জীবনের যে সব অভিজ্ঞতা খুব একটা শেয়ার করা হয়না, সেগুলি বার বার ব্রেনে মেসেজ দেয়। হয়ত কখনো বেদনার ভারে নত হতে হয়,কখনো আনন্দের ফোয়ারায় ভেসে যায় দুকূল। তবু ফিরে ফিরে সেই স্মরণঘাটে নাও নোঙরের চর্চা। সাধারণত মেয়েদের দাম্পত্য নিয়ে সিরিয়াস কোনো কথা বলার বিষয়ে এক অলিখিত পারিবারিক বিধিনিষেধ জারী আছে। যারা বলে তাদের বেহায়া বা ঠোঁটকাটা বা নির্লজ্জ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। সহবাস নিয়ে তো বলা মানে ডাকাত বা লম্পটের দৈন্যতা বা রুচির নিম্নতায় নিজের অবতরণ ঘটানো। সহবাসের ক্ষেত্রে পুরুষই ঈশ্বর তাকে খুশী করে তোলা ভক্ত বা সাধ্বী সহধর্মিণীর কাজ। দেবতা বলে দেবেন তিনি কি চান, কেমন করে চান তার পরিবেশনায় সদাপ্রস্তুত রমণী যাকে শেখানো হয়েছে পতিসেবা তার মৌলিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। অমান্যে অশুভ সংকেত,পারিবারিক অমঙ্গলের ফতোয়াl কখনো ঈশ্বর রুষ্ট হয়ে অপর দুরন্ত ভক্তের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে বলে হুমকি দিয়ে দেন। জো হুজুরি তখন আরো আর্জেণ্ট এক পালনীয় দায়িত্ব হয়ে ওঠে নারীর, কিন্তু অশ্লীলতার এই থ্রেডের বিরুদ্ধে হুংকার নয় বশ্যতাকেই হাতিয়ার করে নারী l
স্বামী গৃহে নিজের ইমোসনকে হত্যা করে নিজেকে ধরে রাখার যে শিক্ষা তা বিদ্যালয়ে কোনো সিলেবাসে পড়ানো হয় না। কিন্তু মেয়েরা শিখে ফেলে। বদমেজাজী স্বামী কখনো স্ত্রীকে প্রকাশ্যে হেনস্থা করে, গায়ে হাত তোলে, স্ত্রী তা নীরবে মেনে নেয় কেননা সে বিশ্বাস করে তার খাওয়া, পড়ার রাখোওয়ালা যেমনই হোক তার ফুডিং, লজিং তার হাতে যতদিন সুরক্ষিত ততদিন সে তাকে মেনে চলতে বাধ্য। এই বাধ্যতার পাঠ সে মা, ঠাকুমা ও পরিবারের অনান্য মহিলা সদস্যদের কাছ থেকে নেয়। কিন্তু সময়ের যে ভাষা তা তারা রিড করেনা।
মহিলা তাস যেমন করে মহিলারা নিজেরাই খেলতে পারে তা নিজেদের জোকার করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। একজন মহিলা অনায়াসেই অন্য মহিলার দিকে ফিঙ্গার পয়েণ্ট করে বলে, বাপরে কি জল্লাদ জানো ও নাকি স্বামীকে তার চুলে হাত দিতে দেয় না ইণ্টিমেটিং মুহূর্তে। আরেকজন ওয়ার্কিং ওম্যানের পরামর্শ আরো মুখরোচক - বিদ্যালয়কে সবসময় সেকেন্ডারী ভাববে, সংসারটা মেইন। কি মুশকিল! প্রফেসনালিজম নেই তবে আর পেশায় অনুপ্রবেশ কিসের তরে কে জানে! তারা গল্পে মাতে এমন করে, জানো! টিভিতে দেখাচ্ছিল কোথায় যেন মেয়ের বিয়েতে ১কোটি ৫১লক্ষ টাকা গুনে গুনে দিচ্ছে। বলার সময় মানবিক লজ্জার চেয়ে নারী সুলভ উৎসাহ বেশী। পিতার আসহায়ত্বের বদলে মূল্যমানের ইন্ডেক্স নিদের্শক হয়ে ওঠে। যে নারী পথে ঘাটে অন্য নারীর পোশাকের আলোচনার মুখর হয়ে ওঠে সে বাড়ি ফিরে শাসুমাকে সেলের বাজারে চার বছরের কন্যার হটপ্যাণ্টস কিনে আনার আব্দার রাখে। ফোকাসের বৌদ্ধিক অসততা মেয়েদের চিরসাথী। তারা সগর্বে বলে কিছু মেয়েকে স্বামী পেটালেই তাকে জব্দ করা সম্ভব। নারী, শিশু, শ্রমিক এই একলাইনে সুসজ্জিত হতে সে কম্ফর্টেবল। উপমা নিয়ে সে তত বেশি চিন্তিত নয়। স্বাধীনতার মানে সে বোঝে সুখে শান্তিতে সংসার করা। পরিচালক থাকুক না পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় মেলায় তার বিস্তর তুষ্টি।
আসলে মর্য্যাদাবোধ নিয়ে কেউ জন্মায় না। সেটা তৈরী করে শিক্ষা, পারিবারিক পরিবেশ ও বিদ্যালয়। গার্লস স্কুলে মেয়েদের ইউনিফর্মের নীচে ইনার, জুতোর নীচে নির্ধারিত মোজা আছে কিনা তা নিয়ে যতটা জোর দেওয়া হয় ততটা তার স্বাধীন চেতনা ও বিশ্বাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নয়। অন্যদিকে কোয়েড স্কুলে সে নিজেকে আবৃত রাখতে ও ছেলেদের চোরাচোখ থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই ব্যস্ত থাকে। সংকোচ সেখানে তার গুণ আবৃত দেহ তার সততার প্রতীক। ছেলেরা তার সহপাঠী হলেও তাদের পরক্রম, প্রভাব যে তার চেয়ে বেশী তা সে মেনে নেওয়ার অভ্যাস তৈরী করে ফেলে। এই অভ্যাস তাকে ধীরে ধীরে অপ্রতিবাদী ও নিজের জন্য জাস্টিস ডিম্যান্ড করতে শেখার বা দাবীর প্রয়োজনকে বিলীন করে দেয়। নিজের মধ্যে নিজেকে কবরস্থ করার প্রক্রিয়া নীরবে শুরু হয়।
বিবাহপূর্ব চোখে পাওয়ার এলে মেয়েদের তা লুকোতে হয়, হাইট কম হলে তা লুকানোর জন্য হিলস, ত্বকের জন্য ফেয়ারনেস ক্রীম। চুল বড় করার জন্য কালা কেশতেল, গান করার জন্য গলা সাধা, যাবতীয় সব কিছুর চর্চা অন্য বাড়ি গিয়ে নিজেকে টিঁকিয়ে রাখার মহড়া যেন।
মানুষের চেহারার মত গৌণ বিষয় নিয়ে এতবড় বিজ্ঞাপন ব্যবসা আর বিবাহ বাজারের এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নেওয়া সমাজপতিদের অবাক করে না দিলেও ইন্ডিভিজুয়াল মেয়ের তো বিস্মিত হবার কথা। ছেলেপক্ষের ভালো বিবাহ মানে অর্থলাভ এবং সুন্দর ত্বকাধিকারিণীকে পুত্রবধু হিসেবে পাওয়া অন্যদিকে সর্বস্বান্ত হয়ে নিজের সঞ্চিয় অর্থ ব্যয় করে ওয়েল স্যালারিড পদস্থ জামাই কেনা মেয়েপক্ষের একটি রেওয়াজ। মেয়ের বিবাহ দায় থেকে মুক্তি পেতে হাসিমুখে পিতাকে ফাঁসিতে চড়ার অভ্যাস করতে শিখতে হয়। এটাই সামাজিক রীতি। বি বোল্ড ফর চেঞ্জের স্লোগান এখানে নীরবে নিভৃতে কেঁদে ফেরে।
কালো রঙের মেয়েদের আত্মহত্যা বা কন্যাসন্তানের পিতার আত্মহত্যা দুই লাইনে স্থান পায় কাগজে। এই গভীর অসুখ ছড়ানোর দায়ে কেউ অভিযুক্ত হয় না। নিরাময়ের দায়িত্ব সময়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আগের থেকে তো বদলেছে! কিন্তু নির্যাতন বা বঞ্চনার কোনো বদল হয় না, নির্মূল না হলে ফর্ম বদলে তা ফিরে ফিরে আসে। আইন সেখানে ক্রীড়নকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কেননা পীড়িতদের মুক্তি চেতনা না জন্মালে বঞ্চনা একটি গল্পমাত্র। যে গল্প সমানে আবৃত্তি করে চলেছি আমরা l যেমন আমার মা করেছেন বা তাঁর মা করেছেন। এই ধারাবাহিকতার সূত্রধর হবার বাইরে আমাদের কোনো ব্যাপক অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি আমি জীবনভোর। এখন ফরাসী সম্রাট লুই দ্য ফর্টিন্থ এর মত বলতে ইচ্ছা করে, আফটার মি দ্য দীল্যুজ কাম! এই বন্যা ভাঙ্গনের অশনি সংকেত নয়, বিপ্লবের, পরিবর্তনের।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন