অবসর সময়ের তরঙ্গাভিঘাত
এ বছরের তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠা
অসহনীয় দাবদাহে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দি হয়ে আছি বেশ ক-দিন ধরে। খাওয়া-ঘুম দুটোই
প্রায় বন্ধ। সারাদিনই বিছানা আঁকড়ে পড়ে আছি। যেহেতু দু-চোখের পাতা বেশির ভাগ সময়েই
এক করতে পারছি না, তাই মনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটোছুটি করে চলেছে কত যে এলোমেলো
ভাবনা, তার ঠিক নেই। সিনেমার পর্দার প্রক্ষেপণের মতো একের পর এক সেইসব ছবি আসছে, আর
শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবনার ঢেউগুলো গুণে চলেছি।
এই রকমই কিছু ভাবনার অবকাশে উঠে এলো আমার জানা কিছু জীবনবিমুখ বিলাপমুখী মানুষের কথা। এঁরা সকলেই সত্তর-আশি বছর পার করা বয়স্ক মানুষ। আমার দেখা অশীতিপর সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখেছি একটাই বাসনা কাজ করে সর্বক্ষণ— "কবে যে ঠাকুর তুলে নেবে!” ব্যতিক্রম কিছু মানুষের মানসিকতা। আমার দেখা প্রথিতযশা কোনো আশিঊর্ধ্ব ব্যক্তির মুখে এরকম কোনো হতাশাব্যঞ্জক শব্দ শুনেছি বলে মনে করতে পারছি না। যদিও এঁরা ঘটনাচক্রে সকলেই পুরুষ। আর সাধারণ শ্রেণির যাঁদের মুখে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটুকু হারিয়ে ফেলার হাহুতাশ শুনেছি, তাঁরা প্রায় সকলেই নারী।
জীবনকে নিয়ে শেষ বয়সে এসে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে এই যে অনীহা— এই নিয়ে বিস্তর ভাবনাচিন্তা করে শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত ভাবে একটা সিদ্ধান্তে এসেছি যে, এই অনীহার পেছনে হয়তো মানসিক এবং অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবিক সংসারে তাদের একা হয়ে পড়া। অশক্ত শরীরের প্রতি যত্নের ছোঁয়া দেবার মানুষের অভাব, একটু সময় দেবার কিংবা মানসিক বল জোগাবার কাছের মানুষের অভাবই তাঁদের বুকের পাঁজরের এই অন্তর্নিহিত দীর্ঘশ্বাসের কারণ।
আবার এর বিপরীত ছবিও যে দেখা যায় না, তাও নয়। অনেক পরিচিত পরিবারেই দেখেছি, যাঁদের দেখার পর্যাপ্ত লোক আছে - ছেলে, বৌমা, নাতি-নাতনি সকলেরই হার্দিক সান্নিধ্য আছে, সকলেরই দরদী নজর থাকে তাঁর ওপর। কারও কাছেই তিনি অবহেলার পাত্র নন — একটা বয়সের পরে তাঁদের মুখেও ‘কবে যাব, কবে যাব’ রব।
আমার পিতৃকুলের অনেক মহিলাই দীর্ঘায়ু। নব্বই পার করে তারপর ইন্তেকাল। আমার ঠামির (ঠাকুমা) মুখেও আশি পার হবার পর একই কথা শুনতাম। ব্যক্তিগত ভাবে আমি যতই তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করতাম এই বলে যে, ‘সময় হলেই যাবে’ বা রসিকতা করে ‘তোমার টিকিটের নম্বর আসেনি’ ইত্যাদি। এছাড়াও বেঁচে থাকার পক্ষে আরও নানা রকম উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলেও কোনো কাজ হতো না। একমাত্র, বংশের পুতি দেখা বা পুতনির বিয়ে দেখার মতো কোনো আশার বাণী শোনালে সাময়িক ভাবে এই প্রলাপ থেকে কিছুটা বিরত হতেন।
পরিচিত অন্যান্য সতীর্থদের পরিবারের ক্ষেত্রেও দেখেছি এই একই ছবি। এইসব মানুষকে আরও কত তত্ত্বকথা দিয়ে মন ভালো রাখার যত রকম প্রয়াসই করা হোক না কেন, এঁদের থেমে থাকতে দেখিনি কখনও। আবার অনেকের ক্ষেত্রে দেখেছি পরিবারের মা-কাকিমারা তাঁদের সব দিক থেকে ছুটি দিলেও এঁদের কিন্তু হাত থামে না। সংসারে কিছু একটা যেন করা চাইই চাই। ব্যাপারটা এমন যে ওটুকু কাজ না করলে সংসারটা অচল হয়ে পড়বে। আবার যথা সময়ে এঁদের মুখেও কিন্তু সেই একই প্রলাপ শুনতে হয়।
এমনিতে হয়তো দেখা যাবে সময়-অসময়ে বড়ির সময় পিঠে রোদ লাগিয়ে বড়ি দেওয়া, পিঠের সময় আনুষঙ্গিক কাজে হাত লাগানো, নিদেনপক্ষে পাশে বসে পরামর্শ দেওয়ার কাজ, এছাড়া আচারের বারমাস্যায় হাত লাগানো তো অছেই। প্রতি সন্ধ্যায় তুলসীতলায় "হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে"র মতো বঙ্গনারীর চিরাচরিত চেনা ছবি, চেনা সুর ঝরছে কম্পমান কণ্ঠ থেকে। কিন্তু অন্য মুখে লেগে আছে বিলাপের সেই একই বুলি। অথচ যখন যাবার সময় হল, আমার ঠামি কাউকে কিছু না বলে বিনা নোটিশেই চলে গেলেন। সম্ভবত নিজেই কিছুই টের পেলেন না!
অনেকদিন পর সেদিন বর্ষীয়ান পিসিমার বাড়ি যেতে তিনিও দু-চার কথার পর চলে এলেন তাঁর সেই ফেভারিট ‘টপিকস’-এ। অথচ এই বয়সেও সমানে ক্রুশের চাদর, ঠাকুরের জামা বুনে চলেছেন। নয়তো শাড়িতে বাহারি সুতোর নক্সা। বাড়িতে এখনও রোজকার ঠাকুর সেবা, ছেলে-নাতি-নাতনির রোজনামচার নিয়মিত খবরাখবর রাখা, পালাপার্বণ, উৎসব-অনুষ্ঠানে আত্মীয়কুটুম্বর আতিথেয়তা সামলাতে সামলাতে মরবার সময় নেই। তবু নানা কথার ফাঁক-ফোকরে ওপারে যাওয়ার তীব্র টান মন থেকে অপসারিত হতে দেখি না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এঁদের এই বিলাপ শুকনো চোখে অত্যন্ত দার্শনিক গম্ভীরতার মধ্যে দিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় চোখ মুছতে মুছতে। আসলে এঁদের মনের অব্যক্ত আক্ষেপ এই— সবাই চলে যাচ্ছে আর উনি কী পাপ করেছেন যে এখনও পড়ে আছেন যন্ত্রণাময় এই জগতে! পিসির বাড়ি যাবার আগের দিনই খবরের কাগজে পড়েছিলাম একশো পাঁচ বছরের জন্মদিন কেক কেটে পালন হল এক ভদ্রলোকের। পিসির সেই অনর্গল ‘টকপিস’-এর পাল্টা এই উদাহরণ তুলে ধরতেই ক্ষেপে গেলেন তিনি। আশ্বস্ত করে বললাম, "আচ্ছা, জন্মদিনে কেক কাটতে হবে না। তুমি শুধু এই রেকর্ডটা ভেঙে দিয়ে নতুন একটা রেকর্ড করো।” এতে আরও চটে গেলেন পিসিমা।
খুব কাছের এই দুই ঘরোয়া মহিলা ছাড়াও আর একজনের কথা খুব মনে পড়ছে। স্কুল জীবনে আমি তাঁর খুব ভক্ত ছিলাম। তাঁর অনমনীয় ব্যক্তিত্ব, অগাধ পাণ্ডিত্য এবং স্বল্প বাক্যে নীচুস্বরের শাসন আমাকে আকৃষ্ট করেছিল তাঁর প্রতি। স্নেহ পেয়েছি অপার। তিনি শুধু সুশিক্ষিকা নন, সুলেখিকাও। ইংরাজি ও বাংলায় ছিল তাঁর সমান দক্ষতা। একসময় সম্পাদিকা হিসেবেও দায়িত্ব সামলেছেন একটি মহিলাদের নামী পত্রিকার। স্কুলজীবনের অনেক বছর পরে তাঁর সঙ্গে আবার যোগাযোগ হয়। তখন আমি সেই চঞ্চল স্কুলকিশোরী থেকে প্রৌঢ়ত্বের দিকে গুটিগুটি হেঁটে চলেছি। তিনি কিন্তু সেই চিরাচরিত স্নেহময়ী মাতৃরূপিনী চরিত্রেই থেকে গেছেন। অবিবাহিতা এই নারীটি সর্বার্থেই চিরস্বাবলম্বী। তাঁর জ্ঞান ও জীবন দর্শনে আজও মুগ্ধ হই। কিন্তু জীবনের সায়াহ্নে তাঁর গলায়ও সেই একই সুর— "আর কেন! এবার গেলেই হয়!” তাঁর মুখেও এই বিলাপ-উক্তি শুনে কিছুটা স্তম্ভিত এবং একই সঙ্গে বিমূঢ় ও হতাশ হয়েছি।কখনও কখনও মনে হয়েছে, সংসারের মায়াঘরটি বুকের মধ্যে আমৃত্যু বেঁধে রাখার বাসনাতেই বুঝি নারীরা সাধ করে পরাধীনতার বেড়ি পরে থাকে। আর তাই বুঝি আশাপূর্ণা দেবী তাঁর সৃষ্টির কথায় বলতে পারেন সেই অমোঘ সত্যটি— "মেয়েমানুষ জেনে বুঝে বোকা সেজে থাকে তার পাখির বাসাটি যাতে ভেঙ্গে না যায়"।
পুরুষ চিরকালই একনায়কতন্ত্রের প্রতীক। নারীকে দখলে ও অবদমিত রাখাটাই তাদের জীবনের সার্থকতা মনে করে। নারী হয়তো সামাজিক বেড়ির কারণে পুরুষের এই দাবি কিংবা অধিকারের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেয়, কিন্তু অন্তরে সে কিন্তু স্বাধীনই থেকে যায়। কারণ তার কাছে যে যে-কোনো কিছুর বিনিময়ে সম্পর্কটি সুন্দর রাখাটাই একমাত্র লক্ষ্য। তাই সে জেনেবুঝেই পরাজিত হয়। কিন্তু অন্তরের ওই যে স্বাধীনতা বোধ! শেষ বয়সে এসে তাই বোধহয় অশক্ত শরীরে পরের হাততোলা হয়ে থাকার লজ্জা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই বার বার তার কণ্ঠে উৎসারিত হতে থাকে ‘চলে যাবার’ এই বিলাপধ্বনি। সকলকে মুক্তি দিয়ে তাই সে দ্রুত পালাবার পথ খোঁজে। উদগ্রীব হয়ে ওঠে পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলনাকাঙ্ক্ষায়। ভারতীয় নারীর এই অন্তিমকালীন বিদায়ী আত্মসম্ভাষণ হয়তো কী স্বাবলম্বী, কী ছাপোষা সংসারী— যুগ যুগ ধরে এভাবেই দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঝরে পড়তে থাকবে। কোনো প্রজন্মই জীবনের এই অমোঘ বিলাপ থেকে হয়তো মুক্ত হতে পারবে না। এই ভবিতব্য নিয়েই এগিয়ে চলবে উন্নত পৃথিবীর এই মনুষ্যকুল— বিজ্ঞানপ্রযুক্তি আর অন্তর্জালিক দুনিয়া যতই রকেট গতিতে এগিয়ে চলুক।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন