অর্বাচীনের রবিযাপন (পর্ব ৬)
গত এক বছরে কত কিছুই না ঘটে গেল। অতিমারি এসে ওলট পালট করে দিল সব, কেউ বিশ মন চাল আর ছাব্বিশ মন আটা কিনে ঘরে দোর দিয়ে বসে রইলাম, কেউ করোনা নিয়ে কবিতা, প্যারোডি লিখে ভারচুয়াল লাইক পেল বিস্তর, কেউ বা সত্যি সত্যি যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন বিপদের দিনে আর পাঁচজনের পাশে একটু দাঁড়াবার, হারালাম অনেক ডাক্তার-সেবাকর্মীকে, কাজ হারালেন অনেকে, আর আমরা বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ - আমরা দূরত্ব বাড়াতে বাড়াতে কখন যে চেনা মানুষকে অচেনা হয়ে যেতে দেখলাম আর নিজেকে চিনতেও ভুলে গেলাম, তার হিসেব রাখা হয়নি।
এই তো
মাস কয়েক আগে, একটু একটু করে যখন সব ‘স্বাভাবিক’ হতে চলেছে, কাজের জায়গায় দেখা হল
‘কাকা’র সঙ্গে। মোড়ের মাথায় ওঁর জেরক্সের দোকান। মানুষটিকে দেখলে মনে হয় খিটখিটে
মেজাজি, কিন্তু ভেতরটা রসে ভরা। সবসময় ওঁর দোকান থেকে কিছু না কিছু বাজে।
বেশিরভাগই রবীন্দ্রসঙ্গীত, নয়ত পুরনো বাংলা গান। মহাপুরুষদের জন্মদিন, মৃত্যুদিন
স্মরণে, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারি- বিশেষ বিশেষ দিনে উনি দু-চার লাইনের
বার্তা লিখে টাঙ্গিয়ে রাখেন দোকানের
সামনে। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা তো বটেই, পথচলতি মানুষজনেরও চোখে পড়ে, ভাল লাগে।
মাঝখানে অনেকদিন সে-সব বন্ধ ছিল, ওঁর দোকানও নিশ্চয় চলে নি তেমন, কী করে চলছিল
ওঁর? কথার ছলে জানতে চেয়ে অবাক হতে হল। উনি লকডাউনের সময়টা জুড়ে সকালে সাইকেল নিয়ে চলে যেতেন শহরতলির এক কমিউনিটি
কিচেনে, সেখানে রান্না করতেন। নিজেরও খাওয়া দাওয়া ওখানেই। আর বিকেলে সবজি বিক্রি।
“এত পরিশ্রম করেছেন এই বয়সে? পারলেন কী করে?” জিজ্ঞেস করে যা উত্তর পেলাম, বাঁধিয়ে
রাখার মত। -“করতে তো হবেই। না করলে, খালি ঘরে বসে হায় হায় করলে আরও
বুড়িয়ে যাব। কপাল খারাপ, খারাপ সময় বলে কি বসে থাকব নাকি? ওই যে দেখুন ওই ওনাকে”। দোকানের দেওয়ালে বাঁধানো ছবিটার দিকে আঙুল দেখান
তিনি, “কী বলে গেছেন? ওই যে, ‘কিসের তরে কান্না ঝরে, কিসের তরে দীঘশ্বাস!’
কান্নার
জায়গায় অশ্রু হবে, দীর্ঘশ্বাস উচ্চারণটা ঠিক হল না, একটা ‘তরে’র জায়গায় ‘লাগি’
হবে -- কিন্তু সে ‘ভুল’ ধরিয়ে দেবার স্পর্ধা ছিল না। এই মানুষটি
তাঁকেই ধরে আছেন, যিনি ‘ভাবগ্রাহী জনার্দন।’ জ্ঞানীর ‘গুরুদেব’ শুধু নন,
অর্বাচীনদের ‘দাদাঠাকুর’ও। গত এক বছরে স্বাভাবিক জীবিকায় কোপ পড়ায় অনেক বেসরকারি
সংস্থার কর্মী, অনেক ‘উচ্চশিক্ষিত’ মানুষ ডিপ্রেশনে চলে গেছেন - দেখেছি, শুনেছি। তাঁদের যন্ত্রণা, হতাশাকে একটুও ছোট না করে বলছি - এই মানুষটির দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন।
‘কাকা’র
কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল আর একজনের কথাও। এক মাটির পুতুল গড়া-শিল্পী। দেখা হয়েছিল
এক হস্তশিল্প মেলায়। দোকানের একটা পাশ জুড়ে শুধু ‘তিনি’ - কোথাও
লিখছেন, কোথাও বাল্মীকির আদলে মূর্তি, কোথাও বিলেত-ফেরত মাটির পটে রিলিফের কাজ - তাকিয়ে আছেন দূরে। অন্য দিকটায় আরও নানা রকম মূর্তি, পুতুল। জানতে
চেয়েছিলাম, “ওঁর এতগুলো, এত রকমের মূর্তি গড়েছেন? এসব কি কেউ অর্ডার দিয়ে কেনেন,
নাকি নিজের ভালোলাগা থেকে করেছেন?” বেশিরভাগ লোকে তো একটা দুটো বিশেষ ভঙ্গিমার ছবি
বা মূর্তিই কিনে সাজিয়ে রাখে, তাই জানতে ইচ্ছে হয়েছিল। তাঁর উত্তর ছিল, “ভাল লাগে
নানারকম ছাঁদে গড়তে। উনি তো একঘেয়ে ছিলেন না। হ্যাঁ, বেশিরভাগ জায়গাতেই দেখি ওই
একটা দাড়িওয়ালা ছবি ধরেই সবাই করে। আমার সেটা ভাল লাগে না। আমি এখান-ওখান থেকে
নানা বয়সের, নানা ধরনের ছবি জোগাড় করে সেই আদলে বানাই। কেউ কিনুক আর নাই কিনুক।”
আরও জানা গিয়েছিল, পড়াশোনা বেশিদূর হয়ে ওঠেনি, কিন্তু ‘সহজপাঠ’, ‘দামোদর শেঠ’ আর
‘পণরক্ষা’ তখনও তাঁর প্রায় মুখস্থ, গুনগুনিয়ে গাইতে পারেন বেশ কিছু গানও।
কে
জানে কোথায় এখন তিনি! নামটাও মনে নেই আর। গত বছরের সংকটে তাঁর মত অনেক কারিগর, কুটিরশিল্পী জীবিকা
হারিয়েছেন জানি। নিবিড় ঘন আঁধারের মাঝে জীবনের ধ্রুবতারা কি তাঁকে পথ দেখিয়েছেন?
এই
কদিন আগেই কথা হচ্ছিল এক সুহৃদের সঙ্গে - কর্মসূত্রে বিদেশে থাকেন
একা, গত বছর সেখানেই আক্রান্ত হয়েছিলেন কোভিডে। সে-দেশে রীতিমত আতঙ্কের প্রহর গোনা
চলছে তখন। এখানে তাঁর পরিবার পরিজন সবাই চিন্তিত। কিন্তু সরাসরি পাশে গিয়ে
দাঁড়ানোর উপায় ছিল না। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পরও অনেকদিন লেগেছিল তাঁর মানসিক
ভাবে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে। সেই সময় নাকি দেশ থেকে এক আত্মীয়া তাঁকে
নিয়মিত ফোন করে গান শুনিয়ে গেছে-- ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না’, ‘চরণ ধরিতে’,
‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’, ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়’, ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর’— বড়
কোন শিল্পী সে নয়, একসময় ক্যাসেটে শুনে শুনে তোলা গান সব, নিজের খেয়ালে -- এভাবে কোনদিন কাজে লাগবে কে জানত! এখন সেই মানুষটি যদি একান্তে আর
দু-একজনের কাছে বলেও থাকেন, তাঁর সুস্থ হয়ে ওঠার লড়াইতে পাশে ছিল ‘তাঁর’ গান --
হয়ত অনেকের মনে হতেই পারে, কিছুটা ব্যক্তিগত আবেগের বশে অতিরঞ্জন আছে এর মধ্যে -- তা হলেও, বিশ্বাস আর ভালবাসায় ভর করে সার্বিক দুঃসময়ের মাঝে, অনেকের মাঝে
একজন—আরও এমন কতজন আছেন না-ই বা জানলাম -- সেই একজন যদি আর একজনের
সুস্থ হয়ে ওঠার চেষ্টায় গানের সেতু গড়ে দেয়, তা কি একেবারেই অবান্তর?
এরকম
আরও কত চরিত্র ছড়িয়ে আছে গল্পে, বাস্তবে অথবা গল্প আর বাস্তবের মিলেমিশে একাকার
হয়ে যাওয়ায়। মনে পড়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে সেই মেয়েটির কথা, যে পরিবারে
দারিদ্র্যের জ্বালা, অশান্তি সহ্য করেও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। হাতে টাকা নেই,
নিতান্ত বিপদে পড়ে কলেজে বাইশে শ্রাবণ-এর অনুষ্ঠানের ফাঁকে বড়লোক বান্ধবীর সাজঘরে
রেখে যাওয়া ব্যাগ থেকে দুটি নোট সরিয়ে ফেলার অনুতাপে তাঁর ছবির সামনে এসে মেয়েটি
কেঁদে ওঠে একান্তে। ভোলা যায় না বাণী বসুর উপন্যাসে ‘নিষিদ্ধ’পল্লির সেই
মেয়েগুলিকে, যাদের পড়াতে এসে সমাজসেবিকা দিদিমণি অবাক হয়ে যান - ‘দেনাপাওনা’র শেষটুকু শোনার আগেই তারা ধরে ফেলে স্রষ্টার ভাবনার নির্যাস,
“ছেলেটার আবার বিয়ে দেবে, এবারে আরও বেশি পণ নেবে।”
এইসব
তুচ্ছ জীবনের ভাঙা আতশকাচ দিয়ে, বারে বারে ‘তাঁকে’ অন্যরকম করে চেনা যায়, অথবা যায়
না। তাঁর
স্মৃতিজড়ানো এক-একটি বিরাট প্রতিষ্ঠানের পাঁচিল-বিতর্ক বা বসন্ত উৎসবের সময় ঘটে
যাওয়া কিছু অবাঞ্ছিত, যন্ত্রণাকর চাপান-উতোরের বাইরে, অতি ‘বিশুদ্ধতা’র কচকচি
একপাশে সরিয়ে রেখে, তাঁর ‘কোটেশন’ কেটেকুটে নিজেদের মতবাদের গণ্ডিতে ঢোকাতে চাওয়ার
দড়ি টানাটানি থেকে অনেক দূরে, একটু একটু করে জমাট বাঁধে এই
চেনা-জানা-না-চেনা-জানার রসায়ন। আর অর্বাচীনের বেলায়, আবারও লজ্জার মাথা খেয়ে বলতে হয় - সেই খেলাতেও হাতছানি দেয় গানের
লীলা। যখন মাথা গুলিয়ে যায় নানা মুনির জটানাড়া দেখে, যখন আশেপাশের চেনা মুখগুলো
অচেনা হয়ে যায় নিমেষে, মনে হয় মেলানো যাচ্ছে না কিছু - কোথায় নীড়,
কোথা আশ্রয়শাখা - তখন ভেসে আসে পঞ্চমে সুর ধরে, উঁচু পর্দায় অনায়াস চলনে,
মীড়ের দরদে মাখা এক অনুপম আশ্বাস - “অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে/ অচেনাকেই চিনে
চিনে উঠবে জীবন ভরে।” কখনও আবার গান যেন শরীরী হয়ে জানায় অভিমান, “চিনিলে না আমারে
কি।” চমকে উঠতে হয়, কোথাকার কে একজন চিনতে পারেনি বলে তার এত কষ্ট! কখন যে দরজায়
এসেও সে ফিরে গেছে, একটু ছুঁলেই নাকি সে দরজা খুলে যেত - জানতেই
পারেনি অর্বাচীন! “দ্বারে এসে গেলে ভুলে, পরশনে দ্বার যেত খুলে” - এমন করে বলে লজ্জা দেবার কোন মানে হয়! কার ভাগ্যতরী কোন বাধায় ঠেকে গেল, তাই ভাবতে ভাবতে গান শেষ।
না না শেষ কোথায়, এই তো ‘সা’ থেকে আবার শুরু, “এ পথে আমি যে...” এই তো বেশ, “চিনিব
তোমায় আসিবে সময়, তুমি যে আমায় চিন।” দীপ নিবে গেলেও বইবে অনুকূল বায়ু, তারার
ভাষাতে লেখা থাকবে ঠিকানা, পথের ধারের অর্বাচীন ফুলগুলো দেবে সঙ্কেত। মিটে গেল।
দাঁড়াও,
অত কি হবে সিধে! যখন মনে হয় এই তো বেশ চেনাজানা হচ্ছে, তখন আবার উল্টো ‘ইমোশনাল
অত্যাচার’- “সেই ভালো সেই ভালো, আমারে না হয় না জানো।” কে আবার দূরে গিয়ে দুঃখ
দিল, কাছে এসে লজ্জা? ‘আমি’ না ‘তুমি’—কে কাকে বলছে? কী জ্বালা, এর যে কিছুতেই মন
ওঠে না!
এবার অর্বাচীনেরও
তো কিছু বলার আছে। বলো দেখি, তুমি চিনেছ তাকে? বারে বারে দুঃসময়ের পাকে ফেলে কী
দেখতে চাও তবে? তোমার হয়ে কথা কওয়ার জন্য তো অনেক গানই লিখে রেখেছ, ভয়েস-ওভার
দেবার ব্যবস্থাটাও করে রেখেছ। এবার অর্বাচীনের জবাবটাও তো শুনতে হবে। সে এবার বলবে - ‘যে জন আছে মাঝখানে’ - আমার আর তোমার - তাকেই এগিয়ে দিলাম, আমার হয়ে গাইতে- “তুমি মোর পাও নাই
পাও নাই পরিচয়।” আসুক দুঃখ, জ্বালুক শিখা, সব আবরণ হোক লয়। আর কিছু না হোক, তুমি
চিনে নিও সে অর্বাচীনকে- বা তার মত আরও অনেক তুচ্ছ, সাধারণকে। তুমিই তো বলেছ- “আমি
তোমাদেরই লোক/ আর কিছু নয়/ এই হোক শেষ পরিচয়।
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। 'তাঁর' কথা বলতে গিয়ে 'তাঁর তাকেই' এত সুনিপুণ ভাবে টেনে আনা!
উত্তরমুছুন