কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

হৈমন্তী রায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


বলছি মহাশ্বেতা

 

(১)

বয়স হয়েছে মহাশ্বেতার। অভিজ্ঞতায় চুল পেকেছে, দুই সন্তানের জননী হওয়ার সুবাদে তলপেটে বেশ চর্বি। যাইহোক, আকর্ষণীয় সে এখন আর নয়। পঞ্চান্ন হলো, তবু সংসার সামলে শাড়ির ব্যবসাটা ভালোই চালায় সে। লকডাউনের জ্বালায় তাতে বেশ ভাঁটা পড়তে রুমকি বলে বসল,
-মা, অনলাইনে চেষ্টা করো না? সবাই করছে।
ব্যাস আর কি, মা মেয়ের যুগলবন্দীতে শুরু হলো শেখা আর শেখানোর পালা। মহাশ্বেতা বুদ্ধিমতি, তাই কিছুদিনেরই সোশ্যাল মিডিয়ায় রপ্ত হতে শুরু করল। বেশ লাগছে, শাড়ির ছবি আপলোড করতে করতেই একদিন নিজের একটা ছবি পোস্ট করেই ফেলল মহাশ্বেতা। এলো চুলে সাদা গন্ধরাজ, অফ হোয়াইট শাড়ি আর ডার্ক লিপস্টিক। কপাল জোড়া লাল টিপ। কী অপূর্ব, কী স্বর্গীয় সেই রূপ!

-বৌদি, দুধ যে পুড়ছে গো, ও বৌদি?
সরমার কথায় সম্বিত ফিরে পায় মহাশ্বেতা।
 
-আরে তাই তো!
 
তাড়াহুড়োতে হাতের আঙুলে ছ্যাঁকা লাগে! কেন জানি না, সেই যন্ত্রণার উপশমের বিন্দুমাত্র চেষ্টাও সে করে না। নাহ, আঙুলেরও তো শাস্তি পাওয়া উচিত। কীভাবে…! চোখে জল ভরে আসে। গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে রয়েছে।
-বৌদি, তোমার কিছু হয়েছে? এমন চুপচাপ তো তোমায় দেখি না। আজ গান শুনছ না? রান্না করতে করতে কেমন গান শোনো, কী ভালো লাগে। কী হয়েছেতুমি কাঁদছ?
কোনও উত্তর দেয় না সে। যেন কথাগুলো কানে পৌঁছয়নি। চুপচাপ রান্নার কাজ করতে থাকে মহাশ্বেতা। সরমা একটু ভয় পেয়ে যায়। নাহ, এই বৌদিকে সে চেনে না। অমন হাসিখুশি মানুষটার আজ কী হয়েছে কে জানে। থাক, আর ঘাঁটিয়ে কাজ নেই। কাচা জামাকাপড়ের বালতি নিয়ে সরমা ছাদে যায়।

ফাঁকা ড্রয়িংরুমে সে এখন একা। কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে। ছি ছি, সবাই কী ভাবল! একটা ছবি পোস্ট করার যে এমন পরিণাম হতে পারে তা কি সে জানত! কাল রাতে পোস্ট করেই তো ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোরবেলা উঠতে হয়, তাই রাত জাগতে পারে না সে। ঘুম থেকে উঠেই সংসারের হাজার কাজ। অনলাইন হওয়ার সময় তো বেলায়, কাজ সেরে, রোজই তাই হয়। আজ তা হলো না। 

-আমাকে না জানিয়ে এমন ছবি পোস্ট করার কি কোনও দরকার ছিল?
রুমকি বেশ বিরক্ত, কিন্তু কেন? কি করেছে সে? মহাশ্বেতা কিছুই বুঝতে পারে না।
তারপর সে নিজে যখন কমেন্ট দেখতে থাকে লজ্জায়, রাগে শিউরে ওঠে! এত  লাইক, এত কমেন্ট? কিসব লেখে এরা! ঈশ্বরকি করি? ছি ছিতাড়াতাড়ি ছবিটা ডিলিট করে দেয় সে।
 
-রুমকি, আমি ডিলিট করে দিয়েছি। রাগ করিস না মা। বুঝতে পারিনি।
মেয়ে আর কথা বলে না। এখন বুঝতে পারে বাজার থেকে ফিরে মানুষটা আজ এত গম্ভীর কেন! সেও কি ওইসব ছাইপাঁশ কমেন্ট পড়েছে নাকি? ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে তার!

(২)

আর একবার মেসেজটায় চোখ বোলায় মহাশ্বেতা। কে এ? কেন লিখল এমন? কী উদ্দেশ্য?
সন্ধের দিকে হোয়াটসঅ্যাপ এ মেসেজটা পড়ে ঘাবড়েই গিয়েছিল প্রথমে। নম্বর সব জায়গাতেই শেয়ার করা, এখানেই সবাই শাড়ির অর্ডার করে থাকে। রূপসা বুটিক, এটাই তার নম্বর। আর একবার চোখ বোলায় সে।
-ছবিটা কেন ডিলিট করলেন?
কে? কে এমন লিখল? কাউকে বলবে ব্যাপারটা? ছবি নিয়ে সারাদিন যা হলো, বাড়ির কাউকে আর জানাতে সাহস হচ্ছে না তার। আবার যদি অশান্তি হয়! কী দরকার! কিছুক্ষণ পর আবার
 
-উত্তর দিলেন না যে! কেন ডিলিট করলেন ছবিটা?
এবার একটু রাগ হলো তার। সাহস তো কম নয়। কে না কে, চেনা নেই জানা নেই, তাকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে নাকি?
রাগের চোটেই টাইপ হয়ে গেল
-কে ভাই? শাড়ির বিষয়ে কথা থাকলে তবেই মেসেজ করবেন। ফালতু মেসেজ করার জায়গা এটা নয়। এটা একটা বুটিকের নম্বর।
নিজের অজান্তেই এমন অনেক মেসেজের আদান প্রদান হলো। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে নম্বরটা ব্লক করল সে।
এমন অদ্ভুত জীব সে আগে দেখেনি। একই প্রশ্ন করেই চলেছে। ছবিটা নাকি তার চাই। মামারবাড়ির আবদার আর কি!
রাতে একাই ঘুমোয় সে। রূপ বহুদিন একসঙ্গে ঘুমোয় না। মেয়ে একটু বড় হতেই মহাশ্বেতা মেয়ের সঙ্গে ঘুমোতো। তারপর রুমকির নিজের ঘর হলো, সেখানে সে ব্রাত্য, কী যেন বলে ওরা, হ্যাঁ প্রিভেসি। সবারই প্রিভেসি আছে, রূপের, রুমকির। তারই কিছু নেই। একদিন মাঝরাতে শরীরের তাড়নায় রূপ এসে দরজা বন্ধ দেখে অভিমান করেছিল। সেই থেকে সে দরজাটা লক করে না। যদিও বহুদিন রূপের আর মাঝরাতে উঠে আসার প্রয়োজন হয়নি। তবু, সে খোলাই রাখে। বাপ, মেয়ে চাইলেই তার ঘরে আসতে পারে। সে নয়! তার যেতে পারমিশন লাগে। ওই যে প্রিভেসি। বিছানায় আজ তার ঘুম এলো না। সেই তখনও আসত না যখন সে মাত্র সাত মাসে কোল খালি করে চলে গিয়েছিল। তাদের প্রথম সন্তান, সেও তো ছিল রুমকি!
 
আর একবার ব্লকড নম্বরটায় যায় সে। মেসেজগুলোয় চোখ বোলায়।
 
মাথার মধ্যে কটা শব্দকেন ডিলিট করলেন ছবিটা?

(৩)

-সারাদিন গাছে চড়া, ছুটোছুটি। পুকুরের জল থেকে তোলে কার সাধ্যিউফ, এই মেয়ে পার করার সময় দেখব! কোন ছেলের বাড়ি এমন গেছো মেয়ে বউ করবে, শুনি? আবার, আবার তুমি হাসছ? আজব বাবা তুমি। যা খুশি করো, তুমি আর তোমার আহ্লাদি।
মা এমনই রাগ করত। আর বাবা, দেওয়ালের ছবিটার দিকে চোখ যায় মহাশ্বেতার। এখনও ছবিতে সেই হাসিমাখা মুখ!
 
-বাবা, তুমিও চলে গিয়েছিলে তোমার আদরের মহাশ্বেতাকে ফেলে। কিসের যে এত তাড়া ছিল তোমার!
 
চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আবার। বাবার কথা মনে পড়লে আজও তার কান্না পায়।
কতই বা বয়স ছিল, তখন মাত্র তেরো, বাবাকে সে হারিয়েছিল। মা তারপর থেকে বড় শান্ত হয়ে গিয়েছিল, আর সেও। নাহ, তাকে পার করতে মাকে কোনও বেগ পেতে হয়নি। সম্বন্ধ বাড়ি বয়ে এসেছিল। সম্বন্ধ বলে সম্বন্ধ, নামকরা উকিল, বনেদি বংশ, রূপের পিসি এসেছিলেন বাড়ি বিয়ের কথা বলতে। এক বিয়েবাড়িতে তাকে দেখেই নাকি রূপঙ্কর জেদ ধরে, এই মেয়েকেই বিয়ে করবে। আর কি, বারো ক্লাসের রেজাল্ট বের হওয়ার আগেই বত্রিশ বছরের অচেনা মানুষটা তার স্বামী হয়ে গেল! কেউ কি জানতে চেয়েছিল আঠারোর মহাশ্বেতা কী চায়? আজ কেন জানি না তার সব পুরনো কথা মনে পড়ছে। যে রূপ দেখে রূপঙ্করের মন মজেছিল আজ সেই রূপ নিয়েই কত কথা শুনতে হলো তাকে! অবশ্য আগেও কথা সে অনেক শুনেছে। বিয়ের পর জানতে পারে শাশুড়ির তাকে কতটা অপছন্দ। শুধু ছেলের জেদের কাছে তিনি নাকি হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার পড়াশোনা যারা বন্ধ করল সেই তারাই আবার তার অল্প বিদ্যে নিয়ে হাসাহাসি করত। আরও কত কারণেও তো তাদের হাসির খোরাক হয়েছে সে। খেলো গয়না, কম নমস্কারি, হাল্কা বাসন, খাট নেই আলমারী নেই এমন কত কত অভিযোগ মিশে থাকত ওই হাসিতে!
 
একটা মেসেজ ঢুকল, নতুন নম্বর। এত রাতে কে আবার!
 

-আমাকে ব্লক করে দিলেন। বন্ধুর ফোন থেকে মেসেজ করতে বাধ্য হলাম। প্লিজ, রাগ করবেন না। জানি বিরক্ত করছি। ছবিটা একবার পাঠাবেন। শুধু একবার দেখব। কথা দিচ্ছি, তারপর ডিলিট করে দেব। চাইলে আপনিও করে দিতে পারেন। না বলবেন না প্লিজ! শুধু একবার
পুরো মেসেজ পড়ার আগেই ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়! কে এ? কী নাম? কী চায়?
নাহ, ভয় পেলে চলবে না। তাকে আজ জানতেই হবে। নম্বরটা আনব্লক করল মহাশ্বেতা।
 
-ধন্যবাদ
-কে আপনি?
-আমি কে, কী বলি বলুন তো। ফেসবুকে কালই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। নাম আকাশ, আকাশ ব্যানার্জি। একটু প্রোফাইল দেখে নিলেই আমাকে অনেকটা জানা হয়ে যাবে। আর একটা কথা, অপেক্ষা করছিছবিটা?

মহাশ্বেতা চটপট প্রোফাইলে চোখ বুলোয়। এ তো বাচ্চা ছেলে! একটু হাসি পায় তার। পাগল নাকি? যাক, ভয় আসতে আসতে কাটছে এবার। বাহ, বেশ ছবি তোলে তো! শিল্পী মানুষ!
-ছবি তো দেবো না। ডিলিট করেছি যখন নিশ্চয়ই তার কোনও কারণ আছে।
-পোস্ট করেছিলেন কেন? নিশ্চয়ই তারও কারণ ছিল। আমি ছবি তুলি, প্রোফাইলে দেখেছেন হয়তো। ওটাই পেশা, আবার নেশাও বলতে পারেন। ছবিটায় এমন একটা কিছু আছেঠিক বোঝাতে পারছি না হয়তো, সত্যি বলি? ছবিটা ভুলতে পারছি না, কিছুতেই পারছি না।
-বুঝলাম।
মনে মনে মহাশ্বেতা না হেসে পারে না।
-ভয় পাবেন না। আমি ক্ষতিকারক নই।
দুটো অচেনা মানুষের এমন অনেক মেসেজের আদান প্রদান হলো। কখন যে মাঝরাত হয়ে গেল, কখন যে সারাদিনের সব খারাপ লাগা ভুলে সে হেসে পাগল হলো সে নিজেও জানে না। যেমন গুমট আকাশ এক পশলা বৃষ্টির পর, মহাশ্বেতার চোখে মুখে যেন সেই রোদের আলো!
 

(৪)

-মা, এখনও ঘুমোচ্ছো? শরীর ঠিক তো?
রুমকির ডাকে ঘুম ভাঙে তার। এত বেলা হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ছোটে সে। যাওয়ার আগে একবার আয়নায় চোখ পড়ে। নিজের অবয়ব সেখানে। আলুথালু চুল, অবিন্যস্ত শাড়িতেও তাকে আজ কী অপরূপ লাগছে! নিজেই যেন একটু লজ্জা পায় সে! রান্না করতে করতে এবার সে আপলোড করে নিজের সেই ছবি, যে ছবি অন্যের ভয়ে ডিলিট করেছিল!
সঙ্গে সঙ্গে মেসেজ ঢোকে
-ধন্যবাদ দেবী!
মহাশ্বেতার ঠোঁট ছুঁয়ে যায় এক অদ্ভুত সুন্দর হাসি!

খাবারটেবিলে সবাই চুপ। শুধু চুড়ির হাল্কা আওয়াজ, কাঁটা চামচের টুংটাং শব্দ! রুমকি খানিকটা খেয়েই উঠে পড়ার উপক্রম করতে মহাশ্বেতা বলে,
-খাবারটা নষ্ট কোরো না!
 
-তুমি কেন
-কৈফিয়ৎ আমি দেব না রুমকি। আমার কোনও কাজের জন্য তোমাকে কৈফিয়ৎ দেব না। তোমার স্বাধীন জীবনকে যদি সম্মান করতে শিখে থাকো, আমার স্বাধীনতার মূল্য দেবে, একুটুই আশা করব।
রুমকি চুপচাপ খেতে শুরু করে। রূপ আজ কিছুটা সতর্ক, শব্দের ব্যবহারে সংযত। তার শ্বেতা, শান্ত, চুপচাপ, বাধ্য সেই শ্বেতা, কেমন যেন বদলে গেছে। একটা রাতেকী এমন হলো?
 
-তোমার ওষুধ। কাল চেকআপে যাওয়া, সকাল সাতটায় বেরোতে হবে।
মহাশ্বেতার কথায় রূপ সম্মতির হাল্কা মাথা নাড়ে।

কত কথাই মনে পড়ছে! প্রথম শ্বেতাকে সে দেখেছিল পিসতুতো বোনের বিয়েতে। মানুষ এত সুন্দরও হয়! ঠিক যেন একটা পুতুল! কিংবা পটে আঁকা কোনও ছবি! দেখেই বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গিয়েছিল আপাত গম্ভীর, মেজাজি ডাকসাইটে উকিল রূপঙ্করের। কত সম্বন্ধ সে হেলায় নাকচ করেছে। আর সেই কিনা একটা বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পড়ল! বাচ্চাই তো, সবে আঠারো, দেখে আরও ছোট মনে হয়, যেন সদ্য কিশোরী। বয়সের এই বিস্তর ফারাক থাকলেও ওই মেয়ে ছাড়া অন্য কাউকে সে আর ভাবতেই পারছে না। নামটিও বড় সুন্দর, মহাশ্বেতা! গোটা বিয়েবাড়িতে সেই সবথেকে উজ্জ্বল, তাকে অবহেলা করে এমন পুরুষ জন্মেছে? রূপের অল্প হাসি পায়! অবশেষে বাড়ির কিছুটা অমতেই শ্বেতাকে ঘরে আনে। বউ হয়ে ওই তো এসেছিল, ওর সবটুকু উজাড় করে রূপকে দিয়েছিল, রূপ কি তাকে ততটাই দিতে পেরেছিল? রূপ কি কোথাও পাওয়ার দম্ভে তার শ্বেতাকেই অবহেলা করতে শুরু করেনি?
 
অথচ সে তো সব কাজই করতো নিপুণ হাতে, কোনও ভুল নেই, অবহেলা  নেই! করতো কেন, আজও কি করছে না? তবু আজ কেন মনে হচ্ছে রূপ ওর কাছে পৌঁছোতে পারছে না!
-কিছু বলবে?
সামনে মহাশ্বেতা দাঁড়িয়ে। আজও সে রূপকে পড়তে পারে।
 
-একটু বসো না, কাল ফেরার পথে সেই রেস্তোরাঁটায় যাবে?
-নাহ। সময় হবে না। ফিরে অনেক কাজ। রুমকির এখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম। মেয়েটা সারাদিন ল্যাপটপে মুখ গুঁজে থাকে। আমি না ফিরলে হয়তো খাওয়াই হবে না ওর।
-শ্বেতা, তুমি কি কালকের জন্য রাগ করেছ?
-নাহ।
-আমার ওভাবে বলা উচিৎ হয়নি।
-আমি একটু বেরোবো। তুমি কি চা খাবে?
-নাহ। এসো।
মহাশ্বেতা চলে গেল। রূপ আজ অনেক বছর পর ওর মহাশ্বেতাকে দূর থেকে দেখছে। আজও ও কী উজ্জ্বল! কোনও পুরুষ ওকে অবহেলা করতে পারে কি? রূপের আজ হাসি পায় না। বুকের বাঁ দিকটা যেন হাল্কা মোচড় দেয়!

(৫)

সন্ধ্যে সাতটা। রূপ রোজের মতই এখন চেম্বারে ব্যস্ত, রুমকি ফোনে ক্লায়েন্ট মিটিংএ, মহাশ্বেতার ঘর থেকে ভেসে আসছে ইয়াদ পিয়া কি আয়েবড়ে গুলাম আলি খানের ঠুমরী! গান শুনতে শুনতে সে যেন এক অন্য জগতে চলে যায়! সরমা বৌদিকে এসময়টা আর জ্বালায় না। কাজ হয়ে গেলে চুপচাপ চলে যায়। প্রথম যখন কাজে এসেছিল, এমন সময়ই একদিন সে ঘরে ঢুকেছিল বৌদিকে বলতে, কাজ হয়ে গেছে, সে এবার বাড়ি যাবে। হঠাৎ দরজাটা হাল্কা খুলতেই সে থমকে গিয়েছিল! একঢাল খোলা চুল পিঠের ওপর, জানলায় আনমনে বৌদি, গান বাজছেহ্যাঁ এই গানটাই তো, বৌদি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়নি। সুর আর বৌদি মিলেমিশে কেমন যেন এক হয়ে গেছে! আলতো করে দরজাটা বন্ধ করে সে চলে এসেছিল। 
হঠাৎ রুমকির ঘর থেকে জোরে একটা আওয়াজ!
 
-কী পড়ল?
মহাশ্বেতা ধড়ফড় করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে। চোখে মুখে একটা ভয়!
 
রূপও চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে, মহাশ্বেতাকে ধরে ফেলে।
-কিচ্ছু হয়নি শ্বেতা। হয়ত কিছু পড়ে গেছে।
 
রুমকিও ঘর থেকে ছুটে মায়ের হাতটা ধরে।
-কিচ্ছু হয়নি মা। এই দেখ, আমি তো, এই তো আমি। জলের জাগটা কেমন  করে জানি না টেবিল থেকে পড়ে গেল। কী হয়েছে মা? বসো, একটু বসো তো!
-সরমা, সরমা, তাড়াতাড়ি জল আনো তো।
 
রূপঙ্করের ডাকে সরমা তাড়াতাড়ি জল নিয়ে আসে। মহাশ্বেতার চোখে মুখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক! সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে!

-কী হলো? কী পড়ল?
মহাশ্বেতা যেন কী একটা পড়ার শব্দ পায়।
-বৌমা শিগগির এসো। সর্বনাশ হয়ে গেল গো!
 
শাশুড়ির চিৎকারে রান্নাঘর থেকে ছুটে ঘরে ঢোকে মহাশ্বেতা। তারপর তার আর পা সরে না!
 
-রুমকি
 
মাটিতে তখন সাত মাসের ফুটফুটে শিশুর মাথা থেকে সাদা মার্বেলের মেঝে ক্রমশঃ লাল!
-এত রক্ত কেন?
রুমকির ছোট্ট শরীরটার পাশে বসে পড়ে মহাশ্বেতা। বুকের মধ্যে চেপে ধরে তার সর্বস্ব, তার সন্তান, তার মৃণ্ময়ীকে।
-কেউ তো কিছু করো! ডাক্তার, ডাক্তার ডাকো, কিছু তো একটা
অসহায় মহাশ্বেতার বুকফাটা কান্না সেদিন গাঙ্গুলী ভবনের প্রতিটা দেওয়ালকে যেন নাড়িয়ে দিচ্ছিল!
 
নাহ, কেউ কিছুই করতে পারেনি। নার্সিংহোমে পৌঁছেছিল ছোট্ট রুমকীর ঠান্ডা শরীরটা।
-রূপ, বাবা, আমি বুঝতে পারিনি।
 
অপরাধীর মত দাঁড়িয়েছিলেন দাম্ভিক গাঙ্গুলী গিন্নী। যে নাতনিকে ভালোবেসে বুকে টানতে পারেননি শুধু সে মেয়ে হওয়ার অপরাধে, সেই নাতনিকে নিজের ভুলে হারিয়ে আজ তিনি যেন নিঃস্ব, সর্বহারা!
নাহ, রূপ মাকে ক্ষমা করতে পারেনি। সবটা শুনে সে কীভাবে পারত ক্ষমা করতে? মেয়েকে বুকে নিয়ে শ্বেতা তো ঘরেই ছিল। মা কেন তাকে রান্নাঘরে পাঠিয়েছিল? ঘুমন্ত বাচ্চাকে ঘরে একা রেখে মা কি করে বাইরের বারান্দায় বসে  কাজের লোকেদের সঙ্গে বউমার নিন্দে করতে ব্যস্ত ছিল? ঘুম থেকে উঠে কাউকে না দেখতে পেয়ে মেয়েটা
উফ রূপ ভাবতে পারে না। সাবেক আমলের পালঙ্ক, অত উঁচু থেকে পড়ে মাথাটা গিয়ে লাগল সামনের দেরাজে। তারপর সব শেষ!


(৬)

আজ আকাশের মনের মধ্যে কিছু একটা চলছে। এক অদ্ভুত অস্থিরতা, যা সে আগে অনুভব করেনি কখনও।
একটা ফোন, আর সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে! সত্যিই কি সে আসবে? বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু ফোনটা তো ওদিক থেকেই এসেছিল!
পরশু, হ্যাঁ পরশুই তো ঠিক হলো, মহাশ্বেতাকে পরশু সে দেখবে সামনে থেকে। যেদিন প্রথম ছবিটায় হঠাৎ চোখ যায় সে যেন একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। পরে ভালো করে দেখবে বলে ছবিটা যে সে সেভ করবে সে সুযোগই হয়নি। হঠাৎই সেটা চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল। পোস্ট ডিলিটেড!
এটা কী হলো? হঠাৎ ডিলিট করল কেন? কীভাবে ছবিটা আবার দেখবে সে? সারাদিন কী ভীষণ অস্বস্তিতে যে কেটেছিল, সেই জানে। শেষে সন্ধ্যের দিকে একটা মেসেজ না করে পারেনি। কে জানত একটা ছবি তাকে এতটা মরিয়া করে তুলবে!
নাহ, মানুষটা খারাপ নয়, বরং একটু বেশিই ভালো। একটা আড়াল রয়েছেভিতরে পৌঁছোনো যায় না। যেটুকু কথা হয়েছে, কথা বলতে ওই রাতের দিকে কিছু চ্যাট, তাতে মহাশ্বেতার প্রতি কৌতুহল জন্মায়নি এমনটা নয়। তবে যেটা দিন দিন তীব্র হচ্ছিল তা হলো তাকে সামনে থেকে দেখা! পঞ্চান্ন, হ্যাঁ তাই তো বলেছিল, তারপর বছর খানেক কেটেছে, কিন্তু ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই। বয়সের ভার ওই চোখ, ওই হাসিতে সে খুঁজে পায় না। রহস্যময়ী! আকাশ হেসে ফেলে! কত মেয়ের ছবি তুলেছে সে। কত মেয়ের সঙ্গে মিশেছে। কাউকে নিয়েই সে কখনও সিরিয়াস নয়। নিজের কাজের বাইরে কিছুই ভাবতে পারে না সে। একটু স্বার্থপরই বটে।
 
তবু, মহাশ্বেতার মত মানুষদের বোধহয় উপেক্ষা করা যায় না, অবশ্য উপেক্ষার ভান করাই যায়, যেমনটা সেও করে। বেশি কথা বলে না। অনেকদিন পর এক আধটা মেসেজ, ব্যাস। কিন্তু নিজেকে কি ঠকানো যায়! একটা দিনও কি কেটেছে যেদিন সে মহাশ্বেতাকে মনে করেনি। ও যখন ছবি পোস্ট করে তার মতো আর কেউ কি দেখে ওই ছবি! কেউ কি কল্পনায় তার মতো করে মহাশ্বেতাকে সাজায়! খোলা পিঠঅলস আঁচলে কিছুটা ঢাকা, কিছুটা উন্মুক্তউদাস দৃষ্টি, ভিজে ঠোঁট! এমন কত কত ভাবেই ওই নারী তার কল্পনায় এসে দাঁড়ায় তা সেই জানে।
-একটা আবদার ছিল।
-কী?
-তোমার ছবি তুলতে পারি?
-আমার? আমি তো বুড়ি!
 
মহাশ্বেতার দুষ্টুমির হাসি যেন সে শুনতে পায়।
-কে বুড়ি?
-আমার বয়স কত?
-সে হিসেব লোকে করুক, আমি তো করি না। তুলবে কি? সেটা বলো আগে।
-হয়ত। এখন বলতে পারি না।
এমন কতবারই কথার ছলে, হাসি ঠাট্টায় কত কী প্ল্যান হয় ওদের। তবে দুজনেই মনে মনে বোঝে বাস্তব কতটা সম্মতি দেবে আর কতটা গোপন বাসনায় থেকে যাবে, যা পূরণ হবার নয়।
আজকাল মহাশ্বেতার মধ্যে একটা পরিবর্তন সে লক্ষ করেনি তা নয়, তবে নিজেই ফোন করে আসার কথাটা বলায় আকাশ সত্যিই কিছুটা অবাক! কিছুটা কেন, অনেকটাই।
 
-আমার ছবি সত্যিই তুলতে চাও?
-হ্যাঁ নিশ্চয়ই।
-তোমার স্টুডিওর ঠিকানাটা দিও। পরশু আসব।
-পরশু? কখন?
-বেলার দিকে। বিকেলের মধ্যে ছেড়ে দিও। ফিরতে হবে।
-আমি কিন্তু অন্যরকম ছবি তুলি।
-জানি, দেখেছি তো, তোমার টাইম লাইনে।
-তুমি ওরকম ছবি তুলবে?
-হ্যাঁ।
-মডেলদের পে করি। তোমাকে তো টাকার কথাও বলতে পারছি না।
-টাকা তো চাইনি।
-কিছু তো একটা নিতেই হবে। কী নেবে বলো।
-চাইব। এমন কিছু যা খুব দামি। দেবে তো?
-এই রে! সাধ্যের বাইরে হলে তো মুশকিল।
-নাহ, সাধ্যের মধ্যেই।
 
কী এমন চাইতে পারে মহাশ্বেতা! আকাশের মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। নাহ, এত ভেবে লাভ নেই। পরশু তো সবটা পরিষ্কার হয়েই যাবে, যখন  সে আসবে। স্টুডিওটা বড্ড অগোছালো হয়ে রয়েছে। বরং একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে আজ। যতই হোক, মহাশ্বেতা আসবে এখানে। আবার কেন জানি না মন বলছেসে কি আসবে?

(৭)

-আমার বন্ধুরা কি বলে জানো?
-কী বলে?
-তোর মা কত সুন্দর! তুই তোর মায়ের মত নোস। মা, আমি কেন তোমার মতো হলাম না বলো তো?
 
আদুরে গলায় মায়ের পাশে এসে বসে রুমকি।
-তুই তোর মতো। আমার মতো হবি কেন?
 
মেয়ের মাথায় আলতো হাত রাখে মহাশ্বেতা। নিজের জীবন দিয়ে সে বুঝেছে কারুর মত হওয়ায় কোনও আনন্দ নেই। নিজেকে চিনতে পারা, নিজের মতো হয়ে উঠতে পারাই বড় কথা! যদিও এই কাজটি করা বড় শক্ত। আসলে সমাজ, পরিবেশ সবের প্রভাবে আমরা হয়ত ভিতরের আমিকে চিনতেই পারি না। একটা মুখোশ পরে যে জীবন কাটাই সেটাই নিজের জীবন ভেবে কত কী যে হারিয়ে ফেলি তার শেষ নেই! একটা দীর্ঘশ্বাস যেন আক্ষেপের মতই বেরিয়ে আসে ভিতর থেকে।
-মা, তুমি ছোটবেলায় খুব ছটফটে ছিলে, তাই না! দিদুনের কাছে শুনেছি।
-হুম।
-তবে তুমি এত শান্ত কীভাবে হলে? আমি তো তোমার মতো ধীর স্থির মানুষ খুব কম দেখেছি। তোমাকে কখনও জোরে কথা বলতেও শুনিনি। খুব একটা রাগতেও দেখিনি।
-তোর আজ কাজ নেই? মায়ের সঙ্গে এত যে বকবক করছিস?
মেয়ের মাথাটা এখন মহাশ্বেতার কোলে, নিজের অজান্তেই তার হাত মেয়ের চুলে, কপালে আদরের প্রলেপ মাখাচ্ছে। রুমকির চোখ বন্ধ হয়ে আসছে এক অদ্ভুত ভালোলাগায়! মা কী নরম! কী ঠান্ডা হাতটা! মায়ের কাছে এলেই মনে হয় কী একটা মিষ্টি গন্ধ! ছোটবেলায় রুমকি বলত,
-বাবা, মায়ের গায়ে কেমন মা মা গন্ধ, তোমার গায়ে নেই।
রূপঙ্কর হাসত। সত্যি, সেও তো অনুভব করেছে শ্বেতার গায়ের গন্ধ! কী যে রয়েছে কে জানে, মানুষটার মধ্যে যেন একটা চুম্বক রয়েছে, অমোঘ তার আকর্ষণ!

রুমকির আজকাল মাকে নিয়ে খুব গর্ব হয়। মায়ের বুটিকের প্রধান বৈশিষ্ট্যই ছিল শাড়ির ডিজাইন, যা মা চিরকালই খুব ভালো করত। বলা চলে ডিজাইন আর কালার কম্বিনেশনে মায়ের ভাবনা অন্য মাত্রা যোগ করত। তবে যত দিন যাচ্ছে তা যেন আরও ভালো হচ্ছে। তবে আর একটি বিষয়ে একটা পরিবর্তন চোখে পড়ার মত, তা হলো মা এখন যেন আরও সুন্দর! বলা ভালো যত দিন যাচ্ছে মা যে কী সুন্দর হয়ে উঠছেআর মায়ের ছবিগুলো, যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরে সেসব দেখে রুমকির অনেক বন্ধুরাই মায়ের ভক্ত হয়ে উঠেছে। তার মা, এই মানুষটাই তার মা, ভাবতে কী যে ভালো লাগে! মাকে আর একবার জড়িয়ে ধরে রুমকি।
 
অথচ আগে সে এত মন দিয়ে মাকে দেখত কি? বাবার প্রভাব, বাবার নাম, এসবেই কি ঢাকা পড়ে গিয়েছিল মা? নাকি মা নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিলআজকাল মা কী সুন্দর কথা বলে! শান্তভাবেই, তবে কথার মধ্যে এমন কিছু থাকে যা অবজ্ঞা করার সাহস হয় না। রুমকি লক্ষ করেছে বাবাও আজকাল মাকে বেশ সমীহ করে চলে। যাক, মানুষটা কত যন্ত্রণা পেয়েছেযার অনেকটাই তো রুমকির জানা, এখন অন্তত মা ভালো আছে, এটাই বড় কথা।
-স্নানে যা। বেলা হলো তো।
মহাশ্বেতার কথায় রুমকি স্নানে যায়। মহাশ্বেতা নিজের আলমারীটি খোলে। কালকে কোন শাড়িটা পরবে? তারপর একটা লাল সাদা ঢাকাই বেছে নেয়। সঙ্গে তার নিজের ডিজাইন করা ব্লাউজ। আজ সব গুছিয়ে রাখবে সে। কাল তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বেরোতে হবে। পৌঁছতে ঘন্টাখানেক তো লাগবেই।
 
রেডিওতে রম্যগীতি শুরু হলো। সাড়ে এগারোটা বাজে। শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে তখন
কতটুকু তুমি জানো, তোমারে দিয়েছি কী যে
আয়নায় নিজেকে একবার দেখে সে! হঠাৎ বুকের কাছটা মোচড় দেয়! চোখদুটো জলে ভরে যায়! তারপর চোখ মুছে আবার নিজেকে দেখে আর একবার।এই প্রথম রূপকে না জানিয়ে সে কোথাও যাবে। যেতে তাকে হবেই!
 

(৮)

সারারাত ঘুম হলো না আকাশের। কেন যে হলো না সেটা সে নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। রাগ হচ্ছে নাকি অন্য কিছু? অভিমান, ঠিক অভিমানও কি? কী যেন একটা অস্বস্তিতে বিছানায় ছটফট করতে করতে উঠে বসল সে। নাহ, আজ আর ঘুম আসবে না। ছবিটা আর একবার দেখার ইচ্ছেটা কেবল তীব্র থেকে আরও তীব্র হচ্ছে যেন!
ল্যাপটপে চোখ রাখল আবার। এখন ভোর চারটে। এত সকালে আকাশটা কেমন লাগে? পর্দাটা অল্প সরিয়ে কাচের জানলায় চোখ রাখতেই মহাশ্বেতার শান্ত মুখটা যেন ভেসে উঠল চোখের সামনে!

মহাশ্বেতা! কল্পনায় সে যাকে দেখত, মনে মনে যে মানুষটা সম্বন্ধে একটা ধারণা তৈরী হয়েছিল, কথার স্বল্প বিনিময়ে যতটুকু চিনেছিল, আজ সব কেমন  ওলটপালট হয়ে গেল! কে এ? একে কি সে চেনে?
 
তখন প্রায় আড়াইটে হবে, দূর থেকে আকাশ প্রথম দেখল মহাশ্বেতাকে। গাড়ি থেকে নামছে, লাল সাদা ঢাকাই, লাল টিপ, ঘাড়ের কাছে হাত খোঁপা, চোখে কালো সানগ্লাস। ছিমছাম, পরিপাটি কিন্তু আড়ম্বরহীন, অথচ কী এক অনন্য রূপ! শান্ত মানুষটা ধীর পায়ে হেঁটে আসছে স্টুডিওর দিকে। ফর্সা রঙ যেন আরও উজ্বল সেইসব উন্মুক্ত অংশে যেখানে লাল রঙের ছোঁয়া, হয়ত ওই লাল ব্লাউজের কারণে। ঝরঝরে নির্মেদ অথচ কোমল নিটোল চেহারা বেশ আকর্ষণীয়  এখনও! স্টুডিওর ভিতরে আসতেই আকাশকে দেখে অল্প হাসল সে। আকাশের কিছুক্ষণ কথা হারিয়ে গেল যেন! সানগ্লাসের আড়ালে ঢাকা ছিল যে চোখদুটো, সে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে কেমন যেন বুকের হৃদপিন্ডের গতি বাড়ছে ভীষণ!
 
-এত দেরি হলো আসতে?
-তা হলো একটু। অপেক্ষা বেশ দীর্ঘ, কী বলো?
-দেরির কারণ তবে কি দেবীর ইচ্ছাকৃত?
-প্রশ্ন নয়। সময় কম হাতে, কাজে মন দাও। দেখি কেমন ছবি তোলো।
-বেশ।
 
আকাশের চোখ আটকে গেল মহাশ্বেতার পায়ের পাতায়। জুতো জোড়া খুলতেই নরম ফর্সা পায়ের আঙুল, তাতে যত্নে লাগানো নেল পেন্ট।
বড় সুন্দর তার মহাশ্বেতা! তার? আকাশের চোখ জ্বালা করছে। নাহ, রাত জাগার অভ্যেস যে নেই তা তো নয়। তবে ভোর রাতেও কেন ঘুম আসছে না আজ? আবার বিছানায় ফিরে এল সে। চোখ বন্ধ করতেই আবার সেই মুখ! অসহ্য, এবার নিজের ওপর অসম্ভব রাগ হচ্ছে তার। একটা মানুষকে নিয়ে এত ভাবার কি আছে? হ্যাঁ সুন্দরী, হ্যাঁ আকর্ষণীয়। তার জীবনে সুন্দর নারী শরীর সে কি কম দেখেছে? তারপরও এই অস্থিরতার কারণ কি? নাকি মহাশ্বেতার চলে যাওয়ার আগে বলে যাওয়া কথাগুলোই তাকে এতটা অস্থির করছে? কি করে সে পারল এভাবে আকাশকে বলতে? সারাদিন ধরে সে যে এত যত্নে ছবিগুলো তুলল, সেই ছবি কি করেও কি মানুষ?

(৯)

একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে আছে মহাশ্বেতা। দূরে রাস্তা দিয়ে গাড়িগুলো ছুটছে যে যার মতো। সবারই ফেরার তাড়া, কিংবা হয়ত পৌঁছবার। মাঠে এখন অন্ধকার। লোক কম, ভিড় নেই। এদিকটায় কেউ নেই। আগে হলে তার সাহসই হতো না। গাড়ি থেকে যখন নামল পলাশ একটু অবাকই হয়েছিল।

-দিদি, এখন নামবেন? বড্ড অন্ধকার কিনা। কাল বরং বিকেলে
-তোমাকে ফোন করলে চলে এসো। কিছুক্ষণ থাকব এখানে। কিছু খেয়েছিলে পলাশ? অনেক দেরি হলো তো।
-দেরির জন্য নয় দিদি। আপনি একা তো, তাই আর কি।
-আমি আসি। তুমি কিছু খেয়ে নিও বরং।
পলাশ আর কথা বাড়ায়নি। আজকাল দিদিকে একটু অন্যরকম লাগে তার। মানুষটা বড় ভালো। অত বড় বাড়ির বউ, কিন্তু কী আন্তরিক! সাহেবকে দাদা বলার সাহস হয়নি কোনওদিন। কিন্তু মহাশ্বেতাকে কেমন সহজেই দিদি ডাকা যায়। পলাশের কোনও সমস্যা হলেই মুশকিল আসান মহাশ্বেতা। সেই যেবার ওর বউয়ের অসুখ হলো, বেশ কদিন ছুটির দরকার ছিল। সাহেবকে বলতে পারেনি সে। দিদি শুনেই বলেছিল,
 
-যতদিন না সব সামলায় কাজে এসো না। সেন্টার থেকে ড্রাইভার পাওয়া যায় তো, অত চিন্তা কোরো না। আমরা ঠিক চালিয়ে নেব। তাছাড়া তোমার দিদি তো গাড়িটা চালাতে জানে। কী, তাই তো?
সাহেব গাড়ি চালান না সে অনেকদিন হলো। চোখের অসুবিধার জন্য। তবে দিদি জানলেও বাড়ি থেকে খুব একটা একা কোথাও যেতে দেওয়া হয় না, এটা পলাশ খেয়াল করেছে। প্রায় সবসময়ই পলাশকেই সঙ্গে যেতে হয়। তবে মাঝে মাঝে দিদির আবদারে সে তাকে গাড়িটা চালাতে দেয়। নিজে পাশে বসে। বাড়ির কেউ একথা জানে না। দিদি যখন গাড়ি চালায়, পলাশ বোঝে দিদি যেন মুক্তি পায়। হাসিমাখা চোখদুটো ঝলমল করে! দিদি তো ভালোই চালায়, তবু কেন যে বাড়ি থেকেযাক, বড়লোকেদের বড় বড় ব্যাপার!
তবে আজ দিদি এটা ঠিক করল না। অন্ধকারে একা একা এভাবে ময়দানেতবে সে আর কী করবে। পলাশ গাড়িটা নিয়ে চলে যায়, কাছেপিঠেই পার্কিং করবে।
 

(১০)

-অত দূরে যাস না মা। পুকুরটা কিন্তু বেশ গভীর! 
-তুমি তো আমাকে সাঁতার শিখিয়েছ বাবা। তবে ভয় পাচ্ছ কেন? আমি ঠিক পারব।
 
তারপরই জলে ঝাঁপ দিত সে। সাঁতরে প্রায় এপার ওপার করত মহাশ্বেতা। শুধু কী তাই! পাঁচিলে উঠলে মা কী বকত! কতদিন মা বকে না। মায়ের সেই সিঁদুর পরা মুখটা হঠাৎ মনে পড়ল যেন! লালের ছোঁয়া যেদিন হারিয়ে গেল কপাল থেকে, সিঁথিটা ফ্যাকাসে সাদা হলো, মা কেমন বদলে গেল! আর সেও! গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, বকুনির দিনগুলো বেশ ছিল!
 

একটা মেসেজ ঢুকল।
 
-এটা কেন করলে?
 
কোনও উত্তর সে দিল না। নাহ, কাউকে কোনও জবাব দেওয়ার দায় তার নেই।
-কী করে পারলে? কিছু তো বলো?

শেষ মেসেজটা ওপর থেকে দেখল মহাশ্বেতা। কিন্তু ব্লু টিক হলো না। ফোনটা এবার ফ্লাইট মোডে সেট করল মহাশ্বেতা। তারপর কানে ইয়ারফোনটা লাগিয়ে পছন্দের গান চালাল। মনের মধ্যের যত যন্ত্রণার ঢেউ ছিল আস্তে আস্তে কেমন শান্ত হচ্ছে আজ। এমন করে তার কখনও ভালো লাগেনি।
 
আজ সে মহাশ্বেতা হয়ে উঠতে পেরেছে। কারোর স্ত্রী নয়, মা নয়, প্রেমিকা নয়, শুধু একজন নারী হওয়ার সুখটুকু পেতে সে তো চেয়েছিল।
 
আচ্ছা, বাবা যদি আজ থাকত, বাবা কি তার মহাশ্বেতাকে ভুল বুঝতো? তার কোনো কাজে বাবা কখনও বাধা দেয়নি। বরং প্রশয়টাই বেশি ছিল। বাবার কাছে কিছু লুকোতে হয়নি কখনও। আজও লুকোবে না। বাবাকে সে সবটা বলতে পারে। সে জানে, বাবা এখন আশেপাশেই কোথাও একটা রয়েছে। কোনও গাছের  আড়ালেই হয়ত।
 

মহাশ্বেতা, এই নাম তো বাবার দেওয়া। এতদিন ধরে একটা শামুখের জীবন কাটিয়ে ক্লান্ত, আধমরা হয়ে এই যে বাঁচার লড়াইটা সে করে চলেছিল, বাবার কি কষ্ট হতো খুব? তাই দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত তার মহাশ্বেতার জিতে যাওয়ার এই দিনটা দেখার জন্য? কেউ তাকে চিনতে পারেনি, বলা ভালো তাকে চেনার চেষ্টাও কেউ করেছিল কখনও? তবু কেন আজ মনে হচ্ছে বাবা চিনত, তাকে বুঝতো!
 
হঠাৎ মনে হলো তার কপালে, মাথায় বাবা বড় যত্নে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আহ, কী শান্তি! দুচোখ ছাপিয়ে আনন্দের ধারা তার গালদুটো ভিজিয়ে দিচ্ছে।
-বাড়ি ফিরতে হবে তো, মা?
-হ্যাঁ বাবা। এবার ফেরার পালা।
-তুমি রাগ করোনি তো বাবা?
-ধুর পাগলী, চল, আজ আমিও তোর সঙ্গেই যাব। বাপ মেয়ে বেশ গল্প করতে করতে, তোকে আজ বড় স্নিগ্ধ লাগছে মা! ঠিক আমার সেই ছোট্ট মহাশ্বেতা যেন।
মহাশ্বেতা বাবার হাতটা ধরল। ময়দানের এই অন্ধকারেও সে যেন দেখতে পেল বাবার সেই হাসিমাখা মুখ।
 

(১১)

-অনেক দেরি হয়ে গেল। তুমি খেয়ে নিয়েছ তো শ্বেতা?
-হ্যাঁ।
 
-রুমকি ফিরেছে? আজই তো মহুয়ার বিয়ে ছিল, তাই না?
-হ্যাঁ। একটু আগেই ফিরল।
-সারাদিন একা একাকী কী করলে শুনি?
-স্নান করবে তো? একটু পরে কফি আনব কি?
-নাহ, আজ আর একা কফি খাব না। আমি ফ্রেস হয়ে আসছি। তারপর দুজন মিলে কফি খেতে খেতে গল্প হবে, কেমন?
-আমি তো রাতে কফি খাই না আর, সে তো অনেকদিন হলো।
রূপের কানে কথাগুলো বড্ড বাজল যেন। সত্যিই তো, সেই কতবছর আগে দুজন রাতে একসঙ্গে কফি খেতে খেতে গল্প করেছে? রূপ তো একাই কফি খায়, কাজের চাপে আর গল্প হয় না। তবু, শ্বেতা মুখের ওপর না বলায় কেমন যেন লাগল রূপের।
 
-তুমি ঘরে যাও। আমি কফি পাঠিয়ে দেব।
-একটু বসো না।
-বড্ড টায়র্ড লাগছে। সারাদিন বাড়ি ছিলাম না তো।
-কই, আগে তো কিছু বলো নি? কোথায় গিয়েছিলে?
-নিজেকে খুঁজতে।
অল্প হেসে মহাশ্বেতা চলে গেল। রূপ তার শ্বেতার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ওকে একবার ছুঁতে চাওয়ার তীব্র তাগিদ অনুভব করল। নাহ, আজ রাতে সে তার শ্বেতার কাছে যাবে।

বড় অস্থির লাগছে আজ রূপঙ্করের। জানলাটা খুলতেই দমকা হাওয়া টেবিলের কাগজগুলো এলোমেলো করে দিল। রূপঙ্করের কোনও কিছু অগোছোলো ভালো লাগে না। কোনওদিনও লাগত না। শৌখিন বলতে যা বোঝায় রূপ অনেকটা তেমন মানুষ। বাড়ির আনাচে কানাচে আভিজাত্যের ছোঁয়া। আর সবকিছু বড় সাজানো। অবশ্য এ ব্যাপারে শ্বেতারই ক্রেডিট! ওর সবদিকে খেয়াল! রূপঙ্করের প্রতিটি পছন্দের দিকে ওর তীক্ষ্ণ নজর! ঘুম থেকে উঠে থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত রূপের প্রতিটি প্রয়োজনের জোগান কি অবলীলায় দিয়ে চলেছে মেয়েটা! অথচ ওদের মধ্যে কথা হয় কতটুকু! তবু রূপঙ্কর তো অনুভব করেছে শ্বেতার অস্তিত্বখাবারের থালায়, বিছানার চাদরে, টেবিলের ধুলোহীন গোছানো জিনিসগুলোতেসবকিছুতেই তো শ্বেতার ছোঁয়া!
আশ্চর্য়, শ্বেতাকে রূপঙ্কর শেষ কবে ছুঁয়েছিলকিছুতেই মনে পড়ছে না। রূপের ঘর দোতলায়। রূপঙ্করের? একদিন এইঘর তাদের দুজনের ছিল। কত বছর আগে যেনকিছুই মনে পড়ল না। তখন রুমকির বয়স বোধহয় আট, নাকি নয়
 
শ্বেতা তখন রুমকির সঙ্গে ঘুমোতো। রূপঙ্করের পাশের ঘরটাই রুমকির। তারপর রুমকিও বড় হয়ে গেল! শ্বেতার ঘর হলো নীচে! আচ্ছা ওপরে তো আরও ঘর ছিল! তাও শ্বেতা নীচের ঘরটাই কেন বেছে নিয়েছিল? রূপঙ্করের থেকে দূরে থাকার ইচ্ছেয়? কিন্তু শ্বেতা তো রূপকে ছেড়ে থাকেনি কখনও। বাপের বাড়ি গিয়েও থাকত না। দেখা করে চলে আসত সবসময়। তবুকবে যেন রূপঙ্কর আর শ্বেতার মাঝে একটা দেওয়াল তৈরী হলো। কে দায়ী? শ্বেতার তো কোনও হাত ছিল না। নাহ, সত্যিই ছিল না।
দাম্পত্যে শীতলতা তো নতুন কিছু নয়, বছরের সংখ্যা যত বাড়ে দুটো মানুষ পাশাপাশি থেকে গেলেও কাছাকাছি থাকা হয় কি? রূপঙ্কর কি এখন শ্বেতার মনের মধ্যে একটা অভ্যাস হয়ে রয়ে গেছে? কর্তব্য? মায়া, নাকি ভালোবাসাকোন টানে শ্বেতা আজও সব কিছু নিপুণ হাতে সামলে চলেছে?
রূপঙ্করের তো অজানা নয় কিছুই। শ্বেতা তার জীবনে এসেছিল একটা ঝড়ের মতো। তার সব বাঁধন আলগা করে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। শুরুর দিনগুলোয় কী উদ্দাম প্রেম! কী এক মাতাল চাওয়ায় রূপ যেন আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো।
 
তারপর
কতদিন শ্বেতাকে সে ছোঁয়নি, কত বছর হলো? বয়সের ভার নাকি পাওয়ার দম্ভ? কোনটা রূপঙ্করকে এত দূরে নিয়ে গেল? কেন সে শ্বেতার জীবনে একাকিত্বের অভিশাপ এনে দিল?
আচ্ছা, শ্বেতা তো কখনও কোনও অভিযোগ করেনি? বরং রূপ এমন বাধ্য মানুষ খুব কম দেখেছে জীবনে। তার সব কথাই শ্বেতা হাসিমুখে শুনেছে, মেনেছেচিরকাল।
নাহ, একবার শুধু রূপঙ্করের অবাধ্য হয়েছিল সে।

(১২)

-মা কে এ বাড়িতে আনবে মানে?
-উনি অসুস্থ।
-ডাক্তার আয়া সব ব্যবস্থাই আমি করেছি শ্বেতা। কর্তব্যে আমি ভুল করিনি। তবে এ বাড়িতে মায়ের জায়গা হবে না। কারণ তুমি জানো।
-আমি পলাশকে নিয়ে আজ ওঁকে আনতে যাব।
-তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ না?
-মানুষটা আর বেশিদিন নেই। শেষ সময়টায় পাশে থাকতে দাও। নইলে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হবে।
 
-শ্বেতা, তুমিকি করে পারছো? সব ভুলে গেলে? রুমকি
-ভুলিনি। নিয়ে আসি? তুমি রাগ করবে?
-বেশ।
মাকে যখন শ্বেতা বাড়ি নিয়ে এল রূপের ভালো লাগেনি। বরং বিরক্ত হয়েছিল শ্বেতার মায়ের প্রতি মায়া দেখে। কী যত্ন করতো মাকে! মা শেষ কটাদিন শ্বেতাকে এক মুহূর্ত ছাড়তে চাইতো না।
 
শ্বেতা কি মাকে ক্ষমা করতে পেরেছিল? কিন্তু রূপ তো পারেনি। আজও পারে না। মা চলে যাওয়ার এতবছর পরও পারে না।
এখানেই রূপের হিসেব মেলে না। এতবছরেও শ্বেতাকে ঠিক চিনতে পারে না। আপাত নিরীহ সাধারণ একটা মেয়ে, তবু কোথাও যেন ও সবার থেকে আলাদা।
ঘর থেকে বের হতেই নীচ থেকে হাল্কা গান ভেসে এলো।
শ্বেতা কি গান গাইছে? কতবছর পর ওর গলায় গান শুনতে পেল রূপ! হ্যাঁ, শ্বেতার ঘর থেকে একটা সুর ভেসে আসছে।
 

কী ভালো গান গাইতো শ্বেতা! আচ্ছা ও কেন গান গাওয়া বন্ধ করেছিল? রূপের কিছুই মনে পড়ছে না। কেউ কি বারণ করেছিল? কই, শ্বেতা তো কখনও তেমন কিছু বলেনি? তবে বহুদিন ও আর গান গায় না। রূপ কেন জানতে চায়নি? কেন বলেনিশ্বেতা তোমার গলায় আর গান শুনি না কেন?
আচ্ছা শ্বেতা কি বদলে যাচ্ছিল? রূপের কেন কিছুই মনে পড়ছে না? কতদিনকতদিন সে শ্বেতার খবর রাখেনি? কেন রাখেনি?
রূপ আস্তে আস্তে শ্বেতার ঘরের দিকে যেতে থাকে। গানটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে!
জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে….
কী অপূর্ব গাইছে শ্বেতা!
দরজায় হাত রাখে রূপ। খোলার চেষ্টা করতেই বুঝতে পারে ভিতর থেকে লকড্!
কবে থেকে ও দরজা লকড্ রাখে? কই আগে তো রাখতো না। রূপ চাইলেই এ ঘরে এসেছে কতবার!
 
সব গুলিয়ে যাচ্ছে! শ্বেতা, তার শ্বেতা কি অনেক দূরে চলে গেছে? অবহেলা কি সম্পর্কের ভিতটাকেনা না, কি সব ভাবছে সে! ছি ছি!
 
কাল সকালেই শ্বেতার সঙ্গে কথা বলবে সে। কিছু দেরি হয়নি। আবার সব ঠিক  করে নেবে। সে জানে, শ্বেতা আজও অপেক্ষায় রয়েছে। শুধু একবার ওর হাতটা ধরলেই
রূপের চোখের সামনে শ্বেতার মুখটা ভেসে উঠল।

(১৩)

রাতদিনের আলোর স্বচ্ছতা নেই, বরং অন্ধকারে গোপন করার সুবিধে থাকায় রাতের বুকে নিজেকে চেনার একটা সুযোগ ঘটে বইকি। আমাদের সকলের জীবনে এমন একটা রাত আসে যখন একা, অন্ধকার ঘরটায় আমরা মুখোমুখি হই নিজের। যে কথা কাউকে বলা তো দূরের কথা নিজেকেও বলতে দ্বিধা হয়, অহংবোধ পাহাড়ের মতো অটল দাঁড়িয়ে থাকে সামনে, কখনও কখনও একটা নির্ঘুম রাতে বিছানায় ছটফট করতে করতে নিজের অসহায়তায় বৃথা আস্ফালন করি আমরা। সেই রাত আমাদের ঘুমোতে দেয় না, মুখোশের আবরণ খসে পড়লে, পোশাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা নগ্ন শরীর, আর তার মধ্যে লুকোনো আমিটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায় একটা অবাধ্য রাত। আজ এমনই এক রাত এসে দাঁড়িয়েছে আকাশের নির্লিপ্ত জীবনে। দক্ষিণ কলকাতার এক  অভিজাত আবাসনের তেরো তলার দশ বাই বারোর বেডরুম। আকাশ ব্যানার্জীর একান্ত নিজস্ব জায়গা। যেখানে অবাঞ্ছিতের প্রবেশ নিষেধ, যেখানে শুধু তার আধিপত্য, যেখানের সবটা জুড়ে কেবলই তারই মর্জি, সেই নিশ্ছিদ্র ঘরেও তো চাঁদের আলো ঢুকে পড়ে আকাশের মতের তোয়াক্কা না করে, কিংবা ঝোড়ো হাওয়ায় ওলটপালট হয় ঘরের ভিতরটা! অসহায় লাগছে তার, চাইলেও ঘুম যে আসবে না এটা বুঝে গিয়েছে সে। মাথার মধ্যে কেউ ঢুকে পড়েছে, আর অস্থির করে তুলেছে তাকে! নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে বারবার হেরে যাচ্ছে কি? পরাজয়সেই মায়াবিনী, রহস্যময়ী নারীর কাছে। চাইলেও আজ তাকে অবজ্ঞা করতে সে পারছে না।

মহাশ্বেতার সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত, তার চলে যাওয়া, যেতে যেতে বলে যাওয়া কথারা, না থেকেও থেকে যাওয়া চুলের গন্ধ, হাতের আঙুলে রয়ে যাওয়া তার শরীরের স্পর্শ, নাহ, আকাশের আজ পালাবার পথ নেই। লেন্সের ভিতর থেকে মুগ্ধ দুটো চোখের তৃষ্ণা, আকাশের জীবনে ঘটে যাওয়া কত কত রোমাঞ্চকর স্মৃতিকে নিমেষে ম্লান করে উজ্বল আজ শুধু সেই মুখ! চোখ বন্ধ রইল না খোলা, তাতে কোনও তফাৎ নেই। হয়ত এই রাত, হ্যাঁ রাত বলেই এত  যন্ত্রণা, দিনের আলোয় সেই মুখ হয়ত আবার হারিয়ে যাবে, মুক্তি হবে আকাশের। কিন্তু রাতটুকু তাকে ছটফট করেই কাটাতে হবে আজ।
 

(১৪)

এই রাত রূপঙ্করকেও তো ঘুমোতে দেবে না। রূপঙ্কর গাঙ্গুলী, তার প্রাসাদসম বাড়ির সাজানো ঘরটায় পায়চারী করতে করতে বারবার ছুঁতে চাইছে তার শ্বেতাকে, সেই শ্বেতা যাকে অবজ্ঞায় বছরের পর বছর খোঁজেনি সে। চাইলেও আজ সে ঘুমোতে পারবে না। চাইলেও এই রাতে সে পৌঁছতে পারবে না শ্বেতার কাছে। শুধু অনুভব করবে শ্বেতাকে। সেই অষ্টাদশী, সেই সরল মায়া ভরা চোখ দুটোসেই যৌবনের উদ্দাম প্রেমের মানসী, তার শ্বেতা, সেই শান্ত থেমে যাওয়া মধ্য বয়সী নারী! হঠাৎ রূপঙ্করের মনে হলো শ্বেতা যেন কপালে হাত রাখল। বুকের মধ্যে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোলো বুঝি। শ্বেতার গায়ের গন্ধ ঘরটায়, তার চোখ ভারি হয়ে আসছে! সে না থেকেও আজ বড় বেশি রয়েছে এখানে। সকালের অপেক্ষায় একটা বিনিদ্র রাত কাটবে রূপঙ্করের। হ্যাঁ, সকালসকাল হলেই ওই বন্ধ দরজা খুলে বেরিয়ে আসবে মহাশ্বেতা। আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা! অপেক্ষা যত তীব্র হয় ততই দীর্ঘ হয় রাত। আজ তেমনই এক রাত। বড় দীর্ঘ বড় অন্ধকারময় এই রাত!

আজ রাতে মহাশ্বেতা কী করছে? সেও কি ঘুমোতে পারেনি? সারাদিনের প্রতিটি মুহূর্তকে হয়ত বারবার মনে করে তার ঠোঁট ছুঁয়ে যাচ্ছে এক আশ্চর্য সুন্দর হাসি! নাকি আজ মহাশ্বেতা ঘুমে আচ্ছন্নশান্ত স্নিগ্ধ তার মুখে এসে পড়ছে চাঁদের আলো। ঘুমন্ত মহাশ্বেতার সেই রূপ কেউ কি দেখতে পেল?
 
জানলার বাইরে গন্ধরাজ গাছটায় এখন ফুল ফুটছে! এই ফুল মহাশ্বেতার বড় প্রিয়! ঘরে জ্বলছে নীল আলো। বিছানার এক পাশে বড় আয়নার সামনে মহাশ্বেতা! আজ সে চুল বাঁধেনি। হালকা আলোয় নিজেকে দেখতে দেখতে তার হাসি পেল একটু। আজও শরীরের কোথাও শিথিলতা নেই! নিটোল শরীরের খাঁজে যে রহস্য লুকিয়ে তা দেখে যেকোনও পুরুষের হৃদস্পন্দন কি মুহূর্তের জন্য থেমে যায়? আজ আকাশের চোখদুটো দেখে ওর তো তেমনই মনে হচ্ছিল। আকাশের সঙ্গে প্রথম যেদিন সারারাত গল্প হয়েছিল, সেদিন সে বলেছিল, ব্যক্তি  মহাশ্বেতাকে নাকি সে চিনতে চায়! মনে মনে মহাশ্বেতা বড় হেসেছিল। মহাশ্বেতাকে আজ অবধি কে চিনতে পেরেছে? রূপঙ্কর, তার স্বামী, সেও কি চেনে তাকে? সে তো চেনে তার শ্বেতাকে, যেমনটা সে চেয়েছিল!
 

হায় রে পুরুষ! তোমার দম্ভ, তোমার অহং তোমাকে তো কখনও পৌঁছতে দেবে না কোনও নারীর কাছে! তুমি যতটুকু পাবে, সেই পাওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে জানতেই পারবে না কী কী পাওয়ার ছিল! এক নারী তোমাকে কী কী দিতে পারে তা যদি তুমি জানতে তাহলে নিঃস্ব হয়ে দুহাত বাড়িয়ে শত শত জন্ম অপেক্ষায় থেকে যেতে পারতে তুমি।
অবশ্য মহাশ্বেতার তাতে কিছু কি যায় আসে? আজ সে শুধু তাই করেছে যা সে করতে চেয়েছে। অন্য কারোর মর্জি চলেনি। একটা দিনের জন্য হলেও সে আজ একান্তভাবে তার নিজের! তার ভালো লাগা, তার চাওয়া, তার ইচ্ছের দামটুকু তো তাকে দিতেই হতো। একবার চিনতে পারার পর কীভাবে অবহেলা করতো সে নিজেকে? কেনই বা করত? কাউকে সে কখনও বঞ্চিত করেনি। সকলের ভালো লাগা মন্দ লাগার দাম সে চুকিয়েছে। নিজেকে অন্যের মনের মতো করে গড়ে পিঠে নিয়ে একটা মেকি জীবন কাটাতে কাটাতে সে আজ ক্লান্ত! নাহ আর নয়। আর নিজেকে ঠকাবে না সে! আজ এই রাত মহাশ্বেতা কাছেও বড় মায়াবী, বড় শান্তির! আলমারি থেকে সাদা মসলিনের কাপড়টা বার করল সে। তারপর সেই শাড়িতে জড়িয়ে নিল নিজের অনাবৃত দেহ! তারপর বিছানায় শরীরটা ডুবিয়ে দিতে দিতে চোখ বুঁজল মহাশ্বেতা। এবার ঘুমোবে।

(১৪)

হঠাৎ মহাশ্বেতার মনে হলো মাথার কাছে একটা ছায়া মূর্তি।

-কে?
-ঘুম পাচ্ছে?
-বাবা, তুমি এসেছ!
 
-তোকে দেখতে বড় ইচ্ছে করছিল যে!
-আমারও!
 
-তোদের বাগানটা বড় সাজানো!
-হ্যাঁ।
 
-তোর গান শুনতে শুনতে আজ মনে হচ্ছিল কতদিন তুই গান গাইতিস না। বড় অভিমান না রে মা?
-তুমি শুনছিলে? নাহ বাবা। আজকাল কারুর ওপর রাগ বা অভিমান, কিছুই হয় না। সেই ছেলেমানুষির কি আর বয়স আছে! তাছাড়া সব মানুষই কোথাও না কোথাও বড় একা। সকলেরই নিজের একটা গণ্ডি রয়েছে। তার ভেতরে প্রবেশ না করাই তো ভালো!
-হুম, তা বটে। তুই ভালো আছিস তো মা?
-হ্যাঁ বাবা। আমি নিজেকে ভালো রাখতে শিখে গেছি।
 
-বড় শান্তি পেলাম মা।
-আমিও!
-এবারে ঘুমো। আমি আসি।
-এসো।
হঠাৎ মনে হলো বড় ঘাম হচ্ছে। স্বপ্ন ছিল? তাই হবে। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে কেন?
 

পা কাটল কী করে? আবার পাঁচিলে চড়েছিলি?
 
বৌমা, রান্নাঘরে স্নান না করে ঢুকতে নেই, মা শিখিয়ে পাঠায়নি বুঝি?
রূপের বউ কেমন যেন চুপচাপ, তাই না মাসিমা, তা ওমন শিক্ষিত ছেলের বউ,  কী পাশ? শুনলাম গ্র্যাজুয়েটও নয়, সত্যি নাকি!
কোথাও যাওয়ার হলে পলাশকে নিয়ে যেও। একা একা গাড়ি নিয়ে বেরিও না, আমার টেনশন হয় শ্বেতা।
মা, আজকের মাটনটা যাস্ট ফাটাফাটি, লাভ ইউ মা!
চোখ সরছে না যে! কী করি! এত সুন্দর মানুষ হয়! এই, তুমি মানুষ তো?
একে একে সবার মুখগুলো ভেসে উঠছে! কত মানুষ, কত চেনা মুখ, কত আবদার, কত অভিযোগ
ঘুম পাচ্ছে। চোখ খোলার ক্ষমতা নেই আর। তবু দূর থেকে কারা যেন কীসব  বলছে! ওরা কারা? কী চায়?
সারা ঘরটা জুড়ে একটা মিষ্টি গন্ধ! তার চেনা গন্ধ! গন্ধরাজ! আহা, কী যে ভালো লাগছে মহাশ্বেতার! শরীরটা পালকের মতো হালকা! ঘুম, একটা শান্তির ঘুমকত রাত, কত রাত যে সে এমন করে ঘুমায়নি!

(১৫)

-মা এখনও ওঠেনি? সকাল আটটা বাজে, আর এখন আমাকে বলতে এসেছ? অদ্ভুত সব! দাঁড়াও দেখছি।
রুমকি গজগজ করতে করতে নীচে নামতে থাকে। সরমা যে কী ভুল করেছে সেটাই বুঝতে পারে না। বৌদি তো কোন ভোরে উঠে পড়ে। আজ যদি না উঠে থাকে তো সে কী করত! মানুষটা কি একদিনও শান্তিতে ঘুমোতেও পারবে না? তোমরা তো সব কত দেরিতে ঘুম থেকে ওঠো বাপু! যেমন বাপ, তেমন মেয়ে! সব কাজ বৌদিকেই করতে হবে যেন! যাক, রুমকির পিছন পিছন সেও নেমে আসে।
 
-মা, ও মা, দরজাটাও তো বন্ধ দেখছি। উফ, ও মা, শরীর খারাপ নাকিমাদরজা খোলো!
রুমকির চিৎকারে রূপঙ্করের ঘুম ভেঙে যায়! ভোর রাতে কখন যে চোখটা লেগে গিয়েছিল! রুমকি চিৎকার করছে কেন? কী হলো আবার!
শ্বেতার ঘরের সামনে সরমা, রুমকি
 
-কী হয়েছে?
-মা দরজা খুলছে না বাবা। কী হলো?
-সেকি? শ্বেতাশ্বেতা আমি রূপ, দরজা খোলো। কী হলো, শরীর খারাপ? রুমকি, মাকে ফোন কর দেখি একটা।
-সে তো কতবার করলাম। বাবা, আমার বড্ড ভয় করছে। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। মা তো কখনও
রূপঙ্করের বুকটা কেঁপে ওঠে! কী হয়েছে? শ্বেতার কী হতে পারে? কাল রাতেই তো মানুষটানা না, আর দেরি করা ঠিক হবে না। রূপ ওপরের ঘরে ছোটে! আলমারীতে একসেট করে সব ঘরের চাবিই তো রাখা থাকে। হ্যাঁ শ্বেতাই তো রেখেছিল। শ্বেতার ঘরের চাবির নম্বরটা যেন কী ছিলধুর কিচ্ছু মনে পড়ছে না। আসলে এসব তো শ্বেতাই মনে রেখেছে চিরকাল। চাবির গোছাটা বার করে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রূপঙ্করের কেমন যেন মনে হয় শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নামছে। না না, শ্বেতা ঠিক আছে। এক্ষুনি বেরিয়ে আসবে, সে জানে, শ্বেতার কিচ্ছু হয়নি।
 
তিন চারবারের চেষ্টায় দরজাটা খুলে যেতেই সকলে হুড়মুড় করে ঘরটায় ঢুকেইএকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রূপঙ্কর।
-ওই তো বৌদিসরমাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে!
মহাশ্বেতা ঘুমোচ্ছে। মুখে হাসি লেগে রয়েছে! খোলা চুল, সাদা শাড়িতে মহাশ্বেতাহ্যাঁ সে ঘুমোচ্ছে।
রুমকি খাটের পাশটায় বসে মায়ের কপালে হাত রাখে।
-মাএকি এত ঠান্ডা কেন? বাবা

(১৬)

সব কাজের মাঝেই বারবার একটা কথা মনে হচ্ছে আকাশের। এমন তো কখনও হয়নি। তার মেসেজ আনসিন অবস্থায় ফেলে রেখেছে মহাশ্বেতা! অবহেলার খেলাটা সেই খেলে এসেছে অনেকবার, কিন্তু মহাশ্বেতা তাকে কখনও প্রত্যুত্তরে অবহেলা ফিরিয়ে দেয়নি। তাহলে? দুদিন আগেই তোকী এমন হলো! সে কি আর একটা মেসেজ করবে? নাহ, কি দরকার। এমনিতেও কারুর সঙ্গেই বেশি জড়িয়ে পড়া তার স্বভাব নয়। 
কাগজটা হাতে নিয়ে কফির কাপে চুমুক দেয় সে। ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরোতে হবে। আজ একটা শ্যুট আছে।
কীকী লেখা এটা? কার ছবি? মহাশ্বেতা
হাত থেকে খানিকটা গরম কফি পড়ে যায় অসাবধানে! কাগজের পাতায় একটা অবিচুয়ারি। কার মৃত্যু সংবাদএসব কী দেখছে সে! মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে আকাশের! নিউজটা ভালো করে পড়ল আবার! তার মানে সেদিন রাতেই!
সেদিন তো কতটা সময় দুজনে একসঙ্গে কাটিয়েছে ওরা। কই, তাকে তো এতটুকু অসুস্থ মনে হয়নি, বরং উল্টোটাই। তার হাসির শব্দ এখনও কানে বাজছে। আকাশের মুগ্ধতার যেন শেষ ছিল না। তবে যাওয়ার সময় হঠাৎ কেমন বদলে গিয়েছিল ও। যেন কিছুই হয়নি। নির্লিপ্ত চাহনি আর তার শেষ কথাগুলো মনে করলে আজও আকাশের মনে হয় মহাশ্বেতাকে তার এতটুকুও চেনা হয়নি। তার যে অহংকার ছিল সে মানুষের ভেতরটা পড়তে পারে সেই দর্প ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে সে চলে গিয়েছিল। অভিমান নয় তবে আকাশের নিজের ওপর বেশ রাগ হয়েছিল। কিন্তু সে তো স্বপ্নেও ভাবতে পারে না মহাশ্বেতা নেই!
 
কী এমন হয়েছিল? আকাশ তো কখনও তাকে এতটুকু জোর করেনি! তার কোনও আচরণে কি সেদিনকিন্তু সে তো সত্যিই কিছুই করেনি। মহাশ্বেতা এসেছিল তার কাছে। সে তো নিজেই এসেছিল তার কাছে!
 
ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই, তবু যদি ঈশ্বর বলে কিছু থেকেও থাকে তিনি তো জানেন সে আর যাই হোক মহাশ্বেতাকে অবজ্ঞা করতে চাইলেও আঘাত করতে সে কখনও চায়নি। আকাশ আর ভাবতে পারছে না! কী করবে সে! কাকে বলবে সবটা? কীভাবে যে জানবে মহাশ্বেতার কী হয়েছিল? কে বলে দেবে সে কোনও ভুল করেছে কিনা!
যদি দেখা না হতোতবে কি সে আজও বেঁচে থাকতো?
 

(১৭)

মহাশ্বেতা! কে এই মহাশ্বেতা? এক সাধারণ মাঝবয়সি ঘরোয়া গৃহবধু বই তো কেউ নয়। এমন শত শত মহাশ্বেতাকে আমরা রোজ দেখি পথে ঘাটে। কখনও বাজারের ব্যাগ হাতে, কখনও স্কুল বা কলেজের গেটে, বাসে ট্রেনে কিংবা গাড়ির ভেতর থেকে নেমে আসে এরা, তারপর শপিংমলে, বা গড়িয়াহাট বা নিউমার্কেট চত্বরে! এদের নিজস্ব কিছু কাজও থাকে হয়ত! কেউ চাকরি করে, কেউ ছোটখাটো ব্যবসা, তবে সব ছাপিয়ে ওই আটপৌরে গৃহিণীর পরিচয়টি সমস্ত  অবয়ব জুড়ে! তোমরা এদের দেখ, সত্যিই দেখ? কী জানি, হয়ত! দেখলে কী মনে হয়? কৌতুহল জাগে? নাকি সবাইকেই এক গোত্রেই ফেলো তোমরা! এদের প্রত্যেকে এক একজন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মানুষ, একেবারে আলাদা, হয়ত ভেতরে  এক সমুদ্র কিংবা ঝড়, হয়ত শুকিয়ে যাওয়া একটা গাছ, বা চড়া পড়া নদী, উচ্ছল ঝরনা! কে বলতে পারে! 
শাড়ির ভাঁজ, মুখের গড়ন, শরীরী পেলবতা, চুলের বাহার এসবের বাইরেও সে একজন, ভীষণভাবে এক নারী! চলতে চলতে একসময় হঠাৎ এরা থেমে গেলে তোমরা কদিন শোক করো? আহা, বউটা বড় ভালো ছিল, সতীলক্ষীশাঁখা সিঁন্দুর নিয়ে স্বর্গে গেল। ভরা সংসার, স্বামী সন্তান সব রেখে চলে গেল! কী ভাগ্য! আহা বড় ভাগ্য!
 

তবু এদের মধ্যে কেউ কেউ মহাশ্বেতা হয়ে ওঠে। যাকে চাইলেও চেনার উপায় নেই! আবার চাইলেও তাকে ভোলার উপায় নেই! অনেকটা পায়ে বেঁধা কাঁটার মতো! সামান্য, কিন্তু চলতে গেলে খচখচ করে জানান দেয় তার অস্বিত্ব!
একটা নাম, মহাশ্বেতা।
তুমি চলে গিয়েও থেকে যেতে পারো, তোমার না থাকায় রয়ে যেতেই পারে কথারা, যা বলা হয়েছিল বা বলার অপেক্ষায় ছিল রাখা। মুহূর্তের আকাঙ্ক্ষায়, যা  মেটেনি কখনও, অঝোর শ্রাবণের জলে, ভিজে মাটি, ভিজে গালে, ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশায়, আধখোলা পাপড়িতে, শুকনো ঘাসের বুকে না জমা শিশিরেও থেকে যেতে পারো!
কোনও এক না পড়া গল্পে, না লেখা কবিতায়,
নেশার গন্ধে, তীব্র চাওয়ায়, অধরা স্বপ্নে, বিস্মৃতির অতলেও!
হয়ত এভাবেই থেকে যেতে পারো, গভীরে ভীষণভাবে!


 


1 কমেন্টস্:

  1. খুব সুন্দর গল্প। লেখিকার আরও গল্প পড়ার ইচ্ছে রইল।

    উত্তরমুছুন