কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১১ |
দাগ
ক্ষমতার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ, অন্ধকারের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, যুদ্ধ যে কোন আধ্যাত্মিক শয়তানের বিরুদ্ধে, সেটাই জীবন। কে
ভেবেছিল এতসব! দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। আলো, যা এতক্ষণ গড়িয়ে গড়িয়ে, নিভলো। অশেষ, পাঁচ দশ, একমুখ দাড়ি, ঘাড় অবধি চুল, চওড়া চোয়াল, বেতের জীর্ণ ইজিচেয়ারটা
ছেড়ে উঠবে কিনা ভাবছিলো। হাতের দশটা আঙুল টিপলো খানিকক্ষণ। শীত চলে
যাচ্ছে। লেপটা কি ঘুমিয়ে! কত
ঘুমোয়! স্বপ্ন দ্যাখে? সেই স্বপ্নটা? দুপুর
গড়িয়ে বিকেলের দিকে। উষ্ণতার জন্য আকাঙ্ক্ষা বাড়ছে। নরম পায়ের গোছা। ধূপের গন্ধ। হালকা রোমশ
স্পর্শ চাইছে আঙুল। ভিজে উঠছে কোথাও। হালকা বৃষ্টির
মতো। খুব ইচ্ছে করছে একটু অন্ধকার। কারখানার ম্যানেজার, ট্রেড ইউনিয়নের নেতা, শ্লা সব এক। এই ঘরেই মদের
টেবিলে টপকে দিয়েছিল দুটোকে। উপায়
ছিল না। দুটোতে মিলে
সব ছারখার করে দিচ্ছিলো। মালিক
কিছুই খবর রাখতো না। মাসে
মাসে মুনাফাতেই সুখ। সে
রাতটা খুব অন্ধকার ছিল। বৃষ্টি খুব। ছুরিটা কলাবাগানে আর ও নাইট শিফটে। নিয়ম মেনেই। দরজাটা আবার যেন খুলছে! বাতাস? আসছে কিছু। আর কিছু? সাদাকে কালো, কালোকে নীল করছে বাতাস। খেলা করছে বাতাস। কালকেও এমন ছিল না। উঠবে
কিনা, অশেষ ভাবছে। স্থবিরতা থেকে। অন্ধকার
থেকে। অসহ্য ঘন্টাধ্বনি আর প্রার্থনার আড়ালে তাবৎ কুৎসিত জিজীবিষা থেকে। ও এখন শাসিত হতে চায়। শঙ্খমাছের
লেজের চাবুক চায়। ঘোড়ার মতো। পিঠে নেবে। সেই নারীকে। যে মৃত্যুকে চেনেনি। যে সমাপ্তি জানে না। পতন বোঝেনি। চলবে দুলকি
চালে। যাতে মাংসের সবটুকু
স্বাদ পাওয়া যায়। অশেষ এখন চলন চায়। ফোঁটা ফোঁটা। আর্থিক
লাভালাভ কবেই বা ভেবেছে অশেষ! না হলে অতিসহজ
টোপ ছেড়ে ও এখানে থাকে! এই প্রায় একটা পোড়ো ঘরে! একদিন সবকিছু ছিল। তারপর কারখানা ছেড়ে ঐ পথ। নেওয়া আর
দেওয়া। ঝকঝকে ছোটবড়ো অস্ত্র। পয়সা তখন উড়তো। অফুরন্ত মদ, হরেক মেয়েছেলে, নিত্যনতুন
ফুর্তি। কেঊ ধরার
নেই। কিন্তু এই এগারো বছরে অশেষ আজ ক্লান্ত। বড়ো একঘেয়ে, বড়ো নিচুপনা। কখনও বা
বাঘ, কখনও ক্ষমতার পায়ের কাছে বসে মিউমিউ। ভালো লাগছিলো না আর। নতুবা
এখন বিড়াল কোলে ঘড়ির দিকে থাকিয়ে থাকে অনিবার!
ঘড়িটা বন্ধ। অশেষের তাতে খুব কিছু আসে যায় না। বিড়ালের গলায় আদুরে শব্দ। ওর মনে পড়ে এক চলে যাওয়া। একমাত্রিক। একটা
ছুরি ঝলকে গেল। দরজার ওপাশে। ও দেখলো। আশ্চর্য! এখন ছুরি কেন! সে গল্প তো কবেই শেষ
হয়ে গেছে! কার্পেট পর্যন্ত পালটে ফেলেছিল। একটা ঘর-ও করতে হয়েছিল। তাহলে এখন কেন
আবার! শীত করছে। হাল্কা অন্ধকারে হাতের তালুর দিকে তাকালো। আঙুলগুলো দেখলো। দাগ? সেদিনই কেটেছিলো ভাঙা গ্লাসে। এখন নেই। ওর
এই মুহূর্তে ওকে দরকার।
এক্ষুনি। ওর সবটুকু। ঐ পেলব আশ্রয়টুকু।
সিঁড়িতে যেন পায়ের শব্দ। অতিপরিচিত
পারফিউম। ও একটা
হাত বাড়িয়ে দিলো। অন্ধকার আর
আলো যেখানে মিশে যাচ্ছে।
খুব ভালো গল্প নাকি না- গল্প ? শেষ পর্যন্ত আশ্রয় লাগে। দারুন।
উত্তরমুছুন