কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

অলোকপর্ণা

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৭


রোববার দুপুরের বিস্মৃতি

সহসা টের পেলাম, আমি তার হাতদুটো ভুলে গেছি। এই আবিষ্কার আমাকে সারাটা দুপুর চুপ করিয়ে রাখল।

এমন নয় যে তার দু’হাত আমার হাতের মধ্যে কখনো ধরিনি, শতসহস্রবার ওই  দু’হাত আমার হাতের মুঠোয় আশ্রয় নিয়েছে। আমার দেহ-আত্মা ছুঁয়ে দিয়েছে। চোখ  বুজলে আমি তার স্পর্শ এখনো টের পাই, টের পেলাম।

আমি কি তবে তাকে ভুলতে বসেছি?

সহসা একটা ভয় মাকড়শার মতো শরীরে জাঁকিয়ে বসে।

চোখ বুজে তাকে জপ করি। তার মুখ মনে পড়ে, চোখ, নাক, চুল, চুলের ঘ্রাণ, ঠোঁট, চিবুক, চাতক গ্রীবা মনে পড়ে। তার সুগন্ধ মনে পড়ে যায়। তার স্তন দেখতে পাই অনায়াসে। তার নাভির গভীরতা পরখ করি। তার তলপেটের কৌমার্য নাগালে আসে। তার যোনি দেখি। যোনির মাংসল ফুল ফুটে আছে, দেখি। তার ঊরু দেখি। জঙ্ঘা দেখি। তার পায়ের পাতায় খুব করে মুখ ঘষতে পারি।

তাকে উল্টেপাল্টে তার পিঠ দেখি, পিঠে শিরদাঁড়ার শাসন দেখতে পাই। সেই ভাঁজ বরাবর আঙুল ছুঁয়ে এলে তার নিতম্বের মালভূমি বেয়ে নেমে যাওয়া যায়। তার বাহুমূল পিছলে খসে খসে যাই। অথচ তার হাত, হাতের পাতাদুটি মনে পড়ে না। যেন কেউ ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে আবছা করে দিয়েছে।

আমি কি সত্যিই তাকে ভুলে যেতে বসলাম?

আমি তার তর্জনি ভাবতে বসলাম। পৃথিবীর দিকে আঙুল তুলে তুলে কিঞ্চিৎ বাঁকা হয়ে যাওয়া তর্জনি। নখ, নখের পালিশ, হালকা গোলাপি, দেখতে পাই সবই। তার মুঠোর শক্তি অনুভব করি আমার হাতের পাতায়। তার আয়ুরেখা ভাবতে বসি। তার জন্মদাগ মনে পড়ে। অথচ তার সামগ্রিক হাত, হাতের পাতা কিছুতেই মনে করতে পারিনা।

তবে কি তাকে পুরোপুরি মন দিয়ে দেখা হয়নি? ফাঁকি থেকে গেছে কোথাও?

হাত, হাতের পাতা মনে করতে গেলে, অন্যান্য হাতের সারি, কবজি, আঙুল ভিড় করে আসে। বিগতদিনের সমস্ত হাতের পাতাদের, আঙুলকে, নখ, নখের আঁচড়কে নাকচ করে দিতে থাকি। ভয় করে, এইভাবে হাতের পাতা থেকে শুরু করে একদিন যদি গোটা মানুষটা স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে যায়, তবে কার কাছে যাবো? কোথায় লুকোবো?

দ্রুত ফোন করি তাকে, সপাটে বলি, “আমি তোমার হাতের পাতা বিস্মৃত হইয়াছি, আমাকে তোমার হাতের দুইখানি ছবি সত্ত্বর পাঠাইবে।”

ফোন রেখে চুপ করে বসি, ছবির অপেক্ষায়। জানি ছবি একবার হস্তগত হলেই, আমি তাকে কোনোদিন ভুলবো না। একবার হস্তগত হলেই, তাকে ভোলা আর সম্ভব নয়।

লকডাউনের এক দুপুরবেলা, একবিংশ শতকে, আর সমস্ত হাতকে ছাপিয়ে একটি গম রঙের হাতের দুখানি ছবি আমার ফোনের পর্দায় জেগে ওঠে। মুখের সামনে সেই ছবি খুলে বিস্মৃতির পোকাকে আমি পা দিয়ে পিষে দিতে থাকি। পায়ের চাপে বিস্মৃতির পোকার পোয়াতি পেট ফেটে অসংখ্য খুদে খুদে বিস্মৃতিকণা ঘরে কোণায় কোণায় ছড়িয়ে যায়, আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। অপেক্ষা করে, একটু বেখেয়াল হলেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে একদিন ফের আমার টুঁটি কামড়ে ধরবে বলে।


4 কমেন্টস্: