কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

শিবাংশু দে

 

গীর্ণকুসুম –




 

বাঙালির গান বোঝা

মধ্যবিত্ত ​​​​​​​নাগরিক ​​​​​​​বাঙালির 'গান বোঝা'র অভ্যেসটির মধ্যে ​​​​​​​সুরের ​​​​​​​ভূমিকা ​​​​​​​বিশেষ ​​​​​​​নেই।  গান নিয়ে আলোচনা করতে গেলে লোকে ​​​​​​​তার ​​​​​​​কথাবস্তুর ​​​​​​​প্রতিই ​​​​​​​মনোযোগ ​​​​​​​দিয়ে ​​​​​​​থাকে। জাতিগতভাবে শ্রোতাদের মধ্যে গত ​​​​​​​শ’দুয়েক ​​​​​​​বছরে বিভিন্ন কালপর্বের গীতিকার'দের রচনার অংশ ঊদ্ধৃত করে একটা তুলনামূলক অবস্থানে পৌঁছোবার তাগিদ বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। বাঙালির অন্যতম প্রিয় ​​​​​​​ব্যসন, শ্রমসাধ্য বিশ্লেষণ পরিহার করে অলস মায়ায় গীতিকারদের মান'কে ‘উৎকৃষ্ট’ বা ‘নিকৃষ্ট’ ঘোষণা করে দেওয়া। এভাবে গীতিকারদের প্রতি সুবিচার করা যায় না। ​​সময়ের​​​​​​​ সঙ্গে ভাষার ক্রমবিবর্তন হয়। অনেক পাল্টে যায় ক্রিয়া ও সর্বনামের  রূপ ও ​​​​​​​প্রয়োগ। লোকপ্রিয়  প্রচলিত, প্রতীক, রূপক ও মোটিফগুলিও বদলে যায়। বাজারের চাপে গড়ে ওঠা নান্দনিক আপোসসমূহ পরবর্তীকালের ​​​​​​​শ্রোতাদের ​​​​​​​কাছে ​​​​​​​'হাস্যকর'মনে ​​​​​​​হতে পারে।  অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্তের ​​​​​​​প্রজন্মে ​​​​​​​আদৃত প্যাথোসের চিহ্ন হয়তো শৈলেন রায়ের লেখার মধ্যেও এলো। কিন্তু 'তব', 'মম', 'পেয়েছিনু' ইত্যাদি  প্রয়োগ ​​​​​​​থেকে  ফেলে আসা নস্টালজিয়া আবার ​​​​​​​জাগানো ​​​​​​​যায় ​​​​​​​না। তাঁর গানে শব্দের এমত ব্যবহার দেখে ​​​​​​​কথাটি ​​​​​​​সুমন, ​​​​​​​সলিল চৌধুরীকে ​​​​​​​স্মরণ ​​​​​​​করিয়ে ​​​​​​​দিয়েছিলেন। ​​​​​​​সলিল একটু ​​​​​​​বিস্মিত ​​​​​​​হন। কারণ ​​​​​​​তিনি ​​​​​​​​​​​​​​ব্যাপারটি ​​​​​​​আগে কখনও ​​​​​​​তলিয়ে ​​​​​​​ভেবে ​​​​​​​দেখেননি। ​​​​​​​ বিবর্তনের​​​​​​​ হিসেব বহু গরমিলে ​​​​​​​ভরা। রবীন্দ্র-প্রজন্ম শেষ ​​​​​​​হয়ে ​​​​​​​যাবার ​​​​​​​পর বাংলাগানের গীতিকাররা ​​​​​​​মূলত ​​​​​​​শ্রোতারুচি ​​​​​​​​​​​​​​বাজারের ​​​​​​​বাধ্যতার ​​​​​​​কাছে ​​​​​​​নিরুপায়। অথচ ​​​​​​​পরিবর্তিত লোকরুচির চাপজনিত দোষারোপ তাঁদের প্রতিই বেশি বর্ষিত হয়। বহুত না-ইনসাফি হ্যাঁয়। 

https://www.youtube.com/watch?v=HM9MompfVus

বাঙালির গান বোঝা মানে মুখ্যত গানের 'কথা' বোঝা। কথা বুঝতে বিশেষ প্রস্তুতি লাগে না। সে তুলনায়  সুরের অন্ধিসন্ধি খোঁজা বড়ো ঝকমারি। লিরিক গানের কথামালার কিছু অতি ব্যবহৃত প্রতীক, কল্প বা অর্থহীন ফানুসপনা বাঙালি শ্রোতার খুব চেনা। স্থায়ীটি হয়তো একটু নতুন লাগলো। অচেনা কিছু কারিগরি। কিন্তু সঞ্চারী আসতে আসতে চেনা ছক যেই ফিরে এলো, পঁচানব্বই ভাগ শ্রোতা আশ্বস্ত হয়ে মাথা নাড়া শুরু করে দিলেন। সেই সব শ্রোতাদের সুরের গড়ন, তালের চলন, অর্কেস্ট্রেশনের জাদু কিছুই তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করতো না। তাঁরা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁরা ছিলেন বাজারের চালিকা শক্তি। তাঁদেরই আকাঙ্ক্ষার রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতো বাংলা গানের বাজার।   

এই অগভীর চক্রের হাতে সব চেয়ে বড়ো শিকার হয়েছিলেন খোদ সলিল চৌধুরী। পার্টি স্বীকার করেনি 'শ্যামলবরণী ওগো কন্যা'র মধ্যে কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক বার্তা আছে। তাঁরা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের লাইনটিতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। সলিল প্রায় 'বিতাড়িত' হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বিশ্বস্ততম আশ্রয়টি থেকে। বিতর্কের সময় তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেন 'বাণী'র যেমন ভাষা আছে, সুরেরও আছে। পার্টির কর্তারা সলিলের বক্তব্যটি ধরতেই পারেননি। 'সুরের ভাষা?' সেটা আবার কী? ভাষা তো একটাই। সেটা গানের কথা। সলিল তাঁদের ফতোয়া অস্বীকার করে নিজের কাজ করে যান। বাঙালি শ্রোতার সৌভাগ্য, সলিল অতো বৃহৎ মাত্রায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক চাপ অস্বীকার করে শেষ পর্যন্ত 'হয়ে' উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই সেদিন পর্যন্ত বাঙালি শ্রোতার গান 'বোঝা', শুধুমাত্র বাণীর অর্থ বুঝে ওঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছিলো ।    

https://www.youtube.com/watch?v=QfBx_4ZNexc

অজয় ভট্টাচার্য, অথবা তাঁর বেশ কিছু পরে, ধরা যাক সুধীন দাশগুপ্তের লিরিকে প্রচলিত সরল শব্দগুলি শুধু মাত্র প্রয়োগের কৌশলে শ্রোতার মনে বহুসময় স্পর্শ রেখে যেতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাগানে রথীমহারথী  কম্পোজারদের কোনও অভাব নেই। নাম শুনলেই রোমাঞ্চ জাগে, এমন লিস্টিও ফুরোয় না। কিন্তু সবার মাঝে একটা নাম, সুধীন দাশগুপ্ত বোধহয় একটা সুরও করেননি যাকে 'also ran' বলা যায়। তাঁর প্রয়োগ কৌশল ছিল অনন্য। শিল্পবিলাসীর মেঘপ্রাসাদ থেকে বহুদূরে তিনি এক শিল্পকর্মী। সশ্রম প্রতিভার ছাপ তাঁর সব শিল্পকর্মে। শুধু তাঁর সৃষ্ট গানের টেকনিক নিয়ে আলাদা আলাদা করে আলোচনা করতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। অন্তর্বস্তু নিয়ে চর্চা চলতেই থাকবে। সত্তরের দশক থেকে  'চাঁদ-ফুল-পাখি' বহুনিন্দিত একটা মোটিফ। এটা সত্যি যে সলিল বা সুধীন এই সহজ সমাধানের অংশ ন'ন।  আরও একজন ছিলেন, রতু মুখোপাধ্যায়। যাঁকে আমি বাংলাগানে সুরের প্রিন্স বলি। ভুলে যাওয়া সঙ্গত হবে না, লিরিক নির্মাণের এই চেনা ছকটি কিন্তু একসময়ের শ্রোতাদের (পড়ুন, বাজারের) প্রত্যক্ষ তাগিদ থেকেই এসেছিলো। সময়ের পলি এসে শ্রোতাদের শ্রবণ অভ্যাস বদলে দিয়ে যায়। গীতিস্রষ্টা তাঁর সময়ের ফসল। পারম্পর্যহীন, বিচ্ছিন্ন ঊদ্ধৃতি শুনে বা পড়ে একজন স্রষ্টাকে সামগ্রিকভাবে বিচার করা যায় নাকবি'রা পাঠ অভ্যাসে স্বচ্ছন্দ। গীতিকারেরা স্বচ্ছন্দ শ্রবণ অভ্যাসে। তাই উভয়ের গুণগ্রাহিতার মাপকাঠি পূর্ণতঃ পৃথক। শ্রোতাদের কাছে নগদবিদায়ের ক্ষেত্রে গীতিকারেরা কবি'দের থেকে এগিয়ে থাকেন। কারণ কবিতা একটা একেবারেই বিমূর্ত মাধ্যম। লিরিকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আকর্ষণীয় সুরের আবেদন খুবই প্রত্যক্ষ। ধরাছোঁয়ার সুযোগ অনেক বেশি।

https://www.youtube.com/watch?v=OUDQd_NJwWA

যদি সুরের প্রশ্ন আসে, তবে বলবো বাংলাগানের মূল নির্মাণটির মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। কীর্তন, ঠুমরি, টপ্পা, কাওয়ালি, কাজরি, চৈতি ইত্যাদি শৈলীগুলি থেকে আহরিত একালের যেসব সুরসৃষ্টি আমরা শুনতে পাই, সেখানে 'পরিবর্তন'গুলি যতোটা প্রসাধিত, ততোটা অভিনব নয়। আমার মনে পড়ছে বহুকাল আগে একজন প্রবীণ শ্রোতা, যিনি সমকালীন গানের হালহকিকৎ বিষয়ে ওয়াকিফহাল ছিলেন না, তাঁকে এ আর রহমানের একটি কম্পোজিশন, 'বম্বে' ছবির কব্বালিভিত্তিক গান "কহনা হি ক্যা" শোনালুম। তিনি তিন-চারবার গানটি শুনে নিজের মনে একটি বৈষ্ণব কীর্তন গেয়ে উঠলেন। দু'টি গানের কংকাল প্রায় এক। তফাৎ ছিলো শুধু সঙ্গীত আয়োজনে। পরবর্তীকালে তালবাদ্যের প্রয়োগে প্রচুর বদল হয়েছে। বেড়েছে ইলেকট্রনিক বাদ্যযন্ত্রের বহুল প্রয়োগ। স্পানিশ গিটার বা স্যাক্সোফোন, ট্রাম্পেটের রমরমা। কিন্তু মৌলিক সুর প্রয়োগের সময় সুরকারেরা লোকপ্রিয় ফ্রেম বা ফ্রেজগুলিকে সতত আশকারা দিয়ে থাকেন। মনে হয় নবতর যন্ত্রানুষঙ্গে যদি এইসব কম্পোজারের রচনাগুলিকে আমরা নতুন করে সাজাতে পারি, তবে হয়তো নতুন সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সমস্যাটি আসবে অন্যদিক থেকে। লোকপ্রিয়তার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে কালসাপেক্ষ বাজারের চাপ। মুহ্যমান লিরিকের দুর্বলতা। বিষয়সমূহ তো পালটায়নি। প্রেম, বিরহ, শৃঙ্গার, একাকিত্ব, অসহায়তা, টুকরো সুখ, গভীর দুঃখ, মানুষের অনুভূতির জগতের ভিত্তি তো একই আছে। কিন্তু মানুষের বোধপ্রকাশের ভাষাটি আমূল বদলে গিয়েছে। বদলে গেছে আবেগের প্রাথমিকতা ও বিনোদনের রূপরেখাগুলি। গানের কাছে প্রত্যাশাটিই পাল্টে গেছে অনেক।

বিশ শতকের তিরিশ দশক থেকে বাংলাগানের প্রযোজনা আর একক স্রষ্টানির্ভর থাকেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুরকার ও গীতিকারের দায়িত্ব ভাগ হয়ে যায়। এর ফলে দেখা গেলো সুরকারই চালকের আসন পেয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তবেই গীতিকারের কিছু সুযোগ প্রাপ্তির সম্ভাবনা। যদি সংখ্যাতত্ত্বে যাই, তবে গত পঞ্চাশ বছরের বাংলাগানের সফলতম গীতিকার ছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, "...আমি কবি ছিলাম কি না জানিনা, তবে কৈশোর থেকে বুঝে নিয়েছিলাম, গান লেখা কবিতা লেখারই একটা অঙ্গ। এখনকার কবিরা আমাদের 'গীতিকার' আখ্যা দিয়েছেন। যার ফলে আমরা গীতিকার হয়ে গেছি, কবি হতে পারিনি।... আমি জানিনা, কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র আর গীতিকার প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পর্কে এঁদের কী ধারণা?" 'কবি' স্বীকৃতি পেলে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন সিদ্ধিলাভ হতো, জানা নেই। কিন্তু 'গীতিকার' হিসেবে তাঁর সাফল্য ও লোকপ্রিয়তা অধিকাংশ স্বীকৃত বাংলাকবির ঈর্ষার কারণ হতে পারে। তবু তাঁর স্বরে স্পষ্ট আক্ষেপ। কেন তাঁকে মানুষ কবি হিসেবে নেয়নি!  

https://www.youtube.com/watch?v=F4wkUOcrJAI

গতশতকে চল্লিশের দশক থেকে যাঁরা শুধু গীতিকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যেমন অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, সুবোধ পুরকায়স্থ, প্রণব রায়, হীরেন বসু, শ্যামল গুপ্ত প্রমুখ, প্রায় সর্বক্ষেত্রেই সুরকারের শর্ত মেনে গানে কথা বসাতেন। বাঘা বাঘা সুরকারের দল, যেমন, হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটক, অনিল বাগচি, শচীন কত্তা, দুর্গা সেন, কালীপদ সেন, গোপেন মল্লিক, নচিকেতা ঘোষ, রবিন চট্টোপাধ্যায়, এঁদের স্তরের স্রষ্টাদের দেখা যেতো হারমোনিয়ম নিয়ে বসে আছেন। সহকারীরা ঘিরে বসে। গীতিকার'কে বলে উঠলেন, "ও মশাই, মুখড়াটা এমন হবে, রিদম আর ফ্রেজগুলো এভাবে দেবো ভেবেছি। একটা জবরদস্ত কথা বসান তো।" গীতিকার, তিনি যতো'ই বরিষ্ঠ, প্রবীণ বা এলেমদার হোন'না কেন, তাঁর মাথায় শুধু তিন অক্ষর, চার অক্ষরের লাগসই শব্দের সন্ধান চলেছে। রিদমে পড়বে, সুরের ছাঁদে বেমানান হবে না। প্রয়োজনে 'কল্পনা' বদলে 'আলপনা' করে দেবার আদেশ আসতে পারে। পাঁচ অক্ষরে ফাঁক পড়লে 'দামালপনা'ও করে দেওয়া যায়। চ্যালেঞ্জটা খুব সহজ নয়। অন্য ধরনটায় ছিল পুরোনো হিসেব। গীতিকারেরা বেশ কয়েকটি গান বেঁধে সুরকারদের কাছে গচ্ছিত রাখতেন। তাঁরা সময়-সুযোগ মতো তাতে সুর বসাতেন। কিন্তু সেখানেও গীতিকারদের সুরের প্রয়োজনে কথায় অদলবদল করতে হতো।

আসলে কী হয় ব্যাপারটা, গান নিয়ে লিখতে গেলে যেটা সতত  মনে পড়ে, পৃথিবীর সর্বত্র তো কোটি কোটি রকম গান তৈরি হয়। কিন্তু যা টিকে থাকে, তা শেষপর্যন্ত দেখা যায় 'সঙ্গীত' হয়ে উঠতে পেরেছিলো। যন্ত্রসঙ্গীতের কথা বাদ দিচ্ছি। কারণ এই আলোচনায় তার প্রসঙ্গটি গৌণ। তার উল্লেখ থাকছে শুধু সহায়ক সুরস্রোত হিসেবে। কন্ঠসঙ্গীতের  ব্যাপারে সব চেয়ে প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে গলার সঠিক সুরসংস্থান। যে পর্দাটি ধরতে চাইছি সেটিকে ঠিকঠাক গলা থেকে বার করা। বাংলায় যাকে বলে ভয়েস ট্রেনিং। পাতিয়ালা ঘরের অজয়বাবুর কথা ভাবা যায়। ওঁদের ঘরানার সব থেকে জরুরি তালিম হচ্ছে এইটা।  কিন্তু এই বিষয়ে বেশি মনোসংযোগ করতে গিয়ে অনেক সময় ওঁরা গানের স্পিরিটটাকে দ্বিতীয় সারিতে রাখেন। এর ফলে গোললাইনের কাছে এসে কিরানা পার্টি মেরে বেরিয়ে যান। সবাই তো আর বড়ে গুলাম নন। আর বাংলা ব্যান্ড কোম্পানি প্রায় পুরোটাই 'স্পিরিট', সুরের তোয়াক্কা কেউ বিশেষ করেন না। কয়েকজন 'জনপ্রিয়' ব্যান্ডগায়ককে যখন খালি গলায় সামনে বসে গান গাইতে শুনেছি, তখন এই সীমাবদ্ধতাটিকে অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠতে দেখেছি। ইক্যুয়ালাইজার, মিক্সার, বাসকন্ট্রোল, সর্বোপরি ধমাধম ধমাধম কৃষ্টির ঢাক ছাপিয়ে অধম শ্রোতাদের কান পর্যন্ত যা পৌঁছোয় তা নিয়ে বিশেষ আশাবাদী হওয়া যায়না। অথচ মনে থাকে, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর কণ্ঠে নিধুবাবুর এই গানটি বাঙালি শ্রোতার মনের বারুদকে একদিন কীভাবে ট্রিগার করতো। কণ্ঠসম্পদ বা পেশকারি, কিছু বলা বাহুল্য মাত্র।

https://www.youtube.com/watch?v=THFqenViglk

শচীন কত্তা বলতেন যে সুরটা রিক্সাওয়ালাও গাইতে পারবে, তাই জনপ্রিয় হবে।  কিন্তু নিজে গানটা গাওয়াতেন রফি, কিশোর, মান্না, লতা, আশাকে দিয়ে, যাঁরা সুরসংস্থানের ঈশ্বর কোটীর মধ্যে পড়েন। এ ব্যাপারে কোনও আপোস নয়। তাই 'জনপ্রিয়' গান গাইতে গিয়ে যদি আমি জনতার গায়নক্ষমতার অনুকর করি, তবে 'প্রিয়তা' হয়তো আসে, 'গান' আসে না। বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গায়নপদ্ধতির স্কিলসেট দিয়ে বাংলা গান বিচার একটা অর্বাচীন লক্ষণ। যেমন অনেকে এখন রবীন্দ্রনাথের গানকেও মূল রাগের সুরসংস্থান অনুযায়ী ভাগ করে গাইতে চান বা পৃথকভাবে তার বর্গীকরণ করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, গানটি 'হয়ে' উঠছে কি না তা নিয়ে চিন্তা করা। না তার সুরের কাঠামো কোন রাগের আরোহ-অবরোহের সঙ্গে মিলছে, তা নিয়ে ব্যস্ত থাকা। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কাব্যগীতিতে লিরিকের সম্মান সুরের উপরে চলে গেছে। কিন্তু 'গান' যেহেতু 'গাওয়া' হয়, আবৃত্তি করা  হয় না, তাই সুরের প্রতি তন্নিষ্ঠ না থাকলে শেষপর্যন্ত সৃষ্টি দাঁড়াবে না। এ একটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ ও সংযমের খেলা। বাংলা গানটির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে যদি আমরা অপ্রয়োজনীয় ভাবে নিকটতম একটি রাগের আরোহ-অবরোহের বিস্তার করতে থাকি, তবে তা বিড়ম্বনার সূচনা করবে

গানের ব্যাপারে শুধু কানে শোনায় বিশ্বাস রাখলে, অর্থাৎ শোনার 'অভ্যেস'টুকুই যদি একমাত্র বিবেচ্য হয়, তবে আলোচনাটা হবে না। সেটা 'নিজস্ব' ভালো লাগা বা না লাগার পর্যায়েই থেকে যাবে। 'আমার' যা শুনতে 'ভালো' লাগছে, অন্যের তা না লাগতেও পারে। অতএব এই চর্চায় বেশি এগোলে শেষপর্যন্ত অহমবোধে আঘাত লাগার সম্ভাবনা থেকে যায়। সেটা বড়ো বিপজ্জনক। আমাদের কর্ণেন্দ্রিয়টি গানের ব্যাপারে বাহির দেউড়ি মাত্র। যা কানে শুনি, তা কতোটা মস্তিষ্কে জারিত হয়ে হৃদয়ে পৌঁছোচ্ছে, সেই পরিমাপ করতে গেলে সুর-অসুরের স্বভাবধর্মটা জানতে হবে। সেটা একটা উচ্চস্তরের গণিত পদ্ধতির মতো। সেই বিচারে অবিমিশ্র 'ভালো' বা 'মন্দ' কিছু হয় না। গোটা প্রক্রিয়াটিই তুলনামূলক বিচার।

এর উপর লোকপ্রিয়তার বালাই একধরনের 'স্টিমরোলার' (কবির উপমা ধার করলুম)। যা সচরাচর মেধাহীন ও নির্মনন। ভিন্নমত সহ্য করতে অপারগ। এমনিতেই আজকাল একটা প্রবণতা বেশ দেখতে পাই, যে কোনও ক্ল্যাসিসিজমকে এলিটিজম নাম দিয়ে গালাগাল দেওয়ার মুদ্রাদোষ। আরো বিপজ্জনক হলো ব্যক্তিগত বুদ্ধিহীনতার দায় সাব-অল্টার্ন সেরিব্র্যালিটির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। প্রবণতাগুলি অত্যন্ত ভুলভাল সময়ের বিষ। গানই বা বাকি থাকে কেন?

https://www.youtube.com/watch?v=VsIRB-7Lufk

এই মুহূর্তে আমাদের বাংলা লিরিকগান শোনার অভ্যেসটি বিশেষ দোলাচলের  মধ্যে আছে। উত্তম, দীক্ষিত শ্রোতারাও প্রায়শ খেই হারিয়ে ফেলেন। প্রায় চার দশক হয়ে গেলো, গৌতম চট্টোপাধ্যায় বাঙালির গান শোনার অভ্যেসটি পাল্টানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন। মহীনের ঘোড়া কিছু মানুষের বাংলাগান শোনার ধরনটা প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু যথেষ্টমাত্রায় অভ্যেসটি পাল্টাতে পারেনি। আড়াইদশক হয়ে গেলো সুমনের একক প্রচেষ্টা 'পাল্টে দেবার ইচ্ছে'টাকে অনেকদূর নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাও থেমে গিয়েছে। ভূমি, চন্দ্রবিন্দুর সাফল্যে ভাঁটার টান। প্রতুল মুখোপাধ্যায়, মৌসুমী ভৌমিক টেনে চলেছেন। এমন নয় যে এলেমদার সুরকার বা কথাকারের বিশেষ অভাব। বাঙালিদের মধ্যে সুর বা বাকসাধনায় এগিয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা চিরকালই যথেষ্ট। এই মুহূর্তেও সেই স্রোতে ভাঁটা পড়েনি। দুখুমিয়াঁর ভাষায় বলতে গেলে, 'মনের আমার পাইনে লো খেই, কী যেন নেই, কী যেন নেই'। এই অধমের ধারণা, বাংলাগানে একটা নতুন বাঁক দরকার। এতো ক্ষমতাশালী সুরকার, গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী রয়েছেন আমাদের। কিন্তু সবাই যেন ট্রায়াল-এন-এরর করে কাজ করে যাচ্ছেন। ‘নকল’নবিশ’দের কোলাহলে বাজার বধির। একশো বছর ধরে তৈরি করা বাংলা লিরিকগানের গ্র্যাণ্ড ডিজাইনটি বামিয়ানের বুদ্ধ হয়ে গেছে। বাঙালির গান শোনার অভ্যেস একটা নকটার্নে দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে। ততঃকিম? ইতর শ্রোতা হিসেবে আমাদের অপেক্ষাটি থেকে যাবে।  

https://www.youtube.com/watch?v=9fj0ukHnnzw

হয়তো একটাই জাদু, "হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে..."

 

 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন