মেয়েদের মধ্যরাতের
স্বাধীনতা এবং মৃণাল সেন
ছায়াময় আলো।
ঠিক যেন প্রকাশ নেই। মেয়েদের জীবন অনেকটা এমনই, মেঘে ঢাকা তারা, কিন্ত যখন মেঘ সরল, আলোর প্রকাশ তখন তীব্র, সাবিত্রী সেই আলোয় নারী যে অপরিসীম শক্তির অধিকারী তা বোঝা
গেল...
সারারাত মেয়েটি
কোথায় ছিল? ছেলেরা বাইরে থাকলে প্রশ্ন ওঠে না, অথচ কোনও মেয়ে বাড়ির বাইরে থাকলে প্রশ্ন ওঠে। রাতের
বেলায় হিংস্রতা বেশি, আমরা সমাজকে বদলাব না, মানসিকতার পরিবর্তন করার কথা ভাবব না, হায়নাদের শাস্তির জন্য কড়া পদক্ষেপ করব না, শুধু মেয়েদের ঘরে রাখব। মৃণাল সেনের জীবননির্ভর ছবি পদাতিক
আগল ভেঙে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসা মেয়েদের রাত দখলের গল্প দিয়ে শুরু হয়েছে।
মৃণাল অতিরিক্ত
আধুনিক। ১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া তাঁর ছবি ‘একদিন প্রতিদিন’, মধ্যবিত্ত সমাজের
চিন্তাক্লিষ্ট তাপস মনোবৃত্তির আয়না, মমতাশঙ্করের চাপা, স্নিগ্ধ অভিনয় আমাদের মনে আছে। রাতভোর কত ছোটাছুটি। মর্গ, হাসপাতাল, বন্ধুর বাড়ি... চিনু কোথাও নেই।
তাহলে কি!
না, খারাপ ভাবতে নেই।
সকালে যখন চিনু
বাড়ি ফেরে তখন যেন নারী স্বাধীনতার তীব্র আশ্বাস, মৃণাল নিজেও জানতেন না চিনু কোথায় ছিল?
এটুকু মুক্তি তো
কাম্য।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের নতুন ছবি ‘পদাতিক’ টুকরো টুকরো মৃণাল সেনের ছবির দৃশ্য, সংলাপের মায়াদর্পণ। সূর্যের আলো বড় কঠিন, বাস্তব। মৃণাল সেনের ভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরী, গীতা সেনের ভূমিকায় মনামী ঘোষ প্রমাণ করলেন অভিনয়ের শিখরবিন্দু কত উচ্চ হতে পারে।
মৃণাল একজন গদ্য
কবি। তাঁর শিল্পবোধ সৃষ্টির তাড়না থেকে নিঃসৃত। আধুনিক চলচ্চিত্র পরিচালক তথা কবি
গদারের বক্তব্য, শিল্প আমাদের ভেতরের লুকিয়ে থাকা গোপন সত্তাকে আকর্ষণ করে। দর্শক তাই ভেবে
নেয় চিনুর অন্তর্ধানসম্পর্কিত আত্মদীক্ষিত ভাবনা।
মৃণাল সেন, তিনি ভাবতে পারেন দরজার ওপারে ভাঙাচোরা একটি খণ্ডহর আছে।
কারুকার্যময় কোনও প্রাসাদ নয়, তিনি তো দেশ তথা সারা পৃথিবীর ক্ষয়িষ্ণুতার কথাই বলেছেন। এক জাদুঘরের মধ্যে
বসেও ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়ির গল্প বলা
মুখের কথা নয়, তিনি পারেন আর সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবির বিশেষত্ব সেই বাস্তবতাকে আবার নিখাদ
তত্ত্বের আলোয় প্রতিষ্ঠা করে।
ছবি তৈরি হয়
এডিটিং টেবিলে। তাই এই ছবির পরতে পরতে সম্পাদনার মাধুর্য। ঠিক যেমন মৃণাল সেনের
ছবিতে থাকত। ক্যামেরার সাবলীল নমস্কার প্রণামের মধুরিমায় ভরা। কীভাবে যেন সব তুমি
আমি হয়ে যায়, আমি হয়ে ওঠে ‘ভুবন সোম’।
সৃজিতের মুন্সিয়ানা আলোর দিশার উত্তরণে, কখনও তা কোরাস আবার কখনও মহানভ মহাপৃথিবী।
ছবির সম্পদ তার
দৃশ্যায়িত আবেগ, সৃজিত সেই কাজ ভালভাবেই করেছেন। আমরা কি ভালবাসতে ভুলে গিয়েছি? মৃণাল সেনের প্রতিটি ছবি নিজস্ব ঘটনার আঙ্গিকে নির্ভরশীল
চেতনার দ্যোতক। ‘কলকাতা ৭১’, ‘ইন্টারভিউ’ এর পথচলা যে সুপ্ত ক্ষোভের জন্ম দেয় তা ক্রমশ মহীরুহের আকার ধারণ
করে ‘আকালের সন্ধানে’ ছবিতে। আমাদের
যাবতীয় ব্যক্তিগত বিদ্রোহ, প্রতিবাদ ক্রমশ সমষ্টিগত প্রতিবাদের চেহারা নেয়। যা বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, বিক্ষোভ, রিরংসা, মদমত্ততার হুঙ্কারকে সদর্থক আত্মজিজ্ঞাসায় পরিণত করে। 'খারিজ' করে দেয় প্রাতিষ্ঠানিক আস্ফালন। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়।
অনেক প্রশ্ন, অনেক চিহ্নিত নমস্কারের আলাপে ঋদ্ধ পদাতিক।
আগুন জ্বলছে...
অন্ধকার দূরীভূত।
'চলো এগিয়ে যাই'।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন