কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

অঞ্জন সেনগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

রূটম্যান




 

(৮)

 

গোচারণ ভূমিতে এই মুহূর্তে যে সব অবলারা এখনো বাড়ি যায়নি বা তাদের বাগালরা কেন এখনও তাদের ঘরে ফেরায়নি তা তারা বুঝতে না পারলেও এটা বুঝতে পারছে যে এই গোচারণভূমিটি তাদের কাছে একেবারেই অচেনা-অজানা। কিন্তু সারাদিনে এমন সুস্বাদু ঘাস তারা এর আগে কখনও খায়নি। তাই আজ তারাও বড়ই তৃপ্ত। মনে হয় আজীবন এমন সতেজ লকলকে ঘাস পেলে আর কোন দুঃখই থাকতো না। কারণ কোন অবলার কাছেই তাদের নিজস্ব গ্রাম বা দেশ বলে কিছু থাকতে নেই। যে বাড়িতে বা যার গোয়ালে তাদের জন্ম, যে প্রাঙ্গণে তাদের ছুটোছুটি করে বড় হওয়া, এ সবটাই বড়ই ক্ষণস্থায়ী! কেউ জানে না আজীবন এই বাড়ির গোয়ালটা তাদের রাত্রিবাসের জন্য নির্ধারিত থাকবে কিনা! একই বাড়ির গিন্নিমা রোজ তাদের জন্য ভাতের ফ্যান বা তারা বিয়োলে পড়ে লাউ কেটে যত্ন করে খাওয়াবে কিনা! এর বেশি আর কোন অবলাই ভাবতে পারে না। আসলে কোন অবলাই তাদের ভবিষ্যত কতটা উজ্জ্বল, বা অন্ধকারময় তা জানে না! খুব কম অবলাই আছে যারা আমৃত্যু একই বাড়িতে রয়ে গিয়েছে। তবে হ্যাঁ, এমন গৃহস্থ বাড়িও তাদের জানা আছে যেখানে তাদের সিঁদুর-ধান-দুর্বা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। আবার বিদায়কালে অঝোরে কাঁদতেও দেখা গেছে। আসলে যে কোন গৃহস্থ মালিকই একান্ত অপারগ না হলে তাদের কোন অবলাকেই বাড়ি ছাড়া করে না। তখন মনে মনে অবলারাও কাঁদে। ভীষণ কষ্ট পায়। কখনও বা চোখের কোল বেয়ে জলও গড়িয়ে পড়ে। মানুষ তা দেখেও ঠিক বোঝে না। নেহাত তারা প্রতিবাদ করতে পারে না তাই। অথচ ওদের থেকে আকৃতিতে অনেক ছোট হয়েও গৃহস্থ বাড়ির বকরিরা দীর্ঘদিন থাকা এবং অনেক অনেক সন্তান প্রসব করতে করতে যখন একেবারে বুড়ি হয়ে যায়, তখন তাদের হয় হাটে নিয়ে যাওয়া হয়, নতুবা বাড়িতেই অন্য লোকের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আর ঠিক এমন সময় একই বাড়িতে লালিত পালিত হওয়া বকরিটি একেবারে মাটিতে লেপ্টে বসে পড়ে। বেদম মার সহ্য করেও সেই বাড়ি ছাড়তে চায় না। সে তখন পরিত্রাহী চিৎকারে পাড়া মাত্ করে দেয়। অথচ কেউ তাকে বাঁচাতে আসে না। বাড়ির মালিক মনেও রাখে না যে তার সন্তানেরা একদিন এর দুধ খেয়েই গাব্দা-গুব্দা হয়েছিল! অথচ সে তার নিজের সন্তানদের পর্যাপ্ত দুধ দেওয়ার আগেই বাড়ির মালিক তাকে নিঙড়ে নিত। আর তাই তার সন্তানেরা শুধু মায়ের দুধের বাটগুলো মুখে নিয়েই তৃপ্ত থাকত অথচ তাদের একটুও পেট ভরতো না! অবশেষে অমন তীব্র প্রতিবাদের মধ্যেই এক সময় তাকে কোলে তুলেই নিয়ে যাওয়া হয় হাটে বা কসাইয়ের কাছে। তারা তাড়াতাড়ি কাঠাল পাতা খেতে দিলেও মাঝে মাঝেই অবলা ছাগলটি চিৎকার করতে থাকে। কে জানে তখন তার চোখ দিয়ে জল পড়ে কিনা! আর এটাই হচ্ছে সব অবলাদের ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাস!

এখনও বর্ষা পুরোপুরিভাবে শুরু হয়নি। তবে একদিন দু’দিন পরপরই বৃষ্টি  হওয়ায় এ সময়টায় নদীর পারে আদিগন্ত বিস্তৃত গোচারণ ভূমিটাকে সবুজ গালিচা বৈ আর অন্য কিছু বলে মনে হয় না। দূর থেকে এমন দৃশ্য দেখলে যে কোন গবাদি পশুই নিজেদের আর সামলে রাখতে পারবে না। সারা মুখ লালেঝোলে একাকার হয়ে যায়।

সূর্যটা অনেক্ষণই সামনের গঙ্গায় টুপ করে ডুবে গেছে। অনেকেই তাদের বাগালের সাথে চলে গেলেও যারা এখনও আছে তারা কেন আছে তা অবশ্য ওদের জানা নেই। সবাই ঘাস খেতে খেতে একবার করে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে একে অপরকে চিনে নিতে চায়। নিজেদের মধ্যে খুব যে ঘনিষ্টতা হয়েছে এমনটাও নয়। কারণ সবাই একই রাজ্যের হলেও একই গ্রামের নয়। তাহলে হয়তো একই গোচারণভূমি হত এবং কারোর না কারোর সাথে আলাপও থাকত। অন্তত মুখ চেনা থাকত। কিন্তু এক একজন এসেছে ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম থেকে। তাই তারপর থেকে সবই অচেনা ঠেকে। সেই মালিক বা সেই বাগালদের ডাক আর শোনা যায়নি! বেশ ক’দিন ধরে শুধু শুকনো বিচালি চিবিয়ে চিবিয়ে চোয়ালের  ছাল চামড়া উঠে একেবারে ব্যথায় টনটন করছে। এতদিন পরে এই প্রথম এমন সুখাদ্য পাওয়া গেল। দু’দিন ধরে এক সাথে গাদাগাদি করে গাড়িতে দুলতে  দুলতে আসা আর সেই সাথে একেবারে নির্জলা উপবাসের পরে আজই প্রথম মুখের সামনে এমন লকলকে খাবার পাওয়া গেছে! আহা! এমনটা কি আজীবন পাওয়া যাবে! এমনটা পেলে তো এই গো-জীবন ধন্য হয়ে যেত। ওরা আবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করে।

কবে থেকে যে গবাদি পশুরা একেবারে মানুষদের সাথে এমন করে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ওদের ঘরের প্রাণী হয়ে গেল তা ক’জন মানুষই বা খোঁজ রাখে সে  ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে সুদীর্ঘ যুগ আগে মুনি-ঋষিদের আশ্রমে প্রথম তাদের পরম যত্নে ঠাঁই হয়েছিল। তারও আগে ওরা সবাই জংলিই ছিল। তবে এটা ঠিক যে, মুনি-ঋষিরা গবাদি পশুদের গো-মাতা বলেই জ্ঞান করতেন। তারাই হয়তো অনেক আগে থেকে গরুর দূধের উপকারিতা বুঝতে পেরেই গবাদিপশুকে গৃহপালিত করে নেয়। আর ওরাও চট করে শুধু দুধের বিনিময়েই নয়, বরং সারা শরীরের মেদ-মজ্জা দিয়ে একদিন মানুষের নেওটা হয়ে যায়। আবার এটাও দেখা যায় যে, বিভিন্ন যজ্ঞে গোবৎসকে উৎসর্গ করে পুণ্যার্জন লাভের প্রথা ছিল বা এখনও যে তা একেবারেই অবলুপ্ত হয়ে গেছে তা নয়। বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে পিতৃ-মাতৃ শ্রাদ্ধে গো উৎসর্গের প্রথা আজও রয়েছে। তবে ইদানীং এর পরিবর্তে মূল্য ধরে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা বহুলভাবেই প্রচলিত হয়েছে। ওরা চিরকালই ভীষণভাবে অবলা। সামান্য শিং নেড়ে বা সামান্য পায়ের চাটি মেরে নিজেদের অসহায়তা বোঝানো ছাড়া ওরা একটা মৃদু হুঙ্কারও দিতে পারে না। আর তাই এখনও প্রায় একশো অবলা প্রাণী বড় নিশ্চিন্তে খেয়েই চলেছে। ওরা জানেই না এরপর ওদের অদৃষ্টে কী বাকি রয়েছে!

গোচারণ ভূমির কাছেই একটা বিশাল লম্বা গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়েছে। একে স্থানীয় ভাষায় ওরা বলে ডাব্বা। অর্থাৎ এক ধরনের বাঙ্কার। বহুদূর থেকে একটা মৃদু  শব্দ ভেসে আসতেই তিনজন বাগাল তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবলাদের তাড়িয়ে নিয়ে এসে ঐ বাঙ্কার বা ডাব্বায় জোর করে নামিয়ে দিয়ে নিজেরাও পাট গাছের ভিতরে লুকিয়ে পড়ে। শব্দটি ক্রমশই বাড়তে বাড়তে এক সময় একেবারে গঙ্গার বুকে প্রকট হয়ে আসে। এটি হল বিএসএফদের জলযান। রাতে ওরা এই লঞ্চে করেই মাঝে মাঝে নিজেদের সীমানা বরাবর টহল দিয়ে যাবে। আর এটাই দস্তুর। তবে ভোরের একটু আগেই ওরা শেষ টহলটা দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যায়। আর এটাও এ অঞ্চলের অনেকেরই জানা।

ডাব্বার ভিতরে তখন একখন্ড যুদ্ধ চলছে। কেউ কাউকেই পাত্তা দিচ্ছে না। দেওয়ার কথাও নয়। সবারই তো শিং রয়েছে। কাজেই একে অপরের পেটে যথেচ্ছভাবে গুঁতিয়ে চলেছে। তাড়াহুড়োর জন্য আর কারোর মুখেই মুখোশটা পরানোর সময় পাওয়া যায়নি। আর এখন তা সম্ভবও নয়। ডাব্বার ভিতরে ঢুকলেই নির্ঘাৎ অবলাদের গুঁতো খেতে হবে! তাই ঐ ডাব্বা বা বাঙ্কারের ভিতর থেকে একটা অদ্ভুত গোঁঙানির মতো কাতর শব্দ মাঝে মাঝেই ভেসে আসছে। বোঝা যাচ্ছে কেউ কাউকেই ছেড়ে কথা কইছে না!

সন্ধার আস্তরণ গাঢ় হতেই যাদের আসার কথা তারা দল বেঁধে চলে এসেছে। সারাদিন ধরে বিশাল বিশাল পাট গাছের আড়ালে তারা স্তূপীকৃত কলাগাছ এনে রেখেছে। সেই সাথে অনেক পাটগাছ। সারা রাত ধরে চলবে পাট গাছ দিয়ে পাটাতনের মতো ভেলা আর একই মাপের কলা গাছের ভেলা তৈ্রির কাজ। আর প্রত্যেকের হাতেই রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র। কাজেই এই প্রান্তে যদিও  বিএসএফের জওয়ানরা ইদানীং আসে না। কিন্তু যদি অতি উৎসাহে নিজেদের কৌতুহল মেটাতে চলেও আসে তাহলে যাতে কেউ জ্যান্ত ফিরে যেতে না পারে সে কথা ভেবেই এরাও একেবারে তৈ্রি হয়েই এসেছে। সবাই জানে এসব ব্যবসায় তো একটু ঝুঁকি থাকবেই।

সব অবলার পা যে ব্যথায় টনটন করছে তা নিজেরা বলতে না পারলেও বোঝে। তাই সারাদিন ধরে যা যা গলাধঃকরণ করেছে তা জাবর কাটতে কাটতে একে অপরের শরীরকে বালিশ বানিয়ে মাথা রাখে। ওরা সারা রাত ধরে কখনই গোয়াল ঘরে দাঁড়িয়ে থাকে না। মাঝে মধ্যে শুয়েও থাকে। আর তা একবার গোয়ালে উঁকি দিলেই দেখতে পাওয়া যায়। কাজেই এখন আর নিজেদের মধ্যে কোন বিবাদ নেই। ঠিক যেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলছে ডাব্বায়।

এখানে আসার আগে অবলাদের ভাড়া করা একটা গোয়ালে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। এ অঞ্চলের অনেকেই নিজেদের কোন গবাদিপশু না থাকলেও এক রাত বা দু’রাতের জন্য গোয়াল ঘর বেশ মোটা অঙ্কের বিনিময়ে ভাড়া দিয়ে  থাকে। সেখানে যারা অবলাদের দেখভালের দায়িত্বে ছিল তাদের মুখের ভাষা অবলারা আগে কখনও শোনেনি! আর শুনবেই বা কীভাবে। অবলারা তো আর এ রাজ্যের নয়। কাজেই প্রথম দুটো দিন কিছুই বুঝতে না পারার জন্য বাগালদের হাতে পাচনবাড়ির বেদম মার খেতে হয়েছে ওদের। তবে এখনও যে পুরোটা বোঝে তা নয়। কিন্তু ইঙ্গিতটা বোঝে।

ডাব্বায় কোন আলো থাকার কথা নয়। তাই ঘুমটাও দিব্বি হচ্ছিল। হঠাৎ একটা বিশাল আলো ঝলসে ওঠায় অবলাদের ঘুম ভেঙে যায়। ওরা বার কয়েক চোখ পিটপিট করে একরাশ বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়! কেউ হাই তোলে আবার কেউ কেউ সামান্য আওয়াজ করে। কারোর আবার বিরক্তিতে দ্রুত মাথা নাড়ানোয় লম্বা কানের ফটফট আওয়াজ হয়। সব মিলিয়ে একটা বিরক্তিকর দৃশ্য আর কি!

একজনের দু’হাতে দুটো চার ব্যাটারির টর্চ। সে প্রথম থেকেই টর্চ জ্বালিয়ে  রেখেছে। আর দু’জন ঢুকে পড়েছে অবলাদের মাঝে। এই মুহূর্তে অবলারা ইচ্ছে  করলে এই দুজনকে গুঁতিয়ে দিতেই পারে। নিদেন পক্ষে পেছনের পা দিয়ে একটা বেদম চাটি মারতেই পারে। আর তাহলে ওদের প্রাণে বাঁচাই সংশয় হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু ওরা বার কয়েক মাথা নাড়ালো বটে তবে তেমন সাংঘাতিক কিছু করল না! অবলারা যে আজন্মকাল থেকে বেদম মার খেয়েও কোন প্রতিবাদ করে না, তা মানুষদের জানা। তাই অবলাদের দুর্বলতার সুযোগে ওদের উপরে মানুষদের ইচ্ছেমত অত্যাচার চলে। ওরা এতটাই নিরীহ যে আজন্মকাল থেকে সবটাই মুখ বুঁজে প্রতিবাদহীন ভাবে সহ্য করে আসছে। মুখ ফুটে সামান্য ‘হাম্বা’ ডাকটিও দেয় না। বরং নিঃশব্দে চোখের দুই কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অবিশ্রান্ত জলধারা।

প্রায় একশো অবলাদের মধ্য থেকে প্রথমে টেনে আনা হল চারটি অবলাকে। ওরা একান্ত বিরক্তি সত্বেও আড়মোড়া ভেঙে ডাব্বা থেকে বেরিয়ে এল। বাইরেটায় তখনও হাল্কা অন্ধকার। প্রাক প্রভাতের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে একজন ঝটপট ওদের মুখে মুখোশ পরিয়ে দিল। যাতে ওরা একটিও অবাঞ্ছিত শব্দ করতে না পারে। তারপর ওদের পর পর দাঁড় করিয়ে চারদিকে পাট গাছ দিয়ে একটা পাটাতনের মতো তৈরি করে দেওয়া হল। এতে সুবিধা হল এমনিতেই তো অবলারা নিজেরাই সাঁতার কাটবে। অথচ ওদের কোন অতিরিক্ত পরিশ্রম হবে না। আর এই চারটি অবলার মধ্যে কেউ যদি ক্লান্তিতে সাঁতার নাও কাটে তবুও ডুববে না। ঐ পাটগাছ দিয়ে তৈরি ভেলাই ওদের ভাসিয়ে রাখবে। আর এভাবেই চারটি করে অবলাকে একসাথে কখনও পাট গাছের ভেলা আবার কখনও কলা গাছের ভেলার সাথে বেঁধে ফেলা হল। ব্যস! সারা রাতের পরিশ্রমের এখানেই শেষ। এবার বাড়ি ফিরে সারাদিন ঘুমিয়ে নিতে পারলেই শরীরটা আবার আগের মতোই চাঙ্গা হয়ে যাবে।

অন্ধকার ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে এসেছে। ভোর থেকেই শুরু হয়েছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। হয়তো আজকের সারা দিনটা এমনই যাবে। এতে অবশ্য ব্যবসায় কোন খামতি পড়বে না। বরং এমন দিনে বিএসএফের লঞ্চের আনাগোনা কমই থাকবে। ফলে জল পাহারায় কিছুটা ঢিলেঢালাই থাকবে। কারণ এমন বাদলায় ওদের দূরবিনেও বেশি দূরের জিনিস খুব একটা পরিষ্কার ভাবে দেখা যাবে না। আর এটাই হচ্ছে ব্যবসার প্রকৃষ্ট সময়।

দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের মধ্যে একেবারে ফিসফিস করে কথা বলার পরে এবার একজন বলে ওঠে – ‘এবার তো হামাদের কাম শেষ। তাহলে উয়াদের হেলায় দিব কি?’

-‘একনা খাড়ায় যা। আগে একবার উপারে ফোন মারে দেখি। তখন তো মাহেদুরের ফোন লাগেনি। কুন কথাও হয় নাই। ‘লোকটি বার কয়েক ফোন করে একবার মাহেদুরকে ফোনে ধরতে পারে। ও হ্যাঁ বলায় সে নিশ্চিন্ত হয়ে ফোন বন্ধ করে বলে- ‘ইসবার লিশ্চিন্ত মনে উয়াদের স্রোতের মুখে পানিত হেলায় দিতে পারিস। হামেদুর গিরিন সিগনাল দিল।

গঙ্গার তটভূমি জুড়ে সেনা বাহিনীর মতো একেবারে সজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অবলা প্রাণীর দল। চারটি অবলাকে নিয়ে পাট গাছের ও কলা গাছের তৈরি একটি করে ভেলার মাঝে ওদের দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ কারোরই জানা নেই যে এখন ওদের আর কি কি করতে হবে। সাধে কি আর ওদের মানুষেরা আদর করে বলদ বলে। অবশ্য অবলারা জানে না যে অনেক মানুষ অন্য মানুষেদেরও ঐ বিশেষণে ভূষিত করে থাকে।

সবাই এখন শুধু হুকুমের অপেক্ষায় সময় গুনছে। অবলাদের একে একে জলে নামিয়ে দেওয়া হল। একসাথে চারটি করে অবলা মোট কুড়িটি পাট গাছ ও কলা গাছের ভেলার ঘেরাটোপে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অবলাদের কিছুটা দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে হবে। ওরা যখন নিজেরাই দিশা পেয়ে যাবে তখন স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে একেবারে ওপারের ঘাটে পৌছে যাবে। তাই আরো দুটো কলার ভেলায় দুজনে উঠে পড়ে। ওদের হাতে ভেলা বাইবার জন্য লম্বা বাঁশের লগি। এটার দুটো কাজ। কিছুটা ভেলা বাইবার জন্য আবার প্রয়োজন হলে অবলাদের লাইন ঠিক করার জন্য। যখন দেখা গেল একসাথে একশোটি অবলা শুধু মাথাটুকু জলের উপর ভাসিয়ে স্রোতের মুখে এগিয়ে চলেছে তখন দু’জন  তাদের ভেলা নিয়ে ফিরে আসে। আর সাথে সাথে ফোন চলে যায় ওপারের লাইনম্যান হামেদুরের কাছে–‘হামেদুর ভাই, একশোকে হেলায় দিলাম। স্রোত ধরেই এগুইছে। তোমরা দেইখে তুইলে লিও’।

এপারের অবলারা যতক্ষণ না জল সীমানা পার হচ্ছে ততক্ষণই একটু ভয় থাকে। তাই বেশ কিছুটা সময় কান পেতে থাকতে হয় লঞ্চের শব্দ শোনার জন্য। তবে এতটা ভোরে সাধারণত ওরা জলে টহল দিতে বের হয় না। হাজার হোক সরকারি কর্মচারীদের সবটাই কিছুটা নিয়ম রক্ষার জন্যও বটে। অবশ্য ওদের জানার কথা নয় যে উপরের অফিসারদের মুখ বন্ধ করা থাকে। তারা তখন চোখ দিয়ে শোনে এর কান দিয়ে দেখে। কাজেই তাদের নির্দেশ না পেলে জওয়ানদের বয়েই গেছে সাত সকালে এমন রিমঝিম বৃষ্টির মধ্যে টহল দিতে। নৌকা বিহার ভালোবাসে না এমন মানুষ বোধ হয় কমই আছে। কিন্তু এমন ভাবে কাজের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে ভরা গঙ্গায় লঞ্চে ঘুরে বেরানোর মধ্যে আর যাই থাকুক কোন মজা বা আনন্দ থাকে না। কারণ তখন মূল বিষয়টাই হচ্ছে চোখে দূরবিন লাগিয়ে পর্যবেক্ষণ করা।

এবার একটা শব্দ সত্যিই ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। অথচ খালি চোখে এমন ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে দূরে্র জিনিস কিছুই স্পষ্ট হচ্ছে না। তবু সবাই দূরে শব্দকে লক্ষ্য করে তাকিয়ে থাকে। শব্দটা আরো এগিয়ে আসে। ওদের বুক ধক ধক করতে থাকে। একজন ফোন করে বলে- ‘সোলেমান ভাই, হামরা কি ইসবার ম্যানেজ করি নাই?’

-হাঁ, উশালা কমান্ডেন্টের হাতে হামি তো লিজেই গুঁইজে দিছিনু। কেন, কিছু ঝামেলা আছে? সোলেমান বলে ।

-ভুটভুটির আওয়াজ আইসছে যে!

-মালগুলান কতদূরে?

-খুব একটা দেখা যায় না। অরা বোধহয় অখনও হেইলছে।

-আরে হেলে তো হেলুক। অদের সীমানায় ঢুইকেছে কিনা সেটাই দেখ। হামি কমান্ডেন্টকে ফোন লাগাইছি। শালা এখনও নিদ পারছে কিনা কে জানে! আগের অফিসারখানই ভালো ছিলরে। টাকাও লিত আবার কামখানও ঠিকঠাক কইরত। অথচ এ শালা টাকা লেয় কিন্তু কাম করে না। ঠিক আছে তুই রাখ।

এপার থেকে ছেলেটি এবার ওপারের হামেদুরকে ফোন করে বলে- ‘হামেদুর ভাই, অবলাগুলাকে দেইখতে পাইছ?’

-হাঁ হাঁ দেখা গেছে। কিছু দেখি অন্য ঘাটের দিকে যায়। দুজন নাও নিয়ে অদের ফিরায় আইনতে গ্যাছে। চিন্তার কিছু নাই। অরা আমাগো সীমানায় ঢুইকা পড়ছে। বিপদ কাইটা গ্যাছে। হামেদুর বলে।

আর ঠিক এমন সময় দুরন্ত বেগে লঞ্চটা ওদের সামনে দিয়ে পেরিয়ে গেল। আসলে ওদের নজরেও পড়েছে যে গঙ্গার জলে সার সার কি যেন ভেসে চলেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। তখনও সার সার দিয়ে অবলারা সাঁতরে চলেছে। লঞ্চের গতি ধীরে ধীরে একেবারেই মন্থর হয়ে যায়। লঞ্চে দূরবিন হাতে নিয়ে বসে থাকা অফিসার মনে মনে গজগজ করে বলে ওঠেন- ‘হামলোগোকো ইয়ে আদমিনে বুড়বক বনাকে ছোড় দিয়ে। অব ইতনে বয়েল হামারা হাত সে নিকল গয়ে’। এসব কথা অবলাদের কানে গেলেও এর গূঢ় অর্থ বোঝার মতো বুদ্ধি ওদের নেই। কারণ ওরা সবাই তো বলদ। তবে ওরা এটুকু বুঝতে পারছে যে কারা যেন ওদের নিতে এসেছে। আর ওপারের ঘাটে অনেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওদেরই প্রতীক্ষায়। আর তাদের সঠিক পথ দেখানোর জন্য কিছু নৌকা ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। অর্থাৎ তারা নিশ্চিন্তে সীমান্ত পেরিয়ে আসতে পেরেছে।

আমরা যেমন তরতাজা সবজি বা জ্যান্ত মাছ দেখলে বেশি খুশি হই ঠিক তেমনি ওপারের লোকেদের ঘাট থেকে অবলাদের ডাঙায় তুলে ওদের ভেজা শরীর দেখেই চোখগুলো চকচক করে ওঠে। আসলে বিহার থেকে বা উত্তর প্রদেশ থেকে যে সব অবলাদের পাঠানো হয় তাদের শরীর বেশ মাংসাল। বিশেষ করে পেছনের দাপনা দেখলেই জিভে জল এসে যায়। কাজেই লোভ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। পদ্মার পারেই ঢাঁই দেওয়া খড়ের আঁটি। তাড়াতাড়ি স্থানীয় ছেলেরা ক্লান্ত অবলাদের মুখে এক আঁটি করে খড় গুঁজে দেয়। গতকালকের পর এই প্রথম ওদের দাঁতে কাটার মতো কিছু খাবার জুটলো। এতটা চওড়া নদী সাঁতরে আসা কি চাট্টিখানি ব্যাপার! সকল অবলারই এতটা সাঁতার কাটা এই প্রথম!  তাই সবাই ক্লান্তিতে প্রায় চোখ বন্ধ করে চিবিয়ে চলে। কেউ বা চার পা মুড়ে বসে পড়ে। আর সেই অবস্থায় জাবর কাটতে থাকে।

একটা হৃষ্টপুষ্ট কালো রঙের বলদের শরীরে হাত ছুঁইয়ে একজন লাইনম্যান বলে- এই বলদখান কিন্তু এক্কেবারে খাসা। এমন বলদ আমাগো দ্যাশে জন্মায় না। এর মূল্য এক লাখের বেশি হবে না মাজিদ ভাই?

-হওয়া তো উচিত। মালটার গতরখান দ্যাখছস। য্যান সারা গায়ে কেউ ত্যাল ঢাইলা দিছে। আহা! এইখান কার নসিবে যে আছে তা আল্লাই জানে। তবে তগো একখান কথা কই। যার নসিবেই থাক না কেন এরে কিন্তু দশ গেরাম না ঘুরায়ে জবাই কইরবে না। আর তার পরেই একবার ভাব দেখি এর গোস্তের কিলো কত করি হতি পারে। কসাই খানায় কত্ত বড় লাইন হতি পারে। আমাগো দ্যাশের মাইনষেরা এমন বলদের গোস্ত বহুদিন খায় নাই। মাজিদ বেশ বিজ্ঞের মতো হাসে।

কালো রঙের বলদটি তখনও তার ডাগর চোখ দুটো বন্ধ করে জাবর কেটেই চলেছে। বাকিদেরও প্রায় একই অবস্থা। অথচ এখানে উপস্থিত লাইনম্যানদের মধ্যে এতক্ষণ ধরে যা আলোচনা হচ্ছিল তার কোন অর্থই ওদের বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। যদি তারা যৎসামান্যও বুঝতে পারত তাহলে আর এতটা নিশ্চিন্ত হয়ে জাবর কাটতো না। বরং বিদ্রোহ করে তেড়ে আসত। কিন্তু ওরা তো বলদ। আর তাই মনের অব্যক্ত ব্যথাটাকে সহজাত ভাবে চেপে রাখাই এদের ধর্ম। কিন্তু ওদের বিশাল চোখগুলো সেই গোপন ব্যথা একেবারেই চেপে রাখতে পারে না। আর তাই তাদের চোখের কোল বেয়ে সকলের অলক্ষেই গঙ্গা-পদ্মার মিলিত জল বয়ে যাচ্ছে। অথচ ওরা ছাড়া আর কেউ তা টের পায় না!  

 

(ক্রমশ)                                                                 

                                                                          


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন