ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(৫৫ ৫)
(৩৫)
প্রশ্নটাকে পুরোপুরি গ্রাহ্য না করে নিজের কথার স্রোতেই নিজেকে ভাসিয়ে দেয় সমিধা। কিছুদিন ধরেই আমার মধ্যে একটা বদল ঘটছে। মা নিজেই যেন ফিকে হয়ে আসছে। আর প্রবল হয়ে উঠছে আমার বাবা। নিজের অধিকার বাড়িয়েই চলেছে। আমার ভেতরটা কিছুদিনের মধ্যেই পুরো দখল করে নেবে আমার বাবা। তাই নিয়েই আমার দুশ্চিন্তা। নিজের সংসারে কোনওদিন নিজের জায়গাটি পায়নি আমার মা। এক কোণে গুটিসুটি মেরে পড়ে থেকেছে। এখন আমার মন থেকেই যদি তার বিসর্জন ঘটে, সেটাই বা আমি চাই কী করে! কিন্তু আমার উপায় নেই। মাকে জায়গা দিলে আমার শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু সেই জায়গায় বাবা এলে গোটা দুনিয়াকে আমি উচিত শিক্ষা দিয়ে যেতে পারব। আমার বাবা এক সাঙ্ঘাতিক মানুষ। নিষ্ঠুর, কঠোর, হৃদয়হীন। জীবনে যা চেয়েছে, তাই আদায় করে নিয়েছে। সামান্য অবস্থা থেকে দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন হয়ে উঠেছে। কাউকে সহ্য করে নি। কোনও কিছু গ্রাহ্য করে নি। এরকম দুর্দান্ত মানুষের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে নি আমার মা। বড়ো বেশী দয়া মায়া দেখিয়ে ফেলেছে। আমার বাবা যা কিছু অপছন্দ করত, তাদের সঙ্গেই বেশী বেশী করে সহবাস করেছে। এখন আমি আমার বাবাকে বুঝতে পারি। বাবা এমনি এমনি অন্য মেয়ের কাছে যায় নি। মা-ই বাবাকে যেতে বাধ্য করেছে। মা নিজে একটু দুর্দান্ত হলে আমাকে ছোটোবেলায় এমন অপদস্থ হতে হত না। আমার রূপ নেই, বুদ্ধি নেই, কিন্তু আমার মধ্যে আগুন আছে। সে আগুন বাবার কাছ থেকে পাওয়া। অন্তত আমি আমার বাবার যোগ্য হয়ে উঠতে চাই। আমি তার সন্তান। আমার মনে তাকেই আহ্বান করি সব সময়। আর তখনই নিজের ভেতর যে দুর্দান্ত শক্তি লুকিয়ে আছে, তাকে আমি টের পাই।
সবাই চুপ করে থাকে। সমিধার দুই চোখ যেন জ্বলছে। একটা ঘোরের মধ্যে সে বলেই যায়, শুধু একটা ঘটনা। হৃদয়ের ওই প্রত্যাখ্যান। আমার জীবনটাই বদেওলে দিয়েছে। আমি আমার সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছি। ভুল দিকে যাচ্ছিলাম আমি। মাকে বেশীদিন আঁকড়ে থাকলে নারকীয় হয়ে উঠত আমার জীবন। আর সে যে কী নরক! শুধু দয়া, মায়া, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা। অসহ্য। একাকিত্ব, করুণা, শাস্তি। পুরস্কারের পর পুরস্কার। ঘৃণা করি আমি এই জীবনকে। বাবাকে এখন আমি বুঝতে পারি। আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। শুধু তাই নয়। এখন আমি তাকে পুজো করি। বাবাই আমাকে শিখিয়েছে, কী করে নিজের মনকে পাথর করে তুলতে হয় আর দুনিয়াকে অর্থের জোরে জিতে নিতে হয়। অর্থ ছাড়া আর কিছু নিয়েই ভাবেনি আমার বাবা। অর্থই মানুষকে এই দুনিয়ার রাজা করে দিতে পারে। আমার বাবা এই দুনিয়ার এক রাজা। কিন্তু আমি শুধু রাজা হতে চাই না। আমি চাই ঈশ্বর হতে। আমার চাই ফুল। ফুলের স্বাদ আমি পেয়েছি। মা-ই আমাকে সেই স্বাদ দিয়েছে। আমি সারাজীবন ফুলের চর্চা করে যাব। ফুলই হবে আমার আরাধ্য। বাবা আর মাকে আমি মিশিয়ে দেব। বাবা শুধু অর্থের কথা ভেবেছে। সে হয়েছে রাজা। মা শুধু ফুলের কথা ভেবেছে। সে হয়েছে ভিখিরি। আমি ফুলের কথা ভাবব কিন্তু অর্থকে বাদ দিয়ে নয়। আমি অর্থের কথা ভাবব, কিন্তু ফুলকে বাদ দিয়ে নয়। আমি হব ঈশ্বর। অর্থ দিয়ে আমি ফুলের সাধনা করব। ফুল দিয়ে আমি অর্থকে উপার্জন করব। এই দুনিয়ায় আমি ঈশ্বরের মতো বাঁচব...
এবার বিহান বলে ওঠে, হৃদয় কিন্তু তোকে
খুব বিশ্বাস করে। ভরসা করে তোর ওপর। প্রিয় বন্ধু ভাবে তোকে। সব জায়গায় তোর কথা বলে।
চোপ! গর্জে ওঠে সমিধা। তারপর বলে, হৃদয় কী করে না করে, তোর থেকে না জানলেও আমার চলবে। কিন্তু হৃদয় আমাকে দুর্বল ভাবে, একথা কি মিথ্যে? একথা ঠিক, ও কোনওদিন আমার অর্থের দিকে তাকায় নি। কিন্তু এটাও ঠিক ও কোনও দিন আমার অন্তরের দিকেও ফিরে দেখে নি। ও শুধু নিজের খেয়ালে চলে। আমি প্রত্যাখ্যাত হয়েছি এবং তার পরেও ওর সঙ্গে আছি। নিজের কর্তব্য করে চলেছি। ভদ্রতা ও সৌজন্য দেখিয়েছি। এসবই ওর কাছে আমার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়েছে। কিন্তু সম্মান বাড়িয়েছে কি? ওর চোখে আমি যা ছিলাম, তাই আছি। দুর্বল হৃদয়ের এক নারী। ওর প্রতি অনুগত, বিশ্বস্ত। ও যা বলবে তাই করতে বাধ্য। অনেক গুণ আছে হৃদয়ের। আমি ওর গুণমুগ্ধ। তুলনাহীন ওর মেধা। ওকে দেখলেই আমি দুনিয়ার তুচ্ছ তুচ্ছ ব্যাপার ভুলে যেতাম। ওর কথায় আমার সম্পূর্ণ আস্থা ছিল। ও যা বলত আমি চোখ বুজে তাই শুনতাম। সেই বই পড়তাম, সেই গান শুনতাম, সেই ছবি দেখতাম। সেই ফুলের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। ও ছিল আমার স্বপ্নের দেবতা। ফুলের মতোই ছিল আমার আত্মা। হৃদয় ফুলের সমঝদার। কী দাম দিয়েছে সেই ফুলের? সেই ফুলটাকে একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতোই ব্যবহার করতে চেয়েছে।
সমিধার অনেক কথাই মনে পড়ছিল। সবই সাম্প্রতিক অতীতের। বিহানের একজন দূর সম্পর্কের বোন ছিল। চমৎকার দেখতে মেয়েটি। অনেকটা বেদপর্ণার মতো। বিহানের সঙ্গেই সে আসত ফুলের বাগানে। নাম উপমা। বিহান বুঝতে পেরেছিল, হৃদয় অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। ওর সঙ্গে উপমাকে জুড়ে দিতে পারলে মেয়েটার একটা হিল্লে হয়ে যাবে। অভাবে মেয়েটার সব কিছুই যেতে বসেছে। সৌন্দর্যটাও। মেয়েটিকে ভালোই লাগতে শুরু করেছিল হৃদয়ের। আর উপমা তো এসেইছিল একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। হৃদয় শুধু একবার বলেছিল, আগ্নেয়র সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক ছিল না? উপমা কয়েকবার আগ্নেয়র সঙ্গে ওদের বাড়ি এসেছিল। অনেকটা সময় হৃদয়ের ঘরে ওরা একা কাটায়। মেহুলী ব্যাপারটা পছন্দ করেনি। আগ্নেয় সরে যেতে বাধ্য হয়। বিহান তখন হৃদয়ের সঙ্গে চেষ্টা শুরু করে। হৃদয়ের মুগ্ধতা ওর চোখ এড়ায়নি।
হৃদয়ের কথার জবাব দিতে গিয়ে বিহান একটু থমকে গেছিল। তারপর বলেছিল, হ্যাঁ, ছিল। কিন্তু তোকে দেখার পর ও সব ভুলে গেছে। অতীতকে এখন আর ও মনে রাখতে চায় না। ব্যাপারটা সবারই চোখে পড়েছিল। বিশেষ করে সমিধার। সমিধা একদিন বিশ্রুতকেও বলেছিল, উপমা দেখতে খুব সুন্দর। ব্যাপারটা আমি বুঝি। সৌন্দর্য নিয়ে হৃদয়ের একটা হ্যাংলামো আছে। তখন মেধাকেও ও তুচ্ছ করে। এটাই আমি সহ্য করতে পারি না। কিন্তু বিহানের উদ্যোগটাও দেখার মতো। ওই এগিয়ে দিচ্ছে মেয়েটাকে। মেয়েটাও সুযোগ নিচ্ছে। সত্যিই আমি বুঝতে পারি না কী আছে ওই মেয়েটার মধ্যে যা আম্র মধ্যে ছিল না? হৃদয় সত্যিই অন্ধ। ওর দৃষ্টি শক্তিই নেই। একে আমি ভালোবেসেছিলাম?
এই উপমার জন্যই কয়েকদিন পর সমিধার কাছে
আসে হৃদয়। বলে, একটা কাজ করে দিতে হবে সমিধা...
সমিধা মনে মনে হাসে। বলে, কী কাজ?
উপমার বাবা নেই। যৎসামান্য সঞ্চয় ভাঙিয়ে
ওর আর ওর মা-র সংসার চলে। ছোট সংসার কিন্তু অভাব খুব। উপমার একটা কাজের খুব দরকার।
তোর বাবাকে একবার বলে দেখবি, তোদের কম্পানিতে যদি হয়...
সমিধা কয়েকদিন সময় চায়। ঠিক যেভাবে
হৃদয় সময় চেয়েছিল। কিন্তু সিদ্ধান্তটা সে আগেই নিয়ে নিয়েছে। বাবাকে সে কিছুই বলে না।
কয়েকদিন পর হৃদয়কে ফোন করে বলে, অনেক চেষ্টা করলাম, কিছুই হল না রে। কিছুই করতে পারলাম
না। সমিধার গলার স্বরে হতাশা যেন ঝরে পড়ে।
কেন? শান্তভাবে জানতে চায় হৃদয়।
কোম্পানির অবস্থা ভালো নয়। বাবা স্পষ্ট
জানিয়ে দিল, নতুন লোক নিতে পারবে না। আর তুই তো জানিস, বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কের
ব্যাপারটা। বাবাকে যে একটু জোর করব, তেমন পরিস্থিতি আমার নেই।
হৃদয় কথা বাড়ায় না। ব্যাপারটা ওখানেই
শেষ হয়ে যায়।
কয়েকদিন পর আবার একটা ঘটনা ঘটে। ফুলের
একটা প্রদর্শনী থেকে উপমাকে নিয়ে ফিরছিল হৃদয়। সঙ্গে ছিল সমিধা। হৃদয় একটা ট্যাক্সি
ডাকে। অনেকটা পথ। তারপর সমিধাকে বলে, চল আমাদের সঙ্গেই যাবি। সমিধা রাজি হয়ে যায়।
সমিধা বসে সামনের সীটে। ড্রাইভারের পাশে। পেছনের সীটে হৃদয় আর উপমা। অন্ধকার রাস্তা। দুপাশে সারি সারি ঝাউগাছ। একদিকের গাছের ফাঁক দিয়ে দূরে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র তীর। শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের গর্জন। অন্যদিকে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঢেউ খেলানো পাহাড়। আকাশে গোল চাঁদ। থিকথিকে জ্যোৎস্নায় ভরে আছে চারপাশ। দুধের সরের মতো যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে ভেসে আছে সেই জ্যোৎস্না। হৃদয় জড়িয়ে ধরেছিল উপমাকে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে ওর স্তনের পাশটায় চাপ দিচ্ছিল। আচমকা চুমু খাচ্ছিল ওকে। সমিধা সবই টের পাচ্ছিল। ভীষণভাবে ঘামছিল সে। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিল। কিন্তু পিঠ সটান করে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। একবারও ঘুরে তাকানোর মতো সাহস ওর ছিল না। ও বুঝতে পারছিল তাকালেই যে দৃশ্য ওকে দেখতে হবে, তা সহ্য করা কত কঠিন হবে ওর পক্ষে।
পরে সমিধা আগ্নেয়কে বলেছিল, যে কষ্ট
সেদিন আমি পেয়েছি, যে যন্ত্রণা ভোগ করেছি, জীবনে আর কখনও তা পাইনি। হৃদয় এভাবে আমাকে
অপমান করল কেন? এভাবে আমাকে শাস্তি দিল কেন? নিজেকে কেন ও সংযত করল না? আমি কি একটা
পুতুল? আমার শরীর নেই? আমার মন নেই? আমার অনুভূতি নেই? কীভাবে ও এতটা নিষ্ঠুরতা দেখাতে
পারল? কী মনে করে ও আমাকে? সবটাই ঘটল আমার সামনে। ও আমার কথা একবারও ভাবল না? ওর চোখে
আমি তাহলে কী?
একটা জড়পদার্থ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
বলেছিল আগ্নেয়।
হৃদয়ের সঙ্গে উপমার সম্পর্কটা অবশ্য
বেশীদিন টিকল না। বিহান ততদিনে সমিধার সঙ্গে রীতিমতো জড়িয়ে গেছে। ফলে হৃদয়ের সঙ্গে
উপমার সম্পর্কের ব্যাপারে উৎসাহও হারিয়ে ফেলেছে। বরং এই সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারলেই ও
তখন বেঁচে যায়। উপমার বাড়িতে অশান্তি একটা চলছিলই। ঠিক সেই সময় নির্মাল্য আসে হৃদয়পুরে।
বিদেশে থাকে। প্রচুর অর্থ। হঠাত একদিন লঞ্চে হৃদয়ের সঙ্গে দেখা। হৃদয় ওকে অনুরোধ করে,
একবার ফুলের বাগানে আসতে। নির্মাল্য আসে। সেদিনই উপমার সঙ্গে ওর প্রথম দেখা হয়। নির্মাল্যর
সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে বিহানেরও বেশী সময় লাগে না। ততদিনে সে চাঁদমারি পেয়ে গেছে। হৃদয়কে
নিয়ে বরাবরই সে সন্দিগ্ধ ছিল। নির্মাল্যকে পেয়ে সে একদম নিশ্চিন্ত হয়। উপমার গতি নিয়ে
তার মনে আর কোনও দ্বিধা থাকে না।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন