ধারাবাহিক
উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(৪৪)
এখনও একমাস হয়নি লিপিকা কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে ফিরেছে। বাবুল দিল্লী চলে গেছে তিনদিন হল। দিনদশেক আগে শোভনের বাৎসরিক শ্রদ্ধা হয়ে গেছে। তিথি অনুযায়ী ওই দিন ছিল। তারিখ হিসেবে আরও আগে দিনটা পার হয়েছে। লিপিকা এখন একা। খুব গরমদিনে এ-সি চালালে যেরকম ঠাণ্ডা আস্তে আস্তে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে, তেমন এক ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। শোক নেই, ব্যথা নেই, শূন্যতা নেই, একাকিত্ব নেই। গত প্রায় একবছর লিপিকা এবাড়িতে ছিল না। বাবুলের সঙ্গে দিল্লী চলে গিয়েছিল। আদ্যশ্রাদ্ধ মিটে যাওয়ার দু-দিন পরে বাবুলের ফেরার কথা ছিল। দুটো টিকিট কেটে লিপিকাকে বলেছিল,
“মা চলো।”
ছেলের গলার স্বরে অবাক
হয়েছিল লিপিকা। তাদের ছেলেমানুষ বাবুল হঠাৎ বড়ো। বলার ধরনে অভিভাবত্ব। তার পরের ন-টা মাস মা-ছেলেতে কেটেছে।
পৃথিবীর অতল শূন্যতার ভার দু-জনের কেউই বোধহয় একা বইতে পারত না। যতবার সে কলকাতায় ফেরার
প্রসঙ্গ তুলেছে বাবুল ঝিমিয়ে গেছে। লিপিকা তাড়াতাড়ি বলেছে, “আচ্ছা থাকব তাহলে এ-মাসটা।”
শেষদিকটা ছটফট করছিল। একই কথার ভার, একই চিন্তার ধারা। তাই জোর করেই
ফিরেছে লিপিকা। কলকাতায় দেবিকা ডাকাডাকি করছিল। শেষ দু-মাস এসে ছিল দেবিকার কাছে, বাপের
বাড়িতে। বাপের বাড়ি শব্দটার অর্থ আর না থাকলেও, লিপিকা আজও তাই ভাবে। তাদের আজন্মের
সেই পাড়া! অনেক বদল হয়েও তরুণী বেলার স্মৃতি টেনে আনে। সময়-অসময়েও পাড়ার কেউ না কেউ
আসে। বসে দুদণ্ড, গল্প করে। দুঃখ করে। তাদের মা-বাবার কথা বলে।
আর দেবিকা দু-টো মাস
তাকে কীভাবে বুকে আগলে রেখেছে, কত যত্ন করেছে, লিপিকা কোনোদিন ভাবতেই পারেনি। এক দুপুরে
খেয়ে-দেয়ে দু-বোন পাশাপাশি। দেবিকার চোখ ছলছল,
‘তদের আমি খুবই ভালোবাসতাম, বুঝলি মেজদি। আবার হিংসামিও
করতাম। সবাই ভালো কইত যে তদের। মনে হইত, আচ্ছা আমি খারাপ হয়েই দেখাই। বয়সের দোষ। শ্যাষে
ভুল একখান করেই ফেললাম।”
“ভুল কিসের? ভালই ত আছস। কৌশিক কি মন্দ নাকি? মন্দ
হইলে এত বছর সংসার করতে পারত তোর লগে?”
“না না, তারে মন্দ কই না। কিন্তু আর দুই জামাইয়ের
মতো উচ্চমানের না। তবে আমাদের মেয়েটা কিন্তু ভাল হইছে মেজদি। হয় নাই, বল?”
“মামপিকে ওর মেশো বড় ভালো বাসত!”
“আমি বুঝি রে মেজদি। কিন্তু সে বড্ড জিদ্দি মেয়ে।
চাকরি ছাইরা আসতেই চাইল না। দেবার্ঘ্যই বা কত অপেক্ষা করবে? আমি অদের দোষ দেখি না।
তার মা-রও একটা মানসম্মান আছে!”
লিপিকা আস্তে আস্তে
বোনের মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মায়ের পেটের ছোটো বোনটা। সেও কাছে টানতে পারত। বরাবর
দূরে ঠেলে রেখেছে। দেবিকার চেহারা ভেঙেচুরে এমন হয়েছে, লিপিকার বড়ো দিদি মনে হয়।
লিপিকা বসেছিল ব্যালকনিতে। একটা বছর! ছেঁড়া-ছেঁড়া খবরের কাগজের টুকরো হয়ে তার গায়ে, মাথায়, মুখে, সারা বাড়িঘর জুড়ে। ঠেলে সরিয়ে দিতে গেলে আবার লেপ্টে বসে যায়। সামনে নিরিবিলি রাস্তা, গাড়ির হর্ন, ধীর চলাচল। তার বাড়ির চলাচল স্তব্ধ। ঘটনার তিন-চার দিন পর নন্দন অ্যাকোয়ারিয়ামটা নিতে এসেছিল। সঙ্গে শ-দুয়েক টাকা। বেঁচে-থাকা বাকি মাছগুলো আর অন্যান্য সররঞ্জাম নিয়ে জিনিসটার দাম নেহাৎ কম নয়। লিপিকা তার হাতে টাকাটা লক্ষ করে বলেছিল,
“নিয়ে যান দেখি ওটা—। জায়গাটা খালি করুন।”
রুক্ষ কথায় নন্দন ঘাবড়ে
গিয়ে আমতা আমতা করছিল। শান্ত গলায় বলেছিল,
“ম্যাডাম, হাতে এর বেশী ক্যাশ ছিল না। আমি পরে বরং
ইনস্টলমেন্টে—,”
লিপিকা জোরে মাথা নেড়েছিল।
টাকার দরকার নেই। বাবুল ঘরে শুয়েছিল। উঠে এল। নন্দনকে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে?”
“না মানে একুরিয়ামের টাকা আমি একটু একটু করে—, তা মাসিমা বলছেন—,”
“টাকা দিতে হবে না। নিয়ে যান এটা। মা আর রাখবে না।”
নন্দন খুব খুশী। আধঘন্টা
ধরে কাজ করল। অ্যাকোয়ারিয়ামের জল ফেলে, মাছগুলোকে প্লাস্টিকের প্যাকেটের জলে ভরে, পাম্প,
হিটার সমস্ত গুছিয়ে তুষ্টমুখে বলল,
“দাদা আসছি তা-লে। মাসিমা গেলাম। কোনও দরকার হলে
ডাকবেন।”
নন্দন বেরিয়ে গেলে অতখানি
জায়গা ভীষণ চোখে লাগছিল। বাবুল তাড়াতাড়ি ছোটো টু-সীটার সোফাটা টেনে এনে রেখে দিল। বেচারা
এত বছর যেন কোণঠাসা হয়েছিল। ড্রইংরুমটা আসলে খুব ছোটো নয়, হঠাৎ ভাবল লিপিকা।
সন্ধে হয়ে গেছে। আলোজ্বলা সচল রাস্তা। একটু পরে রাত হয়ে যাবে। লিপিকা পিছনে সরতে সরতে ফিরে যায় সেই সকালে। ময়নার ফোন পেয়ে বাড়ি ফিরে আসার পথে অ্যাম্বুলেন্সটাকে দেখেছিল। তাড়াতাড়ি এসে ঘরে ঢুকেছিল। বিছানায় অচৈতন্য শোভন নিজের বমিতে মুখ থুবড়ে আছে। পরিষ্কার করে, জামা ছাড়িয়ে, পাতলা চাদর চাপা দিয়ে স্ট্রেচারে দিয়েছিল। ময়নার কাছে বাড়ির চাবি রাখল। ততক্ষণে বিল্ডিং-এর অন্যান্য বাসিন্দারা নীচে গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কথা বলার সময় ছিল না। অ্যাম্বুলেন্সে বসে বাবুলকে কল্ করল,
“অফিসে আছিস? তোর বাবাকে নিয়ে নার্সিং হোমে যাচ্ছি।
আর দেখতে পাবি কি না জানি না।”
বলেই ফোন কেটে দিয়েছিল।
বুকের মধ্যে কটকট শব্দ হচ্ছিল। নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছিল। বাবুল অনবরত ফোন করছিল আর সে
কেটে দিয়েছিল। নার্সিং হোমে ঢুকে বলেছিল,
“আই-সি-ইউতে নিয়ে গেছে, বাবুল। বারবার ফোন করিস
না।”
রিসেপশনে ফর্ম্যালিটিজ্
মিটিয়ে ওয়েটিং কর্ণারে বসে ঝিমোচ্ছিল লিপিকা। নেশার মতো ঘুমের জাল পেঁচিয়ে ফেলছে। বাইরের
কোনও খেয়াল ছিল না। কতক্ষণ পর ময়না এসে পৌঁছেছিল। বাড়িঘর পরিষ্কার করে, গুছিয়ে, তালাবন্ধ
করে এসেছিল। টিফিনবক্সে খানদুই ব্রেড-টোস্ট, ডিমসেদ্ধ মুখের সামনে ধরে দিয়েছিল।
“খেয়ে নিন কাকিমা!”
লিপিকা ভাবলেশহীন চোখে
তাকিয়ে বাক্সটা নিল। পাউরুটি দাঁতে কাটল। ডিমসেদ্ধ খেল। বোতল থেকে জল। মুখ মুছে, চোখ
বুজে বসে থাকল। তখনই আবার ফোন, মামপি।
“মেশো আই-সি-ইউতে? বাবুল ফোন করল এক্ষুণি!”
“হুঁ।”
“কী হলো গো?”
“কার্ডিয়্যাক অ্যারেস্ট।”
“মাসিমনি, তুমি ওর ফোন কেটে দিচ্ছ! ওরা যাচ্ছে রাতের
ফ্লাইটে। চিন্তা করো না প্লিজ। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হুঁ।”
“মা-কে জানাওনি, না? আমি ফোন করে দিয়েছি। মামুকে
মা জানাবে। আমিও দেখছি ছুটি নিয়ে যদি পারি—। রাখি?”
“আচ্ছা।”
মামপির গলা কাঁপছিল।
লিপিকা প্রাণহীন পুতুলের মতো ঠায় সেই চেয়ারে। সন্ধের পর ডাক্তার শোভনকে দেখে বেরিয়ে
লিপিকার কাঁধে হাত রাখলেন,
“স্টেডি থাকুন ম্যাডাম। পেশেন্টকে ভেন্টিলেশনে শিফট্
করে দেবো। আপনার কনসেন্ট লাগবে।”
“আমার ছেলে আসুক।”
“অ্যাজ ইউ ডিসাইড ম্যাডাম। তবে দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
কৌশিককে নিয়ে দেবিকা
এসেছিল। লিপিকা বিরক্ত হয়েছিল। দেবিকার সাজ, গলার স্বর, সান্ত্বনার ভঙ্গী—। লিপিকা তেতোমুখে বলল, ‘বোস’। বেশ রাতে পৌঁছাল বাবুল, সঙ্গে উর্বী।
প্রথম দেখাতেই মেয়েটা দু-হাতে জড়িয়ে ধরেছিল লিপিকাকে। লিপিকা অসম্ভব স্বাভাবিক চোখে
বাবুলের দিকে তাকাল,
“তোদের সাথে আর দেখা
হবে না তোর বাবার।”
উর্বীর হাতের মধ্যে
টলে গিয়েছিল লিপিকা। বাবুল কী করেছিল, মনে করতে পারে না এখন।
দিল্লীতে বাবুলের সেই এক-কামরার ফ্ল্যাট। বাবুল ফেরা পর্যন্ত আলো না জ্বেলে বসে থাকত লিপিকা। ঘরদোর তেমনই অগোছালো। বাবুল এলোমেলো। কখনও ওয়ার্ক ফ্রম হোম, কখনও অফিসে গিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসা। জীবনের গতিকে সমে ফেরাতে পারছিল না দুজনের কেউ। উর্বী আসত। ঝামুর-ঝুমুর চুলের মেয়েটা দুজনকেই আদরে জড়িয়ে ধরত। কিচেনে ঢুকে অনভ্যস্ত হাতে কিছু বানানোর চেষ্টা করত। লিপিকা হেসে ফেলত ওর কাজকর্ম দেখে। ওর বাবা-মা দিল্লীতে এসেছিল ওর কাছে। উর্বী দেখা করাতে এনেছিল। লিপিকা বলল,
“বছরটা কাটলে বিয়ে সেরে ফেলব মধুমতী।”
“আমাদের তাড়া নেই লিপিকাদি।”
“আমার আছে গো।”
হঠাৎ মামপি ফোন করল
একদিন। বাবুল অফিস যাওয়ার পরে একা শুয়েছিল লিপিকা।
“মাসিমণি—, কেমন আছো?”
“তুই কেমন আছিস?”
“আমি ভালো—। তুমি তো বাবুলের কাছে, শুনলাম। দেখা
হল না।”
“এখানে চলে আয়।”
মামপি চুপ করে কী ভাবে।
পরে বলে,
“এক্ষুনি হবে না গো। আসলে তোমার সঙ্গে আমার কথা
ছিল।”
“বল না, শুনছি।”
“সামনে বসে বললে ভালো হত। যাকগে। জানো, দেবার্ঘ্যর
বিয়ে এবছরেই। কলকাতার মেয়ে।”
এরকম হয়ত ভেবেছিল লিপিকাও,
খুব অবাক হল না। জানতে চাইল না কী ঘটনা। ফোনের ওপারে কাঁদছিল মামপি। অনেক কিছু বলে
গেল। লিপিকা চুপ করে ভাবল, “কাঁদুক!” দেবার্ঘ্যর সঙ্গে সম্পর্ক সে ভেঙে দিয়েছে। দেবার্ঘ্য
নিজের জায়গা ছেড়ে একচুল নড়বে না। মামপি এমাসে হায়দরাবাদেই ফিফটি পার্সেন্ট হাইকে অন্য
একটা ভালো কম্পানিতে জয়েন করবে। আর পার্কসও আছে। কথাবার্তা প্রায় ফাইন্যাল। এমন চাকরি
কলকাতায় কে দেবে? দেবার্ঘ্যর মা নাকি বলেছে, মেয়ে হয়ে এত ডাঁট কিসের? তার ছেলের আয়
যথেষ্ট ভালো। মামপি কাজ না করলেও অসুবিধে হত না। না হয় গোটাকতক টিউশনি করত। আস্তে আস্তে
মামপির কান্না বন্ধ হয়ে গলার সুর পালটে যায়।
“এখানে কাজের চাপ যথেষ্ট বেশী। কিন্তু জানো, আমি
এঞ্জয় করছি। আর নিজের ফ্রিডম—।”
“তোর মা-কে বলেছিস?”
“হ্যাঁ। মা-কে তো জানোই। কিচ্ছু শুনতে চায় না। বোঝে
না। কথা বন্ধ করে দিয়েছে।”
“তাহলে বিয়ে করবি না?”
“করবো। এখনই না। একটা বছর অন্তত—, দেখে নিই, মানুষ চিনতে সময় লাগে। বলো?”
মামপির কথা আত্মবিশ্বাসে
ভেজা। হয়ত আর কোনও ইঙ্গিত ছিল। লিপিকা নিজের মতো আঁচ করল। মামপি কিছু একটা এখনই ভাঙতে
চাইল না, বুঝল। মামপি আবার বলল,
“তোমাকে একটা সিরিয়াস ব্যাপার বলার আছে মাসিমণি।
তুমি কলকাতায় ফিরলে ডিটেইলে বলব। তাও একটু জানিয়ে রাখছি—মেশোর আঁকাগুলো নিয়ে আমার একটা প্ল্যান আছে। যদি তুমি রাজি থাকো, তাহলে—।”
“আমি ভেবে বলবো রে। রাখি এবার?”
বলতে গিয়ে লিপিকার গলা
ধরে গেল। শোভনের ড্রইংখাতা কলকাতার ফ্ল্যাটে। সঙ্গে আনেনি। আনেনি আরও কত কী।
বছরটা আয়লা বা উম্ফুনের মতো ঘূর্ণিঝড়ে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। ধুলোকাদা ঢেকে দিয়েছে ছোটো-ছোটো খুশী। উর্বী-বাবুলের বিয়ের তারিখ পাকা করে লিপিকা কলকাতায় ফিরল।
দেবিকার কাছে থাকার
সময়ে আর্বন কম্পানির লোক ডেকে পরিষ্কার করাল ফ্ল্যাট। বাবুলের বিয়ের আগে রঙ করিয়ে পর্দা-ফার্নিচার
পাল্টাবে। দেবিকার মন ভালো নেই। দেবার্ঘ্যর বিয়ে হয়ে গেছে। তার মা দেবিকাকে বিয়ের কার্ড
পাঠিয়েছিল। কোনও সম্বোধন করেনি। বিয়ের খবর যে গুজব নয়, হয়ত জানানোর জন্য পাঠিয়েছে।
ফ্ল্যাটে ফিরে প্রতিদিন
ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে বছরটা দেখছে লিপিকা। ছোট্টবেলার মোটাসোটা লাল-নীল দু-মুখো পেনসিলে ছবি
আঁকার চেষ্টা। রাতে এখন বাবুলের ঘরে ঘুমোয়। ময়না ডিউটি সেরে রাত দশটা নাগাদ আসে তার
কাছে। দু-জনে খায় তারপর শুয়ে পড়ে। শোভনের ড্রইংখাতা, রঙ নিঃশব্দে ঘুমিয়ে থাকে আলমারিতে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
পেনাল্টিমেট পর্বও পড়লাম। খুব সুন্দর। চরিত্রেরা চেনা ছকের কিন্তু জীবন্ত।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ জানাই
উত্তরমুছুন