সমকালীন ছোটগল্প |
ধনকুদরা
জমির উপর উবু হয়ে বসে এক মনে ধান গাছের চারার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছিল বুধু
সোরেন। পাতার দু’ধারে বেশ ধার। একটু অসতর্ক হলেই হাত কেটে যেতে পারে!
পাতাটা হঠাৎ ভারী হয়ে যাওয়ায় বুধু বুঝতে পারে, সে এসে গেছে! বুধু আলতো
করে পাতাটা ছেড়ে দিয়ে মৃদু হাসে।
ধান গাছের চারা দুলতে দুলতে বলে, “কী দেইখছিসরে বুধু?”
বুধু জানে এ কথাটা ও ছাড়া আর কেউ শুনতে পায়না। এমনকি ওর পরিবারেরও কেউ শুনতে
পায় না। তাই পাঁচ-দশ গ্রামের
শুধু মাঝি-মেঝেনরাই নয়, রীতিমত মহাজনরাও ওকে খাতির করে। দেখা হলে ভাল-মন্দ কথা
বলে। অবশ্য এর
পেছনে কারণ হল ঐ একটাই। আর তা হল, ‘ধনকুদরা’ এখন সামান্য
দু’বিঘা জমির মালিক বুধু সোরেনের সাথেই থাকে!
আর তাই বুধুর এত কদর!
“দেইখছি লাইগো, ভাইবছি বটে”। বুধু ফিসফিস করে ঐ চারা গাছটার উদ্দেশে বলে।
“তা কী ভাইবছিস বটে?” ধনকুদরা হাসতে হাসতে জানতে চায়।
“তুমি হামার সঙ্গে ছিলে, তাই হামাদের চার পেট চলে! আর ইখন পাঁচ গেরামের লোকেরা আইসছে তুমাকে দেইখতে! কেমুন মজা বটে বলতো হে ধনকুদরা!”
“তা ঠিক বটে, তব্বে উয়ারা হামাকে দেইখতে লারছে! “ধনকুদরা হাসতে থাকে।
“সে তো হামিও তুমাকে দেইখতে
লারছি। আর ইট্টাই মুশকিল বটে!”
“কেনে?” ধনকুদরা অবাক হয়ে জানতে চায়।
“তুমহার কুন শরীল লাই, কুন মাথা লাই, হাত-পা লাই! কুন চক্ষু
– না, উটা আছে বটে। উটা যদি লাই থাইকতো তাহলে তো তুমি হামাকে দেইখতে লারতে। অথচ তুমি সব্বাইকে দেইখছ
বটে!” বুধু ঘাড় ঘুরিয়ে ধান চারাটির
দিকে তাকায়।
ধানচারাটি দুলে দুলে হাসে। বুধু ওর কানে গোঁজা চুট্টিটাকে
ঠোঁটে চেপে ফস করে ধরিয়ে ফেলে। ফুরফুরে বাতাসে ধোঁয়া ছেড়ে বুধু আনমনে বলে, “তুমি কি স-ব দেইখতে পাও হে ধনকুদরা, সব বুইঝতে পার?”
“হ্যাঁ, পারি বটে। তু সাইমনে দেখ কেনে। কী দেইখলি? একটা লোক আইসছে না? উ লখাই বটে। উ ভাল মানুষ লয়রে বুধু। উ ইক্কেবারে পঁইচে গেইলছে”।
সত্যিই কি তাই! বুধু সামনে তাকিয়ে দেখে লখাই জমির আল টপকে টপকে এদিকেই আসছে। ধনকুদরা বলেছে যে লখাই
ভাল না। তাহলে ও এদিকে কেন আসছে! নিজের অনেক জমি থাকতে ও অন্যের জমিতে কূ নজর দেয়। বুধু জানে ওর সামান্য দু’বিঘা
জমির উপর লখাইয়ের খুব লোভ রয়েছে।
সামান্য হাত কয়েক দূর থেকে লখাই হাঁক পাড়ে, “এক্কা এক্কা বইসে বইসে
কী কইরছিসরে বুধুয়া? ঘুমাই গেঁইলি নাকি?”
“কী আবার কইরব। হাতে কাজ কাম লাইকো, তাই বইসে আছি”। বুধু ব্যাজার মুখে বলে।
“কেনে, তুকে পুরা একশো দিনের কাম দেয় লাই?” লখাই জানতে চায়।
“হ্যাঁ, দিছে বটে। সারা বছরে মিইলেছে বিশ দিনের কাম। বাকি কামটা কে যে শালা খায়ে লিল কে জানে!” বুধু উদাস গলায় বলে।
এ কথায় লখাই একটু সময় চুপ করে থেকে বুধুর
পাশে আলের উপর থ্যাবড়া মেরে বসে পড়ে। তারপর বুধুর হাত থেকে ওর চুট্টিটা নিয়ে বেদম টান দেয়। নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বের করে বলে, “তু ইকটা কাম কইরতে পারবি?”
বুধু এ কথার কোন উওর না দিয়ে চুপ চাপ বসে
থাকে।
বুধুকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে লখাই আবার
বলে, “কামখান ইক্কে বারে সোজা বটে। তু কাল পাঞ্চায়েত অফিসে
যা। সবুজ মারান্ডিকে হামার
কথা বুললেই হবে। আরো দশ দিনের কাম তোর পাক্কা।”
বুধু এবারও লখাইয়ের কথার কোন উওর না দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে ধান চারাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তখনও চারা গাছটি থরথর করে কাঁপছে! বুধু বুঝতে পারে যে এখনও ধনকুদরা তার কাছেই রয়েছে। অর্থাৎ সে সব শুনছে।
বুধুকে আবার চুপ করে থাকতে দেখে লখাই ভাবে যে সে হয়তো তার কথাটা মেনে নিয়েছে। তাই সে বেশ উৎসাহ নিয়ে বল, “এ বুধুয়া, তু চুপ মাইরে গেইলি কেনে? আরে হামি তো বইলে দিছি তুর কাম হইয়ে যাবে। ইখন তু ইকবার হামার কথাটা মুনে ধরিস বটে”।
“কী কথাটা বটে শুনি?” বুধু অবাক হয়ে জানতে চায়।
“হায়-হায়!
কথা খান ভুইলে গেইলি! তুকে হামি তুর জমিনের কথা বলি লাই? তুতো কুন রা কাইটলি লাই!” লখাই কাতর গলায় বলে।
“দেখ লখাই, তু কত্ত জমিনের মালিক। আর হামার আছে মাত্র দু’বিঘা! বছরে দু’বার চার প্যাটের খোরাক দেয়। ইকে হামি বেঁইচতে লারব”। বুধু গলায় একটু ঝাঁঝ নিয়ে
বলে।
“দেখ বুধুয়া, তু মিছাই রাইগে যাছিস। হামি তুকে তিন বিঘা দিব। ইবার খুশি তো? সাথে তু পুরা একশো দিনের কাম পাবি। ইবার হামার কথাটা ভাইবে দেখ”। লখাই ওকে বোঝানোর
চেষ্টা করে।
বুধু বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখে ধান চারাটি খুব
জোরে জোরে মাথা নাড়ছে। বুধু বুঝতে পারে যে ধনকুদরা ওকে মানা করছে।
লখাই পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে বুধুকে
দিতে চাইলে সে ফিরেয়ে দেয়। লখাই আবার সিগারেটটা পকেটে রেখে বলে, “তবে হামি তুকে ভাল দাম
দিব বটে। তু রাজী থাইকলে সাড়ে তিন বিঘা দিব। ইবার দেখ ভাইবে কী করবি”।
বুধু একটু ভেবে বলে, “আচ্ছা লখাই ইকটা কথা বলতো
ইদিক পানেতো তুর কুন জমিন
লাই। তু তবে ই জমিনটা লিয়ে কী
কইরবি? তুর মতলবটা খুইলে বল কেনে”।
লখাই বার কয়েক ঢোক গিলে বলে, “হামার কুন মতলব লাই। আসলে সারা পাথারের বেবাক
জমিন যখন রুখা শুখা থাকে,
তখন তুর জমিনটাকে হামার
লতুন বউয়ের মতুন বড় চটকদার লাগে!
যেন সব সুময় উ হাঁইসছে! বছরে দুবার তুর গোলা ভইরে দিছে। আর লোকে যিটা বইলছে সিটা কী ঠিক বটে?”
“আগে শুনি লোকে কী বইলছে”। বুধু জানতে চায়।
“ঐ যে সব্বাই বইলে বেড়াইছে যে বুধু
সোরেনের জমিনে নাকি ধনকুদরার বাস। তা ইটা কি ঠিক বটে?” লখাই জানতে চায়।
“হাঁ, ঠিক বটে”। বুধু একবার বাঁদিকে তাকায়।
“তা, তু উয়ারে পাইলি কুথাকে? কার জমিনে ছিল?” লখাই জানার জন্য ভীষণ উদ্গ্রীব
হয়ে ওঠে।
“হামি আবার পাব কুথায়। নিজে নিজে একদিন চইলে আইসছে”। একথা বলে বুধু লখাইয়ের
দিকে তাকায়।
বুধুর কথায় লখাই একচোট হেসে নিয়ে বলে, “ইটা প্যাঁন্দা কথা বটে
বুধুয়া। ইটা প্যাঁন্দা কথা বটে। কত্ত ভাল ভাল লোকে পুজা কইরেছে, মানত কইরেছে, তবু উয়ারে পায় লাই। আর উ কিনা হাঁইটতে হাঁইটতে তুর ঘরকে চইলে আইসল! ইটা লোকে মাইনবেক লাইরে বুধুয়া”। লখাই আপন মনে মাথা নাড়ে।
“না মাইনবেক, তো মাইনবেক না। হামি কি ইকথাটা পাঁচজনেরে বইলে বেরাইছি? তু শুধালি বুলেই বলছি বটে”।
লখাই উসখুস করে ওঠে। ওর বুকটা ধরাস ধরাস করে। ও আরো জানার জন্য ব্যাকুল
হয়ে বলে, “তুর কথাটা যদি সত্যি হয়
বটে তাহলে উয়ার শরীল খান ইকবার বল দেখি”।
“উয়ার কুন শরীল লাই”। বুধু নির্লিপ্ত গলায় বলে।
“দেখিস লাই যদি তাহলে কথা বলিস ক্যামলে?”
লখাইয়ের মনে সন্দেহ দেখা
দেয়।
“কেনে, কথা বইলতে কি দেইখতে লাগে? উ কথা বললে হামি শুনি বটে। আবার হামি বইললে উ শুনে বটে”।
“ঠিক আছে, তুর কথাটাকে হামি মাইনব বটে যদি তু উয়ারে ইখানে ডাইকতে পারিস। আর যদি ডাইকতে লারিস তাহলে
তুকে জানগুরুর বিধান মাইনতে হবে মুনে রাখিস”। লখাই বুধুয়াকে জব্দ করতে চায়।
বুধু মনে মনে হাসে। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখে এখনও ধনকুদরা ধান চারায়
বসে আছে। তাহলে এতক্ষণ সে সব কথাই শুনেছে। বুধু লখাইকে বলে, “উয়ারে ডাইকতে হবেক লাই। উ ইখানেই আছে বটে”।
এবার লখাই অবাক হয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে
কাউকে দেখতে না পেয়ে একটু রেগে গিয়ে বলে, “বুধুয়া, তু হামাকে কি বুরবক পাইয়েছিস? তু ভাইবেছিস কি হামি তুর ভেইলকি বুইঝতে লারব! তা তো হবেক লাই। দেখা
– দেখা
কুথায় তুর ধনকুদরা আছে দেখা”।
বুধুয়া জমিতে ধান চারাটিকে দেখিয়ে বলে, “ইটাই হামার ধনকুদরা
বটে”।
লখাই অবিশ্বাসের গলায় বলে, “ইতো ধান চারাগাছ বটে। উয়ারা কি একই হল লাকি?”
“হ্যাঁ, একই বটে। ইকবার ইদিকে তাকায় দেখ কেনে। ক্যামুন দুইলছে দেখ । সারা পাথারে আর কুন
গাছ দুইলছে কি?” বুধু বলে।
লখাই চারদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে মাথা
নাড়ে।
বুধু আবার বলে, “আজ মাঠে বাতাস লাই, তাই গাছও দুলবেক লাই। অথচ ই চারাগাছ দুইলছে কেনে? উটাকে দুলাইছে ধনকুদরা। নিজের চোক্ষে দেইখেলে লখাই। পরে হামাকে দুষবি লাই”।
ব্যাপারটা লখাইয়ের বড় অদ্ভুত লাগে। কেমন যেন একটা গা
ছমছমে ভাব! ও বার কয়েক ঢোক গিলে
বলে,
“বুধুয়া, তু কি উয়ারে ঘরকে পাঠাইন দিতে পারবি?”
“হাঁ-হাঁ,
সুময়টাতো পাইরান যাইছে। ইবার উয়ার ঘরকে
যাওয়াই ভাল। তু ইবার ঘরকে চইলেই যা ধনকুদরা। হামিও যাছি বটে”। বুধু একথা বলার সাথে সাথে লখাই দেখতে পেল যে ঐ চারাগাছটি অন্য গাছের মতো নিশ্চল হয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। আর নড়ছে না !
লখাই সবটাই বিস্মিত হয়ে দেখে। তারপর চারদিকে তাকিয়ে
বিড়বিড় করতে করতে দ্রুত পায়ে কখনও বা একটু দৌড়ে জমির আলের উপর দিয়ে ছুটতে থাকে। দূরে গিয়ে চিৎকার করে বলে, “তু ডাইন আছিসরে বুধুয়া, তু ডাইন আছিস!”
(দুই)
শহরের ব্যস্ত জীবনে কেউ কারোর খবর না রাখলেও
গ্রামীন জীবনটা ঠিক এর উলটো। সেখানে ভোর থেকেই বাতাস সনসন করে ছোটে! সারা গ্রামের খবর ফেলতে ফেলতে যায়! এইভাবেই কার বাড়ির বউয়ের উপর কোন মরদের কূ নজর পড়েছে, কার মেয়ে কার সাথে সটকে পড়েছে বা কার পুকুরের মাছ রোজ ঘাই মারছে , এসব থেকে শুরু করে কার গাইটা বকনা বিয়োলো ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যাপারগুলো
সকালে চায়ের দোকানে দিব্বি টা-এর কাজ করে। তবে ইদানীং রাজনীতির কুট
কাচালি অনেকের মনেই বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে! আর তাই মাঝে মাঝেই চায়ের দোকানের নিষ্কলুষ আড্ডায় বারুদের গন্ধ ভেসে আসছে! তবে এর মধ্যেই সবার কানে পৌছে গেছে বুধু সোরেনের বাড়ির খবর! তাই ধনকুদরার কথা এখন আর কারোর অজানা নয়। তবে তা বুড়োরা যেমন বিশ্বাস
করেছে, ছেলে-ছোকরারা অতটা করেনি। ওরা ব্যাপারটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। তাতে অবশ্য আলোচনা থেমে
থাকেনি। বরং যে যেমন পারে তাতে
রং চড়িয়ে নিজের মতো করে পরিবেশন করছে! তাই গ্রাম-গঞ্জের চায়ের দোকান থেকে
গ্রামের পুকুর ঘাট এবং পুকুর ঘাট থেকে গ্রামের হাট হয়ে গাড়ি চেপে শহরে পৌছে যেতে খবরটার
বেশি সময় লাগেনি! তাই বুধু সোরেনের ঘরের
খবর এখন শহরের চায়ের টেবিলে পৌছে গেছে!
সিন্ডিকেটের অফিসে বসে গুলতানি মারতে মারতে
কথাটা কাননের কানেও গেল। ও তখন একমনে সিগারেট খাছিল। কথাটা কানে যেতেই ওর ছোটবেলার একটা ঘটনা
মনে পড়ে যায়। তখন ওরা গ্রামে থাকত। সেখানে শহরের থেকে বেশি ভূত থাকে আর এ কথাটা সবাই জানে। শহরের এত হৈচৈ, এত আলোর রোশনাই ভূতেরা একেবারেই পছন্দ করে না। ওরা ওদের মতো থাকতে চায়। আর তাই নির্জনতা খোঁজে। গ্রামের বাঁশবাগান, পুকুরের ঈশান কোণের হিজল গাছ বা তাল গাছের মাথা তাই ওদের অত
প্রিয়। তাছাড়া গ্রামের লোকদের
ভয় দেখিয়ে ওরা খুব মজাও পায় এবং নিজেদের মধ্যে তা নিয়ে হাসাহাসিও করে।
তেমনি এক বাঁশবাগান, আমবাগান ঘেরা গ্রামে কাননের ছোটবেলাটা কেটেছে। সেই গ্রামে একটা লোক নাকি
ভূত পুষতো! ওর দুটো বেঁটে-বেঁটে ভূত ছিল! যত ধরনের অকাজ-কূকাজ সব নাকি করে দিত
ঐ বেঁটে ভূতেরা। এই ব্যাপারটা কানন জানে গগনের জন্য। গগন ঐ বাড়ির ছেলে এবং কাননের বন্ধু। ও মাঝে মাঝে অসময়ের ফল এনে দিয়ে বলতো, চট করে খেয়ে নে, কেউ যেন না দেখে! কানন অবাক হয়ে জানতে চাইলে বলত, বাবাকে কে যেন এনে দিয়েছে। তাহলে এই যে ‘ধনকুদরা’ এও কি এক ধরনের ভূত! নাকি দেবতা!
নাকি সবটাই এক ধরনের ভাঁওতা!
ইদানীং সিন্ডিকেটে ক্রমশই ভিড় বেড়ে চলেছে। সবাই ভাবছে এটাই বুঝি একমাত্র
মধুভান্ড! পেটে সামান্য বিদ্যা থাক
বা না থাক, যেন সিন্ডিকেটে গেলেই পেটের ভাত জুটে যাবে। তাই নতুন ছেলেদের ভিড়ে এখন আর বসার জায়গা
পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে তাই সিঁড়িতেই বসে থাকতে হয়! তাও সব মেনে নেওয়া যায় যদি মাসে একটা করে অর্ডার পাওয়া যেত। কিন্তু সে গুড়ে বালি। তবে মাস দুয়েক আগে যে কাজটা
পাওয়া গিয়েছিল ওটা করতে পারলে পুরো বছর পায়ের উপর পা দিয়ে দিব্বি চলে যেত। কিন্তু কপাল মন্দ হলে যা
হয় আর কি! কাজ শুরুর আগেই মাঝখানে
ঝাঁপিয়ে পড়ল কানের লতি কাটা পটলা। ও কারখানার মালিকের কাছে চেয়ে বসল পুরো তিরিশ লাখ! মালিক রাজি না হওয়ায় তার একজন কর্মচারীকে একেবারে তুলে নিল! মালিক ভয় পেয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেল ভিনরাজ্যে। অথচ লতি কাটা পটলার কিছুই
হল না। আসলে আমরা সবাই জানি পটলার মাথার উপরে কার হাত রয়েছে। হাত বললে বোধ হয় ভুল হবে। ওটাকে ছাতা বলাই বরং ভাল। ব্যস, তখন থেকে বসে বসে মাছি তাড়ানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই। বাড়ি ফিরে এসেও কাননের
মাথায় বারবার ঘুরে ফিরে
‘ধনকুদরা’ উঁকি দিয়ে যাচ্ছে! চোখ বন্ধ করেও স্বস্তি নেই। হাতছানি দিচ্ছে। অন্ধকারেও কিছু আকৃতিহীন রেখার সমষ্টি তিড়িংবিড়িং
করে যেন চোখের সামনে নেচে চলেছে!
দেখতে না পেলেও কানন দিব্বি
ওর অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারছে। এমনটা একদিন নয়। প্রায় প্রতিদিনই কাননের চোখের সামনে, মনের মধ্যে নেচে চলেছে। ও কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। আবার কাউকে আগবাড়িয়ে বলতেও
পারছে না। তাই কানন একদিন একেবারে তৈরি হয়েই রওনা দিল ধনকুদরার দেশের উদ্দেশে।
(তিন)
কাননকে বাস থেকে নামিয়ে দিয়ে কন্ডাক্টর দূরে
একটা গ্রাম দেখিয়ে
দিল। ওটাই নাকি খয়েরপুর গ্রাম। গাছপালার ফাঁক দিয়ে কয়েকটা বাড়ির ছাউনি দেখা
যাচ্ছে বটে, কিন্তু রাস্তা কই! রাস্তার
দু’ধারেই জমি। ছোট-বড় ধানচারা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আবার কোন জমি বুকে কিছু গাছপালা নিয়ে বিবস্ত্র নারীর মতো শুয়ে আছে। চারদিকের নিঃঝুম নির্জনতা কাননকে আরো একা করে দিল। বেলাও বেশি হয়নি। সবে মাত্র আটটা। কানন একটা সিগারেট ধরায়।
আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠ পাথার ভেঙে কানন এগিয়ে
যেতেই পারে। কিন্তু জমির আলে যে সব ছোট ছোট গর্ত থাকে আর তাতে যে বিষাক্ত
সাপেরা ইঁদুর ধরার জন্য অপেক্ষা করে, তা কানন গ্রামে থাকার সময় দেখেছে। কাজেই একা ওপথে নয়। আবার এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট
করার কোন মানেই হয় না। হঠাৎ একটা কুকুর কোথা থেকে এসে কাননের পেছনে দাঁড়াল। কানন দেখতে পায়নি। তারপর বুঝতে পেরে একলাফে সরে দাঁড়ায়। কুকুরটিও দু’পা পিছিয়ে গিয়ে করুণ চোখে কাননের দিকে তাকিয়ে থাকে। কুচকুচে কালোরঙ, আর চোখ দুটো অদ্ভুত রকমের হলুদ! কাননের একটু ভয়-ভয় করে। কিন্তু সাথে সাথে মনে পড়ে পান্ডবদের মহাপ্রস্থানে যাওয়ার কথা সেখানেও একটা কুকুর ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাহলে এই মুহূর্তে হয়তো
এই কুকুরটিও তাকে গ্রামের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কানন সাথে সাথে ওর কাঁধের
ব্যাগ থেকে বিস্কুট বের করে কুকুরটির সাথে ভাব জমিয়ে নিতে চায়। এবং নিজে জমির আলে গিয়ে কুকুরটিকে একটা বিস্কুট দেয়। কুকুরটি কাননকে অনুসরণ
করে। কানন তার পিছনে একটা করে বিস্কুট ছুঁড়ে দিয়ে হাঁটতে থাকে। বিস্কুট শেষ হতেই কাননের মনে হয় সে একি করছে! কোথায় কুকুরটির সামনে যাওয়ার
কথা, তা নয়, সে চলেছে পেছনে। তাহলে ওকে সাথে আনার মানেটা
কী! কানন পেছনে তাকায়। দেখে কুকুরটি নেই! কি আশ্চর্য
ও কোথায়! শেষে দেখে আলের উপরে কয়েকটা বিস্কুট পড়ে রয়েছে
আর কুকুরটি আলের নীচে বসে পরম যত্নে একটা ইঁদুর খাচ্ছে। কানন আর ওর জন্য অপেক্ষা
না করে দ্রুত আলের পথে পা বাড়ায়।
বুধু সোরেনের বাড়ি পেতে কাননকে খুব একটা
মেহনত করতে হল না। তবে বুধু বাড়িতে নেই। কানন যে শহর থেকে আসছে
তা জানতে পেরে একটা কিশোর বলল, “উ তো জমিনে
আছে। হামি উয়ারে ডাইকব কি?”
কানন একটু ভেবে বলল, “না, তোমাকে ডাকতে হবে না। বরং তুমি কি আমাকে ওর কাছে নিয়ে যেতে পারবে?”
বুধু তখন জমির আলে বসে এক মনে ধানচারা দেখছে। কাননকে নিয়ে ছেলেটি কাছে যেতেই বুধু মাথা তোলে। কানন কোন ভনিতা না করেই
বলে, “আপনি কি বুধু সোরেন?”
“হাঁ, বুধু সোরেন বটে”।
“আমি আপনার নাম শুনে আলাপ করতে এলাম”। কানন একগাল হাসে।
বুধুও হেসে বলে, আপনি তো হামাকে হাসাইলেনগো বাবু। হামার নাম তো গেরামে থাকে, উ আবার
শহরে যাবেক কেনে!”
“না,না, তা নয়। আপনি কি জানেন যে আপনার নাম এখন সারা দেশের লোকই জানে? তাই আমি আর না থাকতে পেরে চলেই এলাম”। কানন আসল কথাটা কীভাবে যে শুরু করবে তা বুঝতে পারছে না।
“তা কী কথাটা শুইনলেন বটে?” বুধু এক ঝলক কাননের মুখের দিকে তাকায়।
কানন আমতা আমতা করে বার কয়েক ঢোক গিলে বলল, “না, মানে শহরের চায়ের দোকানে এবং খাবার টেবিলে
তো শুধু আপনার কথাই আলোচনা হচ্ছে”।
বুধু অবাক হয়ে বলে, “ঐ যে আলুচনা না কি যেন কইলেন, উটা কী বটে!”
কানন হাসতে হাসতে বলে, “আসলে সবাই আপনার কথা জানতে চাইছে। আপনি যে অসীম সাহসী তা
আমরা জানি। তা না হলে কেউ ভূত পুষতে পারে! বাপরে বাপ! ঘরে সাপ থাকলে না হয় তাকে
দেখা যায় এবং লাঠি দিয়ে মারাও যায়। কিন্তু যাকে দেখাই যায় না, অথচ ঘরে সে আছে! এমন জিনিসকে কখনো কি পোষা
যায়! ও তো যে
কোন মুহূর্তে ঘাড়টা মটকে দিয়ে রক্ত খেয়ে নেবে মশাই! আমার তো ব্যাপারটা ভাবতেই পেটের মধ্যে হাত-পা সিঁধিয়ে
যাচ্ছে!”
বুধু হাঁ করে কাননের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কাননের কোন কথাই ওর বোধ গম্য হয়নি। কানন যে কী বলতে চাইল তা বুঝতে না পেরে বুধু
বলল, “হড়হড়িয়ে কী বুললেন বটে? ভূতের কী কথাটা বইলছিলেন বাবু?”
বুধু জানতে চাইছে দেখে কানন আবার উৎসাহের
সাথে বলে,
“আরে আপনার ভূত ধরার সাহসের
কথা বলছিলাম। তা দাদা, ঐ ভূতটাকে কোন গাছ থেকে ধরেছেন? হিজলগাছ, নাকি বাঁশবাগান? আমাকে একটা
ধরে দিন না। উপযুক্ত দাম দেব। পুরো এক লাখ টাকা দেব”।
বুধু ওর ঘোলাটে চোখ জোড়া কাননের মুখের উপর
রেখে শুধু মাথা নাড়ে। কানন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, তাহলে দু’লাখই দেব”।
বুধু কাননের মুখের উপর থেকে ওর চোখ না সরিয়ে
আবার মাথা নাড়ে। কানন বুঝতে পারে যে এই ব্যাটা বুড়ো বেশ ঘোরেল মাল। তাই সে দুম করে বলে, “ঠিক আছে, আমি পাঁচ
লাখ দেব”।
বুধু এবার ওর চোখ নামিয়ে বাঁ দিকে
অর্থাৎ ধানচারাটির দিকে তাকায়। ধানচারাটি পতপত করে নড়ছে। অর্থাৎ সে আছে । বুধুর কানের কাছে ফিসফিস করে ধনকুদরা বলে, “কীরে বুধু, কী ভাইবছিস? তুকে যে বাবুটা অত্ত ট্যাকার
কথা বইলল, তা তু রা কাইটছিস না কেনে?”
পাঁচলাখ টাকা মাত্র একটা ভূতের দাম! তাও বুধু
সোরেন রাজি না হওয়ায় কানন মনে মনে ভাবে – এ তো বড়
অদ্ভুত ত্যাঁদোড় লোক! দেখে মনে হয় না যে লোকটার এত খাই! শালা বুড়ো জীবনে লাখ টাকা দেখা তো দূরের কথা দশ হাজার টাকা
দেখেছে কি না সন্দেহ। তাছাড়া ওকে তো আর ভূতটা কিনতে হয়নি। গাছে ছিল, টুক করে ফল পাড়ার মতো পেড়ে
নিয়েছে। এতো বনবাদাড় থেকে কুড়িয়ে পাওয়ার মতো ব্যাপার। ভূতটাতো আর ও ছোটবেলা থেকে পোষেনি। তাহলে না হয় বোঝা যেত। তবু ব্যাটা পাঁচলাখেও রাজি হচ্ছে না কেন! তাহলে এর আগে কেউ এসে
ওকে আরো বেশি দাম বলে গেছে! যদি তাই হয়, তাহলে নচ্ছার বুড়ো অমন
ন্যাকা চৈতন্য সেজে বসে আছে কেন! আমাকে সরাসরি বলছে না কেন! কানন ক্রমশই অধৈর্য হয়ে ওঠে। ও হঠাৎ দুম করে বলে বসে, “এই যে বুড়োহাবড়া বুধু সোরেন, তোমার ঐ ভূতের দাম দশ লাখ
দেব। কি রাজি তো? ঐ টাকা দিয়ে তুমি এ তল্লাটের সব জমি কিনে
নিতে পারবে। তুমি মহাজন হয়ে যাবে হে, মহাজন হয়ে যাবে। নেতারা তোমার বাড়ি এসে তোমার পায়ে তেলের বদলে ঘি দেবে। তুমি এ অঞ্চলের প্রধান হতে পারবে। তোমাকে এ বয়সেও মেয়ের বাবারা তাদের মেয়েদের
উদ্ধার করার জন্য তোমার পায়ে ধরবে। নতুন বউ তোমার মাথায় গন্ধ তেল মাখিয়ে চুলে
বিলি কেটে দেবে। তুমি চাইলে সে তোমাকে স্নানও করিয়ে দিতে পারে। আর কি চাই বল? এবার বল তো, তোমার ভূতের
চেহারা কেমন? খুব মোটা সোটা নয় তো আবার । দেখ বাপু, তাহলে নিয়ে
যেতে পারব না। তোমাকে পৌছে দিতে হবে”।
বুধু ধানচারার মাথায় হাত বুলিয়ে আবার মাথা
নাড়ে ।
কাননের দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। ও বিষণ্ণ
মুখে বলে, ?তুমি বরং ওর সাথে একবার কথা বল। ও নিজের শরীরটাকে কতটা
ছোট করতে পারবে, তা বলুক। আচ্ছা, তুমি একবার ওকে ডাকতো। আমি বরং একবার ওর সাথে
কথা বলে নিই”।
বুধু তবু চুপ করে বসে থাকে। এখন ওর মাথাটা ঘুরছে। দশলাখের হিসেবটা ও নিজের
দুই হাতপায়ের আঙুল দিয়েও ঠিক কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ও বুঝতে পারছে না কতগুলো একশো টাকা দিলে দশলাখ হয়! শুধু জানে পাঁচের থেকে
দশ বড়। তবে হ্যাঁ, এই সমস্ত পাথারটাই যদি তার হয়ে যায়, তাহলে সে
অনেক মুনিষ রাখবে। আর কত জোড়া যে হাল-বলদ লাগবে তা অবশ্য এই
মুহূর্তে বলা যাবে না।
কিন্তু পায়ের উপর পা তুলে যে চুট্টি খাওয়া যাবে এবং
মুনিষ খাটানো যাবে তা অবশ্য ঠিক।
হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিস করে ধনকুদরা বলে, “তাহলে তু হামাকে বেঁইচবার ফিকির ভাইবছিস, না রে বুধুয়া? খুব বড়লোক হইতে সাধ হইছে! হাঁরে বুধুয়া, যে মা তুকে দু’বেলা ভাত
খিলাইছে, দুধ খিলাইছে, উয়ারে তু
বেঁইচতে লারবি? তুর বুকটা
ইকটুও কাঁইপবেক লাই?”
এ কথায় বুধু হঠাৎ চমকে ওঠে। সত্যিই তো সে ভীষণ ভুল ভাবছিল। মনটা হঠাৎ দশলাখ টাকার গন্ধে দুর্বল হয়ে
পড়েছিল। তাই সে মনে মনে নিজেকে বেহুদ্দা বলে গালাগাল দেয়।
এতক্ষণ ধরে চুপ করে থাকায় কানন ভাবল যে,
বুধুকে টাকা না দেখালে বোধহয় সে তাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারবে না। তাই কানন এবার ব্রিফকেসটা বুধুর চোখের সামনে খুলে ধরে।
বুধু মাথা তুলে তাকাতেই ওর চোখ দুটো চকচক
করে ওঠে! সে একি দেখছে! এই লালচে টাকাগুলাকে কত টাকা বলে তা বুধুর
জানা নেই! সে জীবনে বোধহয় একবারই পাঁচশো টাকার নোট দেখেছিল। সে জানে না তার থেকেও বড়
নোট আছে কিনা। তবে এগুলো যে একশ টাকার নোট নয়, তা সে বুঝতে পেরেছে। বুধু পলকহীন চোখে ঐ টাকার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ কানন ওর ব্রিফকেসের
ডালাটা দুম করে বন্ধ করে দেওয়ায় বুধু চমকে ওঠে! কানন মুচকি হেসে বলে, “কি এবার বিশ্বাস হল তো? ভেবেছিলে আমি মিথ্যা কথা
বলছি। এবার তোমার ভূতকে দেখাও”।
বুধু ওর মাথাটা হাতির শুঁড়ের মতো দোলাতে
দোলাতে বলে,
“উ হামি দিখাতে লারব”।
“কেন! কেন দেখাতে পারবে না? আমি তো
ওর সাথে কথা বলতে চাই”। কানন বলে।
বুধু কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, “ই হবেক লাই গো বাবু। হামিই তো উয়ারে কুনদিন দেখি লাই! তবে উ হামার
সাথে সব সুময় ঘুইরে বেড়ায়। আর কথাও বলে বটে”।
কানন অবাক হয়ে বলে, “তুমি বলছ
যে ও সব সময় তোমার সাথে ঘুরে বেড়ায় অথচ তুমি ওকে দেখতে পাও না! ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত তো! তাহলে ও
ভূত বলেই কি তুমি ওকে দেখতে পাও না, নাকি অন্য কিছু?”
বুধু আবার
মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, “না,না, উ ভূত হবেক কেনে। উ তো ধনকুদরা আছে। হামাদের
লক্ষ্মী আছে। হামি দেইখতে পাইনা বটে, তবে বুইঝতে পারি”।
“কী করে
বোঝ?” কানন একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
“ইটা হামি
তুমাকে দেখাইতে পারব বটে। তবে ধনকুদরা তুমার সাইথে কুন কথা বইলবেক কিনা তা হামি বইলতে লারব”। বুধু আগে থেকেই ব্যাপারটা বলে রাখে।
“কিন্তু ওকে দেখার পর আমি যদি ওকে ধরে নিতে পারি তাহলে তোমার কোন আপত্তি নেই
তো?” কাননের কথা শুনে বুধু মাথা নেড়ে বলে, না, তার কোন
আপত্তি নেই।
এ কথা শুনে কানন তাড়াতাড়ি বলে, “দেখ বুধু সোরেন, আমি তোমাকে ধরে দিতে বলেছিলাম। তুমি দাওনি। আমি ঐ ভূতটার সরি ধনকুদরার জন্য দশলাখ দেব বলেছিলাম, তুমি তাও হ্যাঁ-না কিছুই
বলনি। এখনও তুমি যদি ওকে ধরে এই বোতলে বন্দি করে আমাকে দিতে পার তাহলে
আমি যা বলেছি তাই দেব। কিন্তু আমি যদি মেহনত করে ওকে বোতল বন্দি করতে পারি তাহলে কিন্তু
এক পয়সাও দেব না। এটা মনে রেখ। কথাটা আগে বলে দেওয়াই ভাল”।
বুধু ঐ ধান চারাটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে , “শুইনলি তো, বাবু কি বইলছে বটে? তুয়াকে দশ লাখে কিইনে লিবে বইলছে। এই বাবুরে যদি তুয়ার মুনে ধরে তাহলে তু উয়ার সাথে যা কেনে। হামি মুনে গুস্যা কইরবক লাই”।
কানন উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পায় না। তবে বুধু যে বিড়বিড় করে কারোর সাথে কথা বলছে তা বুঝতে পেরে কানন জানতে চায়, বুধু কার সাথে কথা বলছে।
এবার বুধু কানলের দিকে তাকিয়ে বলে, “হামার ধনকুদরার সাইথে কথা বইলছিলাম বাবু। উয়াকে সব মুনে করান দিলাম”।
কানন হেসে বলল,
“কি যা তা বলছ বুধু সোরেন, এমন কখনো
হয় নাকি?”
বুধু এবার একটু গলা চড়িয়ে বলে, “কেনে, হবেকলাই কেনে শুনি? হামি কি তুমারে প্যাঁন্দা কথা বলছি নাকি?”
কানন বোঝে যে বুধু ওর কথায় বেজায় রেগে গেছে। তাই ব্যাপারটাকে সহজ করার
জন্য ও বলে,
“না, না, তা নয়। কিন্তু যদি দেখতে না পাই তাহলে বুঝব কী করে যে সে এসেছে?”
“বাতাসরে আপনি দেইখতে পান বাবু? কিন্তু বাতাস আছে উটা সহজেই বুইঝতে পারেন। তাই বাতাসের চাল দেইখা বুইঝবেন গো বাবু উ আছে, কি নাই”। বুধু নির্লিপ্ত
গলায় বলে।
“বাতাসের চলন, সে আবার কেমন?” কাননের সব কিছু যেন তালগোল পাকিয়ে যায়।
“হাঁ, সেরেফ বাতাসের ঢং দেইখা বুইঝতে পারবেন। এ বাতাস অন্য বাতাসের মতন
লয় গো বাবু”।
“সে আবার কী! বাতাস তো বাতাসই হয়!” কানন ভাবে
লোকটা ওকে বুদ্ধু বানাচ্ছে না তো!
“দাঁড়ান বাবু, আপনাকে হামি দেখাইনছি। ও ধনকুদরা, তুমি কি
ঘুমাই
গেইলছ? তুমাকে
কি উঠাইন দিব? কী বুইলছ? আচ্ছা-আচ্ছা। ইবার বাবুরে তুমার ভেইলকিটা ইকবার দেখাইন দাও না কেনে। বাবু তো শহরের মানুষ বটে। তাই তুমারে ভূত ভাইবছেন। তুমাকে মুনে লিতে পাইরছেন লাই”।
বুধু কান পেতে কি যেন শোনে। তারপর সামনের জমিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, “উ দিকে ইকবার তাকান কেনে। কী দেইখছেন? ঐ যে ধানচারাগুলান
মাথা দুলাইনছে, শরীল দুলাইনছে! এত্ত বড় পাথারে আর কুন
ধান চারাকে বাতাস দুলাইনছে কি? আর উখানেই আছে ধনকুদরা। ই কামটা সেই কইরছে বটে”।
কানন একবার আদিগন্ত বিস্তৃত পাথারের দিকে চোখ বোলায়। এতবড় পাথারটায় কে যেন সবুজ
গালিচা পেতে দিয়েছে! কোথাও কোন বাতাস নেই! কোন গাছের পাতাটুকু পর্যন্ত
নড়ছে
না! অথচ শুধু
ঐ সামনের কিছু ধানচারা এখনও দিব্বি মাথা দুলিয়ে চলেছে! যেন ওরা ভীষণ আনন্দে নেচে
চলেছে! ব্যাপারটা বেশ কিছুটা সময় ধরে দেখার পর কাননের বিশ্বাস হয় যে সত্যিই
ধনকুদরা এই মুহূর্তে ঐ জায়গায় অবস্থান করছে। কাননের চোখ দুটো আনন্দে চকচক করে ওঠে। ও তাড়াতাড়ি ওর শরীর থেকে জামাটা খুলে ফেলে। জামার বোতামগুলো আবার লাগিয়ে
নিয়ে হাতা দুটোকে ভাল করে জামার গলার সাথে গিঁট দিয়ে নেয়। এবার জামাটাকে দেখে মনে
হয় একটা বস্তা। ওটার মধ্যে ধনকুদরাকে বন্দি করার জন্য কানন ঐ আন্দোলিত ধানচারাগুলোর
মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে! কিছুটা সময় সে চেষ্টা করে ধনকুদরাকে জাপটে ধরার। কিন্তু ধনকুদরা তখন ধীরে ধীরে তার বাতাস বাড়িয়ে দিয়েছে! হঠাৎ দেখলে
মনে হবে যেন কোন মত্তহাতি ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে সমস্ত কিছুকে দু’পায়ে দলে পিষে ধ্বংস করতে
চাইছে! একসময় বাতাস আরো জোরে পাক খেতে খেতে উপরে উঠতে থাকে! কিন্তু
কানন তখনও ঐ ধানচারাগুলোকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে! আর বাতাসটা এক সময় কাননের
টাকা ভর্তি ব্রিফকেসের ডালাটাকে খুলে দেয়। ওরা দীর্ঘদিনের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে
নীলদিগন্তে ডানা মেলে ভাসতে ভাসতে এক সময় বিন্দু হয়ে যায়!
বুধু সোরেন এতক্ষণ আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে টাকাগুলোর উড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে নিজের ছোটবেলায় চলে গিয়েছিল! ঐ টাকাগুলোকে ওর ভোঁকাট্টা ঘুড়ির মতো মনে হচ্ছিল! আজ যদি শরীরে সেই তাকদ থাকতো, তাহলে হয়তো সে ছুট লাগাত ঐ ভোঁকাট্টা টাকাগুলোর পেছনে। ওকে ঐভাবে ছুটতে দেখে হয়তো আরো কচিকাঁচার দল ওর পিছু নিত। কিন্তু কেউ ঐ ভোঁকাট্টা টাকা ঘুড়ির নাগাল পেত না! কারণ এ ঘুড়িটার কোন সুতো নেই! বুধুর মনে হল, এ তো সাধারণ ঘুড়ি নয়, এ তো মায়ার বন্ধন ছিঁড়ে উড়ে যাওয়া কাননের এক ইচ্ছেঘুড়ি! তাই ধনকুদরা তাকে সাথে করেই নিয়ে গিয়েছে!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন