হঠাৎ বসন্ত
পূব হাওয়াতে দেয় দোলা, মরি মরি,
হৃদয়
নদীর কূলে কূলে - জাগে লহরী।
মরি
মরি-
দোলাটা দেখছি, দেখছি, দেখছি। দোল লেগেছে আমার অন্তরে। সামনের সবুজ মখমল ঘাসের ওপর ডাইনিং রুমের জানলা থেকে ছলকে পড়া আলোতে, কেয়ারী করা আহ্লাদী ঝোপঝাডের গাছপালার সর্বাঙ্গে আর পাতায় পাতায় রঙীন আলপনা। রীতার স্নেহধন্য সন্তানদের সারা শরীরে ফুলের বাসরে রামধনু ঝলসাচ্ছে, নিমেষহারা শুকতারার নিস্পলক চাউনী অগ্রাহ্য করেই। মেলাতি (আমাদের যূঁই), আংরেকবুলান (মুন অর্কিড), আংরেকহিতাম (ডার্ক অর্কিড), চেমপাকা (চাঁপা), বোগেনভিলিয়া সবাই রূপ রঙের উন্মুখ উল্লাসে উচ্ছ্বসিত। ঐ পূবালী হাওয়া, আমার দেশের ফেলে আসা স্মৃতির হাল্কা ছোঁয়ায়, অতলান্তিক মহাসাগরের অশান্ত ঢেউয়ে পাল তুলে শিরশিরানি তুলেছে আমার সোহাগী বাগানে। ঢেউ তুলছে আমার অন্দরমহলের অতলে দু’কুল ছাপিয়ে, আর প্রতিটি গাছের ডালে, পাতায়, শিরায় শিরায়। মিতালী চলছে চেনা ফুলগুলির অচেনা নামের সাথে।
চায়ের ধোঁয়াটা যখন পাক দিয়ে অদৃশ্য হওয়ার মুখে, ঠিক তখনই মোবাইলে বেজে উঠলো, ‘আমার মল্লিকাবনে’র আকুল আহ্বান - দূতাবাস থেকে। শ্রী বসন্ত চৌধুরী জাপান থেকে জাকার্তা হয়ে দেশে ফিরবেন, রাষ্ট্রদূত মিস্টার ডেভারা, তাঁকে যথাযোগ্য সম্বর্ধনা দিতে অভিলাষী। এবং যেহেতু আমার কিছু স্বনামধন্যবাঙালী শিল্পী আর বাংলা সংষ্কৃতির সঙ্গে যৎসামান্য ছোঁয়াছুঁয়ি আছে, তাই…
কমিটির কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে রাষ্ট্রদূতের অনুরোধে শ্রীচৌধুরীকে বিমানবন্দরে যথারীতি স্বাগত জানানো হল। ওনার ইচ্ছানুসারে, তাঁকে আমার বাড়িতেই রাখার কথা আগে থেকেই ঠিক ছিল। উনি হয়তো বিদেশে ঘরোয়া পরিবেশটাই বেশি পছন্দ করেন।
আমাদের বসার ঘরে চায়ের আসরটা জমিয়ে শুরু করার তোড়জোড় চলছে, উনি দুধসাদা জমিদারী পান্জাবী আর পাজামা পরে এসে বসলেন। হীরের বোতামে বিদ্যুতের ঝিলিক। বৈঠকের অনিশ্চিত এলেমেলো মেজাজটা মুহূর্তেই পাল্টে গেল রাজসিক বিন্যাসে। শুরু হল নতুন করে কুশল বিনিময়, জাপানের সম্বন্ধে ভাঙ্গা কথাবার্তা আর এদেশের রীতিনীতি, সংস্কৃতিআর দ্রষ্টব্য সম্ভার নিয়। আড্ডার গতিধারাটা মসৃণই ছিলশ, কিন্তু সকলকার মনের গতি প্রকৃতি তো একপথে চলে না।
বিবেক, আমাদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আচমকা বলে বসলো, “আচ্ছা, সত্যজিৎ রায়ের (বাবু-টাবু যোগ না করেই) কোন ছবিতেই আপনাকে কেন দেখিনি বলুন তো? এইরকম পারসোনালিটি আপনার, অভিনয়ক্ষমতা, এই চেহারা? একটু অদ্ভুত লাগে আমাদের”।
এই বিষয়টাই আমি সযত্নে দূরে রাখতে চেয়েছিলাম, মানে সত্যজিতবাবুর সঙ্গে সম্পর্কটা। এই ভদ্রলোক, শুনেছিলাম তাঁর স্ত্রী অসামান্য সুন্দরী শ্রীমতি অলকা চৌধুরীকে সত্যজিতবাবুর চলতি শ্যুটিং থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। সত্যি মিথ্যা জানি না। আর এই ঘটনার আগে বা পরে এই দুই প্রচন্ড ব্যক্তিত্বের মধ্যে কী সমীকরণ ছিল, তাও আমার জানা নেই। চাইছিলাম না এই অপ্রীতিকর আলোচনার ডালা খুলতে। কিন্তু আমার সন্ত্রস্ত দৃষ্টিকে কোন সমীহ না করেই আরেকটা বোমা ফাটালো বিবেক, “তা সত্বেও কিন্তু উনি আপনার অসাধারণ সম্ভার থেকে ওনার ছবিতে ব্যবহারের জন্যে কখনো কখনো শাল-চাদর নিয়েছিলেন, তাই না?”
লম্বা দু তিনটে সেকেন্ড আমার মাথায় এলোপাথাড়ি দাপাদাপি। আমি শঙ্কিত, কারণ উনি সরকারী অতিথি স্বয়ং রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রিত। কীভাবে রিএ্যাক্ট করবেন উনি আমার জানা নেই। কিন্তু ঐ যে বললাম, অভিজাতভদ্রলোক - মনে হল ঠোঁটের বাঁদিকে একটা প্রায় অদৃশ্য চিলতে হাসির আভাস দিয়েই বিবেকের প্রত্যাশিত (সম্ভবত তীক্ষ্ণ) উত্তর এড়িয়ে গেলেন। “আমার সঙ্গে মেলানোর মত কোন চরিত্র সৃষ্টির কথা উনি ভাবেননি নিশ্চয়ই!”
জানলার কাঁচে আলো-আঁধারীতে, মেজেন্টা বোগেনভিলিয়ার দোলাচল দেখতে দেখতে হাল্কাভাবে কথাটাভাসিয়ে দিলেন সেই অতিপরিচিত গভীর, সংযত, ব্যারিটোনে। বিবেক বুঝলো কি না জানি না, আমার কানে কিন্তু একটা সূক্ষ্ম অভিমানের চিহ্ন ছুঁয়ে গিয়েছিল ঐ চাউনি আর বিশুদ্ধ উচ্চারণের ফাঁক দিয়ে।
“তাছাড়া জানেন তো, চরিত্র নির্বাচন আর অতি সূক্ষ্ম ডিটেলগুলোর ওপরেও কি তীক্ষ্ণ নজর ছিল তাঁর। চায়ের কাপের হাতলটা ঠিক কোন এ্যাঙ্গেলে থাকলে সবচেয়ে স্বাভাবিক দেখাবে, সেটাও। দাঁড়িয়ে একরকম, আর বসে থাকলে অন্যদিকে। আর শাল চাদর? ওতে তো চরিত্রের সমস্ত ব্যক্তিত্ব নির্ভর করে, চরিত্রটাকে প্রথমেই ছেঁকে তুলে এনে দর্শকদের মনে একটা গভীর ছাপ ফেলে দেয়, গ্রহণযোগ্য করে তোলে প্রথম দর্শনেই”।
মনে পড়ছে, অনেক বছর পরে আমাদের কলকাতার বাড়িতে সৌমিত্রদাকে নির্ভয়ে, আমি এই ধরনেরই একটা প্রশ্ন করেছিলাম, ‘নায়ক’ ছবিতে তিনি কেন নির্বাচিত হলেন না! অদ্ভুত সরল হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলেছিলেন, “আরে অম্লান, জানো না? বাংলাদেশে নায়ক বলতে ঐ একজনকেই বোঝায়”। বিশেষ জোর দিয়ে ‘ঐ একজন’ বলার সময়েও তাঁর মুখের অমলিন হাসির কোন পরিবর্তন দেখিনি।
ডুবন্ত অবস্হা থেকে আমাকে পাড়ে টেনে তুলল রীতা। দুটো বাহারী ছড়ানো প্লেটে ঠিক তখনই , সেই সামুদ্রিক মাছভাজা হোয়াইট সস্ আর সম্বর দিয়ে আর ইন্দোনেশীয়ান ‘সাতে আয়াম’, বাদামের পেস্ট মাখিয়ে টেবিলে নামালো। “নিন দেখুন তো, কেমন লাগে আপনার এই দেশের রান্নাঘর?” সাতেটার দিকে ওনার একটু অনির্দিষ্ট জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখেই রীতা বলে দিল, “ওটা মুর্গীর নরম মাংস কয়লার আগুনে পুডিয়ে বানানো, স্হানীয় জনপ্রিয় খাবার”। বেশীরভাগ সময়েই এই জাতীয় বিপজ্জনক অপ্রীতিকর আবহাওয়া থেকে আমার পরিত্রাতা হয়ে হঠাৎ হঠাৎ আবির্ভূতা হয়েছে সে, নিজের অজান্তেই অবশ্য। আমার নিজের ক্যারিশমা বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আমিও কোনদিন ওকে বলিনি এসব।
এইবারও খড়কুটো আঁকডে ভেসে ওঠার সুযোগটা ছাড়ার কোন প্রশ্নই নেই! বিবেককে আর কোন সময় না দিয়ে এই ঘূর্ণীর পাক থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য বসন্তবাবু আর কিছু বলার আগেই, একটু দৃষ্টিকটুভাবেই হয়ত একেবারে ছায়াছবির মেইন স্ট্রীমে ঝাঁপ দিলাম, “বসন্তবাবু, আপনি তো বাংলা হিন্দী মিলিয়ে প্রায় সত্তর আশীটি ছায়াছবি আমাদের উপহার দিয়েছেন। আপনার নিজের নিশ্চয়ই কোন কোন উল্লেখযোগ্য ছবি বিশেষভাবে মনে আছে?”
“হ্যাঁ, সে তো বটেই। প্রথমেই বলব, ‘রাজা রামমোহন’ - বি এফ্ জে এ এই ছবিতে আমাকে পুরস্কার দিয়েছিলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর হাত দিয়ে, সে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। অবিশ্বাস্য ব্যক্তিত্ব, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দেখলাম তাঁর। তারপর বলতে পারেন ‘আঁধারে আলো’ - সুমিত্রাদেবী ছিলেন, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘দ্বীপ জ্বেলে যাই’ - সুচিত্রাদেবীর সঙ্গে এক অসাধারণ মনস্তত্ত্বমূলক কাহিনী, ডায়ালগগুলো বুকে আঁচড় দি। এছাড়া আমার প্রথম ছবি ‘মহাপ্রস্হানের পথে’ তো আছেই। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ দেখেছেন?”
কাহিনীর নিষ্ঠুর সত্যতার জন্যে হোক বা তখনকার নিপীড়িত সমাজের নিখুঁত প্রতিবিম্বের জন্যেও হতে পারে, আমি ছবিটি ঠিক ভাবে নিতে পারিনি। সেদিন ওনাকে সত্যিকথাটা অবশ্য বলতেও পারিনি, তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ - ছবিটি তো জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। আর বোধহয় ক্যানেস্ ফিল্ম উৎসবেও দেখানো হয়েছিল। আপনার এতো সুন্দর অভিনয় ঐরকম অন্য ধাঁচের চরিত্রে - সত্যিই। ভোলা যায়? আপনি নিশ্চয়ই ছোটবেলা থেকেই…”
“না না, সেরকম কিছু নয়, নাগপুরে ম্যাট্রিক আর বি এস সি করেছি। কলেজ টিমে ক্রিকেট ট্রিকেট খেলেছিলাম। সাধারণ নাটকে অংশগ্রহণ করতাম অবশ্য। তখন থেকেই বোধহয় মনে একটা চাড় এসেছিল, আসলে বন্ধুরা আর পাড়া পড়শীরাও এই অভিনয়ের দিকে ঠেলে দেবার জন্যে খানিকটা দায়ী। কলকাতায় চলে এলাম, মাঝে মাঝে যাত্রাও করেছি - সেটা বলতে পারেন দর্শকদের ঠিক করে ভালভাবে চেনার জন্যে”। বলার ধরনটা সহজ, অনাড়ম্বর, পরিচিত স্বরেই।
“তা কলকাতায় এসেই নিশ্চয়ই ফিল্মী জগতের চোখে পড়ে গেলেন? অবশ্য হবারই তো কথা”। চূর্ণী অনেকক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিল।
“না না, তাই হয় নাকি? আমি উত্তর কলকাতার একটা ল্যাবরেটরীতে কাজ পেয়েছিলাম, খুবই খারাপ অবস্হায় ছিলাম তখন। সত্যি কথা বলতে গেলে রাত্রে শোবার ব্যবস্হাতেও তখন অসুবিধা হত। আর, নজরে পড়তে গেলে ভাগ্যের জোরও অনেকটা থাকতে হবে। তাছাড়া তখন নতুন কিছু অভিনেতা চটক দিয়ে, ওভার এ্যাক্টিং করে ছবির বাজার মাত করেছিল” প্রচ্ছন্ন ক্ষুব্ধভাবটা কিন্তু এত বড় অভিনেতাও সেদিন আড়ালে রাখতে পারেননি।
“খুবই
চ্যালেন্জিং বলুন? তাহলে এই অবস্হায় ঐ ‘মহাপ্রস্হানের পথে’ আপনি গেলেন কী করে?”
চায়ের কাপে আলতো একটা চুমুক দিয়ে পুরনো স্মৃতিটা বোধহয় ঝালিয়ে নিয়ে বললেন, “সেটা অবশ্য একটা আকস্মিক ঘটনা। তখন তো মোবাইলের এত ঘনঘটা ছিল না আর আমার বুক ফুলিয়ে বলার মত কোন স্হায়ী বাসস্হানও ছিল না। ডিরেক্টর কার্তিকবাবুর আমাকে খুবই পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু আমার সঙ্গে তো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। অথচ দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ভাগ্যক্রমেই অরবিন্দবাবু একদিন দূর থেকে আমাকে রাস্তায় দেখতে পান। দৌড়ে এসে আমাকে খবরটা দিলেন। সবাই তো তৈরীই ছিলেন, ব্যস, পরেরদিন থেকেই রিহার্সাল শুটিং সব শুরু হয়ে গেল’।
রাত গড়িয়ে যাচ্ছে, রাস্তাঘাটে শক্ত বুটের আওয়াজ জোরালো হচ্ছে ক্রমশ:। এদেশে পাড়ায় পাড়ায় প্রাক্তন সেনাবাহিনীর লোকেদের নিয়োগ করা হয় সূক্ষ্ণ নজরদারী রাখার জন্যে। এবং দেশটি মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত হয় সেনাবাহিনীর দ্বারা, তাই এই অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা নিজেদের কাজ অসম্ভব নিয়মনিষ্ঠায় সামরিক নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গেই পালন করে থাকেন। নতুন অতিথির আগমন, বাড়ি কেনা বেচা, ছোট বড় দূর্ঘটনা বা জলের পাইপ উপছে জল নষ্ট হচ্ছে কি না, কোথায় পথে কোন জন্তু গাড়িচাপা পড়ে মরে আছে - সব কিছুর নিখুঁত খবর চলে যায় যথাস্হানে।
আগামীকাল সন্ধ্যবেলা দূতাবাসে বসন্তবাবুর সম্বর্ধনা। কিন্তু তার আগে ওনাকে যোগজাকার্তাটা ঘুরিয়ে দেখানোর কথা। কিন্তু তার চেয়ে বেশী জরুরী ওনাকে একজন অস্হিবিশারদ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। তার পরের দিন উনি জাকার্তা, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যময় কয়েক শো বছরের পুরনো বুদ্ধমন্দির, দেখতে যাবেন। বলছিলেন, “অম্লানবাবু, গোডালিটা দুদিন ধরেই খুব ব্যথা করেছে, ওখানে গিয়ে তো অ্নেক হাঁটাচলা, সিঁড়ি ওঠানামা না করতে পারলে তো সারাজীবন আফশোষ থেকে যাবে মশাই!” উনি কিন্তু হাঁটার অসুবিধাটা আগে আমাদের বুঝতেই দেননি, হয়তো আমাদের প্রথমদিনেই বিব্রত না করার উদ্দেশ্যে। এই কষ্টটা অবশ্য ওনার অভিনয়ের ছায়ায় আড়াল দিয়ে রেখেছিলেন কি না, জানি না।
এবার রীতা আসর ছেড়ে উঠে গিয়ে ওর দুই সাহায্যকারিণীকে নিয়ে কৃষ্টালের গ্লাস, চায়নাবোনের সামগ্রীতে টেবল সাজিয়ে, ঘরের কোণায় সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালিয়ে আর মাথার ওপরে রাজকীয় ঝাডলন্ঠনে আলোর বন্যায় বাতাবরণ সাজিয়ে তৈরী। নাসি গোরেং, গুলে আয়াম, সাতে কাম্বিং, নাসি উদুক আর পাতি বাঙালি মাছমাংস আর মিষ্টির মেলা বসিয়ে দিয়েছে সে। স্বাগত কমিটির সদস্যেরা যারা বসন্তবাবুকে আনতে বিমানবন্দরে গিয়েছিল দূতাবাসের অনুরোধে, সবাইকে নিয়ে খেতে বসে টেবিল সরগরম করলেন উনি।
পরের দিন সন্ধ্যেবেলা দূতাবাসের অডিটোরিয়ামে ওনার সম্বর্ধনা সুষ্ঠুভাবেই সাঙ্গ হল। আমাদের পূঁজি দিয়ে নাচ-গান, আবৃত্তি, কথকতা। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল নীলাঞ্জনার ‘গণেশ বন্দনা’ দিয়ে। প্রসঙ্গত, ওঁর কাছে অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য গণেশমূর্তির সংগ্রহ আছে, নিছক শখের টানে। যতদূর মনে পড়ছে উনি কোন জার্মান নাটকের বাংলা তর্জমা করে একটি অসামান্য মোনোলগ উপহার দিয়েছিলেন আমাদের।
ডাক্তারের নাম ‘বিষ্ণু’। উনি মুসলিম ধর্মাবলম্বী, কিন্তু নামটা আক্ষরিকভাবেই হিন্দু। অবাক হবার কিছু নেই, বহু নাম, সাংস্কৃতিক উপস্হাপনা, রামায়ণ, মহাভারতের উপাখ্যান এদেশে প্রবলভাবেই বিদ্যমান। প্রেসিডেন্ট সুকর্ণের কন্যা মেঘাবতী সুকর্ণপুত্রী, নামটা অবশ্যই সংস্কৃত ঘেঁষা, ভবিষ্যতে দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। ডাক্তারের সম্মানমূল্যটা আমি দিতেই মি: চৌধুরী আপত্তি জানালেন- “এটা তো ঠিক নয় অম্লানবাবু! আমার কাছে তো কিছু ডলার আছে।
আমি সবিনয়ে বললাম, “বসন্তবাবু, এত যুগ ধরে বিন্দু বিন্দু করে যে অমৃতকুম্ভের জোগান আপনি দিয়ে এসেছেন, এই সামান্য জিনিষটা তো অনুভূতির আওতায় আসতেই পারে না! এটা নিয়ে প্লীজ্, আমাদের লজ্জা দেবেন না। চলুন, ফেরা যাক!” সেদিনের একটা ইঞ্জেকশনেই ম্যাজিকের মত কাজ হয়েছিল।
ফেরার সময়ে কথার ফাঁকে বললেন, “অম্লানবাবু, এই ইসলামিক দেশে আপনারা এই বাঙালি সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন দেখে খুবই ভাল লাগল। আর কিছু? যা কাল পরিবেশন করে উঠতে পারেননি! আমি বাংলাভাষার কথাই বলছি”।
“আমরা সবাই কর্মরত বলে সময় আর সাংস্কৃতিক সামর্থ আমাদের খুবই সীমিত বসন্তবাবু। এইসব নিয়ে এবং নিজেদের রচনা, পরিচালনায় নাচ, গান, নাটক, নৃত্যনাট্য দিয়ে দূর্গাপূজো, পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, বসন্তপূর্ণিমা যথাসাধ্য পালন করি। অনেক সময়ে, বাংলাদেশীয়রাও খোলামেলা উৎসাহের সঙ্গে আমাদের মেলাতে অংশগ্রহণ করেন”।
“বাহ্, খুব ভালো। অন্য দেশ, অন্য ভাষা, ভিন্ন ধর্ম, আলাদা সংস্কৃতির সমন্বয়”।
আমি তখনও নিজেদের বাহাদুরির কাহিনী শেষ করিনি - আমাদের কেরামতি সবটাই তো শোনানো দরকার ওনাকে! মাঝপথেই বলে বসলাম, “এছাড়া এখন আমরা শ্রুতিনাটক চেষ্টা করছি। গতমাসে কবিগুরু ‘তিনবোন’ গল্পটার শ্রুতিনাটক করেছিলাম”।
শেষ করতে পারলাম না। টগবগে উচ্ছ্বাসের ওপর একবালতি জল ঢেলে দিলেন উনি, উষ্ণ বাষ্পটা হিসহিসিয়ে বেরিয়ে এলো ওনারই বক্তব্যের সড়ক ধরে - একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবেই। তিনি বললেন, “এই জিনিষটা কেন যে কলকাতার বাঙ্গালিরা এখনও বিনা বাক্যব্যয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তা বুঝি না। ক্ষমতা থাকলে নাটক করো! অভিনয়, বাচনভঙ্গী, শরীরি ভাষা, মুভমেন্ট্ লোকেরা দেখুক! সবদিক থেকেই নাটক চ্যালেঞ্জিং, ইতিবাচক, আসল শিল্পীকে চেনা যায়”।
সরাসরি আকস্মিক দুর্ঘটনাটা শেষমুহূর্তে সামাল দেবার জন্যে বলে উঠলাম, “না না, ইয়ে, মানে আমরা ওটা শুরু করার কথা ভেবেছিলাম আর কি। আপনি তো ঠিকই বলেছেন - অভিনয়টাই তো আসল দেখার, অনুভব করার”।
“সেই তো। চেহারা ছবির জন্যেও, আবার অনেকেই মানুষের সামনে, ক্যামেরার সামনে আসতে চান না। শুধু দূরে মঞ্চে বসে আবছা আলোয় গলার কারসাজী দেখানো!” গরগরে বিতৃষ্ণাটা সপাটে উগরে দিলেন।
আলোচনাটা কোথায় পৌঁছতে পারে, বোঝা যাচ্ছে না। এক্ষুণি ঘোরাতে হবে, অজান্তে অবাঞ্ছিত জায়গায় খুঁচিয়ে দিয়েছি, মৌমাছির হূল তো সহ্য করতেই হবে!
“বসন্তবাবু, আমরা কিন্তু আপনার বেতার নাটক শুনে মন্ত্রমুগ্ধ। তা, ওটা তো নাটকই। আপনি, কণিকা মজুমদার - কী জুটি ছিল, কী রোমান্টিক - প্রতিটি উচ্চারণে সোহাগ, মান অভিমান, রাগ অনুরাগ, আনন্দ বিষাদের যথাযোগ্য অনুভূতি গলে গলে পড়তো”।
“আর জয়শ্রী, নীলিমা?” বিপজ্জনক ঝাঁঝটা লুপ্তপ্রায়।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো বটেই, এনারাও তো অসাধারণ ছিলেন”। এ যাত্রাতেও ফাঁড়াটা কাটলো বোধহয়, মোডটা ঘুরে শান্তির আলোর ঝলকানি!
কাঠের ওপর হাতের কাজ দেখবার ঔৎসুক্য মেটাতে ‘সারিনা প্লাজা’তে নিয়ে গেলাম ওনাকে। হস্তশিল্পীদের এইরকম অবিশ্বাস্য নিখুঁত কাজ আর এই ধৈর্য ধরে মনঃসংযোগ নিয়ে কাজটা শেষ করাটা বসন্তবাবুকে খুবইঅবাক করেছিল - মনে প্রাণে শিল্পী তো! আমার বাড়িতে যে সেন্টার টেবিল দেখেছিলেন, প্রায় সেরকমই একটা - জিজ্ঞেস করে ওঁকে জানালাম ওটা করতে চারমাস সময় লেগেছে আর দাম এগারোশো ডলার। অবিশ্বাস্য শিল্পকীর্তি। বাড়িতে ফিরলাম আর কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছাড়াই।
বেলাশেষে বিদায় জানিয়ে এলাম যোগজাকার্তার বিলাসবহুল শীত তাপনিয়ন্ত্রিত ভোলভো বাসে ওনাকে তুলে দিয়ে।
বাসটা টোলওয়েতে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হবার পরেই কেন যেন হঠাৎই দুদিনের স্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে বুকটা বিনাকারণেই হু হু করে উঠলো, একটি বিশাল ব্যক্তিত্বের ঘন উপস্হিতি দিগন্তে মিলিয়ে গেল। তার জায়গায় চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা অস্হির আবেগের কালো ছায়া, ‘দীপ জ্বেলে যাওয়া’ একটি দরজার কাঁচে আবছা আলোয় আকুলি বিকুলি করছে তাপসের অস্পষ্ট বিলম্বিত আকুতি। মানসিক শুশ্রূষাকেন্দ্রের কোণায় কোণায় গুমরে উঠছে “রাধা, রাধা, আমি কোনদিন তোমাকে বিরক্ত করব না, কোনদিন না। শুধুএকবার, একবার শুধু তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো - তুমি এতদিন আমার সঙ্গে অভিনয় করেছো। বলো রাধা, বলো , বলো…”কোন অভিব্যক্তি নয়, কোন অভিনয় দেখছি না, শুধু ঐ বলিষ্ঠ গভীর গলার মাপা স্বরে ঝরে পড়ছে একরাশ আর্তনাদ, হাহাকার আর উদ্বেলিত মিনতি। সরাসরি অভিনয় না হলেও, কেবল কণ্ঠস্বরের অসাধারণ কারুকার্যে এই দুঃসহ প্রকাশ কি শ্রুতিনাটকের পর্যায়ে পড়ে না? জানি না বসন্তবাবু, আপনি এই প্রাণ গলানো অনুভূতি কোন পর্যায়ে ফেলবেন!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন