কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১১ |
যাওয়া
সাদা
চাদরে শরীরটা ঢাকা। ঘরময় লোক। লোক বাড়ছে ঘনঘন। মেঝেতে বসে ঠাকুমাকে ঘিরে মা জেঠিমা
কাকিমা অনেক মানুষ। এই এন্টালি আনন্দপালিত রোডের ওপর বাড়িটা একান্নবর্তি সংসার। আমার
অনেকগুলো জেঠিমা অনেক কাকিমা আর চারজন ঠাকুমা দাদু সবাই সারা বছর এই বাড়িতেই। এখন ভারি
ডিজাইনের পালঙ্কের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে বাবা আর দুই জ্যাঠা। বাবার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে
গেছে, রগ ফুলে উঠছে, চোখ জলশূন্য হাহাকার। বাকি সকলের কান্নার রোল উঠেছে। পায়ের ছাপ
নেওয়া হচ্ছে হলুদে। দেওয়ালে তাকিয়ে দেখছি সারসার কবিতা, ফ্রেম বাঁধানো, কাকার লেখা
সব কবিতা। দুপুর হলেও আজ কেউ খেতে দিলো না। আমরা সবাই ছাদে।
কাকিমা
শক্ত করে ধরে আছে হাত, নিচে অনেক নিচে একটা ছোট্ট খাটে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে দাদু আর বাবা কাকা জ্যাঠারা কাঁধে করে
বয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে কোথাও। কোথায়? এখনও জানি না। চাপা স্বরে কারা একবার বলে উঠল বল
হরি, হরিবোল, ছড়িয়ে পড়ল সাদা খই, আমি কাকিমার হাত ছাড়িয়ে ছুটছি তেপান্তরের ছাদে। বড়
ছাদ থেকে ছোটো ছাদ, ওই যে বসে আছে যে যার ঘরে পায়রাগুলো। ওদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই।
সন্ধ্যাবেলা
ভাইবোন সাতজন বসে আছি সেজদাদুর ঘরে। এঘরেও কারুকার্য করা পালঙ্ক। শুয়ে শুয়ে নিচু স্বরে
গল্প বলছেন। সকলে শুনছে ফ্যালফ্যাল করে। এরপর
সেজ ঠাকুমা আসবে বগি থালায় ভাত বেড়ে। সেই থালা থেকে একেকটা গরস একেকজনের মুখে তুলে
দেবে ঠাকুমা। এবাড়িতে মা’কে সারাদিন প্রায় দেখতেই পাই না। সেই মাঝরাতে আবছা দেখব পাশে
মা।
তারপর
থেকে আরো অনেক শীত গ্রীষ্ম আর বর্ষা চলে যায় আর একদিন আবার নির্জন অক্ষরেখায় ছায়া পড়ে
জলের ওপর। সব অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে নদীর ঘাটের কাছে এসে।
এত
রাতে স্নান করে শীত শীত করছে। কাঁপছি। সবে ফিরেছি। আজ খুব বৃষ্টি। কালও থাকবে নিম্নচাপ
আরো কতদিন এখন বৃষ্টি জানি না।
রাস্তাটা
ঝকঝক করছে জলধোয়া হয়ে। ভাই বোন দাঁড়িয়ে আছে। সেই ফর্সা মানুষটি আজ চলে যাবেন। তারই
সামান্য প্রস্তুতি এখনও। নার্সিংহোমের সামনে একটা দুটো আরো লোক ঘোরাঘুরি করছে, মুখে
চিন্তার ছাপ।
এই
শহরে এখন লকডাডাউন।
এই
শহর ছেড়ে চলে যাবে আজ একজন। আকাশে মেঘ কেটে তারা। এসে গেছে। চোখ বন্ধ, হালকা সাদা দাড়ি
না কামানো গাল আজ। বাবা সব সময় ক্লিন শেভড থাকে, শুধু আজ এরকম। একটা প্লাটিকের ব্যাগে
মোড়া শরীর, যেন দম নিতে হাঁসফাঁস করছে বাবা। ছোঁয়া যাবে না আজ আর। ঠোঁটের কোণে দু’ফোঁটা
রক্ত শুকিয়ে আছে। ভাইবোন জলশূন্য চোখ। শুধু ভেতর থেকে একটা বন্যা উঠে আসছে। বৃষ্টি
ভেজা পথে গাড়িটা চলে যাচ্ছে নিমতলা শ্মশান। বাবা চলে যাচ্ছে। ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা
কোভিড। আনন্দপালিত রোডের বাড়িটা মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং হয়ে যাচ্ছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন