কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সুকান্ত পাল

সমকালীন ছোটগল্প

 


নীল হৃৎপিন্ড

কাউকেই ঋতুরাজ তার মনের অবস্থাটা বোঝাতে পারবে না। এ এক গভীর বোধের বিষয় নাকি সে নিজে কোনো ফোবিয়ার শিকার হয়ে গেল তা নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। ঋতুরাজ সিংহ। বর্তমানের উঠতি একজন লেখক। সবাই বলে যদি এভাবে চালিয়ে যেতে পারে তাহলে একদিন বাংলা সাহিত্যে স্থান করে নেওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ঋতুরাজ নিজেও নিজের প্রতি অনেকটাই আস্থাশীল। কিন্তু মাঝে মাঝেই মনে হয় যে তার লেখা বুঝি উতরোচ্ছে না। সে নিজেও জানে লেখকের মনের এই খিধে থাকাটার প্রয়োজন আছে। যদি আত্মতুষ্টি এসে যায় তাহলে সব শেষ। শিল্পের অপমৃত্যু হয়।

সমস্যাটা হয়েছে গত এক সপ্তাহ ধরে। গত রবিবার সকালে লেখার টেবিলে বসে দিনের প্রথম চা টা খেয়েছিল। এই চা টা সে নিজের হাতে বানিয়ে ভোরবেলায় বসে যায় লেখার টেবিলে, পরে তার স্ত্রী মোহনা ঘুম থেকে উঠলে আবার আটটা সাড়ে আটটায় একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে দুজনে চা খায়। তখনই সে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নেয়। তারপর আবার সে তার স্টাডিরুমে গিয়ে লেখায় মগ্ন হয়। সাধারণত সকালের দিকেই সে লেখে আর পড়াশোনাটা করে রাতে।

সেদিন দ্বিতীয়বার মোহনার সাথে চা খেয়ে লেখার টেবিলে এসে বসে লেখার ফাইলটা টেনে নিয়ে, যখন লিখতে যাবে সেই সময় দেখে তার টেবিলের ডানদিকের কোণায় একগুচ্ছ লাল পিঁপড়ে একটা দানা বেঁধে রয়েছে। আসলে সকালের বা দিনের প্রথম চা টা যখন সে খাচ্ছিল তখন হয়তো দু এক ফোঁটা চা পড়েছিল সেখানে আর সেই কারণেই পিঁপড়ের আগমন।

কোন কিছু না ভেবেই ঋতুরাজ তার লেখার কার্ডবোর্ডটা রোলার এর মত চাপিয়ে দেয় পিঁপড়েগুলোর উপর। তারপর দু একটা পেষণেই সব পিঁপড়েগুলো মরে যায়। একটাও পালাবার পথ পায় না। বোর্ডটা তুলে নিয়ে লেখার জন্য সেট করে তার চোখ চলে যায় ওই দলা পাকানো মরা পিঁপড়েগুলোর দিকে।

একটা গাঢ় লালচে দাগ পড়ে গেছে ওই জায়গাটাতে। পিঁপড়েগুলোর কোন অস্তিত্বই আর নেই। এতগুলি প্রাণ এক নিমিষে শেষ হয়ে গেল। কোন প্রতিরোধ ছাড়াই। প্রতিরোধে চেষ্টাও করতে পারল না। প্রতিহত করা তো দূরের কথা, মৃত্যুর আগের মূহূর্ত পর্যন্ত তারা বুঝতেও পারল না যে তাদের জীবনে নেমে আসছে চরমতম বিপদ।

কথাটা মনে হতেই ঋতুরাজের চিন্তাস্রোত ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে সে তো লেখক! এই পৃথিবীর প্রাণীকুলের প্রতি তার তো একটা মমত্ববোধ আছে! এই পৃথিবীর যা কিছু পবিত্র, মহান তাকেই সে তুলে ধরতে চায় তার লেখাতে। একজন সার্থক লেখকের উদ্দেশ্য তো মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলের দিকে যাত্রা। অকল্যাণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, প্রতিবাদকে সমর্থন জানানো। মানুষের চিন্তা, চৈতন্য, বোধকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, হিংসার বিরুদ্ধে, জাগ্রত করাই তো তার কাজ। কিন্তু আজ এ কি হটকারী কাজ সে করল!

পিঁপড়েগুলোকে তো সে তাড়িয়ে দিতে পারতো, কেন সে তাদের মারতে গে্‌ অতি ক্ষুদ্র প্রাণী হলেও প্রাণ, প্রাণই। এই মুহূর্তে এই সমাজে সে প্রাণসংহারকারী একজন ব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। সে একজন খুনী। এমনও নয় যে সে এটা অনিচ্ছাকৃতভাবে করেছ,, সে তো ডেলিবারিটলি ঘটনাটা ঘটিয়েছে। অতএব তার মত জঘন্য খুনী ও অপহন্তা এই সমাজে বিরল।

কিছুদিন আগেই গুজরাটের গোধরার ঘটনার উপর নিরীহ মানুষের স্বপক্ষে এবং জঘন্য হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে গল্প লিখে সে পুরস্কার পেয়েছে, অথচ আজ সবার অলক্ষ্যে , সাক্ষী বিহীন ঘরে , একক মর্জিতে সে এক লহমায় একগুচ্ছ প্রাণকে সংহার করল। দাঙ্গাবাজ, হত্যাকারী খুনীদের থেকে সে কোনো অংশেই কম নয়। এক ঘৃণ্য ও জঘন্য অপরাধে অপরাধী সে। সে একজন চরম দুস্কৃতী। প্রাণী জগতের শত্রু। মানুষের মধ্যে যে শৃঙ্খলা, ভদ্রতা, সহমর্মিতার বিষয়গুলো রয়েছে তা কখনোই সহজাত নয়। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই সেগুলিকে তৈরি করে নিয়েছে। নিজেদের সুবিধার জন্যই মানুষ কিছু বিধিনিষেধ নিজেদের উপর আরোপ করেছে। সমাজকে এক সুন্দর ও সুস্থ করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে মানুষ কখনোই শৃঙ্খলা পরায়ণ নয়, সহমর্মী তো নয়ই। শৃঙ্খলা ও সহমর্মিতা যেটা আমরা সমাজে দেখি তা কৃত্রিম। সহজাত নয়। এই কৃত্রিম নিয়ম ও শৃঙ্খলা পরায়ণতা যদি মানুষ নিজের ওপর আরোপ না করে নিত তবে মানুষ নামক প্রাণী যে কবেই পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যেত নিজেদের মধ্যে মারামারি করে তার ঠিক নেই। এত আইন কানুন নিয়ম নীতি ব্যবস্থা সবই নিজেদের অসভ্যতা আর বর্বরতাকে বেড়া দিয়ে আটকে রাখার জন্য। তবুও সেই বেড়া ভেঙে দুষ্কৃতীর হাঙ্গামা চলছেই কিন্তু পিঁপড়ের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ এত তীব্র যে মানুষ ওদের কাছে হার মানতে বাধ্য। আর সেই সভ্য ও শৃঙ্খলা পরায়ণ পিঁপড়েগুলোকে সে মেরে ফেলল!

ঋতুরাজের মনের মধ্যে এক অবিমিশ্র অশান্তির ঢেউ আছড়ে পড়ছে বারবার। মানসিকভাবে সে ধীরে ধীরে কেমন যেন অসুস্থ হয়ে উঠছে। সময়মতো স্নান, খাওয়া প্রায় ভুলেই গেছে। যেদিকেই তাকায় সেদিকেই সে দেখে সার সার লাল পিঁপড়ের মিছিল। আতঙ্কে আর হীনমন্যতায় এবং খুন করার অপরাধবোধে তার জীবনযাত্রা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মোহনা অনুযোগের সুরে বলে,

--শুধু লেখা নিয়ে চিন্তা করলেই হবে? শরীরটার দিকে একটু নজর দাও!

--ও সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি কিছু ভেবো না। আমি এখন একটা সিরিয়াস প্লট নিয়ে মগ্ন আছি, একটু ব্যাঘাত হলেই সব যেমন ফসকে যাবে তেমনি লেখাটাও একেবারে টাল খেয়ে যাবে।

এইসব কথা বলে সে মোহনাকে শান্ত রাখে।


(দুই)

টেবিলে বসে ঋতুরাজ গভীর মনোযোগের সাথে লিখছে। একটা দারুন মনের মতো প্লট সে পেয়েছে। কয়েকদিন ধরেই মাথায় আষাঢ়ের মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু নেমে আসছিল না। ধীরে ধীরে মেঘ ভাঙতে শুরু করেছে। তাই আজকেই সকাল থেকে শুরু করেছে নতুন উদ্যমে লেখা। হঠাৎ একটা টিকটিকি ঠিক তার মাথার উপরে টিক্ টিক্ করে ডেকে উঠলো। শব্দটা বেশ জোরেই হওয়াতে ঋতুরাজ উপরের দিকে তাকায়। কিন্তু এ কি! দেয়ালের চারিদিক থেকে অসংখ্য লাইনে অজস্র নানা রঙের পিঁপড়ের দল নেমে আসছে তার দিকে। সে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কোনো পিঁপড়ের বড় বড় লাল চোখ, কারুর ভয়ঙ্কর ঘন নীল চোখ, কারুর বড় বড় দুটো হুল বেরিয়ে আছে দুই চোখের উপর থেকে। সারা ঘরটা পিঁপড়েতে ভরে যাচ্ছে। তারা আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসছে। তারপর ঋতুরাজের চেয়ারের দিকে । ঋতুরাজ তার পা দুটো চেয়ারের উপরে তুলে নেয়। এক সময় মেঝে থেকে পিঁপড়েরা তার চেয়ারের উপর উঠে আসে, উপায়ান্তর না দেখে ঋতুরাজ লেখার টেবিলে উঠে পড়ে। ঋতুরাজ লেখার টেবিলে উঠে দাঁড়িয়ে থাকে। টেবিলের পায়া বেয়ে চারিদিক থেকে পিঁপড়ের দল সুর বাকিয়ে তার পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। ঋতুরাজ ঘামতে থাকে। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। একটা আঁশটে গন্ধে ঘর ভরে গেছে। যেদিকে তাকায় সেদিক থেকেই পিঁপড়ের দল তার পায়ের পাতার উপর উঠে পড়ছে। বেশ কিছু পিঁপড়ে তাদের হুল ফুটিয়ে দিতে শুরু করেছে। এবার আর নিস্তার নেই। ওরা কি করবে? ঋতুরস্ত অনুতপ্ত। অনুতপ্ত মানুষের ক্ষমা তবে কি পিঁপড়েদের রাজ্যে নেই! ঋতুরাজ আর থাকতে পারে না। তার গোলাপী হৃৎপিন্ড ধীরে ধীরে কিসের বিষে নীল হয়ে উঠছে? বুঝতে পারে না। সে চিৎকার করে ওঠে। অথচ তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না। গোঁ গোঁ একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে তার গলা আর শ্বাসনালী দিয়ে।

হঠাৎই মোহনার প্রবল ধাক্কায় ঋতুরাজের ঘুম ভেঙে যায়। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে জল হয়ে গেছে।

--কি ব্যাপার কি হয়েছে? স্বপ্ন দেখেছিলে?

--স্বপ্ন? অ্যা, হ্যাঁ।

--কিসের?

--যুদ্ধক্ষেত্রের।

--কিসের যুদ্ধ?

--না, না যুদ্ধ না।

-- তবে!

-- বিচার।

--- কার বিচার?

-- একজন খুনীর।

--- তুমি কয়েকদিন ঘুমের ট্যাবলেট খাও তো! দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন