সমকালীন ছোটগল্প |
নিকটবর্তী রূপকথা
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চারপাশ আরো নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। বলা যায় নিঃশব্দতম। এই শহরটি আসলে বুড়ো হয়ে গেছে। কারণ শহরে কোনো যুবক যুবতী নেই। যারা আছে তারা সবাই ডেলিভারি বয় কিংবা গার্ল। বাড়ি বাড়ি জিনিস পৌঁছে দেওয়াই তাদের কাজ। একসঙ্গে একটি শহর বুড়ো হয়ে গেছে ভাবলে খুব আশ্চর্য মনে হয়। কিন্তু আসলে তাই। সবুজ একটি পাহাড়ের ঢালে, অনেকগুলো হাউজিং কম্পপ্লেক্স বানিয়ে, সঙ্গে শপিং মল, স্কুল, পার্ক ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে শহরটি গড়ে তোলা হয়েছিল। যারা ফ্ল্যাট কিনে এসেছিল এখানে প্রায় সবাই কাছাকাছি বয়সের, সদ্য বিবাহিত বা ছোট ছোট সন্তান। হইচই, খেলাধুলো মুখর করে রেখেছিল শহরটিকে। তারপর যা হয়, পাখিদের হাতছানি দিচ্ছিল নীল আকাশ। তারা ডানা মেলে উড়ে গেলো। এদিকে মা বাবাদের কাঁধ ঝুঁকে এসেছে, হাঁটুতে ব্যথা, অবসর জীবনের না ফুরোনো সময়, কেবলি সন্তানদের কাছে পেতে ইচ্ছে করে। যা কিনা হবার নয়। ফ্ল্যাটগুলো এখন আর আগের মতো ঝলমলে নয়, তাদের এখন রঙের অভাব, পরিচর্যার অভাব। এই বিষণ্ণ শহরটিতে যখন সকাল হয়, তখন দুধের পাউচ, পাউরুটির প্যাকেট, ফল, সব্জি, মাছ, মাংস সব কিছু নিয়ে ডেলিভারি বয়দের ছুটোছুটি শুরু হয়। অনেকে অবশ্য হাঁটতেও বেরোন। তাদের কথাবার্তায় প্রথম প্রথম প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল, সাফল্যের আনন্দ। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় কত ভালো ইত্যাদি, আজকাল সেসব ফিকে হয়ে গেছে। এখন দেখা হলে অন্য গল্প হয়, গল্পটি হলো তাদের ছোটবেলার শহর ছেড়ে আসার গল্প। সেখানে ফিরে যেতে তাদেরও পকেট থেকে হারিয়ে গিয়েছিল সময়। মানুষের কোথাও যাওয়ার জায়গা দিনে দিনে কমে যায়। রাস্তা ছোট হতে হতে শোবার ঘর থেকে বাথরুম বা ব্যালকনি, তারপর শুধু হাতের কাছের রিমোট কন্ট্রোল।
কিন্তু
এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। শহরটিকে বদলে ফেলতে হবে। তাই একদিন এই শহরে একটি মিটিং
ডাকা হলো। পার্কে সেদিন খানিকটা উৎসবের মেজাজ। অনেকদিন পর কিছু একটা হচ্ছে। যে সংস্থাটি
এই সভাটির আয়োজন করল, তারা বেলুন দিয়ে সাজালো। যেন অন্নপ্রাশন বা জন্মদিন। খাবার দাবার
ইত্যাদি। আস্তে আস্তে সভা শুরু হলো। কাউকে না কাউকে শুরু করতে হয়, এমনই একজন মানুষ
শ্বেতশিখর। তিনি খুব জোর গলায় বলতে লাগলেন, বিষাদ কাটিয়ে উঠতে হবে, আমরা যে সমস্যাগুলোর
মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, সেগুলো চলতে দেওয়া ঠিক নয়। রুখে দাঁড়ানো হোক। কিন্ত কীভাবে? মিসেস
রৌদ্রমায়া চিন্তিতমুখে বললেন। পথ কোথায়? সবাই
তো বুড়োবুড়ি, টুক টুক করে দেহ রাখাও শুরু হতে আর বেশিদিন নেই, কিন্তু আবার দীর্ঘজীবনও
হতে পারে। তখন এই সময়টি কীভাবে অতিক্রম করা। মিঃ সমুদ্রবাহন একজন আর্মি অফিসার ছিলেন, তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, আমরা টাকা দেবো, কর্মচারী
রাখব, আর কারো কারো তো প্রথম থেকেই ছেলেমেয়ে নেই। তাই নিঃসঙ্গতা ব্যাপারটি একটি আপেক্ষিক
ব্যাপার মাত্র। তাহলে বৃদ্ধাবাসে চলে গেলেই হয়, মিঃ কর্ণ বললেন। সেখানে একটি প্রবলেম, আরো প্রবলতম হতাশার মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন
যেতে হয়, বলা যায় নেগেটিভ ভাবনার সমাহার, রৌদ্রমায়ার বক্তব্য। মিটিং চলতে লাগল। সমাধান বেরোবে না, একথা সবার জানা ছিল, কিন্তু
কিছু আলোচনা হলে, দীর্ঘশ্বাসের মুক্তি ঘটে,
এটাও দরকার। শেষপর্যন্ত আরো দুদিন পর আর একটি সভা আহ্বান করা হলো। ঠিক কী কারণে আলোচনা
হচ্ছে বা হবে তা ঠিক হলো না, তবে কথাবার্তা হবে সিনিয়র সিটিজেনদের নানান সমস্যা নিয়ে, এটা বলা
হলো। এখন থেকে প্রত্যেক সপ্তাহে মানুষগুলো জড়ো হয়। কিছুক্ষণ গল্প হয়। তারপর যে যার
গুহায় চলে যায়। কিন্তু সবচেয়ে বয়স্কতম মানুষটি প্রত্যেকটি সভার বিবরণ দিতে শুরু করলেন
স্যোসাল মিডিয়ায়। তিনি জিমূতবাহন। ভালোই লেখেন
চিঠিগুলো, পড়লে মনখারাপ হয় অথবা গ্লানি। কিন্তু তিনি সহানুভূতি চান না। খুব
নির্লিপ্তভাবে লেখা হয় চিঠিগুলো। যেমন,
“কাল
বাড়ির সমস্ত খেলনাগুলো খুঁজে বের করলাম, সেগুলো ব্যাগে ভরে, রেখে এলাম ছাদে। পরের দিন, সকাল সকাল ছাদে গিয়ে দেখি খেলনার
ব্যাগ নেই, এতো রাতে কে উঠেছিল ছাদে? আরো একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, খেলনাগুলো আছে।
কারা যেন খেলে গেছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে, সহজে ঠাহর করা যায় না”।
এভাবে প্রায় একবছর কাটল। তারপর সেই বিশেষ ঘটনাটি ঘটল। একদিন প্রায় একই সময়ে সবগুলো ফ্ল্যাটের স্তব্ধ কলিংবেল আচমকাই বেজে উঠল।
দরজা
খুলে প্রত্যেক মা বাবার চমকানোর পালা। একইসঙ্গে সবার ছেলেমেয়েরা ফিরে এসেছে হাসতে হাসতে।
আরও আশ্চর্যের কথা হলো, তারা নাকি আর কোথাও
যাবে না। সবাই সবার মা বাবার কাছে থাকবে। শুধু সমুদ্রবাহন প্রখরভাবে দৃষ্টি রাখেন ফিরে
আসা ছেলেমেয়েদের দিকে। অবশেষে এক ডিসেম্বরের সকালে তিনি আবিষ্কার করলেন, প্রত্যেকটি
ছেলেমেয়ের ভেতরে যন্ত্রপাতি আছে। রক্তমাংসের
হাড় মজ্জা নয়, মাইক্রোচিপস। আসল ছেলেমেয়েরা রোবট পাঠিয়েছে মা বাবাদের জন্য, ঠিক তাদেরই
মতো দেখতে, ভেতরে গুঁজে দিয়েছে আর্টিফিশিয়াল হৃদয়, দুঃখ, আনন্দ এবং ভালোবাসা।
অনবদ্য তুলনাহীন। ভালো থাকবেন।
উত্তরমুছুনবিমল চক্রবর্তী জামশেদপুরে থাকি।