ইতিহাসের জেরোনিমো
(২)
১৮৯৪ সালে বিরসা মুন্ডা এক
তেজস্বী যুবক রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর দৃঢ় চরিত্র, সুন্দর সুঠাম তথা লম্বা
শরীর, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, উজ্জ্বল চোখ সকলেরই সে সময় দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি
নিজেকে বলতেন ‘ঈশ্বরের দূত’। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মুক্তি তথা অধিকার ফিরিয়ে দেবার
শপথ নেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সকলে
বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, তাঁর স্পর্শে অসুস্থ মানুষও সুস্থ হয়ে ওঠে। কালক্রমে
মানুষ তাঁকে ঈশ্বরের দূত নয় বরং স্বয়ং ‘ঈশ্বর’ হিসেবে দেখতে শুরু করেন। ‘ধরতি আবা’
বা বিশ্বপিতা ছাড়াও তাঁকে ‘ভগবান বিরসা’ রূপেও মান্য করতে থাকে। বিরসা বুঝতে পারেন
যে জমিদার, জোতদার, ঠিকাদার ও মহাজন সম্প্রদায় আদিবাসীদের শত্রু, তবে তার চাইতেও
বড় শত্রু ব্রিটিশ সরকার। এই ব্রিটিশ সরকারকে সমূলে উৎখাত না করতে পারলে যে এই
অমানবিক শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্তি নেই! তিনি তা উপলব্ধি করেছিলেন আর তাই তিনি ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ‘উলগুলান’ বা সংগ্রামের ডাক দেন। তাঁর এই ডাক মন্ত্রের
মতো কাজ করেছিল। হাজার হাজার আদিবাসী নর-নারী তাঁদের পরম্পরাগত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে
তাঁর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। এক সশস্ত্র সৈন্যদল গঠিত হয়। এবং তাঁরা ১৮৯৫
খৃষ্টাব্দে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
১৮৯৫ সালে ভারতে জোঁকের মতো
গেড়ে বসে থাকা ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। দু’বছরের জন্য কারাদন্ডে
দন্ডিত করা হয় তাঁকে। কারাগারে থাকাকালীন বিরসা মুন্ডার মুক্তি সংগ্রামের সংকল্প
আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। কয়েদখানা থেকে মুক্তি পাবার পর তিনি বেশ কিছুকাল লোকচক্ষুর
আড়ালে; গোপন আস্তানা থেকেই আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে আরও বেশি আত্মনিয়োগ করেন।
বলাই বাহুল্য তাঁর এই উলগুলানের মূল উদ্দেশ্য ছিল জমিদার, মহাজন ছাড়াও শক্তিশালী
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করা। তাঁর এই ধ্যান-ধারণা বা সশস্ত্র উলগুলানের ডাক
তৎকালীন শোষিত আদিবাসী সমাজকে বিদ্রোহের আগুনে তপ্ত করে তুলেছিল। বস্তুত সেই
আন্দোলন যখন সংগঠিতভাবে আছড়ে পড়ে, তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর জমিদার,
মহাজন, মিশনারির মধ্যে কার্যত থরহরি কম্পন দেখা যায়। আন্দোলনের ছক কষে দূরদর্শী
বিরসা মুন্ডা বিদ্রোহে সামিল জনতাকে দুইভাগে বিভক্ত করেন। এক দলের ওপর
যুবক-যুবতীদের সৈন্যদলে ভর্তি করে পরম্পরাগত অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ
দেবার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর অপর দলটির কাজ ছিল প্রশিক্ষিত তথা অস্ত্র চালনায়
পারদর্শী যুবক-যুবতীদের নিয়ে শক্তিশালী টুকরি গঠন করা।
১৮৯৯ সালের ২৪শে ডিসেম্বর
অর্থাৎ খ্রিষ্ট-মাসের পূর্ব সন্ধ্যায় সশস্ত্র সংগ্রামের দিন ধার্য করা হয়। পূর্ব
নির্ধারিত দিনেই আদিবাসী সৈন্যদল আক্রমণ শুরু করে। প্রথম দিকে ‘খুঁটি’, ‘জমার’,
‘বাসিয়া’ ও ‘রাঁচি’র পুলিশ চৌকির ওপর আক্রমণ করা হয়। এই সংঘর্ষের ফলে ৮জন পুলিশ
নিহত হয়। ৩২জন কোনোক্রমে পালিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচায়। ৮৯জন জমিদারের ঘরবাড়ি
ভস্মীভূত করার সাথে সাথে বহু চার্চ ও ব্রিটিশ সম্পত্তির ক্ষতি করা হয়। বহু ব্রিটিশ
নাগরিক প্রাণভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় বা আত্মগোপন করে নিজেকে রক্ষা করে।
বিদ্রোহের আঁচ এতই তীব্র আকার ধারণ করে যে চতুর্থ দিনই রাঁচির তৎকালীন ডেপুটি
কমিশনারকে পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য সৈন্যদলের শরণাপন্ন হতে হয়। সংঘর্ষের প্রথম
ধাপ শেষ হয় ৫ জানুয়ারী। পরদিনই অর্থাৎ ৬ জানুয়ারী শুরু হয় সংঘর্ষের দ্বিতীয় ধাপ।
জমিদার মহাজন ছাড়াও ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের যে প্রাঞ্জল শ্লোগানটি বিরসা মুন্ডা
দিয়েছিলেন, তা হলো – “শেষ করো ভিক্টোরিয়া রাজতন্ত্র, স্থাপিত হোক ‘অবুয়া রাজ’!” এই
সংগঠিত আন্দোলনের ফলে বহু অত্যাচারী ব্রিটিশ অফিসার ও পুলিশ আদিবাসীদের বিষাক্ত
তীরের আঘাতে নিহত হয়। পরম্পরাগত অস্ত্রশস্ত্র সহ জঙ্গলকে আড়াল করে তথা ছোট ছোট দলে
বিভক্ত হয়ে আন্দোলনরত আদিবাসীরা শত্রুপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁদের এই অনবদ্য
আক্রমণ পদ্ধতিই সম্ভবত বিশ্বের সর্বপ্রথম ‘গেরিলা যুদ্ধ’।
আন্দোলনের ধারা তীব্র থেকে
তীব্রতর করে রাঁচি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরত্বে (রাঁচি-জামশেদপুর সড়কের পাশে)
‘ডোমবারী’ পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে বিরসা বাহিনী একাধিক অত্যাচারী পুলিশ ও সৈন্যদের
হত্যা করে। ভস্মীভূত করা হয় তাদের ঠিকানাও। এই আক্রমণে বিপর্যস্ত ও আতঙ্কিত
ব্রিটিশ প্রশাসনও নড়ে চড়ে বসে। নানাভাবে বিদ্রোহ দমনের ছক কষতে থাকে তারা।
এমতাবস্থায় ব্রিটিশ প্রশাসনের এক কমিশনার এ. ফোব্স ও ডেপুটি
কমিশনার এইচ. সি. স্টেটফিল্ড বিদ্রোহ
দমনের জন্য দু’ কোম্পানি ফৌজ নিয়ে খুঁটির (রাঁচির কাছে) দিকে অগ্রসর হয়। বিরসা মুন্ডাকে
জীবিত অথবা মৃত ধরে আনতে পারলে ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়, সেইসঙ্গে বাড়িয়ে
দেওয়া হয় সাধারণ আদিবাসীদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা। আন্দোলনকারীরা তবুও দমে যাবার
পাত্র নন। দমে যাবার মতো মানুষ নন বিরসা মুন্ডাও। বরং ব্রিটিশ প্রশাসনের এহেন
আচরণে উলগুলানে দীক্ষিত মানুষগুলো যেন আরও বেশি ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। পারম্পরিক
অস্ত্রশস্ত্র সম্বল করে গেরিলা কায়দায় তাঁরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রাণের বাজী
রেখে। অতঃপর ব্রিটিশ প্রশাসনের নির্দেশে তাদের পেটোয়া সৈন্য ডোমবারী পাহাড় ঘিরে
আন্দোলনকারীদের ওপর এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করে। ব্রিটিশ বাহিনীর এই আক্রমণ একমাত্র
জালিয়ানবালাবাগের সঙ্গেই তুলনীয়।
আদিবাসী বীর যোদ্ধারা তাঁদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত
লড়াই চালিয়ে ছিলেন। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে
তাঁরা সেই রণে পেরে উঠতে পারেননি। ১৯০০ সালের ২৫ মার্চ ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার
একটি কলাম থেকে জানা যায়, সেই সংঘর্ষে প্রায় ৪০০ জনেরও বেশি আদিবাসী যোদ্ধা শহীদ
হন তার সিংহভাগ মৃতদেহই পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া হয় খাদে, যাতে সেগুলি পশুখাদ্য হয়ে
প্রমাণ লোপাট হয়। এই সংবাদপত্রটি মারফৎ আরও জানা যায় যে, আন্দোলনকারী বহু যোদ্ধাকে
জীবন্ত দগ্ধ করা হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই নারকীয় ঘটনার পর থেকে অভিশপ্ত
ডোমবারী পাহাড়টিকে ‘টোডেপবুরু’ অর্থাৎ মৃতদেহের পাহাড় নামে আখ্যায়িত করা হয়। তবে
বিরসা মুন্ডার গায়ে তারা সেই সময় পর্যন্ত কিন্তু আঁচড়টি কাটতে পারেনি।
এই সফলতার পর ব্রিটিশ পুলিশ বিরসা মুন্ডাকে হন্যে হয়ে
খুঁজতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯০০ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি চক্রধরপুরের কাছে জামকোপাই
জঙ্গল থেকে অতর্কিতে তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় গ্রেফতার করে। এই খবরটি জানতে পারা যায়
তৎকালীন রাঁচির ডেপুটি কমিশনারের ১২ই নভেম্বর ১৯০০ সালের (পত্র সংখ্যা : সি. আর.
১৩৯৭) লেখা চিঠি থেকে। এই সময় আন্দোলনরত বহু আদিবাসী সৈন্যকে গ্রেফতারও করা হয়। ৬৮
জনের শাস্তি হয়। তাঁদের মধ্যে ৩৯ জনকে আজীবন কালাপানি ও ২৩ জনকে ১৪ বছরের জন্য
কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। বিরসা মুন্ডা সহ ৬ জনকে চরমতম শাস্তি হিসেবে শোনানো হয়
ফাঁসির সাজা।
বিরসা মুন্ডার ফাঁসির সাজা হলেও ১০ মাস ধরে কেসের
প্রহসন চলাকালীন ব্রিটিশ পুলিশের বর্বর অত্যাচারে মাত্র ২৫ বছর বয়সেই স্বাধীনতা
আন্দোলনের বীর সেনানী, আদিবাসী মুক্তি আন্দোলনের জনক ভগবান বিরসা মুন্ডার
জীবনপ্রদীপ অকালে নিভে যায়।
১৯০০ সালের ৯ই জুন রাঁচি জেলের অভ্যন্তরে বিরসা মুন্ডাকে
হত্যা করা হলো, কিন্তু তাঁর জ্বালানো বিদ্রোহের আগুনকে নেভাতে পারেনি ব্রিটিশ
প্রশাসন। নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন চলতেই থেকে।
অতঃপর সমস্ত পরিচিতি বিবেচনা করে ব্রিটিশ প্রশাসন
১৯০৮ সালে ছোটনাগপুর এলাকায় ‘কাস্তকারী’ আইন বলবত করে। এই আইনে আদিবাসীদের জমির
ওপর অধিকার দেওয়া হয় ও তার সুরক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়। মাত্র ২৫ বছরের জীবদ্দশায়
এবং মাত্র ৫ বছরের সংগ্রামী সংকল্পে বিপ্লবী বিরসা মুন্ডা আদিবাসীদের মধ্যে
আত্মসম্মানবোধ দারুণভাবে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই আন্দোলনের শতবর্ষের
আলোকে ‘ঝাড়খন্ড’ একটি আলাদা রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, এ কম বড় কথা নয়। এতে
আদিবাসীদের স্বপ্ন কিছুটা হলেও যে সফল হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন