কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

নীতা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


স্টোরি

আরে! আজও রেলওয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে গান! একটু ভিড়ও দেখতে পাচ্ছি! আবার  সেই রাণু মন্ডল কেস না কি! দেখতে হচ্ছে! ভিড়ের ফাঁক গলে সামনে  আসবার চেষ্টা করি। না, একজন নয়। দুজন বয়স্ক মহিলা-পুরুষ গান গাইছেন একসাথে। আরে! এ তো সেই আই.পি.টি.এ.’র গান। চেহারায় সম্ভ্রান্ত দুই বয়স্ক মহিলা-পুরুষ, গেয়ে চলেছেন সেই জাগরণের গান। আশপাশের মানুষজন গান শুনে বেশ মুগ্ধ দেখছি! গান থামলে তাঁদের কাছে সটান চলে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, এত সুন্দর গান গাইছেন আপনারা, কিন্তু এভাবে এখানে বসে কেন?

গান গাইবার কি কোন স্পেশাল জায়গা লাগে? গানগুলো ভালো লেগেছে আপনার! তবে আর একটা গান করি? গান গাইতে কি সবসময়ে মঞ্চ লাগে! মাটির মানুষের গান মাটিতে বসেই গাইতে হয়।

সে তো করতেই পারেন, কিন্তু এইখানে বসে?

আপনি কি পুলিশের লোক? এখান থেকে উঠে যাবার কথা বলছেন?

আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না প্লিজ আঙ্কল! আমি তো আপনার ছেলের মতো! বলছি এই খোলা জায়গায় বসে…

হ্যাঁ। চারদিক খোলা। শ্বাস নেওয়া যায়। কিন্তু মাথার ওপরটা তো ঢাকা!

মহিলাটি এবার বললেন, আসলে আমরা ঠিক করেছি একটা গানের ক্লাস খুলবো বাবা। তা সবাই জানবে শুনবে তবে তো আমাদের ক্লাসে ভর্তি করবে ছেলে মেয়েদের! তাই এখানে বসে আর কি…

বাঃ! দুর্দান্ত আইডিয়া! এত সুন্দর গাইছেন আপনারা! আমারই তো ইচ্ছে করছে আপনাদের ছাত্র হয়ে যাই।

ভালো গাইছি বলছো! তা বাবা, আমাদের তরুণ বয়েসে গুরু সলিল চৌধুরীর সাথে এক মঞ্চে গেয়েছি। কত গ্রামে গঞ্জে ঘুরেছি জাগরণের গান গাইতে গাইতে। উনি  চলে যাবার পরে আমরা তাঁর  ছাত্র ছাত্রীরা… তখন আমাদের…

তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করি, আপনাদের বাড়ি কোথায় আঙ্কল?

বাড়ি টাড়ি নেই আমাদের। কেন, সবারই কি নিজের বাড়ি থাকে?

সে কি? কোথায় থাকেন আপনারা?

এখন এখানেই আছি।

ও কাছাকাছি থাকেন বুঝি? আমিও তো এখানেই থাকি। ভালোই হবে, কাছাকাছি গানের ক্লাস  থাকলে আমিও জয়েন করতে পারবো আঙ্কল আপনাদের ক্লাসে। ইনি নিশ্চই…

হ্যাঁ, ইনি আমার স্ত্রী। লাইফ পার্টনার বলতে পারো।

এখানে কোথায় থাকেন বললেন না তো আঙ্কল?

না না আমরা এখানে থাকি না! তুমি কি করো বাবা? কলেজ স্টুডেন্ট?

না আঙ্কল, আমি স্টুডেন্ট না, পুলিশেও না। আমি সাংবাদিক।  

সাংবাদিক শুনে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো ওঁদের দুজনে মুখ। জিজ্ঞেস করলেন, কোন কাগজের?

কেন ওঁরা ওঁদের থাকার জায়গাটা বার বার এড়িয়ে যাচ্ছেন? নিশ্চই, সামথিং বিহাইন্ড ইট! মনে হচ্ছে স্টোরি পাবো একটু ঘাঁটলে! 

বললাম চলুন আমাদের কাছে চ্যানেলের গাড়ি আছে, চলুন আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি। যেতে যেতে আপনাদের ইনটারভিউ নেবো।

আমার কথা শুনে চমকে উঠেলেন ওঁরা দুজন। আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললেন, না বাবা। আমরা কোনো সেলিব্রিটি নই। সাক্ষাৎকার-টার দিতে পারি না। কোথাও  যাবো না আমরা বাবা! আমাকে আঙ্কল বলে ডেকেছো বাবা, আঙ্কেলের একটা কথা রাখো প্লিজ! আমাদের কথা কোনো কাগজে বা চ্যানেলে দিও না।

কেন বলুন তো! তাতে তো আপনাদের অনেক ভালো প্রচার হবে! কত ছাত্র-ছাত্রী  হবে আপনাদের মিউজিক স্কুলে!

না না, আমরা বেশি ছাত্র-ছাত্রী চাই না বাবা!

সে কি? বেশি স্টুডেন্ট, বড় স্কুল! প্রচুর নাম! তবেই না পরিশ্রম সার্থক!

এই বয়েসে আমরা কি এত বড় কাজ সামলাতে পারবো! এই আমাদের দুজনের চলে গেলেই…

বলেই থমকে গেলেন বৃদ্ধ। কিছু কি চাপতে চাইছেন ওঁরা!

মানে! আচ্ছা বেশ। যেতে যেতে শুনবো, কেমন? এখন চলুন, সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আপনাদের পৌঁছে দিয়ে… মানে কোন দিকে যেতে বলবো ড্রাইভারকে?   

আরে কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের! বলছি না আমাদের যাবার… মানে… আমরা এখান থেকে অনেক দূরে, সেই যাদবপুরের…

যাদবপুর? তো সেখান থেকে এতদূরে এসে আপনারা স্টেশন প্ল্যাটফর্মে এসে…!

শোনো বাবা, যাদবপুর বা কাছাকাছি কোথাও আমরা বসে গান গাইলে, পাড়ার চেনা লোকেরা জানতে পেরে যাবে যে!

তো কি? আপনারা তো গান গাইছেন! কোনো অসামাজিক কাজ তো করছেন না! জানতে পারলে কি হবে!

ওঃ! তুমি বুঝতে পারছো না কেন বাবা, ওদের কাছ থেকে আমার ছেলে শুনতে পেলে সেটা কি ভালো হবে! কী ভাববে ছেলেটা বলো তো? কী উত্তর দেবে ওদের  ছেলেটা, বল তো? আমার ছেলেটা কত অপদস্থ হবে পাড়ার লোকের কাছে। মা বাবা হয়ে আমরা কি ছেলেকে এরকম হেয় হতে দিতে পারি! বলো? কেউ কি নিজের সন্তানকে…! তুমি ছেড়ে দাও আমাদের! আমরা এখান থেকে অন্য কোথাও আরো  দূরে চলে যাচ্ছি… কোনো একটা স্টেশনের খোলা প্ল্যাটফর্ম তো পাবোই…

বাকি কথাগুলো আর স্পষ্ট শুনতে পেলাম না।           

 

                    


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন