কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২১

কাজল সেন

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৫


মহাকাশভ্রমণ

চলে যাবার জন্য প্রস্তুতিপর্ব প্রায় সেরেই ফেলেছেন তুহিনবাবু। বয়স তো আর নেহাৎ কম হলো না, গত জুলাই মাসেই আশি অতিক্রম করে একাশিতে পা  দিয়েছেন। আবার আশি যে খুব বেশি একটা বয়স, তাও তো নয়! আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এতটাই উন্নত হয়েছে যে, আশি বছর অতিক্রম করে অনেকেই দিব্যি বেঁচে আছেন। মোটামুটি সুস্থও আছেন। তবে তুহিনবাবুর ব্যাপারটা একটু আলাদা। আশি পেরিয়েছেন বলেই যে তিনি চলে যাবার প্রস্তুতিপর্ব সেরে ফেলেছেন, তা আদৌ নয়। আসলে তিনি যখন ক্লাস টেনে পড়েন, সেই বছর স্কুলের ফাইন্যাল পরীক্ষায় বাংলাপ্রশ্নপত্রে রচনা লেখার জন্য যে বিষয়গুলির উল্লেখ ছিল, তার মধ্যে একটা বিষয় ছিল, তোমার জীবনের  লক্ষ্য। বিষয়টা নিয়ে এর আগে তাঁর কোনো চিন্তাভাবনাই ছিল না। কিন্তু পরীক্ষাহলে উত্তর লিখতে বসে, আকাশপাতাল তোলপাড় করে ভাবতে ভাবতে তিনি লিখেছিলেন, আমার জীবনের লক্ষ্য তো অনেক কিছুই, যেমন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার প্রফেসর সায়েন্সটিস্ট ইকনোমিস্ট দেশসেবক সমাজসেবক ইত্যাদি হওয়া। কিন্তু আমি জানি, এসব কিছুই হতে পারব না। আমাদের পারিবারিক চালের ব্যবসা আছে, আমাকে ভবিষ্যতে সেই চালের গোডাউনেই বসতে হবে।

হ্যাঁ, তুহিনবাবু জানতেন তাঁর ভবিষ্যতের জন্য জীবনের কোনো বড়সড় লক্ষ্য ঠিক করার কোনো মানেই হয় না। সুতরাং তিনি স্কুল থেকে বেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েই ছোট ছোট কয়েকটা লক্ষ্য মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলেন। এবং এটাও ভেবে রেখেছিলেন যে, এইসব লক্ষ্যগুলো পূরণ হলেই তাঁর জীবন সার্থক, তারপর আর বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না।  

তাঁর জীবনের প্রথম লক্ষ্য ছিল তুলতুলিকে বিয়ে করা। তুলতুলি পাড়ারই মেয়ে। মুখটা দুর্গাঠাকুরের মতো সুন্দর। গায়ের রঙ সাংঘাতিক ফর্সা। কিন্তু একটা পায়ে  গন্ডগোল আছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে। তুহিনবাবু প্রথম তীরেই লক্ষ্যভেদ করেছিলেন। তুলতুলির মা-বাবা ভাবতেও পারেননি কোনো ছেলে যেচে তাদের মেয়েকে বিয়ে করবে। তুহিনবাবুর বাড়িতে অবশ্য আপত্তি ছিল, কিন্তু তিনি পাত্তা দেননি।

তুহিনবাবুর দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল, বাপ-ঠাকুর্দার মতোই তিনি চালের ব্যবসায় উপার্জন করবেন প্রচুর, কিন্তু তাদের মতো কঞ্জুসি করবেন না, টাকাও ওড়াবেন প্রচুর। আর সারাজীবন তাই করেছেন তুহিনবাবু। বিলাসিতায় যেমন মেতেছেন, দানও করেছেন অঢেল। পাড়ার ক্লাব, মন্দির-মসজিদ, গণবিবাহ সবকিছুতেই।

তৃতীয় লক্ষ্য ছিল, গণেশবাবুকে প্যাঁদানো। তুহিনবাবু নিজের চোখে দেখেছেন, তাঁর বাবাকে একবার ব্যবসায়িক কোনো ঝামেলায় গণেশবাবু খুব অপমান ও বেধড়ক পিটিয়েছিলেন। তুহিনবাবু তখন স্কুলছাত্র। তিনি তখন কিছুই করতে পারেননি, শুধু রাগে ফুঁসেছিলেন। পর নিজে ব্যবসার গদিতে বসে কোনো এক অছিলায় পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের সহযোগিতায় গণেশবাবুকে চাঁদা ক’রে  পেঁদিয়েছিলেন।

তুহিনবাবুর জীবনে এইরকম আরও বেশ কিছু লক্ষ্য ছিল, যা বিগত আশি বছরের জীবনকালে সম্পন্ন করেছেন। এরপর আর বেঁচে থাকা কী জন্য! তুলতুলি  কবেই চলে গেছে। তাঁর বড় ও মেজছেলে তাদের বৌ-বাচ্চা নিয়ে বিদেশে থাকে, সেখানেই সেটলড। ছোটছেলে চালের ব্যবসা তুলে দিয়ে ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা করছে।  

 চলে যাবার আগে তিনি শুধু একবার মহাকাশে ঘুরে ফিরে আসতে চান।  


1 কমেন্টস্: