সমকালীন ছোটগল্প |
ক্যালাইডোস্কোপ
সম্ভাবনা শব্দের অর্থ অনেক পুড়তে পুড়তে অনুমিতা আজ কিছুটা বুঝতে পারে বলেই সে মনে করে। বোঝাগুলোও যে খুব সহজ পথে এসেছে তাও নয়। যেমন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝপথে যেদিন তার জুতোটা ছিঁড়ে গেলো, সেদিনের কথাই ধরা যাক। পাশ দিয়ে লাফাতে লাফাতে যাওয়া নতুন বাছুরটিকে দেখে আদর করতে না পারলেও, একবার ছুঁয়ে দেবার বাসনা মাথায় এমন চেপে বসেছিলো, নিজেকে আটকাতে পারেনি। ব্যাপারটা আর কি এমন, এই ভেবে বাছুরটার কাছাকাছি একটু জোরে এগিয়ে যেতেই সেটা তিড়িং কোরে লাফিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করলো, যে সম্ভাবনা অনুমিতার কল্পনাতেও ছিলো না। পেছনেই তার মা গরু হঠাৎ সন্তানের বিপদ আঁচ কোরে যে তেড়ে আসতে পারে, সে সম্ভাবনা থেকেও সহস্র যোজন দূরে অবস্থান করায় যেটা ঘটলো, দ্রুত ভয় পেয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে মাঝপথে অনলাইনে কেনা সখের জুতোটা ফিচিৎ কোরে ছিঁড়ে গেলো। সে কি কেলো! কাছাকাছি নেই কোন চর্মকার, টোটো-ফোটোরও কোন হদিস নেই। ছেঁড়াজুতো পায়ে রাস্তার পাশে অত্যন্ত স্মার্ট (নিজেকে এমনই ভাবে সে, তাই সমবয়সী বন্ধু তেমন গিঁট বাঁধে না), সতেজ, ছটফটে অনুমিতা বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভাবনাময় যে দুটি বিকল্প এক্ষেত্রে ভাবা যায়-- ১) জুতো দুটো হাতে তুলে নিয়ে বীরদর্পে এগিয়ে যাওয়া কোনো চর্মকার বা কবলার বা মুচির সন্ধানে কিম্বা ছেঁড়া জুতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জুতোর দোকানের অভিমুখে অভিযান ২) ছেঁড়া জুতো ছেঁচড়ে ছেঁচড়েই ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এগিয়ে যাওয়া সম্মুখবর্তী সমাধানের নিমিত্ত। এই হঠাৎ ও আকস্মিক ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের ন্যূনতম সম্ভাবনা আগে টের পেলে অবশ্যই 'প্রিকশনারি মেজার' শিরোনামে কিছু একটা করার কথা ভাবা যেত। এক্ষেত্রে অনুমিতা বরবাদ থেকে দূরবর্তী এক মেঘের সম্ভাবনায় আকুল হয়ে ওঠে। ব্যাপারটা এরকম হতে পারে, হঠাৎ কোনও বাইকবন্ধু আবির্ভূত হয়ে পেছনে তুলে টেনে নিয়ে যেতে পারে কিম্বা যদি কাকাবাবু কেউ হঠাৎ উদয় হয়ে বলে "ওহো, তুমি দাঁড়াও আমি দেখছি কী করা যায়" ইত্যাদী। বস্তুত এ অবস্থায় হাস্যকর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় উদযাপন নিরর্থক। কিছু একটা করতেই হবে। অনুমিতা যখন যাবতীয় সম্ভাবনা নিয়ে গুলিয়ে উঠছে, আকস্মিক এক প্রলয় এসে হাজির। ব্যাগে রাখা মোবাইল বেজে ওঠে। এক্ষেত্রেও একটি ইনফর্মেশন আগাম দিয়ে রাখি। বেশ কিছু অপছন্দের তালিকায় কানের দুপাশ দিয়ে তার ঝুলিয়ে অনর্থক নিজেকে ব্যস্ত দেখানোর চক্করটাকে অনুমিতা ঘেন্না করে। প্রথমত, লোকদেখানো গানপ্রেম তার নেই, সে এমন কিছু ভিআইপি-ও নয় যে মিনিটে মিনিটে তার ফোন আসবে আর ভ্যাজর ভ্যাজর করে বকে যেতে হবে। তার পরিচিত সমবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে সে এক ব্যতিক্রমী বিধর্মী। বরং সুযোগ পেলেই সে যা তা খিস্তিখেউড় করে এইসব ছেলেমেয়েগুলোকে।
যাই হোক, ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করতেই বুকের মধ্যে ছ্যাড়াব্যাড়া। তিড়িক তিড়িক করে কাঁপতে শুরু করেছে বুকের ঠিক মাঝখানটাতে। শ্বাস দ্রুত বেড়ে যায়। ফোনস্ক্রীনে নাম জ্বলছে টনি জনসন। এ শহরের নামকরা তরুণ স্যাক্সোফোন বাজিয়ে। শুধু এই শহর হবে কেন, শহর ছাড়িয়েও তার বাজনার কদর করছে সঙ্গীত জ্জগতের বহু গুণী মানুষ। বিপুল পয়সাবাবার ছেলে। এ শহরে ছড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটা বিভিন্ন মালের শোরুম। টনি জনসন। নামটা তাকে কেউ দেয়নি, সে নিজেই লটকে নিয়েছে। পরিবারের দেয়া নাম গোবর্ধন পাটোয়ারী। পাটোয়ারী পদবী। এমন নাম নিয়ে সুদের কারবারি হওয়া গেলেও স্যাক্সোফোন আর্টিস্ট, ভাবাই যায় না। বাধ্যত টনি জনসন। ওরফে গোবর্ধন পাটোয়ারী। তিনদিন আগে এই টনি তাকে "আই লভ উ" জানিয়েছে। মাঝরাস্তায় রাত্রি ৯.১৩ মিনিটে একা একা বাড়ি ফেরার পথে। আকস্মিক সামনে এসে যে বাইকটা থেমেছিলো, তার আরোহীকে দেখে অনুমিতা ভয় পায়নি বরং কিছুটা পুলকিত হয়েছিলো তার চোখ। টনির বাজনা শুনলে অনুমিতা কেমন এক মন্ত্রমুগ্ধ অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবতে থাকে। বাইক থেকে নেমে সরাসরি তার সামনে এসে দুপায়ে স্পষ্ট দাঁড়িয়ে ছেলেটা বলে দিলো বহুচর্চিত, ক্লিশে তথাপি বিকল্পহীন, অবধারিত, আরোগ্যময় তিনশব্দের এই বাক্যটি-- আই লভ উ। কথাটা বলে প্রায় তিন সেকেণ্ড একইভাবে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আবার বাইকে উঠে তার দিকে কিছুটা হাওয়া ছুঁড়ে নিমেষে ধাঁ হয়ে গেলো। সেই গোবর্ধন পাটোয়ারী ওরফে টনি জনসনের ফোন। আকস্মিক বিপর্যয়ের এমন এক সময় এমন দুর্বল করে দেয়া ফোন পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা না থাকলেও এসে যখন পৌঁছেছে কথা না বললেও ধরতেই হবে, শুনতে হবে শিল্পী মানুষটা কি বলতে চাইছে। এটা একটা সাধারণ সৌজন্য। ভেতরে যে মনপবনের নাওয়ে কুলকুল বাতাস বইছে, সেটা কাউকে না জানানোই ভালো। কুলকুল নয় একেবারে ঝোড়ো বাতাস। টিপে দিয়ে কানে তোলে থাবাফোন। টনি জনসন। বুকের শব্দ শুনে ফেলবে না তো ছেলেটা ! ওপক্ষের 'হাই', এপক্ষের 'হ্যাঁ, বলুন'। এরপর ৮৩ সেকেণ্ড মেয়েটি নিশ্চুপ, বোঝাই যায় ওপক্ষ একাই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গে গলছে। ওপক্ষের গলন থামলে এপক্ষ 'এই মুহূর্তে গরুর তাড়া খেয়ে, জুতো ছিঁড়ে, বাড়ির সামনের বড় রাস্তায় বিপন্ন দাঁড়িয়ে টোটোর জন্য প্রতীক্ষায় আছি, পরে কথা...' বোঝা গেলো লাইনটা কেটে দিয়েছে ওপক্ষ। মনে মনে অনুমিতা ভাবে বড়লোকদের এইসব জানোয়ার ছেলেগুলোকে এই জন্যেই সে পাত্তা দেয় না। নিজেদের মজা ছাড়া আর কিছুই এরা ফিল করতে চায় না। ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে, আবারও টোটোর অপেক্ষা। মিনিট তিনেকও হয়নি তারপর, হঠাৎই রাস্তা ফুঁড়ে এক বাইক এসে পাশে দাঁড়ায়। সেই টনিবাইক। 'এ্যাট ইওর সার্ভিস ম্য্যাম, বলুন কোথায় যেতে হবে'! 'না, মানে, আপনি!' 'পরে ভাববেন, এখন চেপে পড়ুন। ছেঁড়াজুতো কেস মানে কবলার। তাড়াতাড়ি করুন, চার্জ দেরি করলে বেড়ে যাবে।' অনুমিতা এই অভাবনীয়, অসম্ভাব্য সুযোগটিকে কথার জালে কিছুতেই হারাতে চায় না। নির্বিবাদ ছেঁড়াজুতো পায়ে টনির পশ্চাদে লটকে যায়। চেপে বসে পেছনে। বাইক হুশ কোরে তাকে উড়িয়ে নিয়ে এলো শহরের পরিচিত মুচিপট্টিতে। সম্পর্ক ছাড়া সেলাইফোঁড়াইয়ের সব কাজই যা দর্জির কাজ নয়, এখানে হয়ে যাবে। ছেঁড়া ব্যাগ, ছেঁড়া জুতো, ছেঁড়া বেল্ট, পট্টি, তাপ্পি হাতে গরম সাপ্লাই। এখানে যখন এসেই পড়া গেছে, নতুন জুতোর খরচা করতে যে যায় যাক, অনুমিতা কভি নেহি...! উত্তাল মন বলছে— উঁ…ঞ…ঞ বাবু, তোমাকে যে কি দেব, সাপ্টে চুমুও খাওয়া যাবে না। "হাই টনি, আমার যা উপকার করলেন আজ, কি দিয়ে যে কমপ্লিমেন্ট করব, বুঝতেই পারছিনা।" টনির প্রস্তুত উত্তর "ব্যাগে ন্যাপকিন আছে, স্যানিটারি!" এই অসম্ভাব্য কথাটি শুনে অনুমিতা প্রথমে ভাবে ভুল শুনেছে, টনি তার ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা বুঝতে পেরে, দ্রুত বলে "ওদিকের বস্তী এলাকার কাউন্সেলর আমাকে বলেছিলো ওখানকার বয়ঃসন্ধি মেয়েদের সুস্থ রাখতে গেলে, খুব দরকার এই ন্যাপকিনের। বেশি নয়, মাত্র ৫০ প্যাকেট মাসে দেয়ার একটা আবদার করেছিলো আমার কাছে। তবে টাকা দিলে সে নিতে পারবে না, বস্তুটাই তুলে দিতে হবে। আপনি আমাকে কিছু কমপ্লিন্ট করতে চাইছিলেন, তাই বললাম। না থাকলে অসুবিধে নেই, আপনিও মেয়ে তাই বললাম"। অনুমিতা টনির পরের বাক্যগুলো সম্যক অনুধাবন কোরে কিঞ্চিত ধাতস্থ হয়ে বললো, "না, আমার ব্যাগে প্রয়োজন না হলে ওসব থাকে না, তবে এবারের মত দু-এক প্যাকেট আমি স্পন্সর করতে পারি, কারণ নতুন জুতো কিনতে গেলেও তো কিছু খরচা হতো! আর দ্বিতীয়ত, আপনি কেন ভাবলেন আমি ব্যাগে স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে পথে বেরোই, আমাকে কি লাইনের মেয়ে ভেবেছে্ ডাকলেই গিয়ে শুয়ে পড়ব!" "এবার বুঝলেন তো, আগুনে নিজের হাত না পুড়লে কেউ পোড়ার কষ্টটা সঠিক বুঝতে পারে না। বন্ধুত্বের খাতিরে আপনার বিপন্নতা ফিল কোরে জাস্ট একটা কবলারের কাছে পৌঁছে দিয়েছি বলে, আপনি যেভাবে কমপ্লিন্ট দেবার জন্য আকাশ পাথার ভাবতে শুরু করলেন, আমারো মনে হলো আপনাকে প্রকৃতই আকাশ থেকে পড়বার একটা সুযোগ দেয়া দরকার। আরও একটা কথা বলি, লাইনের মেয়ে সবাই হতে পারে না, তার প্রস্তুতিটাই আলাদা!" বাইকের প্যাটেলে টনি স্টার্ট দেবার জন্য পা তুলতেই অনুমিতা বাজার হাট যাবতীয় বাস্তবতা উবু কোরে দিয়ে হঠাৎ টনির মাথাটা জড়িয়ে ধরে তার গালে তীব্র এক চুমু খেয়ে বসে। এবার টনি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা। মাথাটা ছাড়িয়ে হা কোরে তাকিয়ে থাকে অনুমিতার দিকে। এই অসম্ভব ব্যাপারটা চারিদিকে বাজারের মধ্যে দাঁড়িয়ে মেয়েটা কোরে ফেলতে পারলো! অনুমিতা পুনরায় হুঁশে ফিরতেই সেখানে আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে সোজা মুচির কাছ থেকে জুতোটা নিয়ে, তার পয়সা মিটিয়ে হেঁটে যেতে থাকলো বাসরাস্তার দিকে। অনেক দেরী হয়ে গেলো আজ। প্রথম দিকের দুটো ক্লাস মিস হয়ে গেলো। আর টনি জনসন, তার কি হলো! পাঠক, এ এক সম্ভাবনার গল্প, সুতরাং আপনিও এ গল্পের একজন স্বাধীন সৃজক হয়ে ওঠবার অধিকারী। বাকি যে সম্ভাব্য পরিণতি সে কাজটা চলুক আপনার মনের নিভৃত পরিকল্পনায়...
চমৎকার। তারুণ্যময় সময়কে লিখলেন
উত্তরমুছুনতার কাঁটাসহ।
ধন্যবাদ পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য।
মুছুনতুমি বাপু ইস্মার্ট আছ। দু'বার চমকে দিলে। ১) টনির ন্যাপকিন ২) চুমু। ভালো।
উত্তরমুছুনসুন্দর ।
মুছুনদারুণ লাগল। Who cares for পরিণতি, বেশিরভাগ সময়ই একঘেয়ে হয়ে থাকে। সম্ভাবনার ব্যবহার অতুলনীয়।
মুছুন