কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

প্রণব চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


সন্নাটা এবং মাংসের দোকান

 

দরোজায় ঠক ঠক করছি অনেকক্ষণ। তিনি এলেন না। তার বিড়াল এলো, বিড়ালের বাচ্চারা এলো। তিনি নেই। এভাবে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ থাকা যায়! বাধ্যত শেষবারের মতো একটু কি জোর হয়ে গেলো করাঘাতে! হোক। ভেতরে থাকলে অন্তত সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, ব্যস্ত আছি, পরে আসবেন, ইত্যাদী। কিংবা, এটাও বলতে পারেন-- অ্যাপয়েমেন্ট ছাড়া কাউক অ্যাটেন্ড করি না আমি।

যাই হোক, ধাক্কাটা একটু জোর হয়েছিলো বোধহয়। দরোজা খুললো। একফালি মুখ ফাঁক গলে ঝুলে এলো।

-- কাকে চাই?

-- আপাতত আপনাকে।

এবার দরোজা আরেকটু ফাঁক কোরে নাইটি ঢাকা দুটো স্তন দুলে উঠলো সামনে।

-- আমাকে? আমাকে চেনেন আপনি?

-- সন্নাটা।

-- আপনার নাম?

-- নাম মদন বা মদনা কিন্তু চোদনা নামেই অনেক বেশি লোক চেনে।

-- হোয়াট আ ননসেন্স! কোথা থেকে এসে জোটে এগুলো!

ঘুরে নাইটি প্রায় দরোজায় ঢুকে গেছে, ছুটে গিয়ে দরোজাটা হাত দিয়ে আটকালাম। বেশ রোয়াবের সুরেই বললাম--

-- আজ নিয়ে তিনদিন আমি ডেকে ডেকে ফিরে যাচ্ছি। আজ যদিও বা খুললেন দরোজা, আমার কথা না শুনেই ঘরে আবার ঢুকে যাচ্ছেন কেন? এটা কি ভদ্রতা!

-- এত বাজে একটা নামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে আমার ঘেন্না করছে।

-- তাতে কি হয়েছে, বাবার দেয়া নামটাকে মাথায় রাখলেই তো হয়। মদন বা মদনা। আপনার যেটা স্যুট করবে, সেটাই।

-- ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি বলুন কি ব্যাপার।

স্পষ্টত খুব কাছ থেকে, মাঝে খুব বেশি হলে হাতখানেক দূরত্ব, দেখতে পাছি মেদহীন তলপেট, বলিষ্ঠ উরুদ্বয় এবং কোঁকড়ানো চুলের নীচে জলপিছল মুখ ও মুখের চামড়া। এত সুন্দর মেয়েমানুষ এত কাছ থেকে কখনও দেখিনি। এবং দেখাটাও কিছুটা বলপূর্বক দরোজাটা শক্ত হাতে রুখে দিয়ে।

-- আপনার সঙ্গে একটা হিসেব মেটাতে এসেছি।

-- হিসেব? আমার সঙ্গে? আপনার কিসের ব্যবসা? আপনার কাছ থেকে কখনও কিছু কেনাকাটি করেছি বলে তো মনে হচ্ছে না!

কথাটা শুনে আমি হেসেই ফেললাম। -- আরে না না, সে হিসেব নয়। আমি অন্য এক হিসেবের কথা বলছি। মানবিক প্রসঙ্গ।

কথাটা শুনে মহিলার কি মনে হলো জানিনা, বললেন, দরোজাটা লাগিয়ে দিয়ে ভেতরে আসুন তবে! -- ঘরে ঢুকেই টের পেলাম অনেক বড় বাড়ির এটা বাইরের ঘর। ঘরটি বেশ পুরোনো হলেও যথেষ্টই মজবুত তার প্রাচীন দরোজা জানালা। পর্দা থেকে শুরু কোরে ছিমছাম আসবাবে আভিজাত্য নম্র হয়ে আছে। উল্লেখযোগ্যভাবে যা আমার নজর এড়ালো না, ঘরটায় ফ্রেমে বাঁধানো কিছু পেইন্টিং আছে, কপি কিন্তু খরচবহুল, রেম্ব্রান্ট, সেজান, মনেট এমনকি মদিগ্লিয়ানি, পল ক্লি সকলের ছবি থাকলেও ভ্যান গঘ বা পল গগ্যাঁ-র কোন পেইন্টিং নেই। কেন? জিজ্ঞেস করা যেতেই পারে কিন্তু আমাকে বসিয়ে রেখেই মহিলা একটু ভেতরে গেছেন বলেই এত খুঁটিয়ে ছবিগুলো আমার দেখার সুযোগ হলো। দেখলাম দালির সিভিল ওয়ার ইন স্পেন ছবিটির কপিও ফ্রেমবন্দী হয়ে আছে। প্রশ্ন অনেক জমছে। এগুলোকে ফ্রেমে আটকে ঘর সাজাবার তাগিদটা কার ছিলো? ফ্রেম দেখে মনে হচ্ছে, ৫০ থেকে ১০০ বছরের পুরনো তো বটেই। সন্নাটার বাবা কিম্বা তার বাবার কি আধুনিক ইউরোপীয় চিত্রকলার ওপর এই আকর্ষণ ছিলো নাকি অন্য কেউ? মহিলা ঘরে এসে আবার ঢুকলেন। নাইটি ঢেকেছে এবার ওভারকোটে। অপূর্ব এক আলো যেন সন্নাটা। এত সুন্দর কেন, মনে মনে প্রশ্ন করি। আঙুলে একটা লম্বা এবং জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটটা টান দিয়ে আমার সামনের সোফাচেয়ারটায় বসেই বললেন--

-- বলুন, আপনার মানবিক হিসেবটা সম্পর্কে বলুন।

-- এই ছবিগুলো কার পছন্দে টাঙানো হয়েছে এখানে?

-- সে কি, আপনি তো আমাকেই প্রশ্ন করে বসলেন! আপনার উত্তর দিতে কি আমি বাধ্য!

-- এটা সৌজন্যের ব্যাপার। আপনার ঘরে যখন ঢুকতে দিয়েছেন, আমি আপনার অতিথি। আর অতিথির কিছু প্রশ্ন করবার অধিকার স্বতঃসিদ্ধ।

-- ছবিগুলো মায়ের এক বন্ধু মাকে প্রেজেন্ট করেছিলো। যেভাবে এখানে ঝুলছে, ইনট্যাক্ট এভাবেই। আমার বয়স তখন ছয়। আর মা তখন আমার আজকের বয়সের কিছু কম বা প্রায় কাছাকাছি। তারপর সেই বন্ধুর আর কোনো খোঁজ মা পায়নি। মাও একসময় মারা যায়, ছবি সম্পর্কে এটুকুই আমি যা জানি। মায়ের পছন্দকে আমি নিজের পছন্দতে বদলে নিয়েছি, বাধ্যতই যেখানে যেমন ছিলো, তেমনই রয়েছে এগুলো।

-- আপনার বয়স দেখে মনে হচ্ছে আপনি এখন ত্রিশের কোঠায়! ঠিক বললাম!

-- শীট! আমার বয়স জানবার স্পর্ধা আপনার কিভাবে হলো! আই হ্যাভ টু...

-- দাঁড়ান দাঁড়ান, সেই এক ফর্মুলা, বাঙালিরা উত্তেজিত হলেই হয় ইংরিজী নতুবা হিন্দী বলতে চেষ্টা করবে। আমি অন্যায়টা কি করলাম? তাছাড়া আমাকে হিসেবনিকেশ করবার অনুমতি তো আপনি দিয়েইছেন।

-- তাই বলে আমার বয়স!

-- একেবারেই নয়। আপনার বয়স গেস কোরে আমি সেই মায়ের বন্ধুর বয়সে পৌঁছোতে চাইছি। তিনি বেঁচে আছেন কি নেই, থাকলে কিভাবে থাকতে পারেন, ইত্যাদি। বিষয়টা দাঁড়ালো এইরকম যে, আপনার এখন ৩২ বা ৩৪ হলে আপনার মা ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে মারা গেছেন। ঠিক বললাম তো?

-- না, একবারেই নয়। আমার মা সত্তর বছরে মারা গেছেন।

-- Exactly, আমারও হিসেব সেটাই বলছে অর্থাৎ আপনার বয়স তখন ছয় নয় সেটা হবে ষোলো। ভুল বললাম? এটা হতেই পারে যে, আপনি ভুলে গেছেন বা যে কোন কারণেই হোক আপনি সেটা আড়াল করতে চাইছেন। আরও একটা ভুল তথ্য আপনি দিয়েছেন, আপনার মায়ের বয়স তখন আজকের আপনার বয়সের থেকে কম মোটেই ছিলো না, অন্তত ১৫-২০ বছরের বেশি থাকলে তবেই হতে পারে।       

-- আমি চরম ভুল করে ফেলেছি। একজন স্ট্রেঞ্জারকে ঘরে ঢুকিয়ে ফেলেছি।

-- ঢোকাননি, তথ্যটি ভুল। আমি এ ঘরে প্রায় ঠেলে ঢুকেছি, আপনার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই। আমাকে একটা শুধু তথ্য দিন আপনার মা কতদিন আগে মারা গেছেন?

-- হরিবল! এখনও আপনার সাহস হচ্ছে আমার এবং পরিবারের সম্পর্কে খোঁজখবর করতে?

একটু ছদ্ম রাগ দেখাবার চেষ্টা করলাম। একটু জোরেই বলে ফেললাম--

-- নিজেকে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চাইছেন কেন? আপনার দম্ভটা কি অর্থের নাকি একটু বেশি সুন্দরী বলে! হ্যাঁ, আপনার সৌন্দর্য এই পেইন্টিং গুলোকেও ম্লান করে দিচ্ছে, আমি জানি। আপনি নিজেই একটা জীবন্ত ক্যানভাস, যার টান আমাকে এ ঘরে ঢুকতে বাধ্য করেছে। আপনার মুখোমুখি কিছুক্ষণ বসে কথা বলবার এবং আপনাকে দুচোখ ভরে দেখবার লোভ আমাকে অবাধ্য করে তুলেছিলো।

সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে আমার কথার মাঝেই দেখলাম মহিলা প্রায় ভেঙে পড়বার মতো করে নিজের দুহাতের পাতায় মুখটাকে লুকিয়ে ফেলেছে। আমিও থেমে গেছি। দু-এক মুহূর্ত এভাবেই কেটে যাবার পর, দুহাতের আড়াল থেকে প্রায় লাল হয়ে ওঠা মুখটা তুলে প্রায় অনুনয়ের মতো করেই সন্নাটা বললেন--

-- আপনি চলে যান প্লীজ! আমাকে তো দেখলেন, বসলেন মুখোমুখি, এবার লীভ মি আলোন!

আমি এবার উঠে রেম্ব্রান্টের মীট-শপ ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে আমার ব্র্যান্ডের সস্তার সিগারেটটা বার করে ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললাম-- এবং শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর সব মাংসই চড়ামূল্যে বিক্রিত হবার প্রতীক্ষায় থাকে-- কথাটা কি একেবারেই ভুল, মিথ্যে বলে মনে হয় আপনার!

এবার আমার চমকে ওঠার পালা। এক অবিশ্বাস্য প্রতিক্রিয়ায় হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো সন্নাটা। শুধু কানে বাজছে তীব্র এক আকুল গোঙানি, "না না না"। হঠাৎই সোফা থেকে ছিটকে উঠে আমার সামনে এসে একেবারে নতজানু হয়ে হাতজোড় কোরে আমার পায়ের কাছে বসে অপূর্ব এক সঙ্গীতের মতো বেজে জেতে লাগলো "আপনার কাছে ভিক্ষে চাইছি, অনুগ্রহ কোরে আমাকে ছেড়ে যান প্লীজ"! এ এক এমন কান্না যে শ্রোতা, তার হাড়ে নয় রক্তের কোষে গিয়ে মেশে আর্তির এ প্রজ্জ্বলিত সংবেদন। দুটো বাহু খুব সন্তর্পণে ধরে তাকে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করালাম দুপায়ের উপর। খুব অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে সুন্দরী সন্নাটা আর দুচোখ ধুয়ে নামছে নিশ্চুপ দুটো জলের রেখা। এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি কারও পক্ষেই বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয় যে, সন্নাটা যে কোন কারণেই হোক খুব বিপর্যস্ত। আমার চলে যাওয়া না যাওয়া-- এ সবই খুব অবান্তর। ভেতরে ভেতরে সন্নাটার একটা ভাঙ্গনের স্রোত বইছে। নিজে্কে আর আড়াল করতে পারছি না--

-- তুমি তো আলো সন্নাটা, এত অন্ধকার বহন করছো কেন? বন্ধু ভাবো, আমাকে বলো কোথায় রক্তাক্ত হচ্ছ একা এত দীর্ঘ সময়!

কিছুটা থেমে এবার আমার প্রফেশনাল কাজটা শুরু করে দিলাম। কারণ প্রাথমিকভাবে তথ্য ঘাঁটাঘাঁটির সুযোগে আমি তার অবচেতনকে প্রায় সঠিক ভাবেই ছুঁয়ে ফেলেছি। বাধ্যতই সন্নাটাকে দম নেবার কোনরকম সুযোগ না দিয়েই সরাসরি খুব স্থির, নীচু ও নিশ্চিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ফেললাম--

-- পলাশকে খুন করলেন কেন? আপনাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিলো সেই শিল্পী ছেলেটা। শেষ এগজিবিশনের প্রতিটি ছবির ক্যানভাসজুড়ে আপনাকে সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিলো প্রতিটি রেখায়, অভিব্যক্তি ও বিমূর্ততায়। কেন মারলেন!

প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সন্নাটা আমার প্রশ্নের শান্ত দৃঢ়তা নিতে পারলো না। তার ব্ল্যাকাউট হলো। সেন্সলেস শরীরটাকে শেষ মুহূর্তে ধরে ফেললাম। তার গায়ের গন্ধ নিঃশ্বাস ভরে নেবার সুযোগ এসে গেলো। অগোছালো শরীরটাকে সোফায় শুইয়ে ঘরের কোণে ছোট্ট টেবিল থেকে জলের জাগটা এনে চোখেমুখে আলতো ছিটিয়ে দিলাম। ধীরে ধীরে সে কনশাসে এলো। চোখ খুলে আমাকে দেখেই কেমন বিদ্যুতের শক খাওয়া মানুষের মতো তড়াং কোরে সোফায় উঠে বসলো। সৌন্দর্যের যে বিচ্ছুরণটা এতক্ষণ আমি এনজয় করছিলাম, নিষ্প্রভ হয়ে কেমন ফ্যাকাশে ভয় পাওয়া জন্তুর মত আমার দিকে তাকিয়ে বলতে চেষ্টা করতে লাগলো, পলাশকে আমি মারিনি, পলাশকে মারিনি আমি।

এবার আমার খোলস ছেড়ে বেরোনোর পালা। তদন্তের সঠিক মুহূর্ত। অপরাধীর মনের ওপর আমি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছি। বেশ কড়া ভাষাতেই এবার আমাকে বলতে হলো--

-- আপনার সবকিছু আমরা জানি। আপনাকে শুধু শেষ একটা সুযোগ দিতে এসেছি, যদি নিজে থেকে আমার কাছে অপরাধ স্বীকার করেন, আপনাকে আমি বাঁচাতে চেষ্টা করব। না হলে শাস্তিটা বুঝতেই পারছেন, আজীবন কারাগার কিম্বা ফাঁসী। আমি চাইছি না আপনার মতো এমন সুন্দর একজন মানুষী এভাবে ধ্বংস হয়ে যান! আবারও বললাম, আমার প্রস্তাবে আপনি রাজি?

এবার আর আমাকে কিছু করতে হলো না। উঠে দাঁড়িয়ে জাগ থেকে গ্লাসে জল ঢেলে কিছুটা খেয়ে সন্নাটা একটা সিগারেট ধরালো। হয়তো মুক্ত কিছু বাতাস নেবার জন্য ভেতর বাড়ীর দিকের যে লম্বা জানালাটা যার ওপিঠে নানারকম গাছ, সবুজ এবং বিরাট বাড়ীটার টানা লম্বা ঝুলবারান্দা দেখা যাচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে সিগারেটে দ্রুত দু-একটা টান দিয়ে ফিরে এসে আমার সামনে সটান দাঁড়িয়ে বললো--

-- হ্যাঁ, পলাশের মদে সে রাত্রে এখানে বসেই আমি বিষ মিশিয়ে খাইয়েছি, তারপর ছদ্ম টেলিফোন কলে আমাকে বাইরে যেতে হবে তাড়া দেখিয়ে নিজে গিয়ে ট্যাক্সি ডেকে তাকে তুলে দিয়েছিলাম ট্যাক্সিতে। কারণ, যে বিষ মিশিয়েছিলাম সেটি তার কাজ সম্পন্ন করতে বিষপায়ীকে একঘন্টা সময় দেয়। আমি ক্যা্লকুলেট করেছিলাম আমার ঘরে পাঁচমিনিট, ট্যাক্সিতে ২০ মিনিট এবং বাড়িতে গিয়ে সে আর একটা পেগ সাজিয়ে বসবে আর তার মধ্যেই রক্তে মিশে যাবে বিষ, শিথীল হতে থাকবে শিল্পীর স্নায়ু, দৃষ্টি ঝাপসা হতে থাকবে, প্রচন্ড সাফোকেশনে হাঁসফাস করতে করতেই তার ফুসফুস চোকড হয়ে যাবে। ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেটে লিখবে সিভিয়ার কার্ডিয়াক ফেলিওর ডিউ টু হেভী এমাউন্ট অফ এলকোহল কঞ্জাম্পশন। পরদিন সবকটা কাগজে সে খবর প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু কোথাও সেটাকে খুন বলে সন্দেহ করা হয়নি। অতিরিক্ত মদ্যপানে তরুণ এবং প্রতিশ্রুতিময় চিত্রশিল্পী পলাশ রায়ের আকস্মিক মৃত্যু। কেবল একটি ইংরিজী কাগজে আত্মহত্যা বলে সন্দেহ করা হয়েছিলো। ব্যাস, গল্পটা শেষ।

-- না গল্পটা শেষ হয়নি। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে তার শরীরে বিষপ্রয়োগের সব লক্ষণ পাওয়া যায় বলে উল্লেখ থাকায় পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত সুয়োমোটো কেস কোরে সিআইডি-র হাতে কেসটিকে তুলে দেয়। সিআইডির স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ এখন তদন্ত করে দেখছে এটি আত্মহত্যা না খুন। অর্থাৎ বিষ সে নিজে খেয়েছে নাকি কেউ তাকে খাইয়েছে। যে হাউজিঙে তার স্টুডিও সেখানকার দারোয়ান এবং সিসি টিভির ছবি দেখে যে তথ্য পাওয়া গেছে, সেই সূত্রেই অনেকদিন আপনার ওপর নজর রাখতে রাখতে আজ আপনার মুখোমুখি হওয়া। আপনি যা বললেন আমাদের তদন্তে সে সব আমরা পরিষ্কার ভাবে রেকর্ডে রেখেছি। ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং আপনার ব্যক্তিগত মেড-কে আপনার অজান্তে জিজ্ঞাসাবাদ, সবই হয়েছে। শুধু একটা অঙ্ক কিছুতেই মেলাতে পারছিনা, পলাশকে আপনি খুন করতে কেন গেলেন? আর এই প্রশ্নটার  উত্তর পাবার জন্যই আমরা এতটা সময় নিচ্ছি আপনাকে গ্রেপ্তার করতে।

খুব অসহায়ভাবে সে এসে একটা সোফায় বসে পরে। সব বলব মিস্টার গোয়েন্দা, আপনাকে আজ সব বলে আমি হালকা হয়ে যাব। ১৮ টা মাস কী যে বিপন্ন একটা জীবন কাটাচ্ছি আমি, একাকীত্ব এই বিরাট বাড়ীটার অন্ধকার গর্ভে কী যে একটা পাহাড়ের মতো আমাকে চাপা দিয়ে ফেলে রেখেছে-- আপনাকে বোঝাতে পারবনা। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।

এরপর সন্নাটা তার ব্যক্তিগত গল্পটা যা বলেছিলো সেটা সংক্ষেপে বললে এটাই দাঁড়ায়, তার মায়ের সেই অস্ট্রেলিয়ান বন্ধু মিঃ জ্যাকব মাকে পাশ কাটিয়ে ক্রমেই সন্নাটার প্রতি প্রবণ হয়ে উঠতে থাকে। সেটারও কারণ সন্নাটার অল্পবয়েসি যৌবনের বন্য মাদকতা। আর সন্নাটার স্বপ্নে বাসা বাঁধতে থাকে জ্যাকবের বিপুল সম্পদ, তার বিদেশের বসবাস এবং চামড়ার লাল চ্ছটা, ইংরিজী ভাষায় কথা বলবার এক ফূর্তি। কিন্তু বুঝতে পারছিলো মা ভালো চোখে নিচ্ছে না সেসব। তার এবং জ্যাকবের নিবীড়তা বাড়তেই, তাদের যখন তখন এখানে ওখানে ঘুরতে চলে যাওয়া মায়ের কাছে এক চাক্ষুষ বিপর্যয়ের মতো মনে হতে থাকে। জ্যাকবকে তিনি আর কিছুতেই নিজের অধিকারে সেভাবে ধরে রাখতে পারছেন না। ঠিক এমন সময়েই পলাশের সঙ্গে পরিচিত হতেই সন্নাটার মাথায় দ্রুত এক অঙ্ক খেলা করতে থাকে। পলাশকে সাজিয়ে মাকে বিভ্রান্ত করা। মা জানবে পলাশ সন্নাটার প্রেমিক, আর জ্যাকব তার শুধু এক বয়েসী বন্ধু। হিসেব মিলিয়েই সব চলছিলো। হঠাৎই জ্যাকব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সন্নাটাকে নিয়ে সে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে। সেইমতো সন্নাটার পাসপোর্ট ভিসাও তৈরি করে নেয় জ্যাকব। ট্যুরিং ভিসা। মা কোনভাবে সেটা জানতে পেরেই সুইসাইড করে। সন্নাটার যাওয়া হয় না, কিন্তু মাস তিনেক পরে যাবার ব্যবস্থা কোরে জ্যাকব ফিরে যায়। আর এই ফাঁকে, মা না-থাকা দিনগুলোয় পলাশ যখন তাকে উন্মাদের মত বিয়ে করে একসাথে থাকবার প্রস্তাব দিতে থাকে, সন্নাটা জানতো তার হাতে মাত্র তিনমাস সময়। পলাশের হাত থেকে তাকে রেহাই পেতে হবেই। স্বাভাবিক ভাবেই যেদিন তার ফ্লাইটের টিকিট, তার ঠিক ২০ দিন আগে পলাশকে সে বিষ খাইয়ে মেরে দেয়। তারপর তার গোছগাছ যখন শেষের দিকে, আকস্মিক এক রাতে জ্যাকবের সেক্রেটারী ফোন করে জানায়, মিঃ জ্যাকব ব্যবসার প্রয়োজনে রোম চলে যাচ্ছে। কিছুদিন সেখানে থাকতে হবে। একমাস হতে পারে একবছরও হতে পারে। সে ফিরে এসে সন্নাটার সঙ্গে যোগাযোগ করবে আবার। এখন তাকে আসতে হবে না অস্ট্রেলিয়া। তার পর দিনই ফোন-মেস্যাজে টিকিট বাতিলের খবরটাও কনফার্মড হয় তার কাছে। সন্নাটা তার পর থেকে এই বাড়ীর অন্ধকার ঘরগুলো প্রতি রাতে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘুমহীন। বিশাল বাড়ীটার মতই সন্নাটাও যেন শুধুই প্রতীক্ষা করছে জীর্ণ হয়ে একদিন ভেঙে পড়বার।

বিশ্বাস করুন, জীবিকা গোয়েন্দাগিরী হলেও আমি তো একজন আর পাঁচটা সামাজিক মানুষেরই মতো, রূপমুগ্ধ, গুণমুগ্ধ মানুষ। সন্নাটাকে দেখে মনে হলো সবকথা আমাকে বলে দিয়ে ভারমুক্ত হয়ে আজকের রাতের পর সে আর নাও বাঁচতে পারে। এটা মানুষ চড়ানো আমার গোয়েন্দা মনের আশঙ্কা। সুতরাং চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে বলেই বসলাম, সন্নাটা, আমাকে বিয়ে করবে তুমি?

সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, আমি যে আত্মহত্যা করব তুমি সেটা কি করে গেস করলে!

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন