কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

সুবল দত্ত

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৮


কালোসুতো   

আমার সাথে হাঁটছে এই পালোয়ান লোকটা? আমার হালের বন্ধু। আমি দুর্বল। ওর দেহ অহঙ্কারে ফেটে পড়ছে। হাঁটছে তো পিচরোডেই দমদম শব্দ। ওর ডান পায়ে একটা কড়ি পরানো কালোসুতো বাঁধা। জিজ্ঞেস করতেই ওর রাজস্থানী গোঁফ কাঁপিয়ে গম্ভীর উত্তর, আর বোলো না। কয়েকদিন ধরে টের পাচ্ছি আমার এই দেহ মন্দিরে কারো নজর লাগছে। আরে? হাসি পাচ্ছে? তা তুমি কী বুঝবে শরীরের মর্ম! হাড়গিলে অসুস্থ। তোমাকে কে আর খাবে? আমাকে ঠিক কেউ  খাবার তালে আছে। কী? তুমি বলছ আমার দুর্বল মন? ওই... ওই সামনে তাকিয়ে দেখ, গাড়ি থেকে নামছে লোকটা! ওকে সেলাম ঠুকছে কজন! নিশ্চয়ই  ভিআইপি। দেখ ও প্যান্ট তুলে পা চুলকোচ্ছে। ওর পায়ে কালোদড়ি। আর দেখ, দেওয়াল ঘেঁষে ভিখিরিটা বসে? ওর পোলিও ঠ্যাংএ কালোসুতো। থামো, আরো দেখাচ্ছি। ওই যে হেঁটে যাচ্ছে লালছাতা, লালজুতো লালমিডিস্কার্ট পরা মেয়েটা? পায়ে দেখনসই কালোদড়ি। এমনি প্রচুর প্রচুর পাবে।

-হুঁ হুঁ বাবা! এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। যে কেউ যে কোনো  মানুষকে নজর দিয়ে খেয়ে ফেলতে পারে। ভায়া বাঁচতে চাও তো কালোসুতো কেনো আর পরো। চলো আজই তোমার সুরক্ষার ব্যবস্থা করছি।

আমাকে প্রায় হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল বাজারের ফুটপাথের এক কোণায়।  দেখি জড়িবুটি টোটকা ওষুধ বিক্রেতা এক ফকির। খুব ভিড়। ঠেলাঠেলি। পালোয়ান বন্ধু ঠিক গুঁতোগুতি করে একটা কালোসুতো কিনে আমার হাতে দিল।

-এটা আজই স্নান সেরে ভক্তি ভরে পরে ফেল। তোমার ভাল, আমারও।

ঘরমুখো আমি। ফিরতি পথে হঠাৎ টের পেলাম আমার চরিত্র বদলে গেছে। কিছুক্ষণ আগে অব্দি মানুষের মুখের দিকে তাকাতাম, হাসতাম, উইশ করতাম। এখন সবার পায়ের দিকে অবধারিত নজর। আর আশ্চর্য! ময়দানের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম প্রায় প্রত্যেকের পায়ে ওই কালোসুতো। কয়েকদিন আগে অব্দি সবার মুখে মাস্ক ছিল। ভাবতাম বুঝি এও জীবনে পরিধানের অঙ্গ হলো বুঝি। তা এখন আর নেই, কিন্তু এই কালো মানসিক দড়ি কী আর খুলবে  মানুষ? ওই যে প্যারাম্বুলেটরে তিন মাসের বাচ্চার পায়ে, তার মা বাপ সব্বার পায়ে! কেন এত অবিশ্বাস হঠাৎ করে ভাইরাসের মত ছড়িয়ে গেল? তবে আমার গর্ভবতী বউ, বাবা মা? তাদের কী হবে?

আমি ঘরে ঢুকতেই মা এসে বললো, কোথায় ছিলি? আসন্নপ্রসবা বউকে ছেড়ে যাওয়া উচিত নয়। ঘণ্টাদুয়েক আগে ওর ব্যথা উঠেছিল। পাড়ার ওরা সবাই হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

আমি উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়লাম হাসপাতালে। বউ এখন লেবার রুমে। করিডোরে পেশেণ্ট নার্সের আনাগোনা। প্রত্যেকের পায়ে কালোসুতো। আমার অজান্তেই পৃথিবী হঠাৎ করে বদলে গেল? কোনো অদৃশ্য ঘাতক প্রেতাত্মা ক্ষতিসাধনায় তান্ত্রিক কিছু নয়, মানুষ মানুষের প্রতি এক অজানা অবিশ্বাস, ভয়!

লেবার রুম থেকে সদ্যজাত আমার শিশুপুত্রকে কোলে করে নার্স বেরলো। শিশুর পায়ে কালোসুতো বাঁধা। রক্ত লেগে আছে।    

 

    

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন