কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প


প্লাবিত সিঁদুর

অনেকদিন গরমে তাতিয়ে পুড়িয়ে অবশেষে বৃষ্টি এলো। প্রবল বৃষ্টি। কে জানে এটা নিম্নচাপের বৃষ্টি কিনা।

বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই সবিতা গুম হয়ে গেছে। না এমনটা নয় যে এ বিয়েতে তার মত ছিল না। ছিল বইকি। তাছাড়া ও যে পরিবারের মেয়ে সেখানে পাত্রস্থ হওয়াটাকেই মেয়েরা সৌভাগ্য মনে করে। সবিতাও তাই করেছিল। বিয়ে হচ্ছিল না বলে ঘরে বসেছিল ও। তাই সেই সৌভাগ্য বোধটা বোধহয় একটু বেশিই ছিল।

তবে সেটা কেটে গেল কিছুদিনেই। মোটের উপর স্বামী দেখতে সুপুরুষ। বয়সের ডিফারেন্স খুব বেশি নয়। এ সব ক্ষেত্রে যেরকম ডিফারেন্স থাকে সেরকমটা নয়। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই টের পাওয়া গেল সে একজন লম্পট পুরুষ। তার কু পাড়ায় যাতায়াত আছে। তার এই দোষ কাটানোর জন্যই নাকি সবিতার মতো একজন সোমত্ত এবং গায়ে গতরে ডবকা মেয়ের সাথে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবিতার শ্বাশুড়ির মনে হয়েছিল তেমন একটা মেয়ের ছলাকলায় তার দুশ্চরিত্র ছেলে শুধরে যাবে। সে বারমুখো থেকে ঘরমুখো হবে। দেখা গেল দিন পনেরোর মধ্যেই ছেলের নুতন বউয়ের নেশা কেটে গেল। সে আবার খালপারের বস্তিতে যাওয়া আসা শুরু করে দিল।

না ছেলেকে নয় এজন্য শ্বাশুড়িমা দায়ি করেছিলেন সবিতাকেই। চেহারা গা গতর ঠিকই আছে। তবে বউটা মনে হয় ছলাকলাটা কিছু জানে না। ছলাকলা ছাড়া পুরুষ মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যায়?

একদিন একটা মদের বোতল এনে শ্বাশুড়িমা সবিতাকে দিয়ে বলেছিলেন,

- এটা রাখ। রাতে গোকুলকে দিস। নিজেও খাস। অবাক হোস না। পুরুষ পটানোর জন্য করতে হয় এসব।

কিন্তু এ কৌশলও কাজে লাগেনি। গোকুল ঘরে থাকবে তবে তো এসব হবে। সে তো সাঁঝ বেলাতেই হাওয়া হয়ে যায়। ফেরে সেই পরদিন সকালে।

তাই সবিতার জীবন এখন গুম হয়ে যাওয়া মৃতপ্রায় মানুষের মতো।

প্রায়ই পাড়ার লোক এসে ঠেস মেরে কথা শুনিয়ে যায়।

- কি গো গোকুলের মা। তোমার গোকুল তো আবার খালপাড়ে যাচ্ছে। দু দিনেই নতুন বউয়ের নেশা কেটে গেল?

- কাটবেনি? বউ তো ঠান্ডা জল। ঠান্ডা জলে কারো নেশা হয়?

এরকম ঠেস মারা কথা বারবার শুনতে হয় সবিতাকে।

একদিন মরিয়া হয়ে সবিতা বলেছিলো,

- আপনার ছেলেকে বলুন। আমাকে তালাক দেবে।

- কি বল্লি? তালাক। আমরা কি মোসলমান নাকি? হিন্দু বাড়িতে তালাক হয়?

- তালাক না হয়। অন্যকিছু তো হয়। সেটাই দিতে বলুন।

শ্বাশুড়ি চিল চিৎকার করে গোটা পাড়ায় সবিতার এ হেন কু প্রস্তাবের কথা জানিয়ে দিয়েছিল।

কারা কারা যেন গোকুলের মাকে পরামর্শ দিয়েছিল।

- ভরা যৌবনের মেয়েছেলে। পুরুষের সঙ্গ না পেলে উতলা তো হবেই। দেখো দিদি ঘর ছেড়ে পালিয়ে টালিয়ে না যায়। তাহলে কিন্তু মস্ত কেলেঙ্কারি হবে।

কেলেঙ্কারি কিন্তু হয়েছিলো। তবে সেটা অন্যরকম।

সম্পর্ক যেমনই হোক। নিয়ম করে কপালে সিঁথিতে সিঁদুর পড়তো সবিতা। বিয়েতে পাওয়া সিঁদুর কৌটোটাতে যতটা সিঁদুর আছে অনেকদিন তা দিয়ে নিজের কপাল রাঙ্গানো যাবে।

একদিন হঠাৎ সবিতার মামা এসে হাজির। জানালো এই পথেই যাচ্ছিলো। তাই বাপমরা ভাগ্নিটার সাথে দেখা করবে বলে এসেছে।

সাথে একটা গোটা রুই, একবাক্স মিষ্টি। কুটুম বাড়ি বলে কথা!

সবিতার শ্বাশুড়ির তো তাকে দেখেই ঘাবড়ে গেলো। এখন সবিতা না তার মামাকে কি বলতে কি বলে বসে। তাহলেই তো মুস্কিল। পণ হিসেবে গয়না টাকা পয়সা তো কম নেওয়া হয়নি!

কিন্তু না। সবিতা কিছু বললো না। সিঁদুরে রাঙ্গানো কপাল দেখে মামা বুঝে নিলেন। তার ভাগ্নি সুখে সংসার করছে। উনি জানালেন ওনার তাড়া আছে। তাই দুপুরের মধ্যাহ্নভোজ না করেই উনি বিদায় নিলেন। মামা চলে যাবার পর সবিতার শ্বাশুড়ি এই প্রথম বৌমার সাথে পাশাপাশি বসে খাবার খেলেন।

মুখে আলাদা করে কিছু না বললেও সবিতা দেখলো তার শ্বাশুড়ি মায়ের চোখ ছলছল করছে। শ্বাশুড়িমা কোমল কন্ঠে সবিতাকে বললেন,

- আর একটু ভাত নে বউ। যোয়ান শরীল। এ সময় খিদে তো লাগবেই। পেট পুরে খেতে হবে তো। না হলে শরীল ধসে যাবে যে!

একটা খবর উড়তে উড়তে সবিতাদের গাঁয়েও পৌঁছেছিল। সবিতার মা আকুল হয়ে বলেছিলেন,

- ও নরেন। যাচ্ছিস যখন একবার সবির শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘুরে আসিস। দেখে আসিস মেয়েটা ঠিকঠাক আছে কি না? লোকে অ কথা কু কথা বলছে।

আসলে সেই জন্যেই এসেছিলেন সবিতার মামা। দেখে শুনে মন তার শান্ত হয়েছিলো। মনে হয়েছিলো, লোকে যে কতো মিছে কথা ওড়ায়। এই তো সবই ঠিক আছে। দুশ্চিন্তার কিছু নেই। "ভালো থাক মা" এই আশীর্বাদ দিয়ে রওনা দিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু সেদিনের ওয়েদারটা মোটেই ঠিক ছিল না। ঘর ছেড়ে খানিকটা এগোনোর পড়েই বৃষ্টি এসে গেছিলো। বজ্র বিদ্যুৎ সহ তুমুল বৃষ্টি। নরেনমামা ছুট্টে একটা বটগাছ তলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। একটু পরে সেখানেও গাছ ফুঁড়ে জল পড়তে লাগলো। সত্যিই জবর বৃষ্টি।

- আরে মামাবাবু যে। শুধু মুদু বটতলায় দাইড়ে দাইড়ে ভিজে কি হবে। চলুন চলুন গঙ্গা চান করে আসি।

নরেন মামার গোকুলকে চিনতে মুস্কিল হলো। চোখ কচলে দেখতে হলো। কিন্তু শেষে চিনতে পারলেন। টলমলো গোকুলকে দেখে তার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। গুজবগুলো তবে সত্যি?

- মামাবাবু আপনি এই তেলেভাজার পুঁটলিটা সাবধানে ধরুন। দেখবেন ভিজে না যায়। তাইলে গঙ্গা কুরুখেত্তর করবে।

গোকুল নরেন মামার গলা জড়িয়ে ধরে ছাতার নিচে নিয়ে এসেছিলো।

- এবার চলেন। খালপাড়ের গঙ্গায়। ডুব দিয়ে চান করবেন।

হতভম্ব নরেনমামা তাই চললেন।

- ও গঙ্গা দোর খোল। দ্যাখ গরম গরম তেলে ভাজার সাথে আর কি এনেছি।

দোর খুলে গঙ্গা বের হয়ে এসে নরেন মামাকে দেখে মুখ ভেটকে বলেছিলো,

- এ মিনসে আবার কে? বলে নিজের শোবার ঠাঁই নেই শংকরাকে ডাকে।

- শংকরা না শংকরা না। ইনি সবিতার মামা। গুরুজন। তবে পয়সাআলা গুরুজন। মাগনা কিছু করবেন না। তাই না মামাবাবু?

নরেনমামা তখন অন্য কিছু দেখছিল। ভিজে যাওয়ার ভয়ে গায়ে শাড়ি রাখেনি গঙ্গা। গঙ্গার পরনে তখন শুধু সায়া আর ব্লাউজ। তার বুকের পাহাড় দুটোকে আগলে রাখার সাধ্যি তার ঐ এক বিঘতের ব্লাউজের নেই। সেদিক পানে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন নরেনমামা।

- মরণ! দেখছে দেখো!

কিন্তু নরেনমামা গঙ্গার বুকের পাহাড় দুটো দেখছিলেন না। তার নজর আটকে গেছিল ঐ পাহাড়ের মাঝখানে যে হারটা দুলছে তার দিকে। ওটা যে তার ভীষণ চেনা। ওটা তার দিদি মানে সবিতার মায়ের হার। নতুন করে সোনার জল করিয়ে বিয়েতে সবিতাকে দেওয়া হয়েছিল।

দুয়ে দুয়ে চার করতে মামাবাবুর দেরি হলো না। তিনি ছুটে ওখান থেকে বের হয়ে এলেন।

- ওরে গঙ্গা ধর ধর ধর। গঙ্গায় না নেমেই পালাচ্ছে যে। ওগো চান করে যাও। এ গঙ্গা মিঠে জলের গঙ্গা।

- মরণ!

তেলেভাজা চিবুতে চিবুতে গঙ্গা বলে উঠেছিলো,

- দুর দুর মিয়ানো মাল।

তেলেভাজা না মামাবাবু কার উদ্দেশ্যে বলেছিলো কে জানে।

নরেনমামা উল্টো পায়ে ভিজতে ভিজতে দৌড়েছিলো সবিতার শ্বশুরবাড়ির দিকে। কিছু না ভেবেই সে দৌড়। ওখানে পৌঁছে কী বলবেন তিনি!

বলবেন চল সবি। এই নরকে আর তোকে থাকতে হবে না।

বলতে পারবেন?

ওখানে আবার অন্য দৃশ্য। খাওয়ার পর শ্বাশুড়ি বউ বিছানায় বসেছে পাশাপাশি। গোকুলের মা ভাবছিলেন,

যা ভেবেছি তা না। বউটার মনটা বেশ ভালো। শ্বশুরবাড়ির একটুও অমর্যাদা করেনি কো।

তিনি নিজেও ভরা যৌবনে বিধবা। শরীরের জ্বালা যে কি সেটা তারও জানা আছে। আর সে জ্বালা কীভাবে মিটিয়েছিলেন সে সবও মনে আছে। বউয়ের উপর করুণা হলো তার। তিনি হঠাৎ বলে উঠেছিলেন,

- ও বউ। বোতলটা বের কর। দুটো গেলাস নিয়ে আয়। আর চানাচুরের বোয়ামটা।

তুমুল বর্ষায় এ সব কিছুই দিব্যি মানানসই। গেলাসে ঢেলে গেলার ধরনে বোঝা গেল গোকুলের মায়ের এ জিনিসের অভ্যেস আছে। তবে এটা সবিতার জন্য একদম নতুন। ওর গলা জ্বলতে লাগলো। মনে হলো গলা বেয়ে আগুন নামছে পেটে। তারপর সে আগুন উঠে গেল মাথায়। হঠাৎ লাফিয়ে উঠেছিলো সবিতা। টেনে তুলেছিলো শ্বাশুড়িমাকেও। তারপর মাতাল বুড়িটাকে দুই হাতে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে থাকলো,

- এই যে গোকুলের মা। খালপাড়ে আমার জন্য একটা কুঁড়েঘর কিনে দিবি। এখন থেকে ওখানেই থাকবো। দেখবো তোর গোকুল আমার সেই ঘরে আসে কি না।

নরেনমামা ঝড়ের মতো উড়তে উড়তে ঠিক সেই সময়েই ঢুকে পড়েছিলেন সেখানে। আর অবাক বিস্ময়ে এই দৃশ্যও দেখেছিলেন। তবে বেশিক্ষণ দেখতে পারেননি। আবার ছুটে বের হয়ে গেছিলেন।

সবিতা বুঝি কারো ছুটে যাওয়াটা টের পেয়েছিলো। ও এক ধাক্কায় গোকুলের মাকে বিছানায় পটকে দিয়ে বাইরে বের হয়ে এসেছিল। দেখেছিল ছুটতে ছুটতে দুর্যোগের মধ্যে হারিয়ে গেল নরেনমামা।

ও উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ভিজতে থাকলো। হুড় হুড় করে বৃষ্টির জল পড়ছিল ওর মাথায়।

ও টান মেরে ভেজা শাড়িটা শরীর থেকে খুলে ফেলে দিয়েছিল। এখন ও গঙ্গার মতোই। শুধু সায়া আর ব্লাউজ পরে। ওদিকে ঘরের দাওয়া থেকে শ্বাশুডড়িমা চেচাচ্ছিলেন,

- ওভাবে ভিজিস না বউ‌। ঘরে চলে আয়। অসুখ করবে।

তারপর নিজেই নেমে গেছিলেন সবিতার কাছে। ওকে জড়িয়ে ধরে টেনে আনতে গিয়ে চোখে পড়েছিল। এই প্রবল বৃষ্টির ধারায় সবিতার কপাল আর সিঁথি দুই ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। তার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠেছিলো। এয়ো স্ত্রীর জন্য এ তো ভালো লক্ষণ নয়! এতে তার সোয়ামির অকল্যাণ হয়। আর এখানে তো সবিতার সোয়ামি অন্য কেউ নয়। তার নিজের ছেলে গোকুল।

- ঘরে চল বউ। ভেজা কাপড় ছাড়। গা মাথা মুছে। নতুন করে সিঁদুর পর।

ঘরে ঢুকেছিল সবিতা। সঙ্গে গোকুলের মা। চিৎকারটা করেছিল গোকুলের মা অর্থাৎ সবিতার শ্বাশুড়িমা।

- না না বৌ। পাগলামো করিস না। সিঁদুর মেয়েদের সোহাগ হয়। তারপর হঠাৎ ঘরের ভেতর থেকে

একটা সিঁদুর ভরা কৌটো ছিটকে এসে পড়েছিল উঠোনে। ছড়িয়ে গেছিল তার ভেতরের সিঁদুর। বৃষ্টির জলে সেই সিঁদুর ধুয়ে গোটা উঠোনটা দেখতে দেখতে লালে লাল হয়ে গেছিলো। যেন এইমাত্র সেখানে কোন বিশাল রক্তপাত ঘটে গেছে। যেন ঘটে গেছে নিষ্ঠুর কোনো হত্যাকান্ড। যা দেখে গোকুলের অমঙ্গলের আশংকায় থম মেরে গেলো তার মা। তবে সবিতার মুখে দেখা গেল একটা যুদ্ধ জয়ের প্রশান্তি। সাথে দুশ্চিন্তাও।

এত সবের কিছুই কিন্তু টের পেল না গোকুল। ঘোলা গঙ্গার বুকে মুখ গুঁজে ও অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। নেশার ঘুম। সহজে ভাঙ্গার নয়। এদিকের প্লাবিত সিঁদুরের খবর কিছুই জানতে পারলো না ও।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন