কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২১

শুভ্রনীল চক্রবর্তী

 

পৃথিবী কি একটি হলোগ্রাম?




অনেকেই মনে করেন আমাদের এই পৃথিবী একটি হলোগ্রাম অর্থাৎ আমরা একটি সিমুলেশনের মধ্যে বাস করছি। সহজ ভাবে বলতে গেলে, ধরুন আমাদের দৈনিক জীবনযাপন, সময় অক্ষ ধরে পৃথিবীর এই চরৈবেতি মন্ত্রযাপন বহুদিন আগেই কোন জৈবিক পরিবেশে হয়ে গেছে, আমরা শুধু তার প্রতিফলন মাত্র। চিন্তনবিদদের মতে, বহু দূরে কোনো দ্বিমাত্রিক তলে পৃথিবী তৈরি মানে বিগ ব্যাং  বা যেসব তত্ত্বের এখনো অব্দি আবিষ্কার হয়েছে, সেসব থেকে শুরু করে আজ অব্দি যা ঘটে এসেছে বা ভবিষ্যতে ঘটবে, তার সমস্ত রকম ব্লু প্রিন্ট মজুত আছে, আমরা শুধু নতুন এক স্পেস বা তলে তার প্রতিফলন বা আরও সূক্ষ্মভাবে বলা যায় প্রজেকশন দেখছি মাত্র – ঠিক যেমন সিনেমার রিলের প্রজেকশন দেখি সাদা পর্দায়। অর্থাৎ আপনার আমার জীবনযাপন ঐ সাদা পর্দার সিনেমা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এই ব্যাপারটা সম্পর্কে বিশদে জানতে হলে আমাদের আগে জানতে হবে হলোগ্রাম কি বা হলোগ্রফি প্রিন্সিপল কি? আসুন সহজ ভাষায় জেনে নেওয়া যাক এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা –

হলোগ্রাম কথাটি ফটোগ্রাফিতে খুবই জনপ্রিয় একটা শব্দ। সেই চিত্রকেই আমরা  হলোগ্রাম বলে থাকি যেটা আমরা মূলত তিন মাত্রিক তলের দ্বি মাত্রিক রূপ হিসেবে দেখতে পাই। তবে আমরা একটু আলোচনা করবো এর পিছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা গাণিতিক সূত্র নিয়ে। লিওনার্ড সাস্কিন্ড প্রথম বলেন হলোগ্রাফিক তত্ত্ব হলো স্ট্রিং থিওরীর এমন একটি প্রতিরূপ যেখানে কোনো উচ্চ মাত্রার আয়তন বা সমস্ত রকম তথ্য সংযোজিত থাকে অপেক্ষাকৃত নিম্ন মাত্রিক তলে (পাঠক এক্ষেত্রে সিনেমার রিল ও তিন মাত্রিক পর্দার উদাহরণ এর পরিপ্রেক্ষিতে ভাবতে পারেন)। আসলে এই তত্ত্ব অনুপ্রাণিত হয়েছে ব্ল্যাকহোল থার্মোডাইনামিক্স তত্ত্ব থেকে যেখানে মনে করা হয়, কোন বিন্দুতে সংগোপিত  অতি মাত্রিক শক্তি এক মাত্রায় সীমাবদ্ধ থাকে, আমাদের চাক্ষুষ তিন মাত্রিকতায় নয়। ব্ল্যাকশহোল ইনফরমেশন প্যারাডক্স তত্ত্বে অনেকে ব্ল্যাকহোলকে হলোগ্রাম হিসেবে দেখিয়েছেন এবং যদি ব্ল্যাকহোল থেকেই এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়, তাহলে বলাই বাহুল্য, অধুনা পৃথিবী তথা মহাবিশ্বের সমস্ত  কিছু ব্ল্যাকহোলে সংরক্ষিত ছিল।  



১৯৭৪ সালে স্টিফেন হকিংয়ের ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশন লস্ট তত্ত্বের একটি উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যদি এক বান্ডিল ফাইলকে আপনি ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলেন তাহলেও তার মধ্যে থাকা তথ্য ধ্বংস করা সম্ভব নয় বরং হকিংয়ের তত্ত্ব অনুযায়ী তা আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এবং এই তত্ত্ব সমান ভাবে সত্যি যে কোনো বস্তু কণার জন্য। ১৯৯০ সালে সাসকিন্ড বলেন ব্ল্যাকহোল সম্পূর্ণ ভাবে অদৃশ্য বা নিঃশেষিতও যদি হয়ে যায়, তাহলেও তার সমস্ত বস্তু তথ্য সংরক্ষিত থাকে ব্ল্যাকহোলের বহিঃঅক্ষ বরাবর এবং তা পুনরায় তিন মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।

সাস্কিন্ড বলেছেন, “হলোগ্রাফিক তত্ত্বের ন্যায় আমাদের এই মহাবিশ্ব বা আমাদের পৃথিবীতে এই প্রাণের সঞ্চার সমস্তইটাই দ্বি মাত্রিক বস্তু তথ্যের তিন মাত্রার বস্তুতে প্রজেকশন বা সহজ ভাবে বলা যায় প্রতিফলন মাত্র”।

১৯৯৮ সালে পদার্থবিদ মালদাসেনা বলেছেন, একটি হাইপথেটিকাল মহাবিশ্ব  হলোগ্রাম বা একটি বক্র তলের বিপরীতে কিন্তু বহুদূরে অবস্থিত আর একটি কার্ভ মাত্র। তার এই তত্ত্বকে বলা হয় অ্যান্টি ডি সিটার স্পেস থিওরি। মালদাসেনার মতে এই হলোগ্রাফিক তত্ত্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাথে বস্তু তথ্যকে যুক্ত করে যাকে বলা হয় কোয়ান্টাম গ্রাভিটি থিওরী। গত বছর এক অস্ট্রিয়ান ও ভারতীয় বিজ্ঞানী একটা পেপার পাবলিশ করেন, তাঁদের এন্টেঙ্গেল মেন্ট থিওরির মাধ্যমে ঠিক একই কথা বলার চেষ্টা করেছেন।

তবুও একথা ঠিক যে এখনো জনসমক্ষে এ সত্যি আনার মত যথাযথ প্রমাণ বা  একে টেস্ট করার যন্ত্র সম্পূর্ণ ভাবে আবিষ্কার করা যায়নি। এখনো তা পরীক্ষাধীন ও এই তত্ত্ব হাইপোথিসিস পর্যায়েই আছে। বর্তমানে ফার্মি ল্যাবে ক্রেগ হোগান একটি যন্ত্রের মাধ্যমে এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন, যার নাম হলোমিটার।



সুতরাং বলাই বাহুল্য, এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে অনেক বৈজ্ঞানিক ও পদার্থবিদরা এই নিয়ে গভীর চর্চা করছেন। ভাবুন তো একবার যদি এই তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভাবে গাণিতিক রূপে প্রমাণিত হয় তাহলে আমাদের জীবনের উপলব্ধিটাই কেমন পালটে যাবে! এই আপনার বাড়ি, আপনার গাড়ি বা পোষ্যকুকুর মানে আশে পাশের সবকিছুই আগে কখনো ছিল বা হয়ে এসেছে। আসলে বিজার প্রিন্সিপল অফ কোয়ান্টাম ফিজিক্সও কিন্তু সেই কথাই বলে যে, দুটো বহুদূরের বস্তুকণার মধ্যেও পরস্পরের সম্পূর্ণ প্রভাব থাকতে পারে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন