সমকালীন ছোটগল্প |
টকর টকর
তখনো নিশুতিভোর। ভোরের নিশুতি। ডালপাতাকে
পাশবালিশ বানিয়ে নিঃসারে ঘুম দিচ্ছে গাছের কাক। দুমদাম শব্দ করে আমাদের বাড়ি কাজে লেগে
পড়ত বুড়ো। কোনো এক শীতের ভোরে বুড়োকে যেদিন প্রথম দেখি স্রেফ আঁতকে উঠেছিলাম। নাম বুড়ো অথচ নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে আছে একটি
ডালিমছাঁট চুলের মেয়ে। কী বলব - মাথার প্রত্যেকটা
চুল তার সমান ছুঁচলো। মিষ্টির গোল্লা তার চোখ। গায়ে একটা বিশাল গন্ধযুক্ত চাদর। তাতে
বড় বড় ফুটো। প্রতিটা ফুটোয় নিখুঁতভাবে সেফটিপিন লাগানো। অনেক ফুটোয় অনেক সেফটিপিন।
পায়ের পাতা থেকে শুরু করে বুড়োর চাদর শেষ হতো
ঠোঁটের ওপর - যেখান থেকে পুরুষমানুষের গোঁফ তৈরি শুরু হয়।
দেখলাম কিডনির রোগে ভুগে ভুগে বড় ঝুঁকে বেঁকে গেছে সে। তবু প্রথম দেখাতেই বড়ো ভালোবাসায়
ডেকে ফেললাম বুড়োসুন্দরী। সে বাচ্চাকালে দুই বাচ্চার ভালোবাসার মানে যা দাঁড়ায়
তেমনটাই ভালবাসলাম আমার সুন্দরীবুড়োকে। আমার
বুড়োপ্রেমের অনেকটাই ছিল ফ্রী টাইমে তাকে দিয়ে কিছু ফালতু খাটানোর মতলবে। আমি দশ, আর বুড়ো বারো। ধরেই নিলাম, দু দু বছরের বড় বলে
বুড়োরই কাজের বল বেশি। কাজের হকটাও তারই। সকালবেলা আমাদের বাড়ি ঢুকে বুড়োর প্রথম কাজ
এঁটো বাসন পেটানো। এত জোরে আওয়াজ করে বাসন মাজত যে আমরা বলতাম, ঐ দেখো বুড়ো এসেই বাসন
পেটাতে লেগেছে। ঝাড়ু দেয়ার সময়ও ঐ একইরকম। তার ঝাঁটার ঘষঘষ শব্দে মনে হত, ঝেঁটিয়ে ঝেঁটিয়ে বাড়িসুদ্ধু সবাইকে বুঝি
দূর করে দেবে বুড়ো। লক্ষ্য করলাম, শব্দ ছাড়া মোটে থাকতেই পারে না সে।
একদিন কথায় কথায় বুড়োর মা জানাল, ডাক্তার
বলেছে কদিন বাদেই মরবে বুড়ো। আর বলে ফেলেছে বুড়োর সামনেই। যেই না এসব শুনেছে বুড়ো সেদিন
থেকেই নাকি শব্দে খুব প্রেম জমেছে তার, শব্দ ছাড়া বুড়ো বেজার। এরপর থেকে আমি ও আমার মাকে কতদিন মিছামিছি চেঁচিয়ে ঝগড়া
করতে হয়েছে বুড়োকে খুশ রাখতে। আমাদের শব্দের বিনিময়ে বুড়ো আমার হুকুম শুনে যেত দিনভর।
কখনো বলতাম ফুটন্ত জলে বেগুন চুবিয়ে দ্যাখ তো বুড়ো ভাসে কিনা! কখনো এই বুড়ো খুন্তির
আওয়াজ করে করে মেটের লাল ঝোল বানা। কিডনির রোগে তখন বুড়োর মাংস একদম বন্ধ। তবুও দেদার
মেটে খেত বুড়ো। এমন কী কড়া থেকে ঝোলের মেটে
নামিয়েই গনগনে উনুনের পাশে বসে খেতে লাগত।
মৃত্যুর ব্যাপারে বুড়োর এই নির্বিকার
ভাব মোটে সহ্য হত না আমার। রাগ হত। খুব রাগ হত। রাগের চোটে বুড়োকে জাপটে নিতাম বুকে।
তবু শালার খাওয়া থামত না। একসাথে হাফ ডজন চড়
মারতাম। তবুও না। ফলে ধীরে ধীরে রোগা হতে হতে বাচ্চদের লাইন টানা স্কেল হয়ে গেল বুড়ো।
মা আমাদের নিয়ে গেলেন নীলের মেলায়। আমি কিনলাম একটি ফাইন মেমপুতুল। বুড়ো কথা বলা হাত
পা নাড়া পুতুল। নিজে পছন্দ করে। কথা বলিয়ে পুতুলটার কলকব্জা বেশ ভালো করে বুঝেও নিল।
বাসন মাজতে বসে আলসের ওপর পুতুল বসিয়ে রাখতো। কলকব্জা এদিকওদিক হয়ে যেদিন পুতুলটা কথা বলত না,
বুড়োর সে কী মার পুতুলটাকে। মার খেয়ে খেয়ে
স্পঞ্জ নাড়ি চটকে গেল পুতুলটার। একদম বেঢপ হয়ে গেল বুড়োর পুতুল।
একদিন কী মনে হল, হাওয়া খাওয়াবার জন্য বুড়োকে নিয়ে গেলাম আমাদের ঝিলপার্কে। ভাবলাম সাঁঝের শীতল
বাতাস একবার শরীরে ঢুকলে ফের সোজা হবে আমার
বুড়োসুন্দরী। যথারীতি পুতুলটাকে বগলদাবা করে ঝিলের হাওয়া খেতে বসল বুড়ো। তখন সন্ধ্যে ঘনায়। যত বলি, ও বুড়ো আয় আমার
সাথে লাইটের তলায় বস! আমার ভয় লাগছে! বুড়ো দেখি তত চলে যায় ঝোপের ঝুপসি আঁধারে। উঁকি মেরে দেখলাম, আঁধারেই পুতুলটাকে
এন্তার গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে বুড়ো। অন্যদিন পুতুলকে কথা বলানোর জন্য পাগল হয়ে যায় বুড়ো। আর সেদিন যেন কথা বলেই মহাদোষ করে ফেলেছে পুতুল!
বকাবকির পর পুতুলটার কাছে কানমলা দিয়ে মাপও চাইলো। বুড়ো আর বুড়োর পুতুল দুটোকেই বুকে
ঠুসে দৌড়োতে লেগেছি। হাউহাউ করে কান্না আসছে আমার।
-আয় বুড়ো! আয় রে আমার বুড়োসুন্দরী! আমার
সাথে রাস্তার টিউবের নীচে স্টেপ মিলিয়ে চল!
চল চল! পা চালা! আয় আয়! ধেয়ে যাই বাড়ি। ও আমার মা তুই দরজা খুলে রাখ! আমি আর বুড়ো এখনই
ঘর ঢুকব রে মা!
ওমা! দেখি, কেবলি আলো থেকে আঁধারে ঢুকে
যাচ্ছে বুড়ো শয়তান। সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলেছে বুড়ো। একবার লাইটের তলায়, তো পরের স্টেপে
লাইট ছেড়ে আঁধারে। মরো মরো বুড়োর সে কী জোরে জোরে হাসি সেদিন!
কদিন বাদেই মরল বুড়ো। কাঠি কাঠি পা হাত
ছড়িয়ে হদ্দ মরা মরল। তারপর আমিও কত বুড়ো হয়ে গেলাম! রয়ে গেল কেবল পুতুল।
হেথায় হোথায়। কোথাও নিশ্চয়ই। অটুট অবিকল।
সে মরলে যে আরো মুশকিল!
কী অদ্ভুত যে লাগলো ঠিক বলে বোঝানো যায় না। কেমন করে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে বাঁচার আনন্দ শুষে নিতে হয়,যতক্ষণ বাঁচি আনন্দে যেন বাঁচি।
উত্তরমুছুনশরীরের মৃত্যুই কি মৃত্যু ? বুড়ো মরিয়া প্রমাণ করিয়া গেল -- সে মরে নাই । এই ভাবেই তো বেঁচে থাকা স্মৃতিতে ।
উত্তরমুছুনEmni korei beche thaki hoyto aamra !
উত্তরমুছুন