সুভাষচন্দ্র বসু, পরবর্তী
১৯৪৫
সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে আমরা কম বেশী সব বাঙালিই অবগত, তাঁর দেশপ্রেমের জন্য তিনি সমগ্র ভারতবাসী তথা পৃথিবীতে সমাদৃত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, আমরা সুভাষচন্দ্র বসুর সম্পর্কে জেনেছি ১৯৪৫ সালের ১ই আগস্ট পর্যন্ত, তারপরের সুভাষচন্দ্র বা তাঁর কার্যকলাপ নিয়ে বিস্তারিত জানার সুযোগ আমাদের হয়নি বা বলা যায় কাঙ্ক্ষিত ভাবেই দেশবাসীকে সেই সমস্ত ঘটনা জানতে দেওয়া হয়নি।
না জানানোর যথোপযুক্ত কারণও আছে, যেটা সম্পূর্ণভাবেই রাজনৈতিক, সেই বিষয়েও আমরা অবগত, তাই সেই কারণ নিয়ে বিষদে আজ কিছু বলতে চাই না। আজ আমার এই লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট তথাকথিত তাইহুকো বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যুর রটনার পর তাঁর জীবন ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আপনাদের জানানো। আমি কোনোভাবেই নেতাজী রিসার্চার নই, কিন্তু আর পাঁচটা বাঙলির মত সেই মহামানবকে নিয়ে আমার উৎসাহ কিছু কম নয়। আর সেই উৎসাহের বশেই বিগত কয়েক বছর যাবৎ বহু রিসার্চারের সঙ্গে কথা বলেছি এবং কিছু অজানা তথ্য সংগ্রহ করেছিন। বলা যায়, আমি ভাগ্যবান যে এমন কিছু তথ্য আমার হাতে এসেছে যেটা এখনো ডি- ক্লাসিফাই হয়নি। তাই সব ক্ষেত্রে তথ্য সূত্র দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ সেই সূত্র জনসমক্ষে আনা এখনো সম্ভব হয়নি। যদিও রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের ফাইলে সবই বর্তমান, শুধু তাই নয্ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইন্ডিয়ান এম্বেসির কাছেও বহু তথ্য আমি এই লেখার মাধ্যমে আপনাদের জানাতে চাই এবং যতটা সম্ভব আমি তথ্যসূত্র দেওয়ার চেষ্টা করবো। প্রথমেই আমি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে রটিত বিমান দুর্ঘটনা যে সম্পূর্ভাবেই মিথ্যা, সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই এবং তার পেছনে আমার যুক্তিগুলো নিম্নলিখিত -
১) প্রথমত, ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট তাইহুকোতে কোনো বিমান দুর্ঘটনাই ঘটেনি। সর্বোপরি সেদিন সেই বিমানবন্দর থেকে কোনো বিমান ওড়েনি। সেদিন তাইহুকোর থেকে ২০০ মাইল দূরে একটি বিমান দুর্ঘটনা ঘটে এবং সেটি একটি মার্কিন যুদ্ধ বিমান। এই তথ্য উঠে আসে মুখার্জি কমিশনের রিপোর্টে যখন জাস্টিস মুখার্জি ও তাঁর সহকারীবৃন্দ জাপানের তাইহুকোতে গিয়ে তৎকালীন লগবুক চেক করেন ও সেই সময়ে যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত সেরকম কিছু লোকজনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। আরও জানা যায় তাইহুকোতে ঐ সময়ের কাছাকাছি বিমান দুর্ঘটনা ঘটে ২১শে আগস্টে, এক জাপানি সৈনিক তাতে মারা যান যাঁর নাম ইচিরো ওকুরা। মুখার্জি কমিশন মনে করেন রেনকোজি মন্দিরে যে চিতা ভস্মকে নেতাজীর চিতাভস্ম বলে চালানো হচ্ছে, সেটি আসলে নেতাজীর নয়, সেটা ইচিরো ওকুরা নামে ঐ ব্যক্তির।
২) দ্বিতীয়ত, সুভাষচন্দ্র বসুর তথাকথিত মৃত্যুদিনের পর তাঁকে অনেকেই দেখেছেন এবং জওহরলাল নেহরুর কাছে এই মর্মে চিঠিও পাঠিয়েছেন বা সাক্ষাতে বলেছেন এরকম লিখিত দৃষ্টান্ত বা ডকুমেন্টেশন আছে। আলফ্রেড ওয়েগ বলে একজন আমেরিকান সাংবাদিক ও মার্কিন চর ২৯শে আগস্ট নেহরুকে জানান যে, তিনি চারদিন আগে নেতাজীকে সাইগনে দেখেছেন (প্রকাশিত হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ৩০শে আগস্ট, ১৯৪৫)। ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ সালে ঝাঁসির একটি সভায় নেহরু বলেন বাকী অনেকের মতই উনিও বিশ্বাস করতে পারছেন না যে নেতাজি প্লেন ক্র্যাশে মারা গেছেন এবং তার কাছে অনেকেই বয়ান দিয়েছেন এর সপক্ষে। ১৯৪৭ সালে ওয়াগ পাঞ্জাব কংগ্রেসের নিরঞ্জন সিং তালিবকে নেতাজীর ফটো দেখান নেতাজীর তথাকথিত মৃত্যুর পর এবং তালিব পরবর্তীকালে খোসলা কমিশনকে এই ঘটনা জানান। খোসলা কমিশনের রিপোর্ট পড়লে এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আপনারা জানতে পারবেন।
৩) নেতাজীর তথাকথিত মৃত্যুর প্রায় চারমাস পর নেতাজী জাপানি রেডিও থেকে প্রথম ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন ২শে ডিসেম্বর, ১৯৪৫ সালে। দ্বিতীয়বার তিনি বক্তৃতা দেন ১লা জানুয়ারি, ১৯৪৬ সালে এবং তৃতীয় বক্তৃতা রাখেন ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে তিনি বলেন, ভারত আর ঠিক দু-বছরের মধ্যে স্বাধীনতা পাবে, কিন্তু ব্রিটিশরা চাইছে ভারতকে ভাগ করে দিতে নিজেদের সুবিধার্থে এবং চিরকালীনভাবে ভারতবাসীর মেরুদন্ড ভেঙে দিতে। তিনি এই তিনটি বক্তৃতায় গান্ধীজির উদ্দেশ্যেও বলেন - গান্ধীজির উপর তাঁর অপার শ্রদ্ধা, কিন্তু অহিংস পথে কোনোদিন স্বাধীনতা আসবে না। আমি অনুরোধ জানাই, ব্রিটিশদের কোনরকম প্ররোচনায় পা না দিতে। তিনি খুব শীঘ্রই ব্রিটিশদের বিপক্ষে আবার যুদ্ধ ঘোষণা করে সম্পূর্ণ ভারতকে স্বাধীন করবেন। (এই রেডিও সম্প্রচারের বিষয়ে বিষদে জানতে হলে ডি - ক্লাসিফাইড ফাইলের ৮৭০/১১/পি/১৬/৯২ ফাইলটি দেখা যেতে পারে )। ডি ক্লাসিফাইড ফাইলে এটাও উল্লেখ আছে যে, খুরশিদ নাইরোজি মাউন্টব্যাটেনকে বলেন ভারতীয় আর্মি, আই. এন. এ-দের গ্রেফতারি নিয়ে খুবই ক্ষিপ্ত এর মাঝে রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু যদি দেশে ফেরেন, তাহলে গান্ধীজি বা নেহরু কেউই ব্রিটিশদের কোনরকম শর্ত মানার জায়গায় থাকবে না।৪) ১৯৪৬ সালে দেবেন সেন ট্রেড ইউনিয়ন লিডার ফ্রান্সের মার্সেইলি এয়ারপোর্টে নেতাজীকে দেখতে পান এবং এই ঘটনা তিনি পরবর্তী কালে খোসলা কমিশনকেও জানান। এছাড়াও অর্ধেন্দু সরকার নামে এক ইঞ্জিনিয়ার রাশিয়াতে নেতাজীকে দেখেন ১৯৪৭ সালে দুজন মঙ্গোলিয়ান বডিগার্ডের সঙ্গে এবং এই ঘটনা অর্ধেন্দুবাবু মস্কোর ইন্ডিয়ান কনসোলেটে জানানোর পর তাঁর চাকরী চলে যায় এবং তাঁকে ভারতে ফিরে আসতে হয়। এছাড়াও ১৯৫৫ সালে বিজয়ালক্ষ্মী পণ্ডিত বিদেশমন্ত্রকে থাকাকালীন রাশিয়া ঘুরে এসে নেহরুকে জানান যে, নেতাজী সম্পর্কিত বহু তথ্য তিনি রাশিয়ায় গিয়ে পেয়েছেন কিন্তু তারপর আর এই বিষয়ে তাঁকে মুখ খুলতে দেখা যায়নি এবং ভারত সরকার তাঁকে লন্ডনে ট্রান্সফার করে দেয়।
এগুলো বহু তথ্যের কিছু উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম। এছাড়াও অনেক ঘটনা আছে পরবর্তীকালে যেখানে নেতাজীর সঙ্গে অনেকের দেখা করার ঘটনা উঠে এসেছে, সেইসব ঘটনার কিছু নিয়ে আমরা আলোচনা করবো এই প্রবন্ধের পরবর্তী পর্যায়্ বিভিন্ন সময়ে অর্থাৎ ১৯৪৫ পরবর্তী টাইমফ্রেমে নেতাজীর কার্যকলাপ বিশ্লেষণের মাধ্যমে। উপরোক্ত কারণগুলো আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা এতক্ষণে এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, নেতাজী বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি বরং তথ্য সমুহ এই প্রমাণ দাবী করে যে নেতাজী ব্রিটিশ তথা সমগ্র এলায়েড ফোর্সের চোখে ধুলো দিয়ে নিজে আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যান তাঁর কর্ম-পরিকল্পনাকে পূর্ণ রূপদানের জন্য। নেতাজীর পরিকল্পনা যে শুধু মাত্র ভারতবর্ষকে নিয়েই ছিল না তা জানা যায় নেতাজীর ছোটবেলা থেকেই চিন্তাভাবনা, তার জীবনের ব্রত সম্পর্কে জানলে। ১৯২১ সাল নাগাদ তাঁর বাল্যবন্ধু হেমন্তকুমার সরকারকে তিনি চিঠিতে লেখেন যে, স্বাধীনতা সমগ্র বিশ্ববাসীর অধিকার এবং এই সময়ে বিশ্বের অনেক দেশের জনগণই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নাগপাশে বন্দী এবং অসহনীয় কষ্ট সহ্য করছে। সবার এই কষ্টের নিবারণ করাই তাঁর জীবন ব্রত এবং এই মহৎকর্ম যজ্ঞ সূচনার জন্য তাঁর নিজের দেশমাতৃকা উপযুক্ত স্থান। (এই বিষয়ে জানতে হলে সুগত বসু সম্পাদিত ‘এসেনশিয়াল রাইটিংস অফ সুভাষচন্দ্র বোস’ পড়া যেতে পারে )।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন