কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

শৌভিক দে

 

সমকালীন ছোটগল্প


তবে তাই হোক

সুকেশ কুশারির মাথা জোড়া মাছি পিছলানো টাকের জন্যে নন্দিনী নন্দী দায়ী। এটা প্রকৃত ঘটনা নয়। দুর্জনের আন্দাজ মাত্র। আসল কথা হল সুকেশের ঝাড়ে বংশে চুলের মহামারী আছে। শোনা যায় ইডেনের ১৯৭২ এর টেস্ট ইংল্যান্ড হেরে যায় সুকেশের দাদুর জন্যে। মুক্ত গ্যালারিতে বসে ভদ্রলোক একবার টুপি খুলছিলেন আর এক বার পরছিলেন। একে বিষেন সিং বেদী আর চন্দ্র শেখরের ভীষণ স্পিনের প্যাঁচ তার উপর গ্যালারি থেকে - থেকে থেকে - বাতিঘরের মত ফ্ল্যাশ লাইট। ইংল্যান্ড ব্যাটারদের চোখ ধাঁধিয়ে নালে ঝোলে অবস্থা। ক্যাপ্টেন টোনি আম্পায়ার কে অভিযোগ জানান যে গ্যালারিতে কোনো দর্শক আয়না নিয়ে খেলছে । সেই মত মামসা সাহেব গ্যালারিতে পুলিশ পাঠিয়ে খোঁজ খবর ও নেন। পুলিশ কিছুই পায়নি কারণ সুকেশের দাদু তখন টুপিটা পরে নিয়ে ছিলেন। এমন ও শোনা যায় পরে ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেন - অজিত ওয়াদেকার - চুপি চুপি সুকেশের দাদুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যান এবং অনুরোধ জানান যেন এই কৌশল দেশের বাইরে না যায়। এ ঘটনার সত্যি মিথ্যে যিনি হলফ করে বলতে পারতেন - অর্থাৎ সুকেশের দাদু - তার উইকেট পড়েছে - তাও বছর দশেক হয়ে গেল। এখন প্রমাণ খুঁজলে - পালে পার্বণে সুকেশদের আদি বাড়ির তেতালার বারান্দায় যেতে হবে। সেখান থেকে উঠোনটিকে দেখলে ভ্রম হতে পারে যে নিচে সদ্য ধোওয়া কয়েকটা হাঁস ডিম ঘোরাফেরা করছে।

এ গল্পটা অবশ্য সুকেশের নয়। তার ইন্দ্রলুপ্তের তো নয়ই। বরং তার তেইশ বছরের বিবাহিত স্ত্রী নন্দিনী নন্দীর এক সমস্যার। না। সুকেশের কোন দেশী বা বিলেতি দোষ নেই। চুল কম মানিয়ে নিলে - সুদর্শন। মাইনে ভাল। তাছাড়া স্ত্রীর যথেষ্ট খেয়াল রাখে।হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছ। তা সে টাকা থাকলে গৃহ শান্তি রাখতে অনেক স্বামীই কিনে দেন। কিন্তু যেটা সাধারণ নয় - তা হল - প্রায়ই সন্ধেবেলা তাকে হাসি মুখে নন্দিনীর গান শুনতে দেখা যায়। গান ছাড়াও সময়ে সময়ে, কাপড়ের কুকুরের জন্যে চৈনিক ফার, রঙ্গোলীর রং, ঢালাইয়ের মোম, আইসক্রিমের কাঠি, বাল গোপালের আসন অর্থাৎ যা কিছু - যে রকম কিছু নন্দিনী চাইতে পারে - সবই হেসে বা না হেসে সুকেশ ঠিক জোগাড় করে। এমন কি বিয়ের পর সুকেশের আগ্রহে নন্দিনী তার বাবার পদবীও পাল্টায়-নি।তাদের একমাত্র ছেলে বড় হয়ে অনেক বিদ্রোহ করলেও তার পদবী থেকেছে নন্দী কুশারি। ছেলে আর মায়ের দ্বৈরথ হলে - সুকেশ সর্ব সমক্ষে স্ত্রীর পক্ষে দাঁড়িয়ে আর পরে ছেলেকে পিৎজা খাইয়ে 'এক পা এগিয়ে , দু পা পিছিয়ে' সিমলা চুক্তি বজায় রাখে। তা সে ছেলেও এখন নতুন চাকরি নিয়ে শহর ছেড়েছে। সুতরাং ঘরে শুধু আপনি আর কপনি, তুঁহু তুঁহু দুঁহু দুঁহু।

সারাদিন ছেলেকে খাবার নিয়ে ধাওয়া করা, স্বাস্থ্যই সম্পদের উপর একক ডিবেট, নিজেদের সুবোধ ছেলেবেলার ধারা বিবরণী, সারা ঘরের ছাড়া কাপড় সংগ্রহ করা - এ ধরনের অবশ্য কর্তব্য হটাত বন্ধ হয়ে যাওয়াতে নন্দিনী খুবই আতান্তরে পড়েছিল। এত বাড়তি সময়ে আঁচলে রাখা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই তার গীটার শিক্ষা কেন্দ্রে যাওয়া।পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই নন্দিনীকে কমবয়সী ছেলে পিলে 'আন্টি' বলে খুব সমাদর করে। ছা হারানো নন্দিনীর ভালোই লাগে। হারমোনিয়াম আলমারির মাথায় চড়েছে আর গীটার নেমেছে কার্পেটে। সপ্তাহে তিন দিন সুকেশ আধবোজা চোখে ' আলো আমার আলো ' কিম্বা 'আগুনের পরশমণি ' শুনছে যত ক্ষণ না ছেলের ফোন আসে। কিছু গোল ছিল না । গোল বাধাল আর এক নবীন শিক্ষার্থী । সদ্য বিপত্নীক 'এ টু জেড নাগারাজু আন্না'। এ টু জেড মানে নাগারাজুর আগেও বেশ কয়েকটি আরো নাম আছে তার।ঠিক করে বুঝে বলতে গেলে বাঙ্গালীর জিভে ও মগজে গিঁট পড়ে যাবে। তাই সম্বোধনে 'এ টু জেড নাগারাজু ' - সম্মানার্থে 'আন্না' । সম্মানের আলু কাবলী বানিয়ে - এক গোধূলি লগনে তিনি নন্দিনীকে 'আন্টি' সম্বোধন করে বসলেন। নন্দিনী তখন মন দিয়ে 'আলো আমার আলো' গানের অন্তরাতে ডি মাইনর লাগাচ্ছিল। চমকে লেগে তার স্টিল পিস ছিটকে পড়ল শিক্ষিকা শ্রীমতী তরঙ্গময়ী সুরের পায়ে। ' মা গো' বলে তিনি উদারা মুদারা তারা ছাড়িয়ে জি ৯ অক্টেভে চেঁচালেন । ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভাঙতে ভাঙতে বেঁচে গেল। কিছুক্ষণ সবাই হতবুদ্ধি। তারপর নন্দিনী আর তরঙ্গময়ীতে, নাগারাজু আর বাদবাকিতে হুলুস্থুলু কাণ্ড বেধে গেল।শেষে সে দিনের ক্লাস বন্ধ করে তরঙ্গময়ী গেলেন পায়ে চুন হলুদ লাগাতে। বাকিরা যে যার ঘরের রাস্তা ধরল। বাড়িতে এসেও নন্দিনীর মাথা ঠাণ্ডা হল না। আয়নায় বহুক্ষণ বহু ভঙ্গী তে তদন্ত করলেন নিজের এবং তারপর বুঝতে পারলেন বয়সের তুলনায় তার মুখশ্রী একটু, কোমর বেশ একটু...

এর একটু পরেই অফিস ফেরত সুকেশ এল মঞ্চে। নন্দিনীর মুখ দেখেই বুঝল বজ্র বিদ্যুৎ সহ ভারি বর্ষার সম্ভাবনা। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে ব্যাপার জানতে হল। এবং জেনেই ঠিক করল সে এত সহজে ছেড়ে দেবে না। শেষ দেখে ছাড়বে। এখানে বিশেষত তার রজত জয়ন্তী পার করা টাক জরুরী ভূমিকা নিল। বিয়ের আগে নন্দিনী রাস্তায় বেরোলে দু একজন সাইকেল আরোহী তাকে দেখতে গিয়ে নালায় উল্টে পড়ত। সুকেশের মা বাবাও এক দেখাতেই পাঁজি উল্টাতে বসেছিলেন।ভোলার নয় যে - সেই সুন্দরীর বিয়ের কথাবার্তা ঠিক করার দিন - সুকেশকে দেখে নন্দিনীর পিসি ' পাত্রর জ্যাঠা মশাই কি সুপুরুষ ' বলাতে বিয়ে ভণ্ডুল হয় আর কি। পাত্রীর মেজ-কাকা ঝাঁপিয়ে পড়ে - দাদুর ছানির প্রেসক্রিপশন পিসির বলে চালিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। তাছাড়া সত্যিকারের জ্যাঠা মশাই দেখানেই ছিলেন এবং তিনি ভুল জেনেও - পিসির কথায় খুশিতে খাস্তা নিমকির মত মুচমুচে হয়ে গিয়ে ছিলেন। অবশ্য সুকেশের তখন বা এখন মাথা নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই। ও রকম মন্তব্য সে বহু শুনেছে।কিন্তু আজকের ব্যাপার আলাদা।

একমাত্র স্ত্রীকে কোথাকার কে আন্টি বলে যাবে - এ তো ঘুরিয়ে তাকেই অপমান করা। বদলা নেবার ছক কষতে হবে। তার স্ত্রীকে আজীবন - আচ্ছা আজীবন থাক - অন্তত আরো দশ বছর সুন্দরী করে রাখতেই হবে। আবার দু চার জন লোকের মুণ্ডু ঘুরে নালায় পড়া চাই আর সেই চার জনের মধ্যে নাগারাজুর থাকা চাইই চাই ।তার স্ত্রীর প্রাক পঞ্চাশে - প্রায় প্রবীণ নাগরিক আন্টি বলবে - এতো চরমপন্থি কাজ কারবার।প্রতি আক্রমন চাই । মিউচুয়াল ফান্ড, এফ ডি সব গেলে - যাবে। পৃথিবীর প্রথম স্বামী হিসেবে উদারবাদের চরম পরিচয় রাখল সুকেশ। বারিটোন গলায় নন্দিনীকে বলল ' না নন্দিনী না। তোমার সৌন্দর্য দিয়ে পৃথিবী জয় কর। আমি তোমার সঙ্গে আছি'। বিখ্যাত রূপ বিশেষজ্ঞ বেতসলতা বসুর সঙ্গে আপ্যো করা হল পরের দিনই।

বেতসলতা নাম শুনে অনেকেই তাকে মহিলা ভাবে এবং তিনি তার ছেঁড়া ভুরু উপরে তুলে তাদের ভ্রম নিরসন করেন। আজও নেল পলিস লাগানো নখ নেড়ে সুকেশকে বললেন -

'বেতস লতার ল্যাটিন নাম হল বিটা ভালগারিস এবং তাকে না বুঝেই স্ত্রী জাতিতে পরিনত করা মধ্যে বেশ ভালগারিত্ব আছে। লতা হলেও এটি যথেষ্ট শক্ত পোক্ত। ললিত লবঙ্গলতা নয়, পৌরুষেয়। তাছাড়া রূপচর্চা শুধু মাত্র আর নারীদের কুক্ষিগত বিষয় নয়। পুরুষের ও তাতে সমানাধিকার। এখন প্রশ্ন হল আমাকে কার দরকার পড়েছে, আপনার না ওনার'

থতমত সুকেশ - নন্দিনীকে এগিয়ে দিল। নন্দিনী যথেষ্ট হোম ওয়ার্ক করে আসেনি . একটু আমতা আমতা করে বলল -

'চেহারায় একটু বয়সের ছাপ পড়ছে। ভাবছিলাম যদি ...’

বেতস-বাবু মুখে আঙ্গুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বললেন। তারপর বাঁ দিক, ডান দিক আর উপর থেকে লজ্জায় গোলাপী নন্দিনীকে বিলক্ষণ নিরীক্ষণ করলেন। সামনে রাখা আবছা ফুলতোলা কাগজে আঁকি বুকি কাটলেন কিছুক্ষণ। সবার জন্যে চা বললেন গলা তুলে। গলা খুললেন তারপরে -

- ' জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার। পড়েছেন তো? জীবনানন্দ। আমার কাছে কোন যাদু দণ্ড নেই যা আপনাকে তার আগে নিয়ে যাবে। আমার রেকর্ড বড় জোর এগারো বছর এগারো মাস। চলবে'?

দুজনেই সম্মোহিতের মত মাথা নাড়লে।

- ' ভানুরেখা গনেশন, ধর্মদেব পিশোরিলাল আনন্দ... দেখেছেন তো তাদের? বোটক্স সম্বন্ধে কিছু ধারনা আছে'?

কালকেই রাত জেগে গুগুল ঘেঁটেছে সুকেশ। হড়বড় করে বলল -

-' ওই সামান্য, রেখা আর দেবানন্দকে দেখেছি সিনেমায় । কিন্তু প্রাকৃতিক পদ্ধতিতেই কিছু নিদান দিন। কাটাকাটি ইনজেকশন দিয়ে নুন জল - চিত্র তারকা তো হবার নেই... মানে বুঝতেই তো পারছেন ...'

- না পারছিনা । অল্প জ্ঞান সব সময়ই ভয়ঙ্করী হয়।যাক। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতেও হবে তবে সময় লাগবে বেশী। পেছনো যাবে কম। তা ধরুন আট বছর আট মাস। চলবে'?

- 'হ্যাঁ হ্যাঁ চলবে। কবে শুরু করবেন'?

- 'আজ। এখুনি। এই নিন এক লিটার জলের বোতল। শেষ করুন'

- পুরো বোতল? এখুনি'?

- হ্যাঁ। দিনে কম পক্ষে চার লিটার জল। না না রেখে দিন। এই চা খাবেন না। দুধ চা আপনার জন্যে বিষ। আমি একটা লিস্ট দিয়ে দিচ্ছি। পনের দিন সেই মত মান্যি মান আর খাওয়া দাওয়া করে আবার আসবেন। মিস্টার কুশারি - আপনি কি আপনার টাকের জন্যে কিছু...? না ? ঠিক আছে। আমার ফিজ এবং কিউ আর কোড এই যে'

পরদিন অফিস ফেরত পেটমোটা দু থলি সবজি নিয়ে গলদ ঘর্ম সুকেশ ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন করল -

-' কতটা জল খেয়েছ এখন পর্যন্ত'?

নন্দিনী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল-

- 'পৌনে দু লিটার। হ্যাঁগো আর পাচ্ছি না'

- তা বললে কি করে হবে। সাধনা কঠিন হলে তবেই তো পূর্ণ সিদ্ধি হয়। দেখো সারা বাজার ঘুরে তাজা সবজী এনেছি। তিন কিলো শসা , চার কিলো টমেটো, পাঁচ আঁটি শাক,উত্তর প্রদেশের গাজর তাছাড়া কলা, কমলা লেবু, পাকা পেঁপে, অ্যাভোগাড্রো,......'

- এত খেতে হবে'?

- নন্দিনী তুমি একটুও পড়াশোনা করছো না। কাল বেতস বাবুর কাছ থেকে ফিরে আমরা দুজনেই তো কাগজটা পড়লাম। পেঁপে, কলা এক সঙ্গে মিক্সারে থেঁত করে মুখে ঘাড়ে লাগাতে হবে। শসা , টমেটো, লেবুর রস, চন্দন গুড়োর মেলানো প্রলেপ সে রকমই হাতে আর পায়ে।চামড়ায় আলো পিছলে যাবে। সকালে ডিমের সাদাটা আর আলভেরা মিশিয়ে দিয়ে গেলাম। কপালে লাগিয়েছিলে '?

- 'খুব গন্ধ ওতে'

- একটু সহ্য করো। আচ্ছা রাতে বাদাম তেল আমি নিজে লাগিয়ে দেবো। ঘুম থেকে উঠে চোখের চার পাশে ঠাণ্ডা দুধের আস্তর লাগিয়ে দিয়েছিলাম, টের পেয়েছিলে'?

- 'তাই। আর আমি ভাবলাম কি হল চোখে খুলতেই পারছি না'

- 'হুঁ। রাতে কমলা লেবুর খোসা বেটে লাগিয়ে দেব। তবে দিনের বেলা মনে করে আভোক্যাডো ফালি করে কেটে লাগাতে ভুলো না। ডার্ক সার্কল এবার বিলকুল গায়েব হয়ে যাবে। তাও তো জুঁই ফুল পেলাম না। এর সঙ্গে ওর পাপড়ির পেস্ট লাগাতে পারলে আর কথাই ছিল না। তবে ডার্ক চকোলেট এনেছি। রোজ খেও'

- 'ও ভীষণ তেতো । তাছাড়া রোজ খেলে দাঁত খারাপ হবে না'?

- 'খেয়ে ভালো করে কুলকুচো করতে হবে। আর তেতো? ফল টা কত মিষ্টি হতে যাচ্ছে ভাবতো। আচ্ছা সারাদিনে অন্তত চার ঘন্টা ঘুমিয়েছ কি না'?

- 'হ্যাঁ। আর শোনো না রাগ করো না। ঘুমাতে গিয়ে কিছু রান্না করতে পারিনি। আজ কিছু আনিয়ে নেওয়া যাক'

- 'খবরদার না। ফাস্ট ফুড একেবারে বন্ধ। বাই দ্য ওয়ে এক দিন উপোস সপ্তাহে। একটু ধর্মীয় টাচ দিলে বাস্তবিক হবে। কোন দিন হতে পারে? শিব ঠাকুরের সোমবার, বজরঙ্গবলীর মঙ্গলবার,না - শুক্রবার ঠিক থাকবে। পরে দুদিন আমি বাড়ি থাকবো। জয় মা সন্তোষী'

- 'আজ তাহলে খাবার ...'

- 'আমি সুপ বানিয়ে নিচ্ছি। এটা আমাদের নিজস্ব ফরাসী বিপ্লব নন্দিনী। বাস্তিল ভেঙ্গে ফেলার আগে পেছোনো যাবে না। । গাও আমার সঙ্গে - লা মার্সেই, লা মার্সেই'

- নিজের সুরে ফরাসী জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে সুকেশ রান্না ঘরে ভিড়ল। ছোট ছোট টুকরোয় চিকেন কাটতে কাটতে হটাত চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল -

- 'ভুলে গেলাম - গুঁড়ো দুধ, মধু আর লেবুর রস দিয়ে যে ক্বাথটা বানিয়ে দিয়ে গেছলাম সেটা লাগিয়েছিলে তো'?

নন্দিনী শুনতে না পাওয়ার ভান করে জিভ কাটল। ওটা লাগাবে কি ভুল করে খেয়েই ফেলেছে।

দিন যায়। আস্তে আস্তে নন্দিনী অভ্যস্ত হতে লাগল পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে। আর সুকেশের উৎসাহ যেন প্রতিদিন বেড়ে উঠছে। সকালে 'ধিতাং ধিতাং বোলে' আর ' ওই উজ্জ্বল দিন' মিউজিক সিস্টেমে বাজিয়ে দুজনে অ্যারোবিক নাচ ও শুরু করেছে। ওপরে জঙ্গি আক্রমণ হচ্ছে কিনা বুঝতে নিচের তলার অবসর প্রাপ্ত মেজর গুরপ্রীত সিং ব্রার একদিন সকালে দরজায় টোকা দিলেন। সুকেশের বারমুডা আর টি শার্ট পরা নন্দিনী দরজা খুলতে হাঁ মুখে অ্যাটেনসান হয়ে গেলেন। তারপর তার দে দৌড় । দ্রাস বা বাটালিক সেক্টর থেকে যেমন মাঝে মাঝেই তাড়া খেয়ে অনুপ্রবেশকারী পালায়। দু মাস হল নন্দিনী শুধু মাঝে মধ্যে বেতস-বাবুর কাছে যাওয়া ছাড়া কোথাও বেরোয় না। একেবারে তিলোত্তমার কায়দায় দুম করে সুন্দ ও উপসুন্দর দরবারে আছড়ে পড়বে।

বেতসবাবু তার অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট। আরো মাস খানেক পরে সবুজ সঙ্কেত দিলেন এবার আত্ম প্রকাশ।একদিন তাদের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে - গিটার ক্লাসের বার্ষিক অনুষ্ঠানের দিনটিকে 'ডি ডে' হিসেবে চিন্হিত করা হল।নন্দিনী কিছুতেই টপ ও জিনস পরতে রাজি না হওয়ায় মনক্ষুন্ন বেতস-বাবু শাড়িতে রাজি হলেন। তবে কি রকম শাড়ি পরলে রোগা লাগে - তার সাত দফা তালিকা দিলেন সঙ্গে। নতুন কিন্তু একেবারে পাট ভাঙা নয়, শিফন বা জর্জেট, ডোরা কাটা নিচের থেকে উপরের দিকে, পেটে একটা গোপন বেল্ট। অলঙ্কার বলতে লম্বা কোনো হার নয় চোকার্স - মুক্তর হলে ভাল হয়। কানের দুল দু ইঞ্চি শিকল ঝোলানো। সৌভাগ্য বশত নন্দিনীর শ' খানেক শাড়ির মধ্যেই তেমনটা পাওয়া গেল। মুক্তোর গলাবন্ধ আর দুল গদ গদ সুকেশ কিনে আনল।

সেদিন রবিবার। সুকেশের অফিস যাওয়া নেই। সকাল দশটা নাগাদ বেতস-বাবুর ক্লিনিক থেকে মিস শৃঙ্গার সাঁতরা এক বিপুল সুটকেস সহ এসে উপস্থিত হলেন সুকেশদের বাড়ি। নন্দিনী শুধু সকাল সকাল উঠে শ্যাম্পু করে তৈরি। তারপর সুকেশের - নিজের বাড়িতেই - নির্বাসন । বিকেল পৌনে পাঁচটায় বাইশ বছরের পুরোন স্ত্রীকে সুকেশ চিনতেই পারে না। তিলোত্তমাই বটে । মেক আপ ছাড়াও এমন আলগা লজ্জা মাখানো রয়েছে সেখানে যে সুকেশের আবার রূপোর জাঁতি হাতে ধরতে ইচ্ছে হল। মিস সাঁতরা মোটা দক্ষিণা সহ বিদায় হতেই নন্দিনী বলল -

-'এ কি তুমি এখনও তৈরি হওনি'?

সুকেশ একটা গুঢ় হাসি হাসল -

'আমি তো যাব না। তোমার মৃগয়া তুমি একাই যাবে'

- কেন'? আমি একা কেন '?

- কারণ আছে ডিয়ার। ভেবে দেখো এ শুধু তোমার একার সাধনা নয় । আমারও। এখন তোমার পাশে পাশে একটা টাক মাথা লোক ঘুরলে কেউ কি...। যাও জয় যাত্রায় যাও । আমি তোমার ক্যাব বুক করে দিয়েছি। এখন বিজয়ী ভব'

যুক্তিটা ফেলে দেওয়ার মত নয়। নন্দিনী একটু দ্বিধা নিয়ে একাই গিয়ে বসল ভাড়া গাড়ির ভিতরে। সুকেশ ড্রইং রুমের সোফায় জাঁকিয়ে বসল।হাতে এক পাটিয়ালা পেগ, বুড়ো সাধু টলটল করছে। সামনে টেবিলে কাজু ভাজা। তিন মাস স্পর্শ করেনি এসব। এখন উদযাপন। আজ যেমন লাগছে নন্দিনীকে সুন্দ উপসুন্দের সঙ্গে দেবতারাও জড়িয়ে পড়বেন। নাগারাজু উ উ উ ... আজ তো তু গয়া।

মিনিট কুড়ি পরে দোরঘন্টি বাজল। সুকেশের আধবোজা চোখ দরজা খুলেই যামিনী রায়ের আঁকা হয়ে গেল। দুয়ারে নন্দিনী। কিছু ফেলে গেল না কি? গুসির ব্যাগটা? মিউ মিউ পেন্সিল হিল? ডিজাইনার ঘড়ি? না, সবই তো আছে যে-খা-নে যা থাকার।তবে? নন্দিনী ভেতরে এসে ধপাস করে বসে পড়ল সোফায়।

আঠেরো মিনিট পরে দুজনেই বসে আছে পাশাপাশি । দু রকম হাসি দুজনের মুখে। তবে তার বহু ব্যাখ্যা হতে পারে। কি হল বাইরে?

গাড়িতে শাড়ির কুঁচি সামলে ঠিক ঠাক ই বসে ছিল নন্দিনী। ড্রাইভার দাঁত বার করে বলল - হ্যাঁ বলল

- কেমন আছেন আন্টি? খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে আজ'

এক রাশ বিস্ময়ে ভেঙ্গে পড়েছিল নন্দিনী।

- 'তুমি আমাকে চেন'?

- 'আপনিও চেনেন আমাকে । রোজ দেখা হয় তো'

- 'রোজ? কোথায়'?

- ' আপনার বাড়ির দরজাতেই। আসলে আমি সকালে দুধের প্যাকেট দি। প্রত্যেক দিনই আপনি ভোর বেলা দরজা খোলেন। ঘুম ঘুম থাকেন তো তাই চিনতে পারছেন না। আমিও পারিনি। সকাল সকাল এত সেজে গুজে তো থাকেন না। আজ দারুণ লাগছেন বটে। তা ... এবার তাহলে এগোই আন্টি'?

তারপর পাথর প্রতিম নন্দিনীকে নিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল গাড়ি। সম্বিত ফিরতে নন্দিনী বলল -

- 'গাড়ি ঘোরাও'

- সে কি যাবেন না? বিরাট অনুষ্ঠান ওখানে আজ। আমিও একটা কার্ড পেয়েছি। তাই তো আপনার বুকিং তাড়াতাড়ি নিলাম'

- 'না আমি যাব না। গাড়ি ঘোরাও'

হতবুদ্ধি ড্রাইভার ছেলেটি গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। সে তো সাধ্যমত প্রশংসাই করেছে। ম্যাডাম বিগড়লেন কেন কে জানে।

এখন সুকেশের হাসির ঠিকঠাক মানে বোঝা যাচ্ছে না, তবে হয়ত মদ্যপান জনিত ঘামে তার টাক চকচক করছে।

নন্দিনীর মুখের হাসি বলছে - এই ছেলেটি আবার কাল সকালে আলুথালু নন্দিনীকে দেখবে। তারপর হয়ত তার প্রেমিকা কে বলবে

-'আন্টি কাল পটাখা সেজেছিল কিন্তু আসলে তো...'

যেখানে যাচ্ছিল - সবাই চেনে নন্দিনীকে।কি হবে তবে বসন্ত সেনা সেজে? এই অকাল বোধনের আয়োজন সেও তো বিসর্জনের জন্যেই। তারপর? দেহ মন কে আর এত বাণ মারার দরকার নেই। আসছে যখন - আসুক শীত।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন