সমকালীন ছোটগল্প |
পড়ে পাওয়া
বৃষ্টি কি আমার মতো করেই পড়ে! জিজ্ঞাসা
করি, কেমন করে পড়িস তুই বৃষ্টি! এভাবে মাটিতে
পড়তে তোর কেমন লাগে! বৃষ্টি উত্তর দিলো ‘বেশ লাগে’।
এই তো মুশকিল হলো। ‘বেশ লাগে’ বাক্যটা
দ্ব্যর্থবোধক। আনন্দ ও ব্যথা-যন্ত্রণা, দুইই বোঝায়। যে যেমন করে উচ্চারণ করে, যে যেমন
করে বিশ্লেষণ করে। এত সব বুঝিয়ে বলার সময় কি আছে এখন!
আমার পতনমহূর্তকে ফ্রেমবন্দি করতে করতে, আবার ওকে জিগ্যেস করি, অতদূর মেঘ থেকে মাটিতে পড়তে তোর কতটা সময় লাগে? সে কি বলা যায়! মেঘের থেকে মাটির দূরত্ব কোন সময় কেমন থাকে সেটা ক্যালকুলেট কর! আমার গতিবেগও তোমাকে মাপতে হবে! তবে না সময় জানতে পারা যাবে! এসব মাপামাপির দ্বন্দ্বে আমার, মানে, বৃষ্টিপাতের ছন্দ সময় এইসব হাবিজাবি নির্ভর করে আছে। এ দুনিয়ায় নির্ভরতার শেষ নেই। তা, এসবে তোমার কিসের দরকার! আমার মোবাইলে চার্জ নেই তেমন। বেশিক্ষণ কথা বলা যাবে না। বি কুইক! নো ধানাই পনাই! জলদি!
এখানে সকলের সময়ের অভাব পদে পদে,
জানিই তো! তবুও…
বলছিলাম কি আমি এখন পড়ছি, মানে
পড়তে পড়তে চলেছি…
কি বই গো? কবিতার? যাচ্ছোই বা কোথায়?
না মানে আমি বিয়াল্লিশতলা ফ্ল্যাটের
ব্যালকনি থেকে, ঠিক পড়ছি না, কেমন ভেসে চলেছি! পাহাড়ের গায়ে মেঘ-রোদ্দুরের লুকোছাপা
প্রেম দেখছিলাম, মুগ্ধ হয়ে। ঝুঁকেছিলাম কি আরও কিছু নিষিদ্ধ প্রেমের স্বরলিপি পড়তে!
মনে নেই সেকথা। আমি তখন আমাতে ছিলাম না। বিশ্ব বিস্মৃত হয়েছিলাম সেই লীলাখেলার জন্নতে!
ব্যালকনি হয়তো আমার এত বেশী ঝোঁকাঝুঁকি পছন্দ করতে চাইছিল না। কিভাবে যে ভাসিয়ে নিলো!
আর বাতাস? কি আশ্চর্য, ল’ অফ গ্রাভিটেসনকে থোড়াই কেয়ার করে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে!
আমি ভাসতে ভাসতে পড়ছি। আর পড়তে পড়তে গ্রীলবিহীন ফাঁকা জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি এক-একটা
ফ্ল্যাটের একেকরকম আভ্যন্তরীণ রকম সকম! যেমন? যেমন একচল্লিশে দেখলাম ডানা ছাঁটার মস্ত
কাঁচি হাতে সিন্থিয়ার হাসবেন্ড ছুটোছুটি করছে। সিন্থিয়ার ডানাদুটো আজকাল বেশ বেড়ে উঠেছে!
রাত বারটার আগে গুটোয় না। আফটার অল, ওর ওপর হাসবেন্ডডারি করার অধিকার একমাত্র তারই,
একথা রেগে উঠে বোঝাতে বোঝাতে। চল্লিশের খেলোয়াড় দীপক অস্মিতাকে ছক্কা মারার আর্ট শেখাতে
শেখাতে সাজানো ড্রইংরুমে এইসা হাঁকিয়েছে যে ছক্কা শেখাতে দুজনের পাঞ্জা লড়ার যোগাড়।
দেখলাম আমার ভেসে থাকার স্টিয়ারিং আমিই কনট্রোল করতে পারছি। দেখলাম হরিষে কি করে বিষাদ
লাগে আর্টিস্টের একমুহূর্তের ভুল উচ্ছ্বাসে! কেস কতদিন চলবে কে জানে! একটু নেমেছি,
দেখি উনচল্লিশের ব্যালকনির মস্ত মোটাসোটা পামগাছের
আড়ালে লাখোটিয়ার নাতি তার ‘তুতো বোনের সাথে হাতে হাতে দূরন্ত প্রেমে ঘেমে নেয়ে। লাখোটিয়ার
দুটো প্লট মিলিয়ে একটা ফ্ল্যাট। একসাথে একান্নবর্তী। দেখতে একটু বেশি সময় লাগছে! ছেলেমেয়েদের
গা চুঁইয়ে ঘি-মাখন বেরোচ্ছে। বৃদ্ধ নারায়ণ লাখোটিয়া চোখে তেমন ভাল দেখতে পান না। শুনেছি চোখের কাজ অনেক
সময়েই সতর্ক কান করে দিতে পারে! সত্যি হলে অনেক কিছুই কান মারফত দেখতে পান! একদিন আবাসনের
ওয়াকিং গ্রাউন্ডে দামী স্টিক ধরে ধরে হাঁটতে হাঁটতে দুঃখ করে আমাকে বলছিলেন, এত বড়
ফ্যামিলিকে একসাথ রেখেছি, সির্ফ কিসিকো পিতা-মাতাসে বেটা লোগ অলগ না রহে সোচ কর। কিঁউকি
আজকাল ঘরে ঘরে এজেড পারসনস বহুত একা, খুব নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। ওঁর বলার মধ্যে একটা হতাশার
সুর টের পেয়েছিলাম। আজ ওদের হাত ও ঠোঁটের শোষণ
দেখতে দেখতে মনে হলো, এইসবের যোগফল
অচিরেই ভাগাভাগির ভাগফল বা গুণফলের ফলক দেখালে
বৃদ্ধ মানুষটি বড় কষ্ট পাবেন! হয়তো এখনই কষ্ট
পেতে শুরু করেছেন! বৃষ্টি শুধালো তুমি আপাততঃ
কোন ফলে আছ? বললাম, আমি এখন পুরোটাই প্লেজারফলে আছি। ইচ্ছেমতো ভেসে থাকার রিমোটকন্ট্রোল বাতাস আমাকে দিয়ে দিয়েছে, ভালোবেসে।
বৃষ্টি গাইলো, তুউউমি ধন্য ধন্য হে! আমি সাথে সাথে রিমোটে আঙুলের টোকায় তাল রাখলাম। আর ভাবতে ভাবতে নামতে লাগলাম যে, আমার সংসারের তাল আমি ঠিক রাখতে পারবো তো!
বেশী ভাবার আগে আমার হাত থেকে রিমোট নিয়ে বেহিসেবি বাতাস সাঁইসাঁই করে আমায় সাঁইত্রিশ তলার জানালায় নামিয়ে আনলো। হতচকিতে দেখছি একটা আর্টপিস! মিস ছন্দবাণী একমনে ক্ল্যাসিকাল নৃত্যের রেওয়াজে নিমগ্নপ্রাণ এক ডিভোটি! চোখ সরছে না ওর দিক থেকে! কিন্তু বেশী সময় দিলো না বাতাস। বললো, আর কয়েকদিন পরেই তো ওর পারফরমেন্স আছে তোমাদের এই ইউনিওয়ারল্ড আবাসনের আগামী প্রোগ্রামে। দেখে নিও প্রাণভরে। এই মেয়েটিকে আমি শ্রদ্ধা করি। জাগতিক সমস্ত গ্ল্যামারকে ছুঁড়ে ফেলে পঁচিশ-ছাব্বিশের এই যুবতী সংসার ছেড়ে বিরাট ধনী শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে একটা দু-কামরার এই ফ্ল্যাটবাড়িতে চলে এসছে, শুধু নাচ’কে ভালোবেসে। বড় ট্র্যাজিক সেই গল্প! শ্বশুরবাড়ির মডার্ন হুলালা কালচারের কাছে নিজের এই ধ্রুপদী সম্পদকে জলাঞ্জলি না দিয়ে চলে আসা। কতখানি ডিভোটি হলে একজন এরকম ডিসিসন নিতে পারে! এরকম মানুষকে ছদ্মসমবেদনা জানিয়ে মজা দেখতে এই মডার্ন সমাজ খুব ভালো পারে। একা একটা মেয়ে যেরকম ভাবে বাঁচার আশায় চলে এসেছে, পেছন ফিরে না তাকিয়ে, আজকের এই তথাকথিত মুক্ত সমাজ কি তাকে সেই বাঁচা বাঁচতে দেবে! সন্দেহ হয়! কষ্ট হয় মেয়েটার জন্য। কষ্টকে সাথে নিয়ে ফের নামতে থাকি। পঁয়ত্রিশ তলার জানলা দেখালো ওয়েস্টার্ন ড্যান্সার রঙ্গিমা সেনকে। দেখলাম সেখানেও এক সাধনা। ধুমধাড়াক্কা হস্ত-পদ-সঞ্চালনাকে নিপূণ শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাবার সাধনা।
এইভাবে প্রেম অপ্রেম পেরোতে পেরোতে চৌতিরিশের নরম হাওয়ায়, না ল্যান্ড করা নয়, আমার তো ভাসতে ভাসতে নিচে আসা, তো দেখি ঘরভরা কবিতার মাঝখানে খাতা-পেন জন্ম দিচ্ছে নতুন কবিতার। কবিটি একবার মুখ তুলে তাকাতেই চমকে উঠলাম। অনামিকা তুই! শুনেছিলাম আমাদের আবাসনে এক কবি আছেন। সে যে তুই, আজ জানলাম। থ্যাঙ্ক ইউ বাতাস, আমাকে দুম করে ফেলে দিসনি! কলেজ ছাড়ার এতদিন পরে আজ তোর সাথে দেখা! ডাকতে যাবো, বাতাস কানের কাছে নিষেধাজ্ঞা জারি করলো, এখন ডেকো না ওকে, প্লিজ! লেখার মুড ভেঙে গেলে কবির খুব কষ্ট হয়, জানো না? ওকে ওর মতো থাকতে দাও। তাই দিলাম। একদিন ও আর আমি একসাথে আরম্ভ করেছিলাম। অনামিকাকে ধন্যবাদ যে ও এখনও কবিতায় থাকতে পেরেছে! অনেক শুভেচ্ছা ওর জন্য রেখে দিয়ে নামতে লাগলাম।
পরের ফ্লোরের ফ্ল্যাটের দরজায় লেখা ‘নারীজাগরণ সমিতি’। কর্মব্যাস্ত মহাশ্বেতা শেঠ।
চেয়ারে বসে ফাইল দেখছেন। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। বেঞ্চে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু নির্যাতিতা। কিছু সহকর্মী মনে হলো! টাইট টি-সার্ট আর রক্তচোষা জিনস, নারী সৌন্দর্্যের পরাকাষ্টা। আচরণ কাষ্ঠবত। সকলের অনু্যোগ শুনছেন, আইনি পরামর্শ দিচ্ছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তর্জণি তোলার এই প্রচেষ্টাকে কুর্ণিশ জানিয়ে পরের ফ্লোরে এলাম। সেখানে লম্বা চওড়া ডাইনিং কাম ড্রইং ভরা ছোট ছোট প্রজাপতির হাট। পিঠে ডানা নিয়ে তিতলিরা ‘ড্যান্স বাংলা ড্যান্স’এর অডিসনের প্রস্তুতিতে মত্ত! কি তাদের চেকনাই! বাংলা নৃত্যের নাম আর ঐতিহ্য ভুলিয়ে দেওয়া এক-একটা দো-আঁশলা কোরিওগ্রাফির জঙ্গলের মধ্যে বসে থাকা মুগ্ধ মা বাবাবৃন্দ তাদের ছেলেমেয়েদের ক্যারিশ্মা দেখে তাদের ভবিষ্যতের ঔজ্জ্বল্য হিসেব করে নিচ্ছেন! প্রজাপত মহাশয় মহাশয়া অসামান্য অঙ্গভঙ্গীমায় নারী-পুরুষের প্রেমকলামত্ত কোলাজের অভিনব সৃষ্টিকলা বিতরণ করছেন। খুদে খুদে তিতলিরা তা টপাটপ তুলে নিচ্ছে! উত্তেজিত বাতাস আমায় সময় দিলো এখানে আরও একটু ভেসে থাকবার। আসলে দুনিয়াই তো নৃত্যময় কি না? যে যেমন পারে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নাচ দেখিয়ে ছাড়ছে! বাতাসের কি দোষ! বাতাস তো বাহক!
এবার বাতাস আমায় টেনে নিয়ে গেল তিরিশের মধুচক্রে। ভেতরের বাতাস বেশ ভারি। (ওদিকে বাতাস হাল্কা হচ্ছে। আমি ভারী হচ্ছি। জোড়া পা জোড়া হাত আর বাকি বাতাস! এখান থেকে কোন ঘাটে রাধিকা হবেন পার (পাচার) কে জানে!
এবার আমি বুঝতে পারছি বাতাসের কষ্ট
হচ্ছে আমার ভার আর বইতে! তবুও সে থামবার পাত্র নয় দেখলাম। ভাসিয়ে নিয়ে আসছে আরো কি
যে দেখাবার জন্যে কে জানে!
এসে পৌঁছোলাম উনত্রিশের নায়কের
ফ্ল্যাটে। কাঁচের জানালা দেখালো, এক হাতে রঙিন পানিয়ের গ্লাস, অন্য হাত সঙ্গিনী নায়িকার
ক্ষীণকোটি জড়িয়ে। আহা! সময় মধুময়! পাশে হয়তো সিনেমার প্রযোজক অপেক্ষারত, কখন নায়কের নাগপাশ থেকে তাঁর প্রেমপাশে
আসতে ফুরসুত পাবে তরুণী নায়িকাটি!
বাতাস এবার হাঁপাচ্ছে! অতগুলো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আমি বাতাস্র পক্ষে ভারি হয়ে পড়েছি। বাতাসে ডানাদুটো আর আমার লোড নিতে পারছে না। এবার আমি পতনের দিকে।
মনে হলো যে কোনও সঞ্চয়ই কি মানুষকে পতনের দিকে নিয়ে যায়! মানুষের লুকানো পাপ, মিথ্যে অহংকার, ধুর্তামী, অপসাশন, অত্যাচার, দ্বীচারিতা কুটতা— একজজন সাধারণ মানুষের পক্ষে এসবকিছু জেনে ফেলা কি অন্যায়! যে জেনে ফেলে পৃথিবীর বাতাস তাকে বইতে পারে না আর! অনিবার্য্য পতন ও মৃত্যু তার ললাটলিখন!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন