কিশোরকাল
একজন অন্ধ ভিক্ষুক ছিল রংপুর জেলা
প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে, যাকে এক টাকা দিলে সময় বলে দিত। কতদিন লোকটাকে এক
টাকা দিয়েছি অবাক হবার জন্য। রংপুরে সন্ধ্যা নামলে কোলাহল থেমে গেলে
ভিক্ষুকটা তবু দাঁড়িয়ে থাকত; আমি
বলতাম বাড়ি যান মামা। রাত হচ্ছে।
লোকটা ঘাড় কাত করে বলত, বাড়ি নাই মামা।
অন্ধ লোকেরও এক শরীর সমান বিষণ্ণতা থাকে। নুয়ে পড়া থুতনিতে সন্ধ্যার বাতাস ছুঁয়ে যেত তার
নাম না জানা
একাকীত্বের কোলবালিশে।
নি:সঙ্গ মানুষের বুঝি একটা সমান দীর্ঘ
কোলবালিশ থাকে।
আমার বাবারও একটা কোলবালিশ ছিল। মা কতদিন
রেগেমেগে কোলবালিশটা বাইরে ছুঁড়ে ফেল দিত। বাবা হেসে বলতেন, একাকী মানুষের কোলবালিশ থাকে, অন্ধের যেমন লাঠি।
ঘরভর্তি গমগমে মানুষ, আমরা এত্তোগুলোন
ভাইবোন, মায়ের ধুপধাপ সংসার। কড়াইতে তেলের মাঝে ফোঁসফোঁস ফোড়ন, দুপুরের সিলেট রোদে
ঝপঝপ পানি পড়ছে, ৫৭০ সাবানের অবারিত ফেনা। রেডিওতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি মায়ার লাজুক
বিজ্ঞাপন শুনে আমার একাকী লাল হয়ে
যাবার কিশোরকাল। হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্টে প্রমোশন, তবু আমার বাবা একা?
শোবার ঘরে বাবা উপুড় হয়ে কোমরে পিঠে হট
ওয়াটার ব্যাগ দিয়ে রাখতেন। আমি লুকিয়ে বাবাকে দেখতাম, কী ফর্সা বাবার পিঠ! আমার ইচ্ছা করতো
বাবার পিঠে উঠে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। নতুন শেখা বীজগণিতের সূত্র মুখস্থ করি।
এ প্লাস বি হোল স্কয়ার ইক্যুয়েল টু এ
স্কয়ার প্লাস টু এবি প্লাস বি স্কয়ার।
একদিন বাবা আমার চোখের দিকে না তাকিয়ে
নিউজপ্রিন্ট কাগজে মুড়ে কী একটা জিনিস দিয়ে তড়িঘড়ি বললেন, এখন থেকে এটা প্যান্টের
নিচে পরবি।
মনে হচ্ছিল আমি মিশে যাচ্ছি মাটিতে লজ্জার
আঙ্গুর লতায়। চা বাগানের সবুজ ঢোড়া
সাপের মতো হিলহিল করে বড় হচ্ছি।
ডলিকে ভালো লাগে, মুন্নীকে ভালো লাগে, মাধবীকে
ভালো লাগে, ববিতাকে ভালো লাগে।
কচকচ আমড়া, কুল বরই, সুরমা খালা, সুফিয়া
ম্যাডামের হাসিমুখ, থৈ থৈ কুশিয়ারা সব ভালো লাগে।
ঢালু পাহাড়ের ঢাল গলে হুড়মুড় সার-কারখানা,
বৃষ্টি নামলে মনে হয় বাবার ফর্সা পিঠের মতো বড় হচ্ছি। সিলেট বড় হচ্ছে। সিনেমার পোস্টারে লাল রঙের নায়িকারা মদিরা বড় হচ্ছে।
আমার মায়ের অনেকগুলো মোরগ মুরগী ছিল। সন্ধ্যা নামলে মা খুদকুড়ো নিজ হাতে মেখে সুর করে ডাকতেন : আয় আয় তৈ তৈ...
হুড়মুড় করে মোরগ মুরগীর দল ছুটে আসত মায়ের
পায়ের কাছে, গোগ্রাসে গিলত খাবার। আমি অবাক হয়ে দেখতাম মায়ের আলাদা সন্তান, অনন্য নির্ভরতা। আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম বড় হয়ে আমার এরকম প্রাণীজ খামার থাকবে। প্রকৃতির কাছ থেকে নেব হানাহানিবিহীন পৃথিবী।
মা হবেন সেই জগত-জোড়া অধিপতি, আমি তাঁর
দুর্দান্ত সিপাহশালার।
মায়ের চোখর কোণায় এখন বয়সী ঈগল পায়ের ছাপ। সেই অন্ধ ভিক্ষুকটাকে আর দেখিনি। হয়তো তার শরীর খেয়ে নিয়েছে ক্ষুধার্ত মাটি। হুম হুম করে সাঁওতাল শরীরে আমি বাবার মতো বড় হয়ে গেলাম...
চোখ বন্ধ করলে দেখি বাবা ছাতা মাথায়
আমাদের সব ভাই বোনকে ডাকছে; আয় আয় ভিজে
যাচ্ছিস তো! ভিজলে যদিও বৃষ্টির সাথে যোগমায়া হয় বটে তবে জ্বরে পরাজিত হতে পারিস। আমরা ভাইয়েরা সবার আগে ঠেলেঠুলে ছোট বোনটাকে ছাতার নিচে পাঠাই।
বোন রে তুই ছোট হয়ে থাক মানবিক সারল্যে। তোর জন্য নির্ভরতা ছাতা, সমস্ত জনপদ তোর জন্য নিরাপদ সড়ক, ব্যাগ ভর্তি
বই, সারল্য মাখা দুধভাত।
একদিন আন্ত:নগর ট্রেন ভর্তি বৃষ্টিস্নাত
ছায়ানীড়ে বাবা বললেন, শরীরে ব্যথা নামছে মিছিলের দাপটে। আমার মা পাগলের মতো বাবার ফর্সা পিঠে গরম সেঁক দিতে শুরু
করলেন। ভাই বোন চোখ বড়
বড় করে উঁকি দিয়ে দেখল, ছাতা
বিহীন একটা লোক বৃষ্টির অনন্ত সন্ত্রাস উপেক্ষা করে কোথায় যে যাত্রা শুরু করল!
নিষ্ঠুর লোকটা সমস্ত বিলাপ ডলফিন সাঁতারের
মতো পাশ কেটে, চোখের সম্মিলিত জল উপেক্ষা করে একাকী যাত্রা শুরু করলেন।
ফর্সা পিঠ লোকটার কণে আঙ্গুল ধরে থাকলাম
আমি জিপসী বালকের মতো। বিড়বিড় করতে চাইলাম;
: বাইরে বঙ্গবন্ধুর দরাজ কন্ঠের মতো
বৃষ্টি। আমাকে নাও, আমি ছাতা ধরি?
নিষ্ঠুর লোকটা কথাই
শুনলো না...
আহা...স্বচ্ছ একটা লেখা...
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ শ্রেয়সী :)
মুছুন