কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

তুষ্টি ভট্টাচার্য

ভাগ্যের চাকা




ভাগ্য। নিয়তি। কপাল। এই শব্দগুলোর মধ্যে কেমন একটা অনিশ্চয়তা লুকিয়ে আছে না? আমার কর্ম আমি করে গেলেও, তার ফলটুকু যেন এদেরই হাতে থাকে শেষপর্যন্ত। কর্মফল যেন স্রেফ ভাগ্যের পরিহাসে ভেস্তে যায়। অনেকেই হয়ত বলবেন এই সমস্তটাই অন্ধবিশ্বাস, দুর্বল মনের পরিচয়। সবল মনের মানুষ তার ভাগ্যকে নিজে তৈরি করে। আবার হয়ত দেখা যাবে তারাই খবরের কাগজের কোণটা তুলে রাশিফল লুকিয়ে দেখে নিচ্ছে! হয়ত এও এক অভ্যেস, অনেকদিনের সংস্কার। আমাদের অর্থাৎ বেশিরভাগ হিন্দু বাঙালির ঘরেই সন্তান জন্মানোর পরে বাড়ির বয়স্ক কোন সদস্য পাঁজি খুলে দেখে নেন, জন্মের সময় অনুসারে তার রাশি কি, লগ্নই বা কি? এরপরে তৈরি করে ফেলা হয় ঠিকুজী, কুষ্ঠী। ব্যতিক্রম তো আছেই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই চিত্রই দেখা যায়। আমরা যারা ছোটবেলার কৌতূহলে রাশিচক্রের বই পড়েছি, হস্তরেখা বিচারের বই পড়ে নিজের এবং আশেপাশের সবার হাতের রেখা দেখে ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা করেছি, নামী-অনামী জ্যোতিষ বাবাজীদের খপ্পরেও পড়েছি কেউ কেউ, কিছুদিন বাদেই দেখা গেছে এই বিষয় থেকে আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই উৎসাহ চলে গেছে। কেউ আবার বিশ্বাসটা বজায় রেখে চলেছে। দুহাতে গ্রহরত্ন পরে, নিয়মমত পাঁজি দেখুক আর না দেখুক, কোন অনুষ্ঠান হলে শুভ দিনক্ষণ দেখে তবে তার আয়োজন করেছে।

আসলে এই বিশ্বাস এমন এক বস্তু, তলানীতে ঠেকে গিয়েও যেন কোথাও তার একটুখানি অস্তিত্ব ফেলে রেখে দেয়। ফলে যতই বলি রাশিফল মানি না, দেখতে ভুলি না রোজ। আর ভাগ্যও এমন এক আজব বস্তু, যার লেখা অর্থাৎ রাশিফলের ভালো দিক গুলো মিলুক আর না মিলুক, খারাপ গুলো হাতেনাতে মিলে যায়। আর আমাদের তলানীতে পড়ে থাকা অন্ধ বিশ্বাস আবার নড়েচড়ে বসে। ভাবখানা এমন যে, দেখ – বলেছিলাম কীনা! আমি আছি, আমি আছি। আমাদের কর্মফলও যেমন সত্যের মত অন্ধ, আর তার প্রতি বিশ্বাসও যেমন অটল থাকা উচিত, তেমন কিন্তু ভাগ্যর ওপর আমাদের বিশ্বাস মজবুত থাকে না। কখনও তাকে মানি, কখনও এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিই। তবুও তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার কোন উপায় আমাদের থাকে না।

রাশিফল হিসেব করা হয় কীভাবে? মূলত রাশিচিহ্ন অনুসারে রাশিফল নির্ণয় করা হয়ে থাকে। বারোটি জোডিয়াক সাইন বা রাশি চিহ্ন আছে। প্রতিটি চিহ্ন একে অপরের সঙ্গে ৩০ ডিগ্রী কৌণিক দূরত্বে থাকে। পাশ্চাত্য জ্যোতিষশাস্ত্রে একেকটি সাইন সাতগ্রহের একেকজন নিয়ন্ত্রণ করে। আর সূর্য এবং চন্দ্রকে এখানে আলো হিসেবে দেখা হয়। Aries (Mars), Taurus (Venus), Gemini(Mercury), Cancer(Moon), Leo(Sun), Virgo(Mercury), Libra(Venus), Scorpio(Mars), Sagittarius(Jupiter), Capricorn(Saturn), Aquarius(Uranus), Pisces(Neptune) – ব্যাপারটা এরকমই।

ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রে পাশ্চাত্যের মত অর্থাৎ হেলেনিস্টিক প্রথার অন্তর্গত নয়। এখানেও রয়েছে গ্রহরা – মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তূলা,‌ বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন। গ্রহর পাশাপাশি বিভিন্ন নক্ষত্র (২৭টি), রাহু, কেতু, গ্রহণ – এমন কিছুর ওপর নির্ভর করা হয়। এখানেও বারোটি রাশিকে মানা হয়। এবারে দেখা হয়, কোন রাশি চিহ্নের ওপর কোন গ্রহের অবস্থান কেমন, চাঁদের গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি বহু জটিল তত্ত্ব মিলিয়ে চলে ভাগ্যের হিসেবনিকেশ। যার বেশিরভাগই আমরা যারা জ্যোতিষ জানি না, বুঝব না। পাশ্চাত্যে রাশি বিচার হয় জন্মের তারিখ দেখে আর এদেশে জন্মের সময় দেখে। ফলে একই মানুষের দুরকম রাশি! বাংলা কাগজে এক রকম ফল, ইংরেজি কাগজে আরেকরকম। আর তাই দেখে সেই মানুষটির সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে যখন, ভাগ্য মাঝখানে বসে তাই দেখে হাহা করে হাসছে। 


 আসলে আমাদের যত প্রয়োজন ভাগ্যর সঙ্গে। ভুল বললাম, সৌভাগ্যর সঙ্গে। আমরা চাই যেন আমাদের সব সময়ে ভাল হোক, শুধুই ভাল হোক। দুর্ভাগ্য তুমি দূরে থাক। অথচ তা কী আর হবার! কোন ফাঁকফোকর দিয়ে যে দুর্ভাগ্য এসে পড়ে একটা ঝড়ের মত আমরা বুঝতেই পারি না। আর না বুঝে, অসময়ে আমরা অকূল সমুদ্রে পড়ে কেঁপে উঠি। কিন্তু সময় তো সময়ই হয়। তার ভাল/খারাপ হয় না। সময়ের লয় ক্ষয় নেই। সময়ের কাজ এগিয়ে যাওয়া। এক লয়ে। কোন তাড়াহুড়ো নেই, কোন ঢিমেতাল নেই। আমার সময়কে একটা এসকেলেটরের মত মনে হয়। যখন সেই চলন্ত সিঁড়িটি আমাদের নিয়ে ওপরে উঠছে, তখন তা আমাদের সৌভাগ্য। আর যখন নীচে নামছে, তখন দুর্ভাগ্য। দুইই আসে আমাদের জীবনে, সে আমরা চাই বা না চাই। মেনে নেওয়াটা আমাদের নিয়তি, আর এটাই ভাগ্য।  

এই দহন দিনে যখন বৃষ্টি নেই, গরমে হাঁসফাঁস করছে মন, এমন সময়ে যদি কালবৈশাখী আসে কার না ভাল লাগবে! ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ছুটবে অনেকে। আর শিল পড়লে তো কথাই নেই! শিল কুড়নোর আনন্দ যে কী, সে যে কুড়িয়েছে সেই জানে। আর এমন এক আনন্দের দিনে দূরে হয়ত কোন এক গরীব মানুষের ঘরের টিনের চাল ঝড়ে উড়ে গেল। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার ছন্দে তার রাতের ঘুম মধুর হল না। ছাদের আশ্রয় ছাড়া তার আর তার পরিবারের বৃষ্টিতে ভেজাটা তখন আর আনন্দের রইল না। একই ঘটনা কারুর জীবনে সৌভাগ্য নিয়ে আসে তো কারুর জীবনে দুর্ভাগ্য। আর এই দুটোকেই সমান ভাবে মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া, উপভোগ করার নামই জীবন।

ভাগ্যের হাতে মার তো কম খেলাম না, তাই নিজের জীবন দিয়ে জানি, হারতে হারতে খাদের একদম শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েও কীভাবে ফেরা যায় সমতলে। হাল না ছাড়ার মনোভাব সব থেকে জরুরী। হতাশা তো আসবেই। ক্লান্তিও আসবে। এক্ষেত্রে নিজেকেই হতে হয় নিজের মনোবিদ। মনের জোর থাকলে খোঁড়াও পাহাড় পেরোতে পারে। ঠিক সেভাবেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে নাহয় খারাপ সময়টাকে কাটিয়ে দেব। তারপর তো আসবে লম্বা রানিং ট্র্যাকতখন নাহয় বোল্ট হব! সেই সময়ে আমার পাশের ট্র্যাকে থাকব আমি, তার পাশেরটাতেও আমি। আমার জিতে যাওয়া আমার কাছে, হেরে যাওয়াও তাই। সমস্ত অপ্রাপ্তিগুলোকে যদি নাও পাই, অন্য কিছু দিয়ে ভর্তি করব জীবনের খাতা। সব কিছু তো পাওয়ার জন্য না, সবাই যে সব পাবেই, এমনও তো কোন কথা নেই! আর সত্যি বলতে কী, সব পেয়ে গেলে, তৃষ্ণা ফুরিয়ে গেলে, আর দৌড়বার উদ্যম থাকবে না। দৌড়ের শেষে এক গ্লাস ঠান্ডা জল পানের যে শান্তি, তাও পাব না।

ভাগ্য থাক আর না-থাক, সৌভাগ্য আসুক বা দুর্ভাগ্য, বর্তমানকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করাটাই আমার কাছে প্রধান বিবেচ্য। আর যা ভাবে ভাবুক অন্য লোক। আকাশের দিকে এক চোখ রেখে, মাটির দিকে আরেক চোখ রাখি আমি। মনে মনে উড়তেও পারি, বাস্তবে খোঁড়াতে, হাঁটতে বা দৌড়তেও পারি। আমার এই পারাটুকু নিয়েই আমার ভাগ্য আমি তৈরি করেছি।                                      

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন