সিনেমার পৃথিবী – ২০
ইউরোপ এশিয়া ছেড়ে এবার লাতিন আমেরিকা। চিনের পর লাতিন আমেরিকা ধরলাম এক বিশেষ কারণে। চিনের সিনেমায় যেটার অভাব ছিল – সাহস, সেটার ভরপুর প্রয়োগ আপনারা দেখতে পাবেন লাতিন সিনেমায়। থিম, গল্প, চরিত্রায়ন – সবেতেই। ফলে আমার মনে হল এই সুযোগ, আপনারা দেখুন বৈপরীত্য কীভাবে ফুটে ওঠে। ছবির বাছাই সেভাবেই করা হয়েছে। তবে শুরুতেই একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে রাখা ভাল। লাতিন আমেরিকা মূলত ইউরোপের ঔপনিবেশিক দেশগুলোর ঘাঁটি হবার জন্য এখানে এখনো প্রধান তিনটি ভাষা হলঃ স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং ফ্রেঞ্চ। এখানকার বেশিরভাগ ছবি এইসব ভাষাতেই কিন্তু তৈরি হয়। খুব কম ছবিই আছে যেগুলো এখানকার পুরনো নেটিভ ভাষা নিয়ে বানানো হয়। সেজন্য আমি আমার বাছাই ২০টার প্রতিটি সিনেমার ভেতরে ভাষাও উল্লেখ করে দিলাম।
দ্য ইয়ং অ্যান্ড ড্যাম্ড (১৯৫০, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ), মাকারিও (১৯৬০, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ), ডেথ অব আ বুরোক্র্যাট (১৯৬৬, কিউবা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), এন্ট্রান্সড আর্থ (১৯৬৭, ব্রাজিল, ভাষাঃ পর্তুগিজ), দ্য প্লেস উইদাউট লিমিটস্ (১৯৭৮, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ), ডার্ক সাইড অব দ্য হার্ট (১৯৯২, আর্জেন্টিনা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), স্ট্রবেরি অ্যান্ড চকোলেট (১৯৯৪, কিউবা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), সেন্ট্রাল স্টেশন (১৯৯৮, ব্রাজিল, ভাষাঃ পর্তুগিজ), দ্য রোজ সেলার (১৯৯৮, কলম্বিয়া, ভাষাঃ স্প্যানিশ), লাভ ইজ আ বিচ (২০০০, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ), অ্যান্ড ইয়োর মাদার টু (২০০১, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ), সন অব দ্য ব্রাইড (২০০১, আর্জেন্টিনা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), সিটি অব গড (২০০২, ব্রাজিল, ভাষাঃ পর্তুগিজ), সাইলেন্ট লাইট (২০০৭, মেক্সিকো, ভাষাঃ জার্মান), দ্য মেইড (২০০৯, চিলি, ভাষাঃ স্প্যানিশ), দ্য সিক্রেট ইন দেয়ার আইজ (২০০৯, আর্জেন্টিনা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), নো (২০১২, চিলি, ভাষাঃ স্প্যানিশ, ইংলিশ), ওয়াইল্ড টেলস্ (২০১৪, আর্জেন্টিনা, ভাষাঃ স্প্যানিশ), অ্যাকোয়ারিয়াস (২০১৬, ব্রাজিল, ভাষাঃ পর্তুগিজ), রোমা (২০১৮, মেক্সিকো, ভাষাঃ স্প্যানিশ)।
তাহলে কী কী দেশের কতগুলো ছবি আমরা এখানে পাচ্ছি? ব্রাজিল – ৪, আর্জেন্টিনা – ৪, মেক্সিকো – ৭, চিলি – ২, কিউবা – ২, কলম্বিয়া – ১। এবং সবেতেই স্প্যানিশ ভাষার আধিক্য, তাই না? এবার এর ভেতর থেকে বেছে নেব আজকের আলোচনার জন্য মাত্র ৭খানা ছবি - দ্য ইয়ং অ্যান্ড ড্যাম্ড, ডেথ অব আ বুরোক্র্যাট, ডার্ক সাইড অব দ্য হার্ট, লাভ ইজ আ বিচ, সিটি অব গড, নো, রোমা। তাহলে বুনুয়েল ও কোয়ারনের দেশ মেক্সিকোকে সামনে রেখে বাকি প্রায় সব দেশের ছবিকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে।
লুই বুনুয়েলের ৭৬ মিনিটের ছবি ‘দ্য ইয়ং অ্যান্ড ড্যাম্ড’ বেশ কয়েকটা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। মেক্সিকো শহরের বস্তির দারিদ্র থেকে উঠে আসা টিনেজাররাও কীভাবে অপরাধ জগতে মিশে যায়, সেই সামাজিক অভিশাপ এই সিনেমার প্রতি রিলে। এই ছবি নিয়ে মেক্সিকোয় এত হৈ-চৈ হয়েছিল যে সরকার বাধ্য হয়ে ছবি রিলিজের তিনদিনের মাথায় এই সিনেমা বন্ধ করে দেয়। অবশ্য ছ’মাস পর আবার সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। তবে বুনুয়েলের সিনেমা, সুতরাং সামাজিক বাস্তবের মাঝে মাঝেই পরাবাস্তব উঠে এসেছে ছবিতে। আবার অনেকে বলে থাকেন, এই ছবিতে বুনুয়েলের আগের সিনেমা ‘ল্যান্ড উইদাউট ব্রেড’ এর ছায়া ফুটে উঠেছে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। কিন্তু যেটা না বললেই নয়, তা হল, এরপর আমরা যখন ‘লাভ ইজ আ বিচ’ বা ‘সিটি অব গড’ নিয়ে আলোচনা করব, তখন এই সিনেমার প্রভাব আমরা কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারব না।
ছবি শুরু হচ্ছে অজানা এক বস্তির ছেলেদের লিডার এল হাইবোর জেল থেকে ছাড়া পাবার দৃশ্যে। ছাড়া পেয়ে সে আবার সেই বস্তির ছেলেদের মাঝে গিয়ে নিজের গ্যাং চালাতে শুরু করে, রাস্তায় লুটপাট রাহাজানি শুরু করে। পেড্রো নামক এক টিনেজারের সাহায্যে এল হাইবো জুলিয়ানকে খুঁজে বের করে যে তাকে জেলে পাঠিয়েছিল। এবং জুলিয়ানকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করে। এদিকে পেড্রোর মা ছেলের এই অধঃপতন দেখে তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। পেড্রো মায়ের আচরণ দেখে দুঃখ পেয়ে নিজেকে শোধরাবার চেষ্টা করে কিন্তু এল হাইবো তাকে চুরির কেসে ফাঁসিয়ে দেয়। পেড্রোর জেল হয়। ফিরে আসার পর এল হাইবো তাকেও খুন করে। এবং পুলিশের হাত থেকে পালাতে না পেরে পুলিশের গুলিতে মারা যায়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় পেড্রোর মা পেড্রোকে পাগলের মত খুঁজে চলেছে। সে তখনো জানে না পেড্রো খুন হয়ে গেছে। খুব কমখরচের সিনেমা। কারণ ছবিতে অভিনয়ের জন্য বস্তির ও রাস্তার ছেলেদের ব্যবহার করা হয়েছিল। কর্কশ কিন্তু চিন্তার খোরাক জোগানো ছবি। এবং সাদা কালো ক্যামেরার কাজ, বুনুয়েলের সিনেমা মানেই, অসাধারণ।
কিউবার পরিচালক টমাস গুতিয়ারেজ আলেয়া-র ৮৫ মিনিটের ‘ডেথ অব আ বুরোক্র্যাট’ একটু অন্য ঘরানার ছবি। রাজনৈতিক স্যাটায়ার। এই সিনেমা কিউবার রাজনৈতিক ইতিহাসের সামাজিক উত্থান-পতনের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। অবশ্য পরিচালক আলেয়ার ভাষায় উনি এই সিনেমা বানিয়েছিলেন নেহাত মজা করার জন্য - “However, I have to say that I don’t have much faith in the efficacy of satire as a ‘driving force of history’. When making film we thought that we are laughing at the bureaucrats, but then the bureaucrats will come and not only will the film make them laugh, but they will laugh at themselves.”
কিউবার এক রাজনৈতিক নেতা মারা যাবার পর ভুল করে তাকে তার ইউনিয়ন কার্ড সমেত কবর দেওয়া হয়। কিন্তু সেই কার্ড তার বিধবা বউয়ের দরকার, না হলে সে সামাজিক সুযোগ সুবিধে থেকে বঞ্চিত হবে। এদিকে কিউবার আইন খুব শক্ত – একবার কবর দিলে তার দু’বছরের ভেতর সেই শবদেহ বাইরে বের করে আনা যায় না। অগত্যা সেই মৃত নেতার ভাইপো দু’জন চোরকে কাজে লাগায় রাতের অন্ধকারে সবার অলক্ষ্যে মৃতদেহ তুলে আনার জন্য। কিন্তু মৃতদেহের কফিনে যে রেড টেপ থাকে, সেটা খুলে নেওয়ার পর সেটা জোড়া যায় না, ফলে মৃতদেহ আর কবর দেবার সুযোগ থাকে না। সেই নিয়ে শুরু হয় গন্ডগোল। হাসির দৃশ্যায়ন। এবং এক খুন। ‘ডেথ অব আ বুরোক্র্যাট’কে দুর্দান্ত সিনেমা বললে কম বলা হবে। সাহসী তো বটেই, নাহলে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ কমিউনিজম এবং তার রেড টেপ নিয়ে এমন মজা করতে সাহস পায়!
এলিসিও সুবিয়েলার দু’ঘন্টা সাত মিনিটের দীর্ঘ সিনেমা ‘ডার্ক সাইড অব দ্য হার্ট’ মূলত কবিতা ও জাদুবাস্তবতার মিশ্রণ। আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এয়ার্সে এক তরুণ কবি থাকেন। সেই কবি উরুগুয়ে বেড়াতে গিয়ে এক যৌনকর্মীর প্রেমে পড়ার পর তাদের উদ্দাম ভালবাসার গল্প। এবং ফ্রেম থেকে ফ্রেমে সেক্স ও কবিতা পাঠের ফিউশন। এমন কিছু অদ্ভুত কবিতা যা পিকাসোকে মনে পড়িয়ে দেয় - “Don’t stay motionless by the roadside/ Don’t freeze the joy/ Don’t love reluctantly/ Don’t save yourself/ Now or ever/ Don’t fill yourself with calm/ Don’t book in the world/ Just a quiet corner/ Don’t lower the eyelids/ Heavy as judgments/ Don’t stand without lips/ Don’t sleep without sleep…”
অলিভিয়ারো নামক এক তরুণ কবি, যাকে নিজের পেট চালানোর জন্য মাঝে মাঝেই অ্যাড এজেন্সির কাছে নিজের শিল্প ও কবিতা বেচে দিতে হয়, একবার উরুগুয়ে বেড়াতে গিয়ে আনা নামক এক সুন্দরী যৌনকর্মীর প্রেমে পড়ে। আনা কবিতা ভালবাসে। অলিভিয়ারো নিজের সুররিয়েল জগতে থাকতে ভালবাসে। সে প্রতি নারীর পিঠে ডানা খোঁজে, উড়তে পারে কিনা দেখে। বিছানায় কোন নারীর পিঠে ডানা না দেখলে সে খাটের অন্যদিকের হাতল ঘুরিয়ে তাকে অতলে ফেলে দেয়। সে আনার পিঠে ডানা খুঁজে পায়, উদ্দাম ভালবাসা খুঁজে পায়। ঠিক যেন ম্যাজিক। অন্যদিকে আরেক মহিলার প্রতিও অলিভিয়ারো আকৃষ্ট যার নাম মৃত্যু। সে কবিকে আস্তে আস্তে মেরে ফেলতে চায়। আর অলিভিয়ারো চায় আনার সঙ্গে অনন্ত যৌনতা। অবশেষে সে তার হৃদয় খুলে আনার সামনে তুলে ধরে। কিন্তু আনার সেই হৃদয়ে নয়, টাকায় লক্ষ্য।
এই সিনেমা প্রথম দেখেছিলাম রাজেশের বাড়ি। সেটা খুব সম্ভব ১৯৯৯। তখনো যাদবপুরে মাস্টার্স করছি। আমি, রাজেশ আর মোটা। স্বাভাবিকভাবে, সেই সময় ঐ সিনেমা দেখে তরুণ কবি হিসেব খুব চার্জড হয়েছিলাম। যৌনতা দেখে, সাহসী কবিতার পদক্ষেপ দেখে। কিন্তু তখন কিছুই বুঝিনি। অনেক পরে গুয়াহাটিতে একা বসে এই সিনেমা রিওয়াইন্ড করে করে দেখে বুঝেছিলাম কেন এটা কাল্ট সিনেমা, কেন এর ক্যামেরায় এত অন্ধকার, কী সেই ফ্যান্টাসি যা এক কবিকে পরাবস্তবতা আর জাদুবাস্তবতার মাঝে দাঁড় করিয়ে রাখে। জাগিয়ে রাখে। তার হৃদয় নিজে হাতে খুলে আনতে বাধ্য করে। জীবনানন্দ কি তার কবিতায় সেইসব অস্থিরতার কথা বলেননি?
মেক্সিকান পরিচালক আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজের প্রথম ফিচার ছবি ‘লাভ ইজ আ বিচ’। মনস্তাত্বিক ড্রামা। গঞ্জালেজের ডেথ ট্রিলজির প্রথম ছবি। পরের দুটো হল – ‘21 গ্রামস’ এবং ‘ব্যাবেল’। প্রায় আড়াই ঘন্টার এই সিনেমায় তিনটে আলাদা গল্পের ভেতর দিয়ে পশু ও অন্যান্য মানুষের প্রতি মানুষের নৃশংসতা দেখানো হয়েছে। এবং প্রতিবার পশু হিসেবে কুকুর দেখানো হয়েছে বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবে।
তিনটে আলাদা গল্প, জোড়া হয়েছে মেক্সিকোয় কোন এক গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের মাধ্যমে। বস্তির এক টিনেজার যে ডগফাইটিং পছন্দ করে, এক উঠতি মডেল যার পায়ে দুর্ঘটনা ঘটে, এবং এক অজ্ঞাত আততায়ী। এদের নিয়ে তিন গল্প। বস্তির টিনেজার অক্টাভিও নিজের দাদার বৌ সুসানা-কে মনে মনে ভালবাসে, তাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সুসানা একদিন অক্টাভিওর টাকা নিয়ে তার বরের সঙ্গেই পালিয়ে যায়। ওদিকে এক উঠতি মডেল ভ্যালেরিয়া তার ভালবাসার মানুষ ড্যানিয়েলকে নিয়ে নতুন এক ফ্ল্যাটে চলে যায়। আবার এক পেশাদার আততায়ী এল শিভো, যে নিজের ছেড়ে আসা মেয়েকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, এক ব্যবসায়ীকে মারতে চলেছে। ঠিক সেই সময় অক্টাভিওর গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট এদের সবার জীবন বদলে দেয়। এল শিভো ব্যবসায়ীকে মারতে না পেরে অক্টাভিও-র আহত কুকুরকে গাড়ি থেকে তুলে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। ভ্যালেরিয়ার পা ভেঙে গিয়ে সে সারাজীবনের মত মডেলিং থেকে ছিটকে যায়। এবং ড্যানিয়েল তাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের স্ত্রীর কাছে আবার ফিরে যায়। সুসানা, তার বর মারা যাবার পরেও, অক্টাভিওর কাছে আর ফিরে আসে না। গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের কিছুদিন পর এরা সবাই বুঝতে পারে প্রকৃত ভালবাসা বলে কিছু হয় না। এই সিনেমার প্রতি গল্পে নৃশংসতা লুকিয়ে, বিশেষ করে ডগ ফাইট যা নিয়ে এই ছবিকে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু সিনেমার বহমান গল্প দর্শককে আড়াই ঘন্টা বসিয়ে রাখতে সক্ষম। বুনুয়েলের ধাঁচে। আর সেখানেই এই ছবির মুন্সিয়ানা।
‘সিটি অব গড’ ব্রাজিলের অন্যতম সেরা ছবি, যা ষাটের দশক থেকে আশির দশক অব্ধি ব্রাজিলের অপরাধজগৎ প্রায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ১৯৯৭ সালের এক উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে ১৩০ মিনিটের এই ছবির পরিচালক দুজন – ফার্নান্দো মিরেলিস এবং কাটিয়া লান্ড। এই সিনেমা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ দুটো কারণে। এক, বস্তির ক্লোজ সিনেমাটোগ্রাফি এবং প্যানোরামিক দৃশ্য কীভাবে মেলানো যায়, পরিচালক তা দেখিয়েছেন। দুই, দৃশ্য থেকে দৃশ্যে যাবার সময়ের যে মসৃণ এডিটিং, তা আজকালকার উঠতি পরিচালকদের শেখা দরকার। এছাড়াও প্রাণশক্তিতে ভরপুর স্ক্রীনপ্লে এবং সাহসী-শক্তিশালী উপস্থাপনা।
ষাটের দশকের এক ফাভেলা, ছোট্ট এক হাউজিং বস্তি ‘সিটি অব গড’, যেখানে তিনজন টিনেজ ছিঁচকে চোর – শেগি, ক্লিপার আর গুজ আস্তে আস্তে ডন আর ডাকাত হয়ে উঠছে, সেই ফাভেলা সত্তরের দশকে এক কংক্রীটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। প্রচুর জনবসতি। অপরাধ বেড়ে গেছে। সেদিনের সেইসব ছোট ছেলেরা ড্রাগ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের আলাদা আলাদা গ্রুপ হয়ে গেছে। আশির দশকে তাদের নিজেদের ভেতর খুন জখমের প্রভাবে আবার সেখানে উঠে আসছে ছোট ছোট টিনেজ ছেলেদের দল। তারা অপরাধী হয়ে উঠছে, হাতে পিস্তল। খুন করতে পিছপা নয়। ‘দ্য ইয়ং অ্যান্ড ড্যাম্ড’-এর যেন আক্ষরিক ও আধুনিক পর্তুগিজ অনুবাদ। এই সিনেমাকে আমি দশে দশ দেব।
চিলির পরিচালক পাবলো ল্যারেইন-এর প্রায় দু’ঘন্টার ছবি ‘নো’ এক রাজনৈতিক সাসপেন্স। দেখলে হঠাৎ আমাদের রাজ্যের ভোটকুশলী পিকে-র কথা মনে পড়তে বাধ্য। এই সিনেমার এক বিশেষত্ব হল, ল্যারেইন এখানে থ্রি কোয়ার্টার ইঞ্চি ইউ-ম্যাটিক ম্যাগনেটিক টেপ (পাতি আগেকার দিনের থ্রি-ফোর্থ ইঞ্চি ভিডিও ক্যাসেট) ব্যবহার করেছিলেন। কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন যাতে এই সিনেমা সর্বসাধারণের মাঝে কম দামে ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
প্রায় পনেরো বছরের একনায়কতন্ত্র শেষ করে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে চিলির একনায়ক জেনেরাল অগাস্তো পিনোশে ১৯৮৮ সালে জনসাধারণের ভোটের মুখোমুখি হবেন। এই ভোট নির্ধারণ করবে উনি আগামী আট বছর ক্ষমতায় থাকবেন কিনা। জেনেরালের বিরোধীপক্ষের নেতারা সাভান্দ্রা নামক এক অ্যাডনিপুণ ভোটকুশলীকে নিয়োগ করে যাতে পিনোশে কিছুতেই আর ক্ষমতায় না ফেরেন। সেই নিয়ে ‘নো’ সিনেমা। কি, পিকে-র কথা মনে পড়ল তো? দাঁড়ান, এই সিনেমা তার থেকে আরেকটু এগিয়ে। সাভান্দ্রা বুঝতে পারে সেই মিলিটারির দেশে কাঠখোট্টা সংখ্যাতত্বের ক্যাম্পেন করে কোন লাভ নেই। বরং প্রতিদিন যদি বিভিন্ন বিষয়ের মানুষদের দিয়ে বিনোদন ও আনন্দমূলক ক্রিয়েটিভ ক্যাম্পেন করা যায় এবং মিলিটারির ভীতি দূর করা যায়, তাহলে সাধারণের কাছে ‘নো’ বার্তা পৌঁছতে বেশি সুবিধে হবে। এদিকে সাভান্দ্রার বস তার এই গোপন কার্যকলাপ জেনে গিয়ে তাকে চাপ দেয় এই ক্যাম্পেন ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য। ব্যর্থ হয়ে তার বস জেনেরাল পিনোশের চাপে পড়ে শেষে নিজেই ‘ইয়েস’ ক্যাম্পেন করার জন্য নিজের টিম তৈরি করে ফেলে। একদিকে ‘নো’ ক্যাম্পেন, অন্যদিকে ‘ইয়েস’ ক্যাম্পেন। ২৭ রাত চিলির টিভিতে দু’পক্ষের এই ক্যাম্পেন সম্প্রচার করা হয়। অবশেষে ‘নো’ ক্যাম্পেনের জয় হয়, একনায়কতন্ত্রের অবসান। নতুন স্বাধীন চিলি তৈরি হবার পর দেখা যায় সাভান্দ্রা আর তার বস আবার নতুন নতুন অ্যাড তৈরি শুরু করেছে, যেটা তাদের স্বাভাবিক পেশা।
শুরু করেছিলাম মেক্সিকোর লুই বুনুয়েল-কে দিয়ে (অবশ্য বুনুয়েল স্প্যানিশ পরিচালক বললেই বেশি মানানসই হয়), শেষ-ও করব মেক্সিকোর আরেক পরিচালককে দিয়ে। আলফোনসো কোয়ারন। এবং তাঁর বিখ্যাত সিনেমা ‘রোমা’। কোয়ারনের আধা আত্মজীবনী। দু’ঘন্টা পনেরো মিনিটে সেলুলয়েডের পর্দায় ফুটে ওঠা সাদা-কালোয় এক অনবদ্য সিনেমাটোগ্রাফি। অবশ্য বলে রাখা ভাল যে এই সিনেমা মেক্সিকো ও হলিউডের যৌথ প্রযোজনা।
সত্তরের দশকে ক্লিও নামক এক পরিচারিকা এক উচ্চবিত্ত পরিবারের সঙ্গে তাদের বাড়িতে থাকে। বাবা, মা, ঠাকুমা এবং চার বাচ্চা – এই নিয়ে পরিবার। ক্লিওর প্রেমিক আছে এবং তাদের শারীরিক সম্পর্কও আছে। সেই সম্পর্ক থেকে ক্লিও গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এদিকে, সেই উচ্চবিত্ত পরিবারের বাবা ডাক্তারির ছলে অন্য জায়গায় যাবার নাম করে নিজের প্রেমিকার সঙ্গে ঘর ছেড়ে চলে যায়। মা নিজের চার সন্তানকে এবং ক্লিওকে নিয়ে এক জায়গায় বেড়াতে যাবে বলে স্থির করে। ফিরে আসার পর কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে ক্লিও এক মৃত সন্তান প্রসব করে। আবার তারা সবাই সমুদ্রে বেড়াতে যায়। সেখানে গিয়ে সেই পরিবারের মা তার চার বাচ্চা ও ক্লিওকে ডেকে বলে দেয় যে তাদের বাবার সঙ্গে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তারপর নিজেদের মত সি-বিচে আনন্দে মেতে ওঠে।
গল্পের ধরন থেকে বোঝা যায় যে এটা কোয়ারনের ছেলেবেলার ব্যক্তিগত গল্প, সেজন্য এত ইমোশনাল। কিন্তু এটাও ঠিক যে শুধু ইমোশনাল গল্প দিয়ে মাস্টারপিস হয় না। তাহলে? মনে করে দেখুন ইতালির নব্য-বাস্তব সিনেমায় ফেলিনির ছবিগুলো। লা ডোলচে ভিটা, এইট অ্যান্ড হাফ – সেলুলয়েডে জীবন ফুটিয়ে তোলা। ফেলিনির ‘রোমা’ (১৯৭২) দেখুন। পরিচালক হিসেবে প্রথম যখন উনি ইতালিতে এসেছিলেন, মুসোলিনির সময়ে। জীবনের প্রথম দিকের গড়ে ওঠার সময়টা। কোয়ারনের ‘রোমা’, ফেলিনির সেই ‘রোমা’র প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। সাদা- কালোয় নব্য-বাস্তব জীবনের উপাখ্যান ফুটিয়ে তোলা, খানিক ব্যক্তিগত, খানিক ডকু, জীবনের ওঠানামার মাঝে শুরুর দিক থেকে পরিণত হয়ে ওঠা। সূক্ষ্মভাবে এক ক্লাস ডিভিসন, উচ্চ ও নিম্নবিত্ত। এটাই লাতিন আমেরিকার নব্য-বাস্তবতা। সেজন্যই কোয়ারনের ‘রোমা’ এক মাস্টারপিস।
পরিশেষে, আর এক সিনেমা, ইচ্ছে থাকলে দেখুন। গুয়াতেমালার পরিচালক বাস্তামান্তের ছবি ‘ইকানুল’ (দ্য ভলক্যানো, ২০১৫)। কাকচিকেল ভাষায় বানানো। এই ভাষা মায়া সভ্যতার ক্ষয়িষ্ণু ভাষা, টিমটিম করে মাত্র কিছু সংখ্যক গুয়াতেমালার আদিবাসীদের ভেতর এখনো কথ্য হিসেবে রয়েছে। সেই ভাষায় এক সুররিয়েল ছবি।
আজ শেষ করি এই লেখার খানিক ইতিহাস টেনে। এই ধারাবাহিকে আমরা হলিউডের ক্লাসিক নিয়ে আলোচনা করেছি, সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বের। এছাড়াও আর্ট হাউজ, এক্সপেরিমেন্টাল ছবি। আবার এশিয়া মহাদেশ থেকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, চিন; ইউরোপ থেকে ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, ব্রিটেন, জার্মানি, রাশিয়া; উত্তর ও দক্ষিন আফ্রিকা; লাতিন আমেরিকার মেক্সিকো, চিলি, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা – প্রায় সব মহাদেশ থেকেই আলোচনা করেছি। বাকি রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। আর কিছু সংখ্যক বাছাই দেশ, যেমন বার্গম্যানের সুইডেন, যেগুলো আমরা পরে কোন এক সময় ফিরে দেখব। তাহলে এবার কয়েকটা পর্বে আমার বাছাই কিছু নায়ক, নায়িকা আর পরিচালককে নিয়ে একটু চর্বি চিবোনো যাক। কেমন! তারপর আবার পৃথিবী ঘুরতে বেরোব।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন