কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৩


ট্রেন আসছে


টানের সময় নদী সরে যায়। মনসুর, শ্যামাপদ, শচীনের খুব কষ্ট। মাঝ নদীতে চরা। অনেকে কোমর জল বুক উঠলেও হেঁটে পেরোয়। শহরের বাবুরা পিকনিকে এলে লাভ। সে আর কত! ধান জমি কি আর সকলের হয়! গ্রামটা বেঁচে ওঠে দূরের প্রথম ট্রেনের ভোঁ-এ। গ্রামটা মাঝরাতে জেগে ওঠে স্বপ্নের মতো যখন তীব্রগতিতে দূরপাল্লার ট্রেনটা চলে যায়। পাশ ফিরে শোয় আবার গ্রামটা।

কার্তিকপুজোর পর রাতে এমনই মাঝরাতের ট্রেনে গলা দিয়েছিলো জনাই রোড স্টেশন থেকে আরো দু’কিমি দক্ষিণের বদনপাড়ার শামু। ‘মরিবার হলো তার সাধ’... শামুর বউর বাচ্চা হয়নি। সেবার কার্তিক ফেলে গেলো কারা যেন। কানাঘুষো শোনা যায় শামুর শিশ্ন কেঁচোর মতো নির্বীজ ছিলো।

শামুর বউ শহরে পালিয়ে গেল পরের জগদ্ধাত্রী পুজোর ভোরে প্রথম ট্রেনে ঠিকে মিস্ত্রি আনোয়ারের সাথে। এখন মেয়ের কোলে ছেলে, ফের পোয়াতি নাকি!

কার্তিক পেরিয়ে অগ্রহায়ণ মাসে এমন সময় আমরাও পাঁচ-মিনিটের হল্টে হাঁচোর-পাঁচর ইকিরমিকির সব নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিলাম।

ছাতিম গাছে ম-ম সুবাস। সন্ধ্যে হলে যা কুয়াশা সকালে তাই তো শিশির!  

ওভারব্রীজের ওপর দিয়ে ঝমঝম করে ট্রেন যায় শহরে। এখন ভুলে যাবার দিন। সুর্য হেলে। ছায়া আসল মানুষটাকে ছাড়িয়ে অনেকটা দূর বিস্তার করে। স্মৃতি কোনটা আর কোনটা কল্পনা, মিলেমিশে যায় একসময়।

বড়োদিঘির গা-ঘেঁষে বাড়িটা একতলায় নতুন সংসার। ছোট্টোমেয়ে কোলে ছেলে কর্তা গিন্নী একটা পোষা কুকুর আর একটা মস্ত হনুমান। সারা পাড়ায় নতুন পরিবারটি নিয়ে ঢি-ঢি। হনুমান কেউ পোষে!  

জলের ধারে বাঁধানো চাতালে কুকুর আর হনু বসে থাকে দীর্ঘ ল্যাজ ঝুলিয়ে। একটা ঝুলপড়া নোংরা সিঁড়ির মাথায় সাজানো ফিটফাট ঘর। ছোটো বটতলায় দত্তডাক্তার আজীবন দু’টাকায় রুগী দেখে এখন ছবি।

ঘুমের মধ্যে উসখুশ। বাতাসে আর্দ্রতা সামান্য। ঠিক তখনই ঘুম ভেঙে যায়।

স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে লাফালাফি করে ঝাড়েবংশে বেড়ে ওঠা হনুমানের দল। একদিন বাচ্চাটা ট্রেন চাপা পড়ল। বোঝেনি কী পারে আর কী না পারে! মা-হনুমানটা বসেই রইলো চকমকে রোদ ছিটকোনো রেলের পাতে। কেউ ভাবতে পারেনি এমনটা হতে পারে।

সাতদিন ওর মা বসে বসে হাহূতাশ করলো নিঃশব্দে। না খাওয়া না জলস্পর্শ। তারপর থেকে প্রতিটা ট্রেন নতুন বিষাদ বয়ে আনে। সেই পরিবারও তামাদি হয়ে গেলো। আমি নিশির ডাকে এগিয়ে যাই। এখানে ঘড়ি নেই। প্রতিটা ট্রেনের সঙ্গে জুড়ে আছে নিত্যদিনের লিপি। শেষ রুটিটা সেঁকে খরিদ্দারের হাতে তুলে দিচ্ছে মাসী। রাস্তায় এসে আটকে রয়েছে কার চোখ, নেভেনি এখনো আগুন, গরম রুটি অথবা প্রণয়...

ঝমঝম করে এগিয়ে আসছে ট্রেন। তোমার মুখ ফ্যাকাশে রক্তহীন। মৃত। একটা সার্কাসের লরি কোথা থেকে ছুটে আসছে... এখন ওভারব্রীজে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে...

আমার রক্তে ভেসে যাচ্ছে পথ। কাঁদছি ঘুমের ভেতর, ঘামছি।

ভোরের ট্রেন পার হয়ে গেল। ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে বসি শীতঘরে। বুকের ভেতর জোরে ঘন্টা বাজছে। জানলা খুলে দিই। সামনে ছাতিমগাছ। প্রতিটা স্বপ্ন লিখে লিখে রাখি। যদি সত্যি হয়ে যায় কখনও!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন