কালিমাটি
অনলাইন / ১০৮
আজ
সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি অভিনব সংবাদ আমাকে এক অভূতপূর্ব ভাবনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে
দিল। জীবন সম্পর্কিত ধারণায় একটি নতুন দিগন্তের ইশারা উঁকি মেরে গেল। এবং আজ ৯ নভেম্বর
দুপুর দেড়টার সময় কালিমাটি অনলাইন ১০৮ সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখতে বসে সেই সংবাদটা এড়িয়ে
যেতে পারলাম না।
ঘটনাটা
রাজস্থানের ভরতপুরের। দুটি চরিত্র। মীরা ও কল্পনা। দুজনেই নারী। মীরা ছিলেন একটি স্কুলের
শারীরশিক্ষার শিক্ষিকা এবং কল্পনা তাঁরই ক্লাসের ছাত্রী। আমরা এর আগে বিভিন্ন ঘটনা
সূত্রে জেনেছি ও শুনেছি, শিক্ষক ও ছাত্রীর মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রণয়ের সঞ্চার
হয়েছে, বস্তাপচা নীতিকথার তোয়াক্কা না করে তারা পরস্পরকে ভালোবেসেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে
বিয়েও করেছে। বেশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় এই ধরনের সম্পর্ক নিন্দিত
হতো, তাদের সমালোচনা করা হতো, আবার এমনও হয়েছে, পাত্রপক্ষ ও পাত্রীপক্ষ এই সম্পর্ক
মেনে নিতেও অরাজী ছিল। এখন অবশ্য ব্যাপারটা আদৌ কোনো জটিল সমস্যা নয়, এমন বহু সম্পর্ক
গড়ে উঠেছে, সমাজ তাতে আর বিরোধিতা করেনি। কিন্তু শিক্ষিকার সঙ্গে ছাত্রীর সম্পর্ক!
অর্থাৎ সমকামিতার সম্পর্ক! আমরা সবাই জানি যে, কিছুদিন আগে পর্যন্ত শুধু আমাদের দেশেই
নয়, বরং বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই তা ছিল নিতান্তই অবৈধ সম্পর্ক এবং আইনের বিচারে দন্ডনীয়
অপরাধ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আমরা পড়েছি, আমরা জানি, যখনই যে আয়তন অচল হয়ে যায়, তখন সেই
অচলায়তনকে ভেঙে ফেলতে হয়। এবং বলা বাহুল্য, বিশ্বের ইতিহাস সেই ভাঙনের যাবতীয় তথ্যকে
নিজের বুকে বেঁধে রেখেছে। সাধারণভাবে একটি কথা প্রচলিত আছে, যেখানে যত বাধা, সেখানে
তত প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ। আর এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকে কোনো বাধাই সামলাতে পারে না।
আর পারে না বলেই, বিশ্বে বিভিন্ন দেশে, সম্প্রতি আমাদের দেশেও সমকামিতা আর অবৈধ নয়।
দন্ডনীয় অপরাধ নয়। কিন্তু আইনের বিচার সমাজ মানতে বাধ্য হলেও তাকে সহজে স্বীকৃতি জানাতে
পারে কই? আর তাই এখনও আমাদের দেশে সমকামি সম্পর্কের কথা বা ঘটনা শুনতে পেলেই সাধারণ
মানুষের মনে একটা বিতৃষ্ণা জাগে, স্বাগত জানাতে দ্বিধা জাগে। আর সমকামি বিয়ে তো এখনও
পর্যন্ত আমাদের দেশের আইনে স্বীকৃত নয়, যদিও বিশ্বের অনেক দেশেই আইনত স্বীকৃত।
আর
এখানেই এসেছে রাজস্থানের ভরতপুরের ঘটনায় এক নতুন মোড়। যেহেতু সমকামি বিয়ের সম্পর্ক
এখনও বে-আইনী আমাদের দেশে, দন্ডনীয় অপরাধও বটে, তাই কল্পনার সঙ্গে প্রণয়সম্পর্ক অটুট
রাখার জন্য, বাধ্য হয়ে, মীরাকে তার লিঙ্গ পরিবর্তন
করতে হয়েছে, তাকে নারী থেকে পুরুষ হতে হয়েছে, মীরা নাম মুছে ফেলে তাকে আরভ কুন্তল নামে
পরিচিতি অর্জন করতে হয়েছে। আর তারপরেই কল্পনার সঙ্গে আরভের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষত
মীরার এই লিঙ্গ পরিবর্তনে কল্পনা অস্ত্রপচারের সময়ে আরভের সঙ্গেই ছিল বরাবর। এবং কল্পনা
একথাও সাংবাদিকদের জানিয়েছে, সে মীরাকে ভালোবেসেছে এবং বিয়ে করতে চেয়েছে। মীরা যদি
লিঙ্গ পরিবর্তন করে আরভ না হতো, তাহলেও সে মীরাকেই বিয়ে করত। এবং এখন মীরাই যেহেতু
আরভ, তাই সে আরভকে বিয়ে করেছে।
আমি
নিশ্চিত রাজস্থানের ভরতপুরের এই ঘটনার কথা ইতিমধ্যে অনেকেই জেনেছেন। কিন্তু তাঁরা কি
একথাটা কখনও ভেবে দেখেছেন, মীরা অথবা আরভ, একই ব্যক্তিমানুষ, সে ভালোবেসেছে কল্পনাকে।
যখন সে মীরা ছিল তখনও ভালোবেসেছে, আবার আরভ হয়েও ভালোবেসেছে। অন্যদিকে, কল্পনা, ভালোবেসেছে
সেই ব্যক্তিমানুষকে, যে একদা মীরা অর্থাৎ মহিলা ছিল এবং পরবর্তীতে আরভ অর্থাৎ পুরুষ
হয়েছে। সুতরাং ব্যক্তিমানুষ কিন্তু বদলায়নি, একই আছে, তাহলে কেন তাদের পারস্পরিক প্রণয়
সম্পর্কের মাঝে সমাজ এবং আইনের বিচারে বিপত্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে? আমার আরও প্রশ্ন
হচ্ছে, আমরা কি কোনো ব্যক্তি মানুষকে বিচার করব তার শারীরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কেন্দ্র
করে? সে পুরুষাঙ্গের অধিকারী, অথবা স্ত্রী-অঙ্গের অধিকারী, তার ওপর ভিত্তি করে? নাকি
আমরা কোনো ব্যক্তিমানুষকে বিচার করব তার শিক্ষা-সংস্কৃতি, চিন্তা-ভাবনা, মেধা ও বোধের
পর্যালোচনা করে? কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার মধ্যে সমাজ নাক গলায় কোন অধিকারে? কোনো
পুরুষ বা মহিলাকে তার ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য কেন বাধ্য করা হবে লিঙ্গ
পরিবর্তন করতে? আমরা কেন ভুলে যাই, প্রতিটি পুরুষ ও মহিলার বুনিয়াদি পরিচয়, সে মানুষ?
এবং শুধু পুরুষ বা মহিলাই নয়, সমাজে বিশেষিত প্রতিটি তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিও মূলত মানুষ!
আর প্রতিটি মানুষেরই থাকে একটা মস্তিষ্ক, এবং সেই মস্তিষ্ক ‘মন’ নামে একটি অনুভূতিকে
পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে। সেই মনের চাওয়া-পাওয়া যারা বোঝে না, বিদ্রুপ করে, অপরাধ
বলে মনে করে, প্রশ্ন জাগে, তাদের মানসিক বিকাশ কি আদৌ হয়েছে? নাকি তারা এখনও অপরিণত
অবস্থায় আছে?
অগ্রহায়ণের
শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই সবাইকে।
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা
:
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com
দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal
Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন