প্রজাপতি প্রভাব
কথাটা একটু নতুনত্ব লাগছে? তাহলে এর বহুল প্রচারিত ইংরাজি শব্দটা বলি, সেটা হলো বাটারফ্লাই এফেক্ট। অনেকেই হয়তো এই শব্দটা আগে শুনেছেন, এই নামের পেছনে যথেষ্ট গাণিতিক ব্যাখ্যা ও সর্বোপরি একটা গল্প আছে। গল্পটা হলো - ধরুন পৃথিবীর এক প্রান্তে যদি কোনো প্রজাপতি ডানা ঝাপটায় তাহলে নাকি ঠিক অপর প্রান্তে সুনামী হতে পারে। খুব অবাক লাগছে নিশ্চয় শুনে? এমনই একটি প্রশ্ন তুলে তৎকালীন মানে ১৯৫০ সাল নাগাদ এম আই টি অর্থাৎ ম্যাসাচুসটেস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গণিত ও আবহবিদ এডোয়ার্ড লোরেঞ্জ বৈজ্ঞানিক মহলে হাসির খোরাক হয়ে গেছিলেন। অনেকে তাঁকে মানসিক বিকার গ্রস্থ বলেও অভিহিত করেন। কিন্তু বিজ্ঞানের জয়যাত্রা তো আর তাতে থেমে থাকে না। পরবর্তীকালে এই থিওরির জন্যই তিনি বিশ্ব বিজ্ঞান মহলে স্বীকৃতি ও পুরস্কার পান।
বাটারফ্লাই এফেক্ট বা প্রজাপতি প্রভাব সম্পর্কে বিষদে বলতে গেলে যে তত্ত্ব নিয়ে আলোকপাত করা উচিত তা হলো কেওস থিওরি বা বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব। এডওয়ার্ড মূলত আবহাওয়া সম্পর্কে সঠিক পূর্বাভাস দিতেই এই তত্ত্বটি আবিষ্কার করেন। পুরনো সাধারণ মডেলগুলো দিয়ে সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া যেত না কারণ যে কোনো একটা নির্ণায়ক বা ভ্যারিয়েবল-এর সামান্যতম পরিবর্তন হলেই পূর্বাভাসে এক বড় পরিবর্তন আসতে পারে এবং যেটা তৎকালীন সাধারণ মডেলগুলো ধরতে পারতো না। মূলত এখান থেকেই আবির্ভাব হয় বাটারফ্লাই এফেক্ট-এর।
সাধারণত বিস্ময়কর, অরৈখিক এবং অনিশ্চিত ঘটনাসমূহের বিজ্ঞানকে বলা হয়ে থাকে ক্যাওস (Chaos) বা বিশৃঙ্খলার বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের অন্যসব শাখা সাধারণত সরলরৈখিক, গণিতনির্ভর এবং নির্দিষ্ট ফলাফল প্রাপ্তির ঘটনা নিয়ে কাজ করে, যেমন - তড়িৎবিজ্ঞান, মহাকর্ষ কিংবা রাসায়নিক বিক্রিয়া। এসব ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মান কিংবা নির্দিষ্ট শর্তাবলীর জন্য যে মান পাওয়া যাবে, তা গণনা করে বের করা সম্ভব।
কিন্তু বিশৃঙ্খলা তত্ত্বে সাধারণত যেসব ঘটনার সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না, সেসব ঘটনাই বর্ণনা করা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শেয়ার মার্কেট, আবহাওয়া, মানুষের মনস্তত্ত্ব, ব্যবসা ইত্যাদি - যেসব সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়।
যদিও প্রজাপতির পাখা ঝাপটানো নিয়ে লরেঞ্জ তার এই প্রশ্নে আসলে এটা বোঝাতে চাননি যে, আসলেই পৃথিবীর এক স্থানে প্রজাপতি ডানা ঝাপটালে আরেক স্থানে টর্নেডো হয়। বরং তিনি তাঁর এই অদ্ভুত প্রশ্নের মাধ্যমে এটিই দেখাতে চেয়েছিলেন যে, কোনো বৃহৎ এবং জটিল সিস্টেমের ক্ষুদ্র পরিবর্তনের কারণে সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য কতখানি বদলে যেতে পারে। তিনি আবহাওয়ার পূর্বাভাস গণনা করার জন্য এই নতুন তত্ত্ব কাজে লাগান।
লরেঞ্জ আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার জন্য প্রাথমিক শর্ত হিসেবে একটি গাণিতিক মান ব্যবহার করেন, যার মান ০.৫০৬। এই মান আসলে আরো একটু বিস্তৃত ছিলো, অর্থাৎ দশমিকের পরে আরো অঙ্ক ছিলো। এর মান ছিলো ০.৫০৬১২৭। তিনি যখন দশমিকের পরে ছয় অঙ্ক নিয়ে গণনা করলেন, তখন একটি মান এলো। কিন্তু যখন দশমিকের পরে তিন অঙ্ক নিয়ে গণনা করলেন, সেই ফলাফল ছিলো পূর্বের ফলাফলের থেকে অনেকখানি আলাদা। অথচ শুধু দশমিকের পরে কেবল তিন অঙ্কই বাদ দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু ফলাফলে দেখা গেলো অনেক পরিবর্তন। এর থেকে লরেঞ্জ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে মানের সামান্য পরিবর্তনের জন্য এর উপর যে প্রভাব পড়ে, সেটি মোটেও সামান্য নয়, বরং ব্যাপক। এভাবেই জন্ম নিলো বাটারফ্লাই ইফেক্ট নামক বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব।
এডোয়ার্ড লরেঞ্জ তাঁর গবেষণালব্ধ ধারণাকে পেপার আকারে প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম দেন ‘ডিটারমিনিস্টিক ননপিরিয়ডিক ফ্লো'। এটি পরবর্তীতে পুরস্কার পায়। তাঁর এই গবেষণাপত্রের মূলকথা ছিলো এই যে, আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মডেলসমূহ পুরোপুরি শুদ্ধ নয়। এর কারণ সঠিকভাবে প্রাথমিক শর্ত বা অবস্থার মান পাওয়া বা সেটা নিয়ে গণনা করা সম্ভব নয়। একইসাথে সামান্য পরিবর্তনের কারণে পূর্বাভাসে বিরাট পরিবর্তন আসতে পারে। এই তত্ত্বকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য করতে গিয়েই লরেঞ্জ প্রজাপতি প্রভাবের ধারণা দেন। এই ধারণাকে সিস্টেমের ‘প্রাথমিক শর্তাবলীর সংবেদনশীল নির্ভরতা’ নামেও অভিহিত করা হয়।
তবে এই প্রভাবকে 'প্রজাপতি প্রভাব' বলার পেছনে আরো একটি কারণ আছে। লরেঞ্জ যখন তাঁর এই আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেল নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন আবহাওয়ার বিভিন্ন প্রভাবক যেমন তাপমাত্রা, বাতাসের গতি বা আর্দ্রতার অনেকগুলো মান ব্যবহার করেছিলেন, সেটা আগে বলা হয়েছে।
তো তিনি দেখলেন তিনি প্রতিবারই আলাদা ফলাফল পাচ্ছেন। কিছুতেই তিনি একটি নির্দিষ্ট ফলাফল আবার তৈরি করতে পারছেন না। তিনি বিভিন্ন প্রভাবকের মানও একটু হেরফের করে দেখলেন, কিন্তু প্রতিবারই ভিন্ন ফলাফল আসতে থাকে। তাঁর ব্যবহৃত এসব মানকে গ্রাফে বসালে এমন একটি গ্রাফ পাওয়া যায়, যা দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো। এ কারণেও তার এই তত্ত্বের সাথে প্রজাপতির নাম জুড়ে গেছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন