তিনি ঠিক করে খেলে দ্যান। বালির ঝড়ের আগে সচিনও সেদিন কিছুটা অস্বস্তিতে খেলছিলেন আশেপাশে অনেকগুলো উইকেট পড়ে যাওয়ায়, লক্ষ্মণ আউট হলেই টেইল বেরিয়ে পড়বে, শুরু হয়ে যাবে 'শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা'! এহেন অবস্থায় বালির ঝড় শেষ হবার পর সেদিন যখন খেলা শুরু হয়েছিল, তেন্ডুলকার আক্ষরিক ভাবেই ঝড় হয়ে ফিরে এসেছিলেন। শ্যেন ওয়ার্ন থেকে ডেমিয়েন ফ্লেমিং কেউ পার পাননি। একা ফাইনালে টেনে তুলেছিলেন টিম ইন্ডিয়াকে। তাঁর প্রতিভা এবং মেধা অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের নিয়ে স্টেডিয়ামের চতুর্দিকে ছেলেখেলা করেছিল সেদিন। বল থেকে শুধু বালি উড়েছিল তারপর। সেঞ্চুরি করেন সচিন। ফাইনালে ওঠার জন্য যত রান দরকার ছিল সেটা করে ফেলার পর ইন্ডিয়াকে ম্যাচটা জেতানোর চেষ্টা করেন যেটা এক ঘন্টা আগে থেকেই আমরা ভাবা ছেড়ে দিয়েছিলাম, কারণ ফাইনালে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় টার্গেটই এত দূর অস্ত ছিল যে, ম্যাচ জেতা, মানে আরো ৪০-৫০ রান, সে তো অসম্ভব! কিন্তু সচিন যে আমাদের নাছোড়বান্দা 'ভগবান', তাই ফাইনালের কোয়ালিফাইং স্কোর করে ফেলার পরেই দর্শকরা সবাই এবার ম্যাচ জেতার স্বপ্নে ফিরে আসে, আর এই সময় আরো কয়েকটা রাজকীয় ড্রাইভের পর আউট হয়ে যান সচিন, ভারত তখন ফাইনালে কিন্তু ম্যাচ জেতার স্বপ্নে ওখানেই ইতি। তার পরের ম্যাচে অর্থাৎ ফাইনালে আবার সেঞ্চুরি করে আমাদের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জিতিয়েছিলেন তিনি কিন্তু সেই ইনিংসে যাচ্ছি না। আমার কাছে শারজার এই ভার্চুয়াল সেমিফাইনাল ‘ভগবান’ আর মানুষ সচিনের অপূর্ব এক সঙ্গমক্ষেত্র, যা এই দুই প্রতিস্বকে আলাদা করার জন্য জরুরি এক দৃষ্টান্ত। সেদিন একা হাতে বা যাকে বলা যায় একা ব্যাটে প্রায় ঐশ্বরিক কায়দায় সচিন ভারতকে ফাইনালে তোলেন, কিন্তু ফাইনালের কোয়ালিফাইং স্কোর অব্দি ইন্ডিয়াকে টেনে তোলার পর যখন আমরা তাঁর থেকে আরো বেশি চাইতে শুরু করি, তখন ম্যাচ জেতাতে ব্যর্থ হয়ে প্যাভেলিয়নের দিকে হাঁটা দ্যান তিনি আর ঠিক সেই সময় হাঁটতে হাঁটতেই তিনি আবার মানুষ বনে যান। সচিন রমেশ তেন্ডুলকার তখন ঘর্মাক্ত পরিশ্রমী প্রতিভার এক মানুষ-শরীর, যাঁর হাতে রয়েছে ততোধিক শ্রমে বানানো কাঠের ব্যাট, তাঁর যুদ্ধাস্ত্র।
১৯৯৯এর বিশ্বকাপ চলাকালীন নিজের বাবাকে হারান সচিন। তখন তিনি সচিন রমেশহীন তেন্ডুলকার। পিতার শেষকৃত্য করে ইংল্যান্ড ফেরেন ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে এবং প্রথম ম্যাচেই কেনিয়ার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেন। দেশ জুড়ে জল্পনা শুরু হয়, বাবার মৃত্যুর শোকের জবাব দিয়ে এবার ভারতকে বিশ্বকাপ এনে দেবেন সচিন। কিন্তু না, এমনটা হয়নি। কারণ সচিন ভগবান নন, তিনি আমাদের ইচ্ছাপূরণের যন্ত্র নন, তিনি স্বয়ম্ভর একজন মানুষ, একজন খেলোয়াড়। কিন্তু কেনিয়ার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরির পর হয়তো কেরিয়ারে প্রথমবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যাট তোলেন সচিন, যেন মৃত পিতাকে সম্বোধন করছেন ব্যাট দিয়ে। এই মুহূর্তটির সঘন আবেগে আবার মানুষ হয়ে ওঠেন এক-একা-অনন্য এই খেলোয়াড়টি। বাবার মৃত্যুর পর থেকে শেষ দিন অব্দি সেঞ্চুরি করলেই আকাশের দিকে তাকাতেন তিনি। আবেগের সিগনেচার এই মুহূর্তগুলো আমার স্মৃতিতে মানুষ সচিনের কীর্তিময়তা হয়ে রয়ে যাবে সারা জীবন। যেমন ওয়ান-ডে তে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করলেন যেদিন, আমি খেলাটা দেখতে পারিনি, ট্রেনে ফিরতে ফিরতে সহযাত্রীদের মুখে সচিনের ২০০ রানের খবর শুনে চমকে যাই, ভাবি লোকটা কি 'ভগবান'? তখনকার সময়েও ওয়ান-ডে তে ২০০ রান প্রায় অসম্ভব, তখনও টি-টোয়েন্টি নামক প্রাণীটা জিরাফ হয়ে ওঠেনি! কিন্তু রাতে ফিরে হাইলাইটস দেখতে বসে বুঝতে পারি, না, আদ্যন্ত একটা মানুষ ব্যাট করছেন এখানে। তাঁর মুখ মানুষের মুখ, ভগবানের মুখ আমি দেখিনি, তিনি কি ব্যাট করতে পারেন? আমি অবিশ্বাসী লোক, জানি না ঠিক।
সবার মতোই আমিও চেয়েছিলাম ভারত ২০১১র বিশ্বকাপ জিতুক, কারণ ওটাই সম্ভবত সচিনের শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছিল এবং ভারত সত্যিই দেশের মাটিতে ওই ওয়ার্ল্ড কাপ জেতে। কিন্তু ততদিনে ৯০এর 'ওয়ান ম্যান টিম' থেকে সৌরভ গাঙ্গুলীর পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে 'টিম ইন্ডিয়া' নামক এক এককত্ব আর মহেন্দ্র সিং ধোনি সৌরভের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সেই টিম স্পিরিটকে, তাই সচিন রমেশ তেন্ডুলকারকে একা জেতাতে হয়নি সেই বিশ্বকাপ। সকলের হাতে একসাথে উঠেছে সেই ট্রফি, ক্রিকেটের একা-দোকা-অনেক থেকে অনেকের একীভবনের প্রতীক হয়ে। ফাইনালের শেষে ভারত জিতে যাবার পর যখন গোটা টিম মাথায় তুলে স্টেডিয়ামে ঘুরিয়েছে সচিন রমেশ তেন্ডুলকারকে, সেই দৃশ্যে ক্রিকেটের 'অনেক' আবার ফিরে পেয়েছে তার ভেতরের 'একা' ওই এক-টিকে, নিজের ভেবে জড়িয়ে ধরেছে তাকে! সচিন আবার মানুষ হয়ে উঠেছেন, শুধু সচিনের টিম নয়, টিমেরও সচিন, এমনই বলে গেছে সেই মুহূর্ত!
সচিনের ফেয়ারওয়েল স্পিচ দিয়েই শেষ করি ফেয়ারওয়েল-সূচক এই লেখা। ২৪ বছরের এই কিংবদন্তি অমরত্ব এবং ঈশ্বরত্বপ্রাপ্তির পর বিদায়ের সন্ধ্যায় যখন হ্যাটের আড়ালে চোখের জল লুকোচ্ছেন মানুষের মতো, পাছে ভুলে না যান তাই কাগজে লিখে এনেছেন সবার নাম, যাদের এতদিনের সফরের জন্য ধন্যবাদ দিতে চান এবং সর্বোপরি স্বভাবসিদ্ধ বিনম্রতায় যখন বলছেন যে আর সবার মতো তিনিও একজন ক্রিকেটার, মহান এই খেলার এক রূপক-প্রতিনিধি মাত্র, তখন তিনি আবার মানুষ, ভগবান নন। বিদায়ী সম্ভাষণের একেবারে শেষে এসে তিনি যখন বলছেন তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দর্শকদের এই সচিন সচিন কলধ্বনি বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসবে তাঁর কানে, তখন সত্যিই জীবন-বিস্তীর্ণ এই শুশ্রুষা ভেসে বেড়াচ্ছে তাঁর মনুষ্যত্বে, পরম আদরে তাঁকে মানুষ করে রাখছে। ২৪ বছর ধরে নিজের ও কোটি কোটি মানুষের সম্মিলিত ইচ্ছার পাথর নিয়ে একা সিসিফাসের মতো শ্রম করে গেছেন সচিন, অবশেষে এবার ক্রিকেটের বাইরে, যেখানে শুধু তাঁর ইচ্ছা আমাদের সকলের ইচ্ছা থেকে মুক্ত হয়ে অবসর গ্রহণ করছে, সেখানে নতুন খেলা শুরু করবেন তিনি। আমার বিশ্বাস সচিনের মতো ক্রিকেটারের কাছে ক্রিকেট জীবন এবং ইচ্ছার নামান্তর।
'খেলবে সচিন খেলবে সচিন মারবে সচিন চার / খেলবে সচিন খেলবে সচিন মারবে সচিন ছয়।'
আমি নিশ্চিত এমনটাই হবে যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন। এমনটাই হবে কিন্তু এখন থেকে তিনি একা। আমরা আর দেখব না সেই খেলা।
আমাদের সকলের মতো অবশেষে তিনিও আজ অনেকের ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে এক থেকে একা হয়েছেন। চলুন এবার বরং আমরা তাঁকে তাঁর একার ক্রিকেট খেলতে দিই, যেখানে আর তাঁকে আমাদের সবার অসম্ভব স্বপ্নপূরণের বাহন হতে হবে না।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন