তরুণিমার কোনো অসুখ নেই
কাজল সেন
তরুণিমার কোনো অসুখ নেই। তার সব কিছুতেই সুখ। তা সে চলাফেরায় হোক বা কথাবার্তায়, সাজপোশাক বা রূপটান, ঘুমোনো বা ঘুম থেকে ওঠা। তরুণিমার বই পড়তে ভালো লাগে, গান শুনতে ভালো লাগে, ছবি দেখতে ভালো লাগে। এবং ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসা। আর ভালোবাসা মানেই যে অব্যর্থ সুখলাভ, তা তরুণিমার থেকে আর কে ভালো বোঝে! তরুণিমা বোঝে। তরুণিমার কোনো অসুখ নেই।
এই যেমন অরুণিমা খেতে খুব ভালোবাসে। সাধারণ ভাত ডাল চচ্চরি থেকে শুরু করে মাটন বিরিয়ানি, তন্দুরি চিকেন, সব কিছুই। খেয়ে খুব সুখ হয়। সুখ শুরু হয় খেতে বসার আগে থেকেই। তারপর সেই সুখের রেশ থেকে যায় খাওয়া শেষ হবার পরও। এমন কী গরম ভাতের সঙ্গে গরম ডাল, আর সেইসঙ্গে সামান্য তেল, নুন, ধনেপাতা ও কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখা আলুভাতে, আহা! অনবদ্য মনে হয় তরুণিমার কাছে। আবার যদি চাকা চাকা করে কাটা ভাপা ইলিশ বা ঢাউস গলদা চিংড়ির মালাইকারি থাকে কোনোদিনের খাদ্য তালিকায়, তাহলে তো সুখের গড়ের মাঠ। খেতে খেতে সুখের প্রাবল্যে তরুণিমার দু’চোখ বন্ধ হয়ে যায়। তবে এজন্য তরুণিমাকে কখনই পেটুক বলা ঠিক হবে না। যদি কেউ ভেবে থাকে, তার প্রচন্ড খিদে পায়, আর তাই যা পায় তাই গোগ্রাসে খায়, তা তো নয়! বরং সে যে-কোনো খাবার খেয়ে সুখ পায়, আর তাই সে খায়।
ইদানীং তরুণিমার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয় শ্যামসুন্দরের। হয়তো তখন দুজনেই কোথাও যাবার জন্য হন্তদন্ত হয়ে চলেছে অটোস্ট্যান্ডে। অথবা হয়তো রিফাইন তেলের প্যাকেট কিনে শ্যামসুন্দর তার ঘরে ফিরছে, আর তরুণিমা ভ্রু প্লাক করতে যাচ্ছে কোনো লেডিজ পার্লারে। তা দেখা হলেই কিছু কথা হয়। হয়তো, যতসব অপ্রাসঙ্গিক এবং অসংলগ্ন কথা। কিন্তু! তবুও!
--‘আজ বেশ ঠান্ডা পড়েছে, তাই না?’ শ্যামসুন্দর বলে।
--‘হ্যাঁ, কাল মনে হয় আরও জাঁকিয়ে পড়বে!’ আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে তরুণিমা বলে।
--‘নাও পড়তে পারে, হয়তো কাল হঠাৎ ঠান্ডা কমে গেল, গরম পড়ে গেল!’
--‘তা যা বলেছো! তোমার অনুমান তো মাঝে মাঝে ঠিকঠাক লেগেও যায়!’
--‘তাই! তবে কী জানো তরু, এভাবে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলে তো খুব মুশকিল!’
--‘কেন? মুশকিল কেন?’
--‘না, আমার ভালো লাগে না। সব কিছু গোছানো থাকবে, তবেই না আনন্দ!’
--‘না শ্যামসুন্দর, এটা ঠিক কথা নয়। এলোমেলো হলো তো কী হলো! যত এলোমেলো হবে ততই তো মজা হবে! গতানুগতিকতা ও একঘেয়েমি কাটবে! না হলে তো সবাই আমরা অসুখে ভুগবো!
শ্যামসুন্দরের ব্যস্ততা আছে। তেল পৌঁছলে মা রান্না চাপাবে। অথচ তরুণিমাকে ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করে না। কী যে আছে এই মেয়েটির মধ্যে!
মনোরমা একদিন তরুণিমাকে বলল, ‘তুই মাঝে মাঝেই জঙ্গলে চলে যাস্। কী ব্যাপার বল্ তো তরু! জঙ্গলে তোর কোনো প্রেমিক থাকে নাকি? তার সঙ্গে দেখা করতে যাস্? তোরা জঙ্গলে অনেক কিছু করিস্, তাই না?’
তরুণিমা হাসে, ‘হ্যাঁ, আছে তো! আমার প্রেমিক থাকে জঙ্গলে। আমরা তো মিলিত হই!’
চোখ উলটে যায় মনোরমার, ‘সে কী রে! আর কোথাও জায়গা পেলি না, একেবারে জঙ্গলে?’
তরুণিমা কীভাবে মনোরমাকে বোঝাবে যে, তার প্রেমিক গাছেরা জঙ্গলেই যে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করে! তাদের সঙ্গে সহবাসের জন্য তাই তাকে জঙ্গলেই যেতে হয়। আর গাছেদের সঙ্গে সহবাসে কী যে সুখ, তাই বা সে কেমন করে মনোরমাকে বোঝাবে! তরুণিমা তো জানে, মনোরমা তার ফিয়াসেঁ হরিহরের সঙ্গে লাগামছাড়া মিলিত হয় নিজেদের বাড়িতেই। তা থাকুক! সেই সুখ নিয়েই থাকুক মনোরমা। তরুণিমার তাতে কিছু যায় আসে না। আর তরুণিমার সুখ তো মনোরমার কখনই সইবে না। তরুণিমার কোনো অসুখ নেই।
মাঝে মাঝেই তরুণিমার খুব ইচ্ছে হয়, কৈশোরের দিনগুলোয় ঘুরে বেড়াতে। খুব তো বেশি দিনের কথা নয়, এই তো কয়েক বছর আগেও তরুণিমা ছিল এক উচ্ছ্বল উজ্জ্বল উৎফুল্ল কিশোরী। একই সঙ্গে টানটান এবং টানাটানা। অথচ সেই সময়টা খুব একটা নিরাপদও ছিল না। সারা শরীর আর মন জুড়ে তখন কত রকম যে টানাপোড়েন, ভাঙচুর, অগ্ন্যুৎপাত! না, তরুণিমা সেইসব দিনগুলোর কথা একদম ভোলেনি। ভুলবেই বা কী করে! তরুণিমার শরীরের ভেতরে, কতটা ভেতরে তা অবশ্য তরুণিমা জানে না, সে যে কী এক আশ্চর্য টালমাটাল ক্যাটরিনা-ঝড়! কেমন যেন সব এলোমেলো ব্যাপার স্যাপার! কিন্তু সুখ। বড়ই সুখ। কোথা থেকে যে সুখের জোয়ার এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল তরুণিমাকে! সুখসাগর কি তবে একেই বলে? তরুণিমার কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। সে শুধু বুঝতে পারছিল, একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে তার শরীরের জ্যামিতি। পালটে যাচ্ছে ভূগোল। আর তারপর, বাকিটা তো ইতিহাস!
আরও বেশি করে মনে পড়ে সেই বিশেষ দিনটার কথা। ধিকি ধিকি অগ্ন্যুৎপাত তো কবে থেকেই শুরু হয়ে গেছিল। সারা শরীরটাই যেন ক্রমশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। তারপর একদিন হঠাৎ সেই যে সাংঘাতিক বিষ্ফোরণ ঘটলো! তোলপাড় হয়ে গেল বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ড! সে যে কী এক ভয়ংকর সুখের দিন! কী এক সাংঘাতিক আনন্দের দিন! তরুণিমার মনে পড়ে, উষ্ণ দুরন্ত দুর্দান্ত অপ্রতিরোধ্য লাভাস্রোতে সেদিন ভেসে গেছিল তাদের ঘরদুয়ার, ইস্কুলবাড়ি, দাঁড়িয়াবান্ধা খেলার মাঠ।
এই সুখের সন্ধান শ্যামসুন্দর কোথায় পাবে? তার পাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। তবে মনোরমা হয়তো পেয়েছে। অথবা হয়তো পায়নি। আর যদি পেয়েও থাকে, তবে সে যে কতটা সেই সুখের গভীরতায় ডুবে মরেছে, কে জানে! সবাই তো আর সত্যি সত্যি সুখি হতে পারে না। সুখের সন্ধান অনেকেরই তো ধাতেও পোষায় না!
তরুণিমার কোনো অসুখ নেই।
তরুণিমার কোনো অসুখ নেই। তার সব কিছুতেই সুখ। তা সে চলাফেরায় হোক বা কথাবার্তায়, সাজপোশাক বা রূপটান, ঘুমোনো বা ঘুম থেকে ওঠা। তরুণিমার বই পড়তে ভালো লাগে, গান শুনতে ভালো লাগে, ছবি দেখতে ভালো লাগে। এবং ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসা। আর ভালোবাসা মানেই যে অব্যর্থ সুখলাভ, তা তরুণিমার থেকে আর কে ভালো বোঝে! তরুণিমা বোঝে। তরুণিমার কোনো অসুখ নেই।
এই যেমন অরুণিমা খেতে খুব ভালোবাসে। সাধারণ ভাত ডাল চচ্চরি থেকে শুরু করে মাটন বিরিয়ানি, তন্দুরি চিকেন, সব কিছুই। খেয়ে খুব সুখ হয়। সুখ শুরু হয় খেতে বসার আগে থেকেই। তারপর সেই সুখের রেশ থেকে যায় খাওয়া শেষ হবার পরও। এমন কী গরম ভাতের সঙ্গে গরম ডাল, আর সেইসঙ্গে সামান্য তেল, নুন, ধনেপাতা ও কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখা আলুভাতে, আহা! অনবদ্য মনে হয় তরুণিমার কাছে। আবার যদি চাকা চাকা করে কাটা ভাপা ইলিশ বা ঢাউস গলদা চিংড়ির মালাইকারি থাকে কোনোদিনের খাদ্য তালিকায়, তাহলে তো সুখের গড়ের মাঠ। খেতে খেতে সুখের প্রাবল্যে তরুণিমার দু’চোখ বন্ধ হয়ে যায়। তবে এজন্য তরুণিমাকে কখনই পেটুক বলা ঠিক হবে না। যদি কেউ ভেবে থাকে, তার প্রচন্ড খিদে পায়, আর তাই যা পায় তাই গোগ্রাসে খায়, তা তো নয়! বরং সে যে-কোনো খাবার খেয়ে সুখ পায়, আর তাই সে খায়।
ইদানীং তরুণিমার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয় শ্যামসুন্দরের। হয়তো তখন দুজনেই কোথাও যাবার জন্য হন্তদন্ত হয়ে চলেছে অটোস্ট্যান্ডে। অথবা হয়তো রিফাইন তেলের প্যাকেট কিনে শ্যামসুন্দর তার ঘরে ফিরছে, আর তরুণিমা ভ্রু প্লাক করতে যাচ্ছে কোনো লেডিজ পার্লারে। তা দেখা হলেই কিছু কথা হয়। হয়তো, যতসব অপ্রাসঙ্গিক এবং অসংলগ্ন কথা। কিন্তু! তবুও!
--‘আজ বেশ ঠান্ডা পড়েছে, তাই না?’ শ্যামসুন্দর বলে।
--‘হ্যাঁ, কাল মনে হয় আরও জাঁকিয়ে পড়বে!’ আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে তরুণিমা বলে।
--‘নাও পড়তে পারে, হয়তো কাল হঠাৎ ঠান্ডা কমে গেল, গরম পড়ে গেল!’
--‘তা যা বলেছো! তোমার অনুমান তো মাঝে মাঝে ঠিকঠাক লেগেও যায়!’
--‘তাই! তবে কী জানো তরু, এভাবে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলে তো খুব মুশকিল!’
--‘কেন? মুশকিল কেন?’
--‘না, আমার ভালো লাগে না। সব কিছু গোছানো থাকবে, তবেই না আনন্দ!’
--‘না শ্যামসুন্দর, এটা ঠিক কথা নয়। এলোমেলো হলো তো কী হলো! যত এলোমেলো হবে ততই তো মজা হবে! গতানুগতিকতা ও একঘেয়েমি কাটবে! না হলে তো সবাই আমরা অসুখে ভুগবো!
শ্যামসুন্দরের ব্যস্ততা আছে। তেল পৌঁছলে মা রান্না চাপাবে। অথচ তরুণিমাকে ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করে না। কী যে আছে এই মেয়েটির মধ্যে!
মনোরমা একদিন তরুণিমাকে বলল, ‘তুই মাঝে মাঝেই জঙ্গলে চলে যাস্। কী ব্যাপার বল্ তো তরু! জঙ্গলে তোর কোনো প্রেমিক থাকে নাকি? তার সঙ্গে দেখা করতে যাস্? তোরা জঙ্গলে অনেক কিছু করিস্, তাই না?’
তরুণিমা হাসে, ‘হ্যাঁ, আছে তো! আমার প্রেমিক থাকে জঙ্গলে। আমরা তো মিলিত হই!’
চোখ উলটে যায় মনোরমার, ‘সে কী রে! আর কোথাও জায়গা পেলি না, একেবারে জঙ্গলে?’
তরুণিমা কীভাবে মনোরমাকে বোঝাবে যে, তার প্রেমিক গাছেরা জঙ্গলেই যে পাকাপাকি ভাবে বসবাস করে! তাদের সঙ্গে সহবাসের জন্য তাই তাকে জঙ্গলেই যেতে হয়। আর গাছেদের সঙ্গে সহবাসে কী যে সুখ, তাই বা সে কেমন করে মনোরমাকে বোঝাবে! তরুণিমা তো জানে, মনোরমা তার ফিয়াসেঁ হরিহরের সঙ্গে লাগামছাড়া মিলিত হয় নিজেদের বাড়িতেই। তা থাকুক! সেই সুখ নিয়েই থাকুক মনোরমা। তরুণিমার তাতে কিছু যায় আসে না। আর তরুণিমার সুখ তো মনোরমার কখনই সইবে না। তরুণিমার কোনো অসুখ নেই।
মাঝে মাঝেই তরুণিমার খুব ইচ্ছে হয়, কৈশোরের দিনগুলোয় ঘুরে বেড়াতে। খুব তো বেশি দিনের কথা নয়, এই তো কয়েক বছর আগেও তরুণিমা ছিল এক উচ্ছ্বল উজ্জ্বল উৎফুল্ল কিশোরী। একই সঙ্গে টানটান এবং টানাটানা। অথচ সেই সময়টা খুব একটা নিরাপদও ছিল না। সারা শরীর আর মন জুড়ে তখন কত রকম যে টানাপোড়েন, ভাঙচুর, অগ্ন্যুৎপাত! না, তরুণিমা সেইসব দিনগুলোর কথা একদম ভোলেনি। ভুলবেই বা কী করে! তরুণিমার শরীরের ভেতরে, কতটা ভেতরে তা অবশ্য তরুণিমা জানে না, সে যে কী এক আশ্চর্য টালমাটাল ক্যাটরিনা-ঝড়! কেমন যেন সব এলোমেলো ব্যাপার স্যাপার! কিন্তু সুখ। বড়ই সুখ। কোথা থেকে যে সুখের জোয়ার এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল তরুণিমাকে! সুখসাগর কি তবে একেই বলে? তরুণিমার কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। সে শুধু বুঝতে পারছিল, একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে তার শরীরের জ্যামিতি। পালটে যাচ্ছে ভূগোল। আর তারপর, বাকিটা তো ইতিহাস!
আরও বেশি করে মনে পড়ে সেই বিশেষ দিনটার কথা। ধিকি ধিকি অগ্ন্যুৎপাত তো কবে থেকেই শুরু হয়ে গেছিল। সারা শরীরটাই যেন ক্রমশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। তারপর একদিন হঠাৎ সেই যে সাংঘাতিক বিষ্ফোরণ ঘটলো! তোলপাড় হয়ে গেল বিশ্ব ব্রক্ষ্মান্ড! সে যে কী এক ভয়ংকর সুখের দিন! কী এক সাংঘাতিক আনন্দের দিন! তরুণিমার মনে পড়ে, উষ্ণ দুরন্ত দুর্দান্ত অপ্রতিরোধ্য লাভাস্রোতে সেদিন ভেসে গেছিল তাদের ঘরদুয়ার, ইস্কুলবাড়ি, দাঁড়িয়াবান্ধা খেলার মাঠ।
এই সুখের সন্ধান শ্যামসুন্দর কোথায় পাবে? তার পাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। তবে মনোরমা হয়তো পেয়েছে। অথবা হয়তো পায়নি। আর যদি পেয়েও থাকে, তবে সে যে কতটা সেই সুখের গভীরতায় ডুবে মরেছে, কে জানে! সবাই তো আর সত্যি সত্যি সুখি হতে পারে না। সুখের সন্ধান অনেকেরই তো ধাতেও পোষায় না!
তরুণিমার কোনো অসুখ নেই।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন