প্রতিবেশী সাহিত্য
সুধা অরোরার গল্প
(অনুবাদ : মিতা দাশ)
লেখক পরিচিতিঃ
সুধা অরোরা
জন্মগ্রহণ করেন ৪ঠা অক্টোবর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের লাহোরে। অবশ্য তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরবর্তী সময়ে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি কলেজে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কর্মরতও ছিলেন। তিনি বহু
গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য Uncut (১৯৬৭), যুদ্ধক্ষেত্র (১৯৭৭), মৈথিলির মৈথিলি (১৯৮৭), ব্ল্যাক ফ্রাইডে (২০০৪), কাচের গ্লাস (২০০৫), রহোগি তোম ওয়াহি (২০০৭) ইত্যাদি। তিনি সম্মানিত হন বিভিন্ন পুরস্কারে - ইউপি হিন্দি ইনস্টিটিউট (১৯৭৮), ভারত নির্মাণ (২০০৮), মহিলা অর্জন পুরস্কার (২০১১), মহারাষ্ট্র হিন্দি সাহিত্য একাডেমী (২০১২), কেন্দ্রীয় হিন্দি পরিচালক পদক (২০১৩), ভারমানানী সমমান (২০১৪), মুন্সী প্রেমচন্দ্র কাঠ সম্মান (২০১৪),
মীরা স্মৃতি সম্মান (২০১৬) ইত্যাদি।
তারাবাই
বারোয়ারী বাড়ি -- ঘর নম্বর -- একশো পঁয়ত্রিশ
সেই বাঁঝা (বন্ধ্যা) মেয়ে লোকের
আটত্রিশ বছরের মরদ মারা গেছে আজ মাত্র চোদ্দ দিন হল। স্নান সারার পর নিঙড়ানো সায়াটা দিয়েই নিজের গোটা গা
মুছতে মুছতেই ওর চোখ পড়ল আয়নাতে।
সে আয়নায় জমাট ধুলো ভেজা আঙুল দিয়ে মুছে দিল।
সে চমকে উঠলো। সপ্তাহ, মাস, বছর গড়িয়ে গেছে - সে আয়না দেখেনি!
কতদিন আগে সে আয়না দেখেছিল? বোধহয় তখন ...
বিয়ের আগে ... যখন সে ক্লাস
ফাইভে পড়ত আর স্কু্লে যাওয়ার আগে চুলে ফিতে বাঁধতে হত ...
তখন সে আয়না দেখেছিল। আজ ওর মনে হল যে, সে আজ প্রথমবার আয়না দেখছে। আগে যখন সে আয়না দেখে চুল বাঁধত, তখন সে শুধু নিজের চুল দেখত আয়নাতে। আর যখন চোখে কাজল পড়ত, তখন শুধু নিজের চোখ দুটোই দেখত। আবার যখন কানে দুল পড়ত, তখন তো ওর চোখদুটো শুধু ওর কান দেখত। আজ সে প্রথমবার টুকরো টুকরোভাবে দেখা শরীরের
অঙ্গগুলিকে এক সঙ্গে আয়নায় দেখছে।
আয়নাটা বেশ আবছা আর ছোট ছিল। সে নিজের পায়ের আঙুলের ভর দিয়ে ওপর হল। খুব আস্তে ভাবে গায়ের ভেজা কাপড়টা সরাল। সে নিজের গলা থেকে নিচের শরীরটা কখনই দেখেনি আয়নায়। সে নিজেকে এক দৃষ্টিতে চেয়েই রইল, চেয়েই রইল। হঠাৎ যেন ওর পায়ের
তলা দিয়ে মাটি বালিতে বদলে গেল আর পা দুটি বালিতে ডুবে যেতে লাগল। সে দু’ হাত দিয়ে নিজের মাথা ধরে চোখ বন্ধ করে তলঘরে নেমে গেল। সে নিচে ডুবে যেতে লাগল, ডুবেই গেলো, এতটা ডুবে গেল যে
ওর ঠোঁট দুটি বালিতে কিরকির করতে লাগল, হৃদয়টা লাফিয়ে
হাথের তালুতে এসে হাজির। সে নিজেকে গুটিয়ে নিল আর একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে দুই হাতে নিজের বাম বুকের নিচের ধড়ফড়ানিটা উপভোগ করল। তারপর নিজেকে উপরে টেনে নিয়ে, মাটিতে নিজের পা’কে সন্ধান করল আর বুকের কম্পমান হা্তের তালুর বন্ধন থেকে রেহাই দিল। এখন ওর আঙুলগুলি বুকের নতুন ও পুরনো জখমগুলিতে হাত বুলোতে লাগল। বুকে দুটো জায়গায় ও
আরও অনেক জায়গায় বেশ কালো কালো ও খয়রি খয়রি কালশিটে
দাগ পড়ে গিয়ে গর্ত হয়ে গেছিল। শেষ দাগটি পনেরো দিন পুরনো ছিল, সেই তখনের দাগ যখন ওর মরদ সহবাসের পর বিড়িটা ধরালো আর শেষ ধোঁয়াটা টান মেরে জ্বলন্ত বিড়িটা বাম বুকে বসিয়ে দিইয়েছিল। সে যখন ব্যথায়
ডুকরে উঠেছিল, ওর মরদ খৈনি
রাঙানো দাঁত বার করে হেসেছিল। যত ক্ষণে সে জোর করে সিগারেটা সরাতো, বিড়ির টুকরোটা চামড়ার ভেতর অব্দি ঢুকে গিয়েছিল। সে ব্যথায় আক্রান্ত, কিন্তু তার ডানহাত সে মোচড় দিতে ছাড়ল না। তাও তার মরদ আরো জোরে হেসে উঠেছিল। বিড়ি বা সিগারেট
ধরিয়ে ওর শরীরে যখন তখন যেখানে সেখানে পোড়ানো বা দাগ দেওয়াটা ওর মরদের যেন একটা খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
“তোর গোটা শরীরে কুষ্ঠ ছড়ায় যেন,
মরার সময় যেন তোর মুখে কেউ এক ফোঁটা জল না দেয়”। ওর মুখ থেকে শুধু গালমন্দ ঝরত। কিন্তু ওর মরদ ততক্ষণে পিঠ ঘুরিয়ে নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়ত। ঘরটা নাক ডাকার
শব্দে ভরে যেত। ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠত। ওর মরদের
খিলখিল হাসি আর নাক ডাকার শব্দে বিশেষ কোন তফাত আছে বলে মনে হত না।
০০০
আর সেইদিন সে ভায়খালা’র লোকাল দুর্ঘটনায় ওর মরদ আর ফিরলনা ... ফিরল ওর লাশ, কিন্তু ওর বিশ্বাস হল না। ওই
ঘরে ওর মরদের লাশ পড়েছিল, ঘরের ছাদ থেকে টিপটিপ করে
বর্ষার জল গড়িয়ে ওর শরীরে পড়ছিল। ঘরের দেয়ালে ঝুলন্ত ওর রঙচটা কাপড়চোপড় ও নাক ডাকার
শব্দ এখনো মিলেমিশে রয়েছে।
ওর বুকে গত রাতের তরতাজা ঘা’গুলো আগের চেয়েও বেশি ব্যথায় ভরে উঠেছিল। সে চীৎকার করে কেঁদে উঠল, কে জানে কেন এতো কান্না, জখমের ব্যথায়, নাকি মরদের
মৃত্যুতে! ছাদের জল ও চোখের জলের ভেতর যে কখন দেহটা তুলে নিয়ে যাওয়া হল, বোঝাই গেল না। সে কালো দানাওয়ালা মঙ্গলসূত্রটা গলা থেকে নামিয়ে দেয়াল আলমারিতে তুলে রাখল। ঠিক চারদিন পর সে নিজের কাজে বেরিয়ে পড়ল।
০০০
ফেরত আসার পর ঘরটা তার বেশ বড় বড় লাগল। এবড়ো খেবড়ো মেঝেটায় হাঁটু দিয়ে
হামাগুড়ি দিচ্ছে এমন একজোড়া ছোট পায়ের আনাগোনার ইচ্ছেগুলো ঘরের এ কোণ ও কোণ থেকে বেরিয়ে এসে গোটা
ঘরটাকে ভূতুড়ে করে তুলছিল। এই ঘরটা আগে দু’জনের ভিড় বলে মনে
হত, কখনও ওরা নিজেরা ঠোকাঠুকি করত
আবার কখনও একজন আরেকজনকে
এড়িয়ে চলতো। এরপর দিনগুলিও বড় মনে হতে লাগল। কাজ থেকে ফিরে এসে সে প্রত্যেক দিন
মেঝেটাকে ঘষে ঘষে মুছতো, কিন্তু একটি আজব গন্ধ থমকে
থাকা সময়ের মত এমন করে বসেছিল যে যাওয়ার নামই করে না কখনও। যখন রাতে কাজ থেকে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে খাটে শুতে যেত তখন ছাদে দেয়ালে ঝোলানো নাক ডাকার শব্দগুলি নিচে
নেমে আসত আর ওকে ঘিরে
ধরে। ছাদের ফাঁকফোকর দিয়ে বর্ষার জলের মত ওর মরদের খিলখিল হাসি ঝরতে থাকত অনবরত। ওর রোজ একটা করে নতুন ঘায়ে ফুটন্ত জলের তীব্র ধারা ঝরে পড়তে থাকে আর সে চমকে উঠে বসে।
০০০
সে নিজের মরদের সব জিনিসগুলি
নিজের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রাখল। দেশী মদের বোতলটা দরজার বাইরে বের করে দিল আর
দেয়ালের পেরেকে ঝোলানো জামাটা খাটের তলায় ফেলে রাখা কাপড়ের ভেতর গুঁজে দিল। তারপর সেই পেরেকে পুরনো আয়নাটা ঝুলিয়ে দিল। এটা সেই আয়না যেটাতে সে লাফিয়ে শুধু নিজের চুল বা নাকটাই
দেখতে পারত। এখন সেই আয়নাটা না চাইতেই যখন তখন
ওর সামনে এসে পড়ত।
আয়নায় দেখতে দেখতে সে নিজের বুকের শুকিয়ে আসা ঘা-এর পাপড়িগুলিকে একটু করে ছোলার চেষ্টা করতেই তার ভেতর থেকে লাল রক্তের ফোঁটা ছলছল করে উঠল।
তার মনে হয়েছিল যে, ঘা শুকিয়ে উঠেছে। কিন্তু ঘা এখনও ভেজা। সে নিজের ভেজা সায়াটা দিয়ে বুকের রক্তের ফোঁটা মুছে নিল, আর সেই সায়াটা দিয়েই আয়নাটা ঢেকে দিল এবং আয়নার সামনে থেকে সরে গেল।
০০০
কাপড় পড়ার পর সে দেখল, জানলার উঠে যাওয়া কালো কাঠের ফাঁকের ভেতর থেকে ছোট ছোট তেলেপোকা ওর মরদের চোদ্দদিন
ধরে রাখা দাঁত মাজার ব্রাশের ওপর
হাঁটাচলা করছে। তার পাশে সিগারেটের খালি প্যাকেট পড়ে ছিল। সে ওটা মুড়ে
ফেলতে গিয়ে দেখল, তাতে একটি শেষ সিগারেট এখনও আছে।
সে সিগারেটটা ধরালো আর নিজের মরদেরই মতো একটা টান মারল। তারপর আর একটা। শেষে সে একের পর এক
টান মারতে মারতে একটা পাগলামিতে মেতে উঠলো আর তারপর সিগারেটের টুকরোটা নিজের পেটে চেপে ধরল। পেটের
নরম চামড়ায় আগুনের ছ্যাঁকা লাগতেই একটা চিৎকার গোটা ঘরে আর ছাদে ছড়িয়ে পড়ল। তার চোখের কোণায় জল ছলছল করে উঠলো। হঠাৎই কান্নার রোল উঠল, তার কান্নায় সব ভেসে গেল।
০০০
কান্নায় ভেঙ্গে পড়ায় সে বেশ
ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এবার সে শান্ত হল। কান্নাভরা চোখে সে খাটের দিকে তাকালো। সেখানে তার মরদের আবছা আবছা চেহারা আর পা দোলানো দেখতে পেল। আর দেখল, তার চেহারার
নির্মম হাসি ... আয়নার মতোই
পরিষ্কার।
অনুবাদক পরিচিতি :
জন্মতারিখ ১২ জুলাই ১৯৬১ মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে। বর্তমানে বসবাস ছত্তিশগড়ের ভিলাই শহরে। একাধারে কবি, গল্পকার,
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সম্পাদক। হিন্দি ও বাংলা দুই ভাষায় সমানভাবে লেখালেখি
ও অনুবাদ করেন। হিন্দিতে তাঁর অনুবাদ সংকলন ‘কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের প্রতিনিধি কবিতা’। বাংলায় নিজস্ব কবিতা সংকলন ‘অন্তরমম’। এছাড়া হিন্দি কবিতার বাংলায় অনুবাদের সংকলন ‘ভারতীয় ভাষার অঙ্গনে’।
সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন হিন্দি ভাষায় খুবচাঁদ বাঘেল সম্মান, মহাত্মা গান্ধী
রাষ্ট্রীয় ভাষা প্রচার-প্রসার সম্মান এবং বাংলা ভাষায় কবি রবীন সুর সম্মান (শিলিগুড়ি)।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন