কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


গিট্র্যাঙ্কুর

নতুন বাড়ি। গণতন্ত্রের বাড়ি। হাউসওয়ার্মিং পার্টি! বাড়ি উদ্বোধনের দিন ছিল সেটা। অন্যান্য দল বয়কট করেছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের বাড়ি তো একটাই, একটাই পার্টি! এক ভাষা, এক দেশ, এক ধর্ম আর একটাই বাড়ি। আর একনায়কের একটিমাত্র দন্ড: তার ফ্যালিক ঐশ্বর্য ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক মাধ্যম আর টিভির পর্দায়।

তার কিছুদিন আগেই যৌন নিগ্রহ নিয়ে বিক্ষোভরত মহিলা খেলোয়াড়দের রাজপথে ঘষ্টে ঘষ্টে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ! সে পুলিশ কি পুরুষ ছিল না নারী? আইপিএলের ফাইনাল ছিল সেদিন। বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল। মুখে কুলুপ আঁটা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটারদের। ভয়ে একজনের মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোয়নি! পাছে কিছু খোয়া যায়! আর সম্মান? সেটা যে খোয়া গেছিল সেদিন? তার বেলায়?

প্যারিসে সেদিন চাক্কা জ্যাম ছিল। মেট্রো ছাড়া কিছুই চলছিল না। সর্বোনে কনফারেন্সে যেতে অধ্যাপকদের বেগ পেতে হয়েছিল। কেউ কেউ যায়নি। পিকেটিং লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। প্যারিসের স্ট্রাইক আর ইউকের বয়কটের পিছনে কারণ ছিল পেনশন স্কিমের অবনতি।

পাঠক ভাবছেন একি নিবন্ধ না কাহিনী? গল্প কই? গল্পের সংবেদ এখানে সংবাদ হয়ে গেছে, কিন্তু সংবাদের সূক্ষশরীরে কোথাও একটু সংবেদন রয়ে গেছে! দেখা যাক গল্পের গরু কোন গাছে ওঠে?

লোকটা অবশ্য গাছে না উঠে পাড়ি দিয়েছিল প্যারিস শহর থেকে দূরে গিট্র্যাঙ্কুর বলে একটি কমিউনে। জনৈক মনোবিশ্লেষক জাঁক লাকাঁর কবর দেখবে বলে! জীবিত মানুষের মৃতের প্রতি এই টান! দাহ্য শরীরের দফন হবার অসম্ভব আকাঙ্খা! অথচ দেশে ধর্ম একটাই! হিন্দু ধর্ম! লোকটা আবার অপ্রেসোর কাস্ট: ব্রাহ্মণ! কোন রেহাই নেই, সে তুমি মানো বা না মানো!

লোকটার স্বভাব ছিল যেকোন নতুন জায়গায় গেলেই কবরখানায়যাওয়া। পাশ্চাত্যে লোকে অবিশ্যি গিয়েই থাকে! শায়িত শরীরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে, ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হয়ত নিজেকে আরো জীবিত মনে হয় মানুষের। লোকটা মনোবিশ্লেষণ নিয়ে পড়াশোনা করেছিল, লাঁকা তার গুরু! তাই তার কবর দেখার বাসনা তার বহুদিনের। কর্মসূত্রে ফ্রান্সে এসে তক্কে তক্কে ছিল গিট্র্যাঙ্কুর যাবার। স্ট্রাইকের কল্যাণে ছুটি পেয়ে গেল একদিনের।

গুগল ম্যাপে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না কিভাবে যেতে হবে। স্ট্রাইকের জন্য একাধিক ট্রেন বাতিল। তাই ঘুরপথে যেতে হল। ট্রেন যতদূর নিয়ে গেল সেখান থেকে দেড় ঘন্টা হাঁটা গিট্র্যাঙ্কুর সেমেটারি! খাবার জলের বোতল স্টেশন থেকে ভরে নিয়ে হাঁটা লাগালো! ফ্রান্সের গ্রীষ্মকাল নেহাত কম গরম নয়! গ্লোবাল ওয়ার্মিং প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মিলিয়ে দিয়েছে। গুগল ম্যাপের ঈষৎ বেগড়বাই এবং ভুল পথে ১০ মিনিট অতিরিক্ত হাঁটার পর লোকটা যখন ফাইনালি শেষ দু কিলোমিটারের গ্রাম্য পথ ধরলো, দুদিকে শস্যক্ষেতের হলুদ আর সূর্য মধ্যগগনে! ছোট্ট রাস্তা, মাঝেমাঝে দুদিক থেকে গাড়ি! গাড়ির লোকজন অবাক চোখে দেখছে কারণ এ রাস্তায় পথিক চোখে পড়ে না সচরাচর!

গাড়ির লোকেরা কি ভাবছিল লোকটা এক্সিস্ট করে না? হয়ত প্রকাশ্য দিবালোকে কবরখানার পথে হেঁটে যাচ্ছে অশরীরী আত্মা! লোকটা কি মনে করতো ও এক্সিস্ট করে? মৃতদের মাঝে কি ওর আদৌ নিজেকে বেশি জীবন্ত লাগতো? নাকি মৃত বোধ করতে চাইত বলেই কবরখানায় ঘুরে বেড়াত? লাঁকা বলেছিলেন না, সব ড্রাইভই এক অর্থে ডেথ ড্রাইভ! গিট্র্যাঙ্কুর জায়গাটা যে 'কমিউন' এই ব্যপারটা বেশ ভালো লেগেছিল তার। বামপন্থী সুগন্ধ আছে এই শব্দে! ১৮৭১ এর পারি কমিউন থেকেই তো এই নাম ছড়িয়ে পড়েছিল ফ্রান্সে!

গিট্র্যাঙ্কুরের ইতিহাস ঘেঁটে বিশেষ কিছু পায়নি লোকটা। ছোট্ট জায়গা। মাত্র ৬০০ লোক থাকে। জাঁক লাঁকা ৫০এর দশকে এখানে একটা কান্ট্রি হাউস কেনেন। সুযোগ পেলেই এখানে এসে থাকতেন, মাঝে মাঝে এখানে প্র্যাকটিসও করতেন! এই বাড়িতে হাইডেগার সহ নানা বিখ্যাত চিন্তক এসেছেন। লোকটা ছবি দেখেছে ইন্টারনেটে, লাকাঁর বাড়িতে হওয়া নানা পার্টির! লাঁকা সেখানে টোস্ট করছেন, আড্ডা মারছেন। সে হাউসওয়ার্মিং গণতন্ত্রের সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহের থেকে আলাদা!

হলুদ শস্যক্ষেতে হাওয়া খেলে যাচ্ছিল ফিসফিস করে! লোকটা দেখতে পেল  ক্ষেতের ভেতর একটা ধ্বসে যাওয়া বাড়ি! ভিতর থেকে ধ্বসে গেছে, বাইরে থেকে নয়! কেমন যেন কোমর ভেঙে পড়ে থাকা মানুষের মৃত শরীরের মত! একটু আগে ফাঁকা রাস্তার পাশে দাঁড় করানো পরিত্যক্ত ক্যাম্পার ভ্যানকে যদি ভুতুড়ে মনে হয় তবে এতো ভুতুড়ের বাবা! লোকটার মনে হল ভিতর থেকে ধ্বসে যাওয়া বাড়িটাই যেন তার মনের বাসা! এমন করে ধ্বংসস্তূপ হয়ে উঠেছে তার মাথা! গণতন্ত্রের বাড়ি যেভাবে তার পরিচিত দেশের মত হঠাৎ একদিন অপরিচিত হয়ে ওঠে! অন্দর থেকে দফন হওয়া ঐ বাড়ি মধ্যদিনের সূর্য আর হাওয়ায় ভর করে লোকটার কানে কানে বলে গেল, 'অল ড্রাইভস আর ডেথ ড্রাইভস!' আর তাই তো থেকে যায় বিস্ফোরণের সম্ভাবনা!

ক্লান্ত লোকটা যখন অবশেষে কবরখানায় পৌঁছল, তার অবসেশনাল মগজ নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরী করল! দরজা যদি বন্ধ থাকে কবরখানার? একটাও তো লোক নেই আশেপাশে? কমিউন খাঁখাঁ করছে! যদি লাকাঁর কবর অন্য কবরখানায় হয়? গিট্র্যাঙ্কুরে কি একাধিক কবরখানা থাকতে পারে না? দরজা খোলা পেয়ে আশ্বস্ত হল বটে কিন্তু ঢুকে ছোট্ট কবরখানায় দুপাক মেরেও যখন খুঁজে পেল না লাকাঁর কবর তখন ইন্টারনেট খুলে ছবি মেলাতে লাগলো কবরের! একটা সাইটে একজন লিখেছে কবরখানার উপরদিকে একপ্রান্তে রয়েছে লাকাঁর কবর। লোকটা উপরের দিকে উঠলো এবং শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেল তার গন্তব্য!

এই কবরখানার সব থেকে সাদামাটা কবর লাকাঁর! কোন পরিচয় লেখা নেই! নাম প্রায় উঠে গেছে কালক্ষয়ে! কবরের উপর কোন ফুলের তোড়া রাখা নেই! একদিকে কেউ দুটো ছোট চারাগাছ লাগিয়েছে টবে! আর একটা লাল ফুলের ছোট পাপড়ি পড়ে রয়েছে কবরের ওপর, সেটা কেউ রেখে গেছে নাকি হাওয়ার কেরামতি জানা যাবে না কোনোদিন! লোকটাও সেরকম আরেকটা ফুল যেটা কবরের বাঁপাশে ফুটে ছিল তাকে কবরের ওপর রাখলো!

মনে হয়না এই কবরে অনেকে আসা যাওয়া করে! অনাদরে রয়েছে কি সমাধি? কে বলবে এ কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির কবর? তবে, লাঁকা হয়ত এমনটাই চেয়েছিলেন। অনাড়ম্বর ছিল ওঁর মৃত্যুপরবর্তী আচার অনুষ্ঠান। লোকটা পড়েছে লাকাঁর জীবনীতে। লাঁকা শুধু চেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় কমিউনে সমাধিস্থ হতে! হয়েছেন। রয়ে গেছেন আলগা আলতো অস্তিত্বের ক্ষীণ পথে। অবচেতনের মতো।

লোকটা সেদিন একটা ছোট নোট রেখে এসেছিল লাকাঁর কবরে। এ পার্সোনাল মেসেজ। যতক্ষণ না হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যায় বা বৃষ্টি গ্রাস করে। গিট্র্যাঙ্কুরে ঘুরে ঘুরে লাকাঁর কান্ট্রি হাউস খুঁজে পায়নি । বাড়িটার এক্স্যাক্ট লোকেশন দেওয়া নেই। বাড়ির নামের রাস্তাটা পেয়েছিল। বাকিটা কল্পনা করে নিয়েছিল। আর খোঁজেনি কারণ জীবিত লাকাঁর থেকে মৃত লাকাঁর বাসা খোঁজাটাই তার আসল উদ্দেশ্য ছিল!

প্যারিসে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছিল। স্ট্রাইকের জন্য অনেক ট্রেন বাতিল। ফেরার পথে কিছু বাইকচালক ছাড়া কারুর দেখা মেলেনি! লোকটা ভাবছিল শেষ কবে কেউ লাকাঁর কবরে এসেছিল আর এরপরের বার কে কখন আসবে? বোর্হেসের গল্পের মত সেদিন তার আগে কি তারই মত আরেকটা লোক ওখানে গিয়েছিল যাকে হুবহু তার মতোই দেখতে? সে জানে না কারণ এটা বোর্হেসের গল্প নয়। এটা হয়ত কোন গল্পই নয়! গল্প এখানে জার্নি! সংবাদের ভিতর সংবাদ নাকি সংবেদ?

দিনের পড়ন্ত আলোয় শস্যক্ষেতের মাঝখানে ভিতর থেকে ধ্বসে যাওয়া বাড়ি আর ক্যাম্পার ভ্যানের পরিত্যক্ত অন্দরমহলে লোকটা ফেরার পথে কি নিজের কোন অল্টার ইগো দেখেছিল যে ওকে টাটা করেছিল? ও কি আবার আসবে গিট্র্যাঙ্কুর? খুঁজে পেতে চাইবে লাকাঁর বাড়ি? এসব প্রশ্ন হয়তো নিষ্প্রয়োজন, আরো নিষ্প্রয়োজন তাদের উত্তর। চিঠি সদাই তার গন্তব্য খুঁজে নেয়। আর না খুঁজে পেলে দফন হয়ে যায়! যেমন দফন হয়ে গেছে লোকটার দেশের গণতন্ত্র! আর জনহীন গিট্র্যাঙ্কুরে লোকটা খুঁজে বেড়াচ্ছে তার সাধের ইউটোপিয়ান কমিউন!

 


 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন