ভাইরাস মতাদর্শের
সন্ধানে…
প্রথমত আমি ঝাঁকিদর্শনে অভ্যস্ত নই, দ্বিতীয়ত মতাদর্শগতভাবে
রিভিউ নামক ক্রিয়ার বিপরীতে অবস্থিত এই বই। রিভিউয়ে যে পুনরাবৃত্তির সম্ভবনা থাকে, যে ‘রি’
নামক পূর্বযোজনটি অনুষ্ঠিত হতে চায়, তাকে ব্যাহত করে এই বইয়ের মুল সুরটি। অতীতের
আবর্তন নয়, বরং তাকে মুছে ফেলা, সাজানো ফাইল সমূহের কোরাপ্ট হয়ে যাওয়া, সভ্যতার
ফরম্যাটিং-এর আশু প্রয়োজন এই গপ্পের আধার। জঁর সমালোচনায় না গিয়েও একে প্রচলিত
সার্বিক জীবনের এক দীর্ঘ ছবির অঙ্কে নভেল বলতে দ্বিধা হয়, তবে প্রয়াস হিসেবে বেশ
নতুন তো বটেই — সেই অর্থে নভেল।
এই গপ্পে নতুন কী? নতুন কী মানে নতুনের কী নতুন ধারণা আছে?
নতুনের ধারণা এখানে প্রচলিত যে অতীত তাকে
হারিয়ে ফেলা, পৃথিবীকে অপার্থিব করে তোলা, তাই এর নাম হয়তো বা ‘অপার্থিব’।
অ-পার্থিব। পৃথিবীর যে ধারণা আমাদের স্মৃতি জুড়ে, যে ভূত ও ভবিষ্যৎ আমাদের সমস্ত স্বপ্নকে
হানা দেয় তাকে মুছে ফেলাই তো আসলে অ-পার্থিবকে আহ্বান — তাই তো এক নতুন পৃথিবী। এই
বইয়ের সব থেকে দৃঢ় প্রত্যয় — অপার্থিব আসলে অপার্থিব নয়, বহিরাগত নয়; সভ্যতার, সমাজের, সংস্কৃতির, জাতির অস্তিত্বের কাছে
ত্রাসের নয়। হয়তো বা যাদবপুরের ক্যাম্পাসে ছাত্র আন্দোলনের মুহুর্মুহু তরঙ্গ
চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক — ‘অপার্থিব’ বইয়ের লেখক অনিন্দ্য সেনগুপ্তকে ভাবিয়েছে
ছাত্র-শিক্ষকের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর-বাহিরের বিভাজনগুলিকে। শাসকের, প্রশাসকের
ভাষা যখন বহিরাগতর ভয়ে ত্রস্ত, নিজের ইহকাল বাঁচাতে মরিয়া — শাসনতান্ত্রিকতার
কাঠামোয় যাদের খাপ খাওয়ানো যায় না, সেইসব খাপছাড়া বিপজ্জনক ভাইরাসদের ক্লিন করতে
যখন সিস্টেম বদ্ধপরিকর, তখন অনিন্দ্যর বই
আমদানী করে এক ভাইরাস আইডিওলজি। শাসকের
তাসের দেশে নিয়মের বিপরীতে নয়া ভাবাদর্শ
স্থাপন যদি নাই বা করা যায়, তবে
প্রয়োজনে নিজেদের মস্তিস্কের ময়লা পরিশুদ্ধ করতে লিখনের মুছে দেওয়া। জেনে শুনে জরদ্গবে পরিণত হওয়ার এক ভিন্ন রাজনীতির পথ বাতলায় এই বই।
গল্পের নায়ক দারিয়াস মজুমদার একজন এথিকাল হ্যাকার, একজন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলতায় বিশ্বাসী।
তাকে পাঠানো হয় করোনা নামক পৃথিবীর সমতুল গ্রহে। রহস্য দানা বাঁধে। স্পষ্ট হয় না, সেই
গ্রহ ঠিক কত দূরে, সত্যই সেখানে যেতে গেলে ওয়ার্মহোলের মধ্যে প্রবেশ করতে হয় কি না
মহাকাশযানকে। দারিয়াস নির্বাসন দণ্ড পেতে পারত, পরিবর্তে তাকে পাঠানো হয় করোনা গ্রহে
একটি মিশনে। সেখানে কর্মরত বিজ্ঞানীরা একে একে জরদ্গবে পরিণত
হচ্ছিলেন। মানব নির্মিত
নিয়মের নেটওয়ার্কগুলিকে জঁরে পরিণত করা যার নেশা ও পেশা তার ওপর
দায়িত্ব পরে জরদ্গবে
পরিণত হওয়া বিজ্ঞানীদের আসন্ন শূন্যতার হাত থেকে রক্ষা করার। সাথিহারা দারিয়াস সেখানে
সম্পর্ক স্থাপন করে বিজ্ঞানী ইকিরার সাথে। রহস্যের সমাধানে ব্যর্থ দারিয়াস সব কজন বিজ্ঞানীকেই
ফেরাতে চায় পৃথিবীতে, শুধু একা থেকে যেতে চায় করোনায় — রহস্য
সমাধানে অথবা অসমাধানে। ইকিরা আত্মহত্যা করে। আত্মহননের দর্শন ছড়িয়ে এই বইয়ে। দারিয়াসের
পূর্বতন প্রেমিকাও ধরা না দিয়ে আত্মাহুতি দেয়। মানুষের ভবিতব্যও কি এমনি আত্মহনন, সভ্যতার
সংকটের মুখে? ভাইরাস আসলে কী? ভাইরাস কি প্রোগ্রামের আকারে আসলে সিস্টেমের মধ্যেই গোপন
অন্তর্ঘাতের বীজ নয় যা আবার সিস্টেমেরই অঙ্গ হয়ে ওঠে? অনেক সময় ভাইরাস মুক্ত করতে সিস্টেমকে
আত্মধ্বংসের দিকে যেতে হয় ফরম্যাটিং-এর মাধ্যমে। মুছে যায় জমা তথ্যভান্ডার, স্মৃতি।
অনিন্দ্য এই বইয়ে এক অন্য আত্মহত্যা আঁকেন। আত্মত্যাগ সেখানে বীরত্বের চিহ্ন নয়, আত্মবিসর্জন
আসলে সেখানে স্মৃতির ক্ষয়। জাতীয়তাবাদ, মার্ক্সবাদ, আত্মপরিচয়ের রাজনীতিতে যে বীরত্বের
গাথা বারংবার রচিত, সেখানে নূতনের আহ্বান উপর্যুপরি গতিরুদ্ধ হয় অতীতের কাছে। যে স্মৃতি
প্রতিরোধের চালিকাশক্তি, সেই অতীতই স্থবির করে মানুষের মুক্তির, এবং সভ্যতার যাবতীয়
জঞ্জালমুক্তির স্বপ্নকে। স্মৃতির জন্য নয়, বরং স্মৃতির থেকে আত্মহননের ছক কষেন অনিন্দ্য।
দারিয়াসের ভাইরাস মতাদর্শ আসলে সিস্টেমের ভিতরেই সিস্টেমকে জরদ্গবে পরিণত করার ভাবকল্প। এমনকি দারিয়াস এখানে এক ব্যর্থ নায়ক,
বিজ্ঞানীদের জরদ্গবে পরিণত হওয়ায় তার কিছু করার থাকে না। শেষপর্যন্ত সে এই আত্মহননের
প্রক্রিয়ায় নীরব দর্শক ও সমর্থক হয়। মানুষের স্মৃতির রোম্যান্টিক মেদুরতা ও অটোনমির
দুটি প্রকাণ্ড মিথকে এই ভবিষ্য-কাহিনিতে সমূলে আঘাত করতে চেয়েছেন অনিন্দ্য। করোনা আসলে
পৃথিবীর অতীত অবস্থা শুধু নয়, তা ভবিষ্যৎ সম্ভবনাও। এভাবেই শূন্য থেকে শূন্যে ছুটে
চলার মাঝে যে সব কথকতা জমে ওঠে তার মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে এক মিথিক দুনিয়ায় কাল অতিবাহিত
করি আমরা। শূন্যতা তো দার্শনিকভাবে আমাদের বেঁচে থাকার নিয়মের ও দৈনন্দিনতার ছকগুলিকে
সমস্যায়িত করে।
অনিন্দ্যর লেখাকে অনেকে পলিটিকাল সায়েন্স ফিকশন
বলছেন। আমি এর নাম দিলাম ভবিষ্য-কাহিনি। It takes us back to the future। করোনা আমাদের
অতীত। করোনা আমাদের ভবিষ্যৎ। শেষে দারিয়াস
করোনার জরদ্গব বিজ্ঞানীদের মহাকাশযানে পাঠিয়ে দেয় পৃথিবীতে। এই কি অপার্থিবের সুচনা?
এই কি তবে পৃথিবীর যাবতীয় বানানো মূল্যগুলি জলাঞ্জলি দিয়ে, অতীতকে মুছে ফেলে পৃথিবীর
অ-পার্থিবায়ন? প্রসঙ্গত যে কোনো সাইফাই গল্পে আমরা দু’ধরনের এলিয়েন
মূলত পাই — এক, শত্রুভাবাপন্ন যারা মানব সভ্যতাকে আক্রমণ করে;
দুই, বন্ধুভাবাপন্ন যারা মানুষের উপকার করতে আসে। এই ব্যবধান অনিন্দ্য মিলিয়ে দিয়েছেন,
ঠিক যেমন বেঁচে থাকার প্রকাণ্ড পরিকল্পনায় যন্ত্রবৎ মানুষের মাথার ভিতরের সব তথ্য মুছে
মৃত্যু ও জীবনের ভেদগুলিকে প্রশ্ন করেছেন তিনি। করোনার মূক ভাইরাস সদৃশ ভীনগ্রহীদের
বহন করে পৃথিবীর মানুষ কি শাপমূক্ত হবে তার যাবতীয় স্মৃতি বিসর্জন দিয়ে? করোনা থেকে
জরদ্গব বিজ্ঞানীদের নিয়ে যন্ত্রযানের উত্তরণের মূহূর্তটিই সেই
অনাগত ভবিষ্যৎকে নির্দিষ্ট করে। বইটা ওখানেও শেষ হলে পারত। এরপর আলাদা করে দারিয়াসের একাকিত্বময় নির্বাসনের
রোম্যান্টিকতার আর কি কোনো প্রয়োজন ছিল? অধ্যাপক অনির্বাণ দাশের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়
উঠে এসেছিল এই প্রশ্ন। ব্যক্তির সমাজ ও সভ্যতাকে ছুঁড়ে ফেলার রোম্যান্টিক কল্পনা তো
বহু পুরাতন। আমরা বরং ভাবতে চাইব অনিন্দ্যর বইয়ে সেই অনাগত গোষ্ঠিকে যারা ভাইরাস আক্রান্ত
হয়ে ভুলতে চায় অতীতের যাবতীয় আকর। আমরা কি চেয়ে থাকব না এমন এক পোস্ট-কমিউনিটির দিকে
যা স্মৃতি নির্ভর নয় বরং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অঞ্চল ও বিবিধ পরিচয়ের শাসনতান্ত্রিক ছক-অতিক্রান্ত? আমরা কি অপেক্ষা করবো না সেই নয়া ইন্টারন্যাশেনালের?
অপার্থিব
অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
ISBN: 978-81-933877-0-2
প্রথম প্রকাশ : মে, ২০১৭
প্রকাশক : বৈভাষিক প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : অভীক কুমার মৈত্র
মূল্য : ১৮০ টাকা
প্রাপ্তিস্থান : দে’জ; ধ্যানবিন্দু; দে বুক
স্টোর (দীপু);অভিযান; চক্রবর্তী-চ্যাটার্জী; দে বুক স্টোর (আদি); কাফে কবীরা;
‘স্টাডি’ (যাদবপুর কফি হাউসের নিচে); ‘স্টাডি’ (যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস
বিল্ডিং-এ লিফটের পাশে); অক্সফোর্ড বুক স্টোর; স্টোরি (এলগিন রোড); দিল্লি: মুক্তধারা; বেঙ্গালুরু: ফেভারিট বুক
স্টোর; বাংলাদেশ: বাতিঘর, তক্ষশীলা, পাঠক সমাবেশ, প্রথমা;
উত্তরবঙ্গ: সরাসরি প্রকাশকের মাধ্যমে; অনলাইন: www.dokandar.in ; www.readbengalibooks.com
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন