কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

                        

লাল-নীল-পেন্সিল


 

(৪৫)

লোহার বড়ো গেটের কালো পেইন্ট পুরোনো। গেট এখনও মজবুত। গেটের ভেতর মাঝ-বরাবর নাক বরাবর লাল মোরামের সুঁড়িপথ। শেষ মাথায় হালকা হলুদ ছোটো বাড়ি। মাথায় অ্যাসবেস্টসের চাল। লম্বা জানালার শিকগুলোও চোখে ধরা পড়ে। এটি আসলে মূল বাড়ির অংশ, হয়ত আউটহাউস। বাঁদিকে ঘুরে গেলে টানা বারান্দাওয়ালা মূল বাড়ি। প্রাচীন জমানার একতলা। পোর্টিকো থেকে চার-পাঁচটা সিঁড়ির ধাপ উঠেছে বারান্দায়।

পথের দুপাশে সাজানো টবে ছোটো ছোটো ফুলগাছ। দু-পাশে খোলা জমিতে ঘন সবুজ মহীরুহের ভীড়। চোখ জুড়োনো ছবির বিন্যাস।

খাতা বন্ধ করে হাতের পাতায় চোখ ঢাকল মনোজ। চোখ ডলে শ্রুতিকে দেখল। বলল,

অ্যাবসার্ড! ভেরি কুইয়ার।

আই সেইড!”

কিন্তু দেখার চোখ না থাকলে মিউজ্‌ বোঝা যাবেনা!”

মনোজের চওড়া কপালের পাড় ঘেঁষে এলোমেলো চুল। রোদেলা শুকনো মাঠের পাশের সবুজ ছায়া। গালে কাঁচাপাকা দাড়ি। টিন্টেড-গ্লাস চশমার পেছনে চোখ কালো গভীর। চওড়া চোয়াল, চৌকো মুখ। শ্রুতি সেই মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। এলোমেলো মানুষটা দমকা হাওয়ার মতো। কাছে বসলে দুঃখ, ভাবনা উড়ে পালিয়ে যায়। নিজের আঙুলের দিকে সে তাকায়। অনামিকায় সলিটেয়ার বসানো সোনার আংটি। গতমাসে দু-জনে সংক্ষেপে রেজিস্ট্রি বিয়ে সেরেছে। শ্রুতি আরো কাছে সরে যায়। তার গালে ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে মনোজ হাসে,

কা হুয়া?”

কিছু না। ছবিগুলো আর একবার দেখি?”

ওরা দেড়-ঘন্টা ধরে শোভনের আঁকা ছবি দেখে চলেছে। মনোজ পাতা উলটে প্রথম ছবিতে গেল। হোটেলের ছবিটা। রেখা-রঙের কাজ নিখুঁত নয়। পাতি আর্ট-পেপারে পেন্সিল রঙ ঘষা। অথচ আশ্চর্য সরব। টাইপ-রাইটারের খটখট, মানুষের অস্তিত্বের শব্দ, গাছের পাতার দুলুনি ভীষণ বাস্তব! লাল ব্রিকের দেওয়াল, সবুজ জানালার কপাট বুঝি ছোঁয়া যায়। প্রত্যেক রেখা আলাদা, সমস্ত রেখা জুড়ে জুড়ে একটা গল্প। প্রেক্ষাপট দেওয়া আছে, চরিত্র সাজিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা। গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল শ্রুতির। মনোজ লক্ষ করল। বলল,

রিয়েলি অ্যামেজিং! অ্যায়সা আর্ট কভী নহীঁ দেখা! ইটস্‌ লাইক, আই মিন বিয়ণ্ড এক্সপ্লানেশন।

পরপর পৃষ্ঠা উলটে শ্রুতির দিকে এগিয়ে দিল,

ইয়ে দেখো!”

উফ্‌!”

বাড়ির সামনের উঠোনে সাপের ছবিটা। উদ্যত সাপের ফণা দুলে উঠবে এখনই। দু-জন মহিলার উঠোন থেকে ছুটে পালানোর ভঙ্গী। শ্রুতি বেশীক্ষণ দেখতে পারল না। চোখ বুজে খাতা বন্ধ করল। মনোজ স্বগতোক্তি করল,

হাউ স্ট্রেঞ্জ!”

ইয়েস।

তোমার মৌসির সঙ্গে কী কথা হয়েছে?”

প্ল্যান জানিয়েছি। মানে হিন্টস্‌

না, নট্‌ অ্যাবাউট প্ল্যানস্‌। ছবিগুলোর ডাইমেনশন নিয়ে

সেম, সেম অভিজ্ঞতা। অনেকদিন আগে বলেছিল মাসিমণি।

বাবুলের বিয়ে হয়ে গেল মাসতিন আগে। মামপি দশদিনের জন্য কলকাতা গিয়েছিল। লিপিকার বদল খুব চোখে পড়েছে। উদাস, নির্লিপ্ত, নিরাবেগ। ছোটোখাটো চেহারা শীর্ণ আরও। ধপধপ করছে গায়ের রঙ। সঙ্গত রেখে মাথার রুপোলি সুতো প্রকট, অবাধ। শান্ত হাসিমুখে মামপিকে স্বাগত জানিয়েছিল।

এসেছিস? লোকজন বেশী বলিনি রে। বাবুলের কোনও বন্ধুও তো এখানে নেই, সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ওরা দিল্লী ফিরে গিয়ে বন্ধুদের ডেকে অনুষ্ঠান করবে বলেছে।

মামপি একসেট কাপল্‌-ওয়াচ গিফট কিনেছিল। দেবিকা-কৌশিক এসেছিল। দেবিকা নিজের সোনার গয়না ভেঙে দুল গড়িয়েছিল নতুন-বউয়ের জন্য। দাদা-বৌদিকে নেমন্তন্ন করেছিল লিপিকা। দিদিকে কার্ড পোস্ট করেছিল, আসবে না জেনেও। আর শ্বশুরবাড়ির ক-জন আত্মীয়, বিল্ডিং-এর অন্যান্য বাসিন্দা। নিমন্ত্রণ করেছিল শোভনের হোম ফিজিশিয়ানকে। কন্যাযাত্রী মিলিয়ে পঁচাত্তর-আশি জনের মতো অতিথি।

দেবিকা এসে হৈ-চৈ বাধিয়েছিল,

একমাত্‌তর ছেলের বিয়ে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া দিবি মেজদি? আলো কই, বাজনা কই? কইরে বাবুল আয়, দেখি। ছোটোমাসিরে সেই কবে দেখেছিস, মনে আছে?”

বাবুলের এরকম পরিবেশে থাকেনি আগে। একবাড়ি আত্মীয়জন, প্রতিবেশী। অস্বস্তি সত্বেও ভালোও লাগছিল। সে দেখছিল লিপিকাকে, সন্ধেবেলার বাগানে ফুলগাছের মতো অস্পষ্ট। ঠিক বুঝতে পারছিল না। কেমন দূরত্ব রাখছে তার সঙ্গে। বিয়ে করতে যাওয়ার আগে উপস্থিত মহিলারা তাকে লিপিকার কোলে ঠেলে দিয়ে বলল,

মা-কে প্রণাম করে বলো, তোমার জন্য বউ আনতে যাচ্ছি

বাবুল লিপিকার মুখের দিকে তাকিয়ে শেখানো কথাগুলো বলল। লিপিকা হাসল, স্নিগ্ধ নরম একটু হাসি। একফোঁটা শিশিরের মতো। ছেলের মাথায় আলতো হাত রাখল,

সুখ-দুঃখে সারাজীবন ওকে সঙ্গে রেখো, এইই ব্যাস

মুহূর্তে বাবুলের বুকে তুমুল ধুলোর ঝড় উঠল, চোখ ঝাপসা। বাবা-মা-সে আজন্ম, এমনকি গতবছর পর্যন্তও তিনজন ছিল সম্পূর্ণ বৃত্ত। লিপিকা মজা করত,

তুই তো এখানে থাকবি না, দিল্লীতে থাকবি। তুই আর তোর বউ। আমরা বুড়োবুড়ি থাকবো এখানে। যাওয়া-আসা করবো। দূরে থাকলে তোকে শাশুড়ি-বউ ঝগড়াও দেখতে হবে না।

ওঃ মা, তুমিও পারো!”

বাবুল খুব হাসত। শোভনও। অথচ সেই মুহূর্তে লিপিকার শান্ত, কোমল আশীর্বাদ আগামীর ছবিটা স্পষ্ট করে দিল। বাবুল ভাবল, শুধু সে আর উর্বী? বৃত্ত এত ছোটো করে দিল মা? নিজেকে সরিয়ে নিল? গত প্রায় একবছর দিল্লীর ফ্ল্যাটে কাটিয়েছে সে আর মা! ওই সময়টা বুঝি স্বপ্ন ছিল? বুদ্ধি দিয়ে যতটা বুঝেছে, লিপিকা ভবিষ্যতে কারও ওপর নির্ভর করতে চাইবে না। অন্তরমহল তোলপাড় হল তার। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে মা-র কোলে মুখ গুঁজে বাবুল কেঁদে ফেলল। বরযাত্রী যাওয়ার জন্য তৈরি আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, তাকে নিতে-আসা উর্বীর বাড়ির লোক অপ্রস্তুত! মামপি স্তব্ধ। দেবিকার দিকে তাকাল, মুখ দেখতে পেল না। নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে দাঁড়াল ব্যালকনিতে। বাড়ির বাইরেটা এবং ব্যালকনি সাজানো হয়েছে জ্বলা-নেভা টুনি-বালব দিয়ে। তার আলো মামপির চোখের মণিতে চিকচিক করতে লাগল। বাবুলের ভেঙে পড়ার দৃশ্যটা গেঁথে রইল মনে।

লিপিকা কাঁদল না, চোখও মুছল না। সকলকে নীচে গিয়ে গাড়িতে অপেক্ষা করতে অনুরোধ করল। কিছুক্ষণ পর বলল,

ওঠো বাবুল। বিয়ের একটা শুভ সময় থাকে, লগ্ন বলে। সেটা পেরিয়ে যাওয়া উচিত না। উর্বী তোমার জন্য ওয়েট করছে। ওঠো, শান্ত হয়ে বাথরুমে গিয়ে মুখ-চোখ মুছে নাও।     

লিপিকার কথায় অনেকে নীচে গিয়েছিল। অনেকে ছড়িয়ে বসেছিল এদিক-ওদিক। মামপি ঘরে এসেছিল পায়ে পায়ে। কাছ ঘেঁষে এল লিপিকার। শাড়ির খসখসানিতে ঘুরে তাকাল লিপিকা। তার দেওয়া সোনালি-রঙ বুটিদার কাঞ্জিভরম শাড়িতে, খোলা চুলে, চশমায়, ছিপছিপে, মধ্য-তিরিশের আত্মসচেতন দীর্ঘ আলোর রেখা। মুগ্ধচোখে দেখে বাবু্লের মাথায় লিপিকা হাত রাখল,

কিরে ওঠ্‌! দ্যাখ বরযাত্রী যাবে বলে কী সুন্দর সেজেছে মামপি!”

এয়ারপোর্টে ল্যাণ্ড করে সেবার মামপির মন গুমড়ে উঠেছিল, ‘আমার শহর! আমার আজন্মের শহর! কেন ছেড়ে যেতে হল? কেন ফিরে আসব না?’ যে দশটা দিন রইল কলকাতায়, নিরন্তর এই ভাব তাকে আঁকড়ে রইল। বাবুলের বিয়ের তিনদিন আনন্দ করল সকলের সঙ্গে, যদিও সে মেলামেশায় তত পটু নয়। বাকি দিনগুলো বাড়িতে। নিজের ঘর ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছেই করল না। লিপিকা তাকে ফোন করে যেতে বলেছিল। বাবুল-উর্বী থাকবে না জেনে এক বিকেলে অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিল। চাওয়ামাত্র শোভনের খাতা তাকে দিয়েছে লিপিকা। আপত্তি করেনি, প্রশ্নও করেনি। বলেনি, সাবধানে রাখিস। মামপি অসম্ভব অবাক হয়েছিল। এতখানি নিরাসক্তি কী করে অর্জন করতে হয় বুঝতে পারেনি। সে নিজেই বলেছিল,

মাসিমণি, আমি নিজের চেয়েও বেশী যত্নে রাখবো।

আমি জানি মামপি। নিয়ে যা, এত ভাবিস না।

বাড়িতে পৌঁছে খাতাটা কাপড় মুড়ে স্যুটকেসে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। দেবিকা এসে দাঁড়িয়েছিল ঘরের দরজায়,

গেছিলি মেজদির বাড়ি?”

হ্যাঁ।

কী কইল?”

কী আর বলবে?”

খাইছস কিছু?”

খেয়েছি স্ন্যাক্‌স্‌। রাত্তিরে অল্প একটু খাবো।

চলে যাচ্ছিল দেবিকা যেন অনিচ্ছায়, মনে হল মামপির। ডেকে বলল,

ও-মা, কিছু বলবে?”

ও-ই! কী দিল তোরে মেজদি দেখাইবি না? ডাকছিল ক্যান?”

ইতস্তত করে বলেছিল দেবিকা। নিমেষে মামপির নরম ভাবটুকু উবে গেল। সামলে বলল,

দিয়েছে তো মা জামাকাপড়, সবাইকেই। দামী শাড়ি দিয়েছে তোমাকে, আমাকে। বাবুলের শ্বশুরবাড়ি থেকে শাড়িও পেয়েছ!”

হ্যাঁ, পয়সা আছে। খরচাও করছে। আমি কইছিলাম নতুন বউয়ের উপহার থেকে তোরে একটা কিছু, আমিও মেজদির বিপদের সময় কম করি নাই।

বিশ্রী কাঙালপনা! মামপির ভেতরটা ছী-ছী করে উঠল। একগাদা কথা এসে গলা আটকে দিল। জোর করে বলল,

একটু কাজ আছে আমার। দরজা টেনে দিয়ে যাও।

বন্ধ ঘরে নিশ্চুপ বসে রইল সে। শরীর, মন, মস্তিষ্ক নিস্তেজ, তিতকুটে অনুভূতি। মুহূর্তে হায়দরাবাদে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হল। মনোজের কথা মনে পড়ল। তিনদিন পর তার ফ্লাইট। এশহর পরবাস। এখানে তার জন্য কোথাও নরম বিছানা পাতা নেই।

প্রতিমাসে দেবিকার অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা সে পাঠায়। এবার আসার আগে মা-র জন্য অনেকখানি মায়া, বাবার জন্য স্নেহ জমিয়ে এনেছিল। আশা করেছিল, আলোয়-ছায়ায় মাখামাখি হয়ে থাকবে। বাড়ি সাজাবে। কিনে দেবে বেড-কভার, সুন্দর পর্দা, আধুনিক ডাইনিং টেবিল। দিদিমার স্মৃতি ঘাঁটবে। এবং তার সম্পর্কের কথা জানিয়ে দেবে। মা-বাবা অভিমান করুক, অনুযোগ করুক, ভালো লাগবে। এসে দেখছে দেবিকার চোখে অদ্ভুত সমীহমাখা দূরত্ব। কৌশিক তুলনায় স্বাভাবিক। রাতে অনুজ্জ্বল, একঘেয়ে জায়গাটায় খেতে বসে বিষণ্ণ লাগল। রান্নার মহিলা রুটি, আলু-বিনস ভাজা আর ডিমের কারি রেঁধে রেখে গেছে। রুটি ছিঁড়ে মুখে দেওয়ার আগে মামপি বলল,

মা-র অ্যাকাউন্টে পঁচিশ-হাজার রাখলাম। চার-সিটারের ডাইনিং টেবিল অর্ডার করে দিয়ো, স্কোয়ার হলে ভালো। যা লাগবে, বাকিটা দিয়ে পর্দা-টর্দা

কৌশিক স্পষ্টভাবে বিব্রত হল। বিরক্তি নিয়ে বলল,

এইসব কী দরকার মামপি? টাকাগুলা শুধু-মুধু নষ্ট!”

দেবিকার চোখ চকচকে। কৌশিককে দাবিয়ে রেখেছে চিরকাল। সেই সুরেই বলল,

চুপ করো দেকি। রোজকারি মেয়ে দিচ্ছে, নেব না? তোমার মুরোদই আছিল না! কোনওরকমে খাওয়া-পরা টানছ। এই পুরান নড়বড়া ডাইনিং টেবিল, এইটাও আমার বাবারই। টাকা সব ওইদিকেই ঢালছ। তোমার মায়ের অসুখ, বোনদের বিয়া,”

দেবিকা থামতে পারে না। কৌশিক আবার চুপ। মামপি গম্ভীরভাবে বলে,

বাবা, একটা কথা জানানোর ছিল। আমি সেট্‌ল্‌ করছি, রেজিস্ট্রি বিয়ে।

থমকে গেছে বাতাস, থমকে গেছে মামপির মা-বাবা। খানিক পরে শ্বাস টেনে দেবিকা বলে ওঠে,

অ! এইটার জন্যই বুঝি দেবার্ঘ্যরে পছন্দ হইল না?”

মোটেই না।

মিথ্যা কথা কইস না মামপি। দেবার্ঘ্যর মতন পাত্র, ভালো পরিবার হেলায় হারালি। তুই কি ভাবছিলি সে তরে ছাড়া বিয়া করব না? খুবই ভালো বিয়া হইছে। তা এনার চাকরি-বাকরি আছে, না তোর পয়সাতে বইসা খাবে?”

মামপির ইচ্ছে করে আঁ-আঁ করে গলা চিরে চীৎকার জুড়তে। খাবার, থালা-বাটি, ফেলে-ছুড়ে তছনছ করে দিতে। শৈশবে করত, তারপর দেবিকার হাতে উত্তম-মধ্যম। দম আটকে আসত। খাবার ঠেলে দিয়ে সে ঢকঢক করে জল খায়। কৌশিককে বলে,

বাবা শোনো, জানি তোমরা মত দেবেনা। তাহলে ফিউচারে আসবো না কলকাতায়।

কৌশিক মাথা নেড়ে বলতে চায়, গলায় শ্লেষ্মা। মামপি অপেক্ষা করে। কৌশিক ভেবে-ভেবে বলে,

কেমন ছেলে, কী করে? স্বজাত?”

মামপি খুলে বলে সমস্ত, লুকোয় না। মনোজ সহায় জামশেদপুরের ছেলে। প্রথম পরিচয় হায়দরাবাদে একটা ফোটোগ্রাফি একজিবিশনে। বয়সে তেতাল্লিশ। ব্যাঙ্গালোর ক্রাইস্ট কলেজ থেকে মাস্টার্স। হায়দরাবাদে একটি নামী মিডিয়া সংস্থায় জার্নালিস্ট। ফোটোগ্রাফির নেশা। মা নেই, বাড়ির ছোটো ছেলে। অল্পবয়সে দাদিমা বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ে টেকেনি, ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেক বছর। বউয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তার বাপের বাড়ি অবস্থাপন্ন, খোরপোশ নেয় না।

দেবিকা-কৌশিক শোনে। এতসব বুঝতে পারেনা, মাথার ওপর দিয়ে যায়। কোথায় টিকটিকি টকটক করে ডাকে। দেবিকা আচমকা তারস্বরে চীৎকার করে ওঠে,

শয়তান মেয়ে! নুংরামি কইরা পার পাবি ভাবছস? ডাইভোর্স, অ্যাঁ? ডাইভোর্স-করা ছেলে? সেইটারে বিয়া করবি? এত অধপ্পতন হইছে? মুখ ভাইঙ্গা দেব তর! নমস্তস্‌সই পয়সা ছিটাইয়া সাপের পাঁচ-পা দ্যাখছ? সুখী হইবি না, কোনওদিন না

দেবিকা অনর্গল বলে। যে কথাগুলো একদিন গায়ত্রী তাকে বলেছিলেন, সেগুলোও অহেতুক মিশে যায়।

মামপি চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়ায়। স্পষ্ট করে বলে,

বে-শ করবো! নিজেরা কী করেছিলে? মনে নেই? সারাজীবন অপমান আমাকে পেতে হয়নি?”

মামপি চুপ কর!”

ধমকে ওঠে কৌশিক। দেবিকা চোখমুখ লাল করে বলতেই থাকে। হাঁপায়, আবার বলে। মামপি চলে যেতে যেতে কৌশিককে বলে,

তোমরা ডাক্তার দেখাও। মাথার ট্রিটমেন্ট করো

ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় ভেঙে পড়ে মেয়ে,

এরা আমাকে কেন কষ্ট দেয়? সারাজীবন? এই লাস্ট, আর কখনও আসবো না!”

রাতের স্তব্ধতা চিরে কান্নার শব্দ ছিটকে আসে। কৌশিক দরজা ধাক্কা দিতে ভয় পায়। করুণভাবে দেবিকাকে বলে,

কী করলা দেবী? আমাদের সন্তান! তারে এমন গালি দিলা?”

শব্দক-টি যেন মন্ত্রপড়া জল! ভাঙা গাছের মতো দেবিকা কৌশিকের বুকের ওপর আছড়ে পড়ে,

আমারে কয়-ঘা লাগাইয়া দাও তুমি। আমি কইতে চাই নাই, কইতে চাই না! মুখ দিয়া বের হয়ে যায়! মাথা য্যান আগুন! ভাবছিলাম বলব, জীবনেও প্লেনে চড়ি নাই। আমারে একবার হায়দ্রাবাদ নিয়ে যাবি মামপি?” 

ডিটিডিসির ভারী পার্সল এসে পৌঁছাল। মামপি পাঠিয়েছে। সাবধানে খোলে লিপিকা। শোভনের আঁকার খাতাটি সযত্নে কাপড়-মোড়া। তার মধ্যে চারটি আঁকার ফোটো এনলার্জ করে বাঁধানো। বেছে-নেওয়া বারোটি ছবির ডিজিটাল প্রিন্টে দশটি বারোমাসের টেবল ক্যালেণ্ডার। প্রতি ছবিতে লেখা আছে, ‘আ ট্রিবিউট টু দ্য ক্রিয়েটর। লিপিকা বিক্রি বা উপহার দিতে পারে। পাঠানোর আগে মামপি ফোন করেছিল। নিজের বিয়ের খবরও দিয়েছিল। লিপিকা খুশী হয়েছে। খরচের প্রসঙ্গ ওঠায় নি। বিশেষ দোকানের দামী গহনা পছন্দ করে মামপিকে তার নামে বিল্‌ করে দিতে বলেছিল।

ফোটো, ক্যালেণ্ডার নিবিষ্টমনে দেখে লিপিকা। নেই! সেই জাদু সম্পূর্ণ অন্তর্হিত। প্রাণহীন ছবিগুলো অপটু শিল্পীর আবেগলব্ধ। হয়ত বিষয়বস্তু কিছু আলাদা। লিপিকা তাড়াতাড়ি লিভিংরুমের দেওয়ালে টাঙিয়ে দেয়। একটা ক্যালেণ্ডারও রাখে। বাকি শোভনের আলমারিতে তোলে। শোওয়ার ঘরের দেওয়ালে ফ্রেমে-বাঁধানো শোভনের হাসিমুখ। ফোটো। কিন্তু তাকালে মনে হয় ফ্রেমের পেছনে শোভন সশরীরে উপস্থিত। লিপিকা ছবিটার দিকে চোখ ফেলে না। চলে-যাওয়া মানুষকে ফেরানো যায়না। মেঘ কেটে সাময়িক আলো ফোটার অস্বস্তি হয় শুধু।

বাবুল-উর্বী ফিরে যাওয়ার পর আবার সে সারাদিন একা। ময়না আসে রাত দশটার পর। আজকাল নিজেকে ভারহীন পালকের মতো বোধ হয়, হালকা। মন কাগজে-তৈরি ঘূর্ণির মতো শুকনো হাওয়ায় ঘোরে। বাবুল ফোন করে, উর্বী অনুযোগ করে। দিল্লীতে ওদের কাছে গিয়ে থাকতে বলে। লিপিকা হাসে, ‘যাবো রে যাবো। তোরা ভালো তো?’ মামপির জন্য মন খারাপ জমে থাকে। অমন শক্ত মেয়ে ফোনে খুব কান্নাকাটি করেছে।

তোমার বোনকে একটু দেখো মাসিমণি। ক্রমশঃ মেন্টাল হয়ে যাচ্ছে। কোনও সায়কায়্যাট্রিস্টের খোঁজ থাকে তো প্লিজ যোগাযোগ করে দিয়ো।

নিশ্চয়ই দেখবো, এত চিন্তা করিস না রে।

ভরসা দিয়েও দ্বিধায় থাকে লিপিকা। দেবিকা বহুদিন ফোন করেনি। কী ঘটেছিল, মামপিই সংক্ষেপে বলেছে। এই পরিস্থিতিতে কৌশিকও নড়বড়ে। সত্যিই হয়ত মানসিক সাহায্য দরকার ওদের। কিন্তু রাজি করানো আদৌ সম্ভব? লিপিকা আনমনে মোবাইলে নম্বরটা খোঁজে। অপ্রয়োজনীয় অনেক নম্বর ডিলিট করে দিলেও এটা থেকে গেছে। দ্বিধা নিয়ে ফোন করে ক্লিনিকে। তারিখ বুক্‌ করে।

এবার তার সঙ্গে কেউ নেই। ডাক্তারের কেবিনে ঢুকতে বুকের ভেতর গুড়গুড় করে। এই ডাক্তার তার মেঘাচ্ছন্ন অসহায়তা বুঝে বলেছিলেন, ‘আপনিও ডিপ্রেশনে আছেন। ঠাণ্ডা কেবিন। সে মুখোমুখি চেয়ারে বসে। ডাক্তার চোখ কুঁচকে সহাস্যমুখ,

মিসেস,”

আমি লিপিকা।

ইয়েস। পেশেন্ট কই? কেমন আছেন তিনি?”

লিপিকা কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে মাথা নীচু করে। মাথা নাড়ায়। গলা ধরে গেছে। ডাক্তার আঁচ করেন।

কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট? না সেরেব্র্যাল?”

কার্ডিয়াক

কবে হল?”

দু-বছর প্রায়।

হুঁ, হার্ট কণ্ডিশন ভালো ছিলনা কম্প্রোমাইজড

ডাক্তার কনসাল্ট করার সুযোগই দিলেন না।

ভেরি স্যাড্‌। আপনি কেমন আছেন?”

এখন ভালো।

দেখে মনে হচ্ছে। তবে বয়সটা বেড়েছে। ভালো থাকবেন।

আর কী! সিনিয়ার সিটিজেন হতে চললাম!”

গুড্‌। প্রবলেম কী হচ্ছে?”

আমার না, আমার ছোটো বোনের।

আচ্ছা! আসতে চাননা, ভুলিয়ে আনতে হবে? বলুন, আপনার ভার্সন শুনে নিই আগে।

লিপিকা বলে। থেমে, ভেবে, গুছিয়ে যতটা বোঝে দেবিকাকে, বলে যায়। তাদের আজন্মের অতি সাধারণ পরিবারের কথকতা। ভাবে, এত ধৈর্য নিয়ে, মন দিয়ে শোনার মতো কাউকে দেবিকাও পাবেনা। কৃতজ্ঞতা নরম করে রাখে। ডাক্তার বলেন,

বুঝলাম। নেক্সট উইকে আউটিং-এর লোভ দেখিয়ে একদিন নিয়ে আসুন। আলাপ করি।

ধন্যবাদ দেয় লিপিকা। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। ডাক্তার গলা ঝাড়েন, ঈষৎ দ্বিধার ভাবে বলেন,

একটা প্রোপোজাল ছিল ম্যাডাম।

অকারণে বাতাস তপ্ত। লিপিকার কান গরম। হাতের মুঠো শক্ত। সোজাসুজি পলকহীনভাবে তাকায়। ডাক্তার অনুত্তেজিতভাবে বলেন,

মিনিটদুই বসুন, আপনাকে বলি। আপত্তি থাকলে না করে দেবেন।

বলুন?”

আমাদের একটা ট্র্যাভেল-গ্রুপ আছে। একেবারেই ক্লোজগ্রুপ। সাতজন মেম্বার। আমার দুই এক্স-কলীগ, তাঁদের মিসেস। একজন লেডি ডক্টর, বিয়ে করেন নি। একজন উইডোয়ার আর আমি। আপনি কি জয়েন করবেন, আমার বন্ধু হিসাবে?”

কী অভাবনীয় প্রস্তাব! লিপিকা আচমকা অজানা পথের মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকক্ষণ কথা খুঁজে পায় না। তারপর বলে,

আপনার মিসেস? যান না?”

ওপরে চলে গেছেন, আটবছর হল। ক্যান্সার হয়েছিল। মেয়ে-জামাই-নাতি জুরিখ্‌-এ।

আবার দীর্ঘ নৈঃশব্দ। এ-সি চলার ফিনফিনে শব্দ। লিপিকার মনের মধ্যে, মাথার মধ্যে দানা-দানা চিন্তা ভাসমান। সেগুলো সরিয়ে ফেলে পরিষ্কার করে বলে,

বেশ। আমি যাবো।

ছেলে-মেয়ে?”

ছেলে-বউমা দিল্লীতে। জানিয়ে দেবো ওদের।

মত না দিলে?”

রহস্যময় দৃষ্টি লিপিকার চোখে। ডাক্তরের ব্যগ্রতায় মিটিমিটি হাসে। প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নেয়। বলে,

আমার চলার পথ আমিই ঠিক করি ডাক্তারবাবু। চিন্তা করবেন না। আপনার টিমকে বলুন একজন নতুন সদস্য যুক্ত হল। যেখানেই আপনারা যাবেন, আমি সঙ্গী হব। আসি? ফোনে কথা হবে।

(সমাপ্ত)

                             

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন