ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(৩২)
কয়েকদিন পরে ফুল নিয়ে একটা সেমিনার ছিল। কোম্পানিই আয়োজন করেছিল। বিষয় ফুলের ভবিষ্যৎ। হৃদয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম সেদিন ভর্তি। বিদেশ থেকেও বেশ কিছু ফুল বিশেষজ্ঞ এসেছেন। হৃদয়কেও সেখানে দেখতে পেল অনির্বেদ। সেমিনার পরিচালনা করছিল প্রাইভেট সেক্রেটারি। বিশেষজ্ঞরা সব বক্তব্য রাখলেন। সেমিনার শেষে প্রাইভেট সেক্রেটারি বলল, তাহলে অতলান্ত, ফুলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি কিছু বলতে চাও?
অতলান্ত কিছুই বলতে চায় না। সে চুপ করেই রইল।
মেহুলী? তুমি কিছু বলতে চাও?
মেহুলীও চুপ করেই রইল।
বিহান? তুমি কিছু বলতে চাও?
না বিহানেরও কিছু বলার নেই।
প্রাইভেট সেক্রেটারি সেমিনার শেষ করে দিল। অনির্বেদ দেখল,
কিছু বলার জন্য হৃদয় ছটফট করছে। ওর মুখটা কেমন থমথমে হয়ে আছে। ফুল নিয়ে ও যা ভেবেছে,
যত পড়াশুনো করেছে, যত গভীরে ঢুকে তলিয়ে দেখেছে ব্যাপারটা, তেমন আর একজনও কি আছে এই
হৃদয়পুরে? প্রাইভেট সেক্রেটারি ওকে দেখেছে। কিন্তু কিছুই বলল না ওকে। ইচ্ছে করেই ওকে
উপেক্ষা করে গেল। সবচেয়ে যোগ্য লোকটাকে কিছু বলার সুযোগই দেওয়া হল না। আর যাদের কিছুই
বলার নেই, তাদের বলার জন্য সাধাসাধি করা হল। ভীড়ের মধ্যে মিশে হৃদয়কে সেমিনার হল থেকে
বেরিয়ে যেতে দেখল অনির্বেদ।
সেদিন সেমিনারের পর একটা পার্টি ছিল। সেখানেই প্রাইভেট
সেক্রেটারি অনির্বেদকে নিয়ে গেল ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কাছে। তারপর বলল, তাহলে ওকে হয়েন
করতে বলে দিই স্যার?
এম ডি হাসলেন। আলতো করে অনির্বেদের পিঠে হাত রেখে বললেন,
বেশ তো!
একটু পরেই এম ডি চলে গেলেন। কিন্তু অনির্বেদকে নিয়ে অনেক
রাত পর্যন্ত হাসাহাসি চলল। বিশেষ করে অতলান্তের টিপ্পনির যেন আর শেষ নেই। হাসতে হাসতে
সে গড়িয়ে পড়ছে। প্রাইভেট সেক্রেটারির দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে কাল থেকে অনির্বেদের চাকরি
পাকা! দারুণ। এম ডির চোখে পড়ে গেছে অনির্বেদ। কাল থেকে আমরা আর কোথায়? কেউ আমাদের খুঁজে
পাবে না। এক নতুন নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে কাল। কোম্পানির ব্যানারে শুধু তারই নাম চোখে
পড়বে। অনির্বেদ!
প্প্রাইভেট সেক্রেটারি ভোদকায় চুমুক দিতে দিতে হাসছে।
মেহুলী প্লেটে করে কেক আর প্যাটিস বাড়িয়ে দিচ্ছে সবার দিকে। তার মুখে কৌতুকের হাসি।
অনির্বেদের সামনে খাবার, পানীয় রাখা। কিন্তু কিছুই মুখে
তুলতে পারছে না সে। পাকা চাকরি খুব দরকার ছিল ওর। কিন্তু সবার চোখে ও একটা হাসির খোরাক
হয়ে উঠেছে। সবাই ওকে করুণার চোখে দেখছে। আর তার সঙ্গেই মিশে আছে শ্লেষ আর ঈর্ষা। চারপাশে
যেন একটা অসুস্থ পরিবেশ। এখান থেকে হঠাত ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল অনির্বেদের। কিন্তু
সে হওয়ার জো নেই। এখানেই বসে থাকতে হবে ওকে। স্থির মূর্তির মতোই বসে রইল সে। যত ওর
মুখ বেঁকেচুরে যেতে লাগল, ততো অতলান্তের টিপ্পনি আরও বাড়তে থাকল।
প্রাইভেট সেক্রেটারি হঠাৎ বলল, ব্রেকের সময়ে এম ডির সঙ্গে
কথা বলতে দেখলাম হৃদয়কে। কী চায় ও?
আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। অতলান্ত আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল,
নিজেকে ও লুকোতে পারবে না। ওর স্বভাবে লুকোচুরি নেই।
অনির্বেদ বুঝতে পারল। ফুল নিয়ে ব্যবসার কথা ভাবতেই পারে
না হৃদয়। ফুল ওর কাছে সাধনার ব্যাপার। ফুলকে একটা পণ্য হিসাবে দেখা ওর পক্ষে অসম্ভব।
কিন্তু এই বাজারসর্বস্ব যুগে কাউকে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে একমাত্র কোম্পানিই। হৃদয়ের
পক্ষে কখনই কোম্পানির ঘনিষ্ঠ হওয়া সম্ভব নয়। কোম্পানি ওকে নিজের ছাঁচে ফেলতে চাইবে।
বাজারের উপযোগী করে ওকে গড়ে তুলতে চাইবে। কিন্তু হৃদয়ের একটা নিজস্ব ছাঁচ রয়েছে। তার
বাইরে যাওয়া ওর পক্ষে অসম্ভব। হৃদয় ফুলকে পুজো করে। তাকে বিক্রি করার কথা সে ভাবতেই
পারে না।
অনির্বেদ মনে মনে ভাবে, হৃদয় একজন শিল্পী। আর অতলান্ত
একজন সেলসম্যান। লেনদেনের কারবারী। নিজেকে ও শুধু বিক্রি করতে জানে। আর জানে হাতেবনাতে
নগদ বুঝে নিতে। কোনও নীতি বা মূল্যবোধই ওর নেই। একজন সেলসম্যান বলেই ও এইভাবে ভাবতে
পারে...।
প্রাইভেট সেক্রেটারি বলল, এম ডির কাছ থেকে সরে আসার পর
তুমি ওর কানে কানে কী বলেছিলে?
অতলান্ত বলল, ওকে আমি বিহানের সেই কথাটা মনে করিয়ে দিলাম।
বিহান বলেছিল, হৃদয় আমাদের সঙ্গে সীমাহীন অন্যায় করেছে। শুনে ও চুপ করে রইল। তখন আমি
জুড়ে দিলাম, দ্যাখ যদি নিজেকে লুকোতে পারিস। এতে ও আরও ঘাবড়ে গেল...
প্রাইভেট সেক্রেটারি হাসতে হাসতে বলল, হৃদয় তোমার বন্ধু
ছিল না?
অতলান্ত যেন ফেটে পড়ল, বন্ধু? এই দুনিয়াটা একটা নরক, বুঝলেন
মশাই? এখানে বন্ধুত্ব একটা অলীক ধারণা, যার কোনও অস্তিত্বই নেই। এখানে শুধু প্রতিযোগিতা
চলে...
সে যাই হোক, প্রাইভেট সেক্রেটারি মৃদু হেসে বললেন, চিমটি
কাটায় তোমার জুড়ি নেই। ও দেখছি তোমার কাছে মূর্তিমান আশঙ্কা হয়ে উঠেছে। ওকে দেখলেই
তুমি নিরাপত্তার অভাবে ভুগছ।
অনির্বেদ মনে মনে ভাবল, সে আর হবে না? তোমার স্বরূপ ওর
চেয়ে বেশী কে-ই বা আর জানে! অনির্বেদের মনে পড়ল, প্রথম যখন অতলান্ত ফুলের বাগানে আসে,
কত যত্নে হৃদয় ওকে ফুলের ব্যাপারে অনেক কিছু বুঝিয়েছিল। অতলান্ত খুব বাধ্য ছাত্র ছিল।
অনির্বেদের সামনেই একদিন হৃদয়ের দুহাত ধরে অতলান্ত বলেছিল, সত্যিই ফুল নিয়ে কত জানিস
তুই। ফুলের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী জানেন ঈশ্বর। আর ঠিক তার পরেই যদি কেউ থাকে, সে হলো
তুই। হৃদয়ের ফুল নিয়ে করা স্কেচগুলো দেখে অতলান্ত কীভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করত, সেকথাও
ফুলের বাগানের কে না জানে! অথচ সে ব্যাপারে অতলান্ত এখন আর উচ্চবাচ্যই করে না। একদিন
অনির্বেদ অতলান্তের সামনে হৃদয়ের স্কেচের প্রসঙ্গ তুলেছিল। বলেছিল, কত ভালো ভালো স্কেচ
করে একসময়ে তোকে দেখিয়েছে হৃদয়, তাই না?
অতলান্ত এমন ভাব করেছিল, যেন ও কিছুই জানে না। নতুন কথা
শুনছে। শুধু ওর মুখটা অসম্ভব গম্ভীর হয়ে গেছিল।
সেদিন অতলান্তের কথা শুনে হৃদয় মৃদু হেসেছিল। কিছু বলেনি।
অতলান্ত জানত, মিষ্টি কথায় হৃদয় কীভাবে ভুলে যায়। আসলে এইসব কথাকে ও প্রেরণা হিসাবেই
গ্রহণ করে। এতে ওর কাজের উৎসাহ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু এর মিথায়টাকে ও ধরতে পারে না।
ফুলের কোম্পানিতে অতলান্ত জয়েন করার পর হৃদয় একদিন জানতে
চেয়েছিল, তুই তো নতুন অনেক কিছু দেখছিস। শিখছিস। ফুলের ব্যাপারেও অনেক তথ্য পাচ্ছিস,
যা একমাত্র কোম্পানির ভিতরে থাকলেই জানা সম্ভব। এ ব্যাপারে আমাকে একটু বলবি?
অতলান্ত ভারিক্কি চালে বলেছিল, বলতেই পারি। অনেক কিছু
শেখাতে পারি তোকে। কিন্তু এমনি এমনি নয়। আমাকে তার জন্য টাকা দিতে হবে।
এই হচ্ছে অতলান্ত। গোটা ব্যাপারটা অনির্বেদের সামনেই ঘটেছিল।
হৃদয় অবশ্য আর কথা বাড়ায়নি।
পাকা চাকরিতে জয়েন করার পরে ব্যাপারটা লক্ষ করল অনিকেত।
সাঁঝকে আজকাল আর অতলান্তের সঙ্গে দেখাই যায় না। তার বদলে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে ঘোরাঘুরি
করে সে। মেয়েটির নাম বেদপর্ণা। কয়েক বছর আগে হৃদয়ের সঙ্গে এই মেয়েটির একটা সম্পর্ক
ছিল।
একদিন মেহুলীকে জিজ্ঞেস করল অনির্বেদ, আজকাল আর সাঁঝকে
দেখি না।
দেখবি কী করে? সাঁঝের বাবা তো আর কোম্পানির ম্যানেজিং
ডিরেক্টর নয়।
বুঝেছি। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অনির্বেদের।
আমি ভাবছি মেয়েটি পারছে কী করে? পাশাপাশি যখন দুজনে দাঁড়ায়,
আমার যা মজা লাগে! ছেলেটি একটি আস্ত ভাঁড়, বেঁটে, মাথায় টাক, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, রোগা
শরীর। আর মেয়েটি রূপকথার পরী, সুন্দর শরীর, ফর্সা মুখ, ছেলেটিকে মাথায় ছাড়িয়ে গেছে।
মেয়েতি বরাবর পড়াশোনায় ব্রিলিয়্যান্ট, ছেলেটি অতি সাধারণ। অথচ মেয়েটির চোখে যেন ঘোর
লেগেছে। আসলে ছেলেটিই জাদু জানে। একটার পর একটা সাফল্য সে পেয়ে চলেছে। কেউ খতিয়ে দেখছে
না কীভাবে সেই সাফল্যগুলি আসছে। মেয়েটিকে সে বশ করে ফেলেছে। মেয়েটির মেধা আর সৌন্দর্যকে
মেয়েটির অজান্তেই মূলধন করে সে নিজের ব্যবসায়ে খাটাচ্ছে। অথচ মেয়েটি টেরও পাচ্ছে না।
সাফল্যে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে। কিন্তু এই ভুল তার একদিন ভাঙবেই। বাইরের ওই মিথ্যা মুছে যাবে, ভেতরের কালো গর্তটা দেখে মেয়েটি সেদিন
শিউরে উঠবে। হয়তো এই আশঙ্কা ওর এখনই মাঝে মধ্যে হয়। মেয়েটিকে দেখে আমার কখনও খুব সুখী
মনে হয় না। ওর ভেতরে একটা অভাব আছে। কখনও সখনও সেটা ও নিশ্চয়ই টের পায়। কিন্তু ওর সঙ্গে
যে কতবড়ো প্রতারণা হয়ে চলেছে, সেটা ও ধরতে পারছে না...
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন