ধারাবাহিক
উপন্যাস
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
(৬)
- প্রাণ কি আচার্য্য?
- বিভ্রম!
- শুধু?
- হ্যাঁ।
- অথচ আপনি তাকে ত্যাগ করার জন্যই উপবাসে
বসেছেন!
- হ্যাঁ।
- বিভ্রম হলে এর
প্রয়োজন কি?
- আছে।
- বুঝিয়ে দিন।
- ইচ্ছের মধ্যে
প্রাণের আসল অস্তিত্ব।
- জড় বস্তুর ইচ্ছে
নেই, জীবের আছে।
- হ্যাঁ। তাই জড়
বস্তু ইচ্ছেতে বাড়তে চায় না, ইচ্ছেতে ক্ষয়েও যায় না। ঘটনার
দ্বারা সৃষ্টি হয়, ঘটনার মতো পরে থাকে অবিরল শেষের প্রতীক্ষায়।
- জীব বাড়ে। ঘটনার
জন্ম দিতে চায়। আর?
- ঘটনার জন্ম দিতে
গেলে তার অধিকারে লাগে স্থান, লাগে সময়। সাম্রাজ্য গড়ে তোলে।
গড়তে গিয়ে ভাঙে অন্য কোনো সাম্রাজ্য। জীব সাম্রাজ্যবাদী।
- আপনি সাম্রাজ্যে
ক্লান্ত?
- হ্যাঁ।
সম্প্রসারণে ক্লান্ত। ঘটনার জন্ম দিতে দিতে ঘটনার আর প্রয়োজনীয়তা নেই আমার কাছে।
- তাই অনশন? আমার শাস্তির ভয়ে না?
- বালক তুমি!
বিদ্রোহ দমন করেছ। ঘটনার জন্ম দিতে যাচ্ছ। এ ঘটনার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাকে আরো
বহু বহুকাল জীবিত থাকতে হবে। দ্বন্দ্বে যেতে হবে তোমার সঙ্গে। সে সময় প্রকৃতি
আমাকে দেবে না। অথচ এ সাম্রাজ্য তোমার পিতামহের চেয়েও বেশি করে আমার সৃষ্ট। দু’হাতে দুটি গড়েছি।
একহাতে তোমার পিতামহ,
অন্য হাতে সাম্রাজ্য। এ মায়ায় আটকে থাকব। কাল আমাকে জড়ের মতো ফেলে চলে যাবে। ঘটনা এতকাল আমি সৃষ্টি করেছি,
এভাবে থাকলে আমাকে ঘটনা সৃষ্টি করবে। সে অনির্দিষ্ট, অনিশ্চিত। আমি তা দেখতে চাই না। নিয়তির নির্দেশ - এ সাম্রাজ্য তুমি নিয়ে
যাবে পতনে। সেও আমি দেখতে চাই না।
কথা
বন্ধ করলেন আচার্য্য চাণক্য। প্রায়ান্ধকার কক্ষে দীপের স্তিমিত আলো তেলরঙের মতো
গড়িয়ে পড়ছিল আচার্য্যের কাঁধ বেয়ে। অশোক দেখছিল চেয়ে এখনো কী প্রশস্ত,
বলিষ্ঠ!
সুনীলের
চোখে আঁকা ছিল সে তাকানো। সুনীল এবং অশোক এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এক জায়গায়। ওরা আসলে
একটাই আলোকণা। একটা স্ক্রিনের মধ্যে দুটো ছিদ্র করে তাকে পাঠানো হয়েছিল। একটা ছিদ্র করলে একটাই ছাপ আসত।
তার বদলে দুটো ছিদ্র দিয়ে একটা কণা দুটো ছাপ ফেলেছে। এবং অনেকটা পরিসরে আসলে নিজেই
নিজেকে বাতিল করে দিয়েছে, ছাপ ফেলেনি। সুনীলের রাজা হবার
ইচ্ছে বাতিল করেছে অশোকের মৌর্যত্বকে। অশোকের মহান হবার ইচ্ছে বাতিল করেছে সুনীলের
মাহাত পরিচয়। দুজনে একে অন্যের দিকে যায় আর চলে আসে এর ফলে এবং একরকম দেখতে হয়েও
গ্রামের মেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাই না। অশোকের নির্মাণে সুনীল বসে, সুনীলের স্মৃতিতে অশোক। আমি যাতায়াত করি।
যাতায়াত
করছিলাম সনাতনের চায়ের দোকানে। বিভিন্ন বয়সী কিছু লোক সন্ধের দিকে মাছের বাজারের
মধ্যে দিয়ে সেদিকে এগিয়ে চলে প্রতিদিন। মাছগুলোর সনাতন মৃত্যু এবং বিক্রি হবার
মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসত ওরা। আমি অনেকবার দেখেছি মাছগুলোকে। খুব কাছে গিয়ে লক্ষ্য
করেছি। সন্ধের দিকের বাজারে এরা আসে। বেশিরভাগ সমুদ্রের মাছ। ওদের চেহারার
মধ্যে সমুদ্রের শীতল প্রতিজ্ঞা দেখা যায়। সমুদ্র একটু একটু করে জমি গ্রাস
করে নিচ্ছে। মানুষ বাঁধ দিচ্ছে। সমুদ্র বাঁধ ভেঙে চলে আসছে। বাঁধ জলের তলায় নিয়ে
ঘুরে বেড়াচ্ছে। সরে যেতে হচ্ছে মানুষকে। বাড়ি-ঘর ছেড়ে নৌকোতে উঠে পড়ছে বেশি বেশি করে মানুষ। অনেকবার
ভোরবেলা যখন ঢেউ-এর মাথাগুলো নাচে,
তখন দেখেছি জেলেরা তাদের নৌকাগুলোকে ঠেলে ঠেলে ঢেউ পার করে দিচ্ছে।
সামনের ঢেউগুলোকে পার করে লাফিয়ে উঠছে নৌকোতে। তারপরে ঢেউ-এর মাথায় নাচতে নাচতে
চলে যাচ্ছে চুণ্ণী হয়ে সমুদ্রের গভীরে। ওদের মুখগুলো দেখলে আমার মনে হয়, প্রত্যেকবার মনে হয় ওরা সমুদ্র থেকে জমি তুলে আনবে। আরেকটু হাত-পা ছড়াবে বলে
যাচ্ছে। প্রত্যেকবার যখন ফেরে তখন দেখি ওদের জালে অনেক রূপোলি মাছ লেগে আছে। জালে
জমি ধরা পড়েনি বুঝতে পারি।
সেই
সব মাছ আসে এই সব বাজারে। ত্রিভূজ মাছেদের চেহারার মধ্যে জমি জমি ভাব লক্ষ্য
করেছি। কেমন পাতা হয়ে থাকে মাছগুলো। আনুভূমিক শব্দটা এখানে কাজ করবে।
ওরা কখনো উল্লম্ব হয়নি। দূর দূরান্ত থেকে আসে বরফের চাদরে মুড়ে। নিঃশব্দে শুয়ে
থাকে বাজারে। কাছে গেলেই একটা গুমগুম শব্দ শুনতে পাই। ওদের মৃতদেহে সমুদ্র বাজছে
বুঝতে পারি। যত যত মাছ বাজারে আসে তত তত সমুদ্র জমি খায়। নীরব এক হিংস্রতা আছে
সমুদ্রের এই ব্যবহারে। সেই ব্যবহার পেরিয়ে মানবাধিকার আন্দোলনের কিছু লোক জড়ো
হয় সনাতনের চায়ের দোকানে প্রতি সন্ধ্যায়। সমুদ্র এমন হলে মানুষের অধিকার
নিয়ে কথা তো বলতেই হয়।
- এইটা তো খুব অদ্ভুত
ব্যপার। এদিকে আপনি মার্ক্সিজম-মাওইজম নিয়ে কথা বলবেন, ও দিকে বলবেন
হোমিওপ্যাথির দেশে চর্চা বাড়ানো উচিত - না না রথীনদা তা হয়
না।
- দেখ, একটা কথা বুঝছ না, যেভাবে চিকিৎসার খরচ বাড়ছে -
- তাবলে হোমিওপ্যাথি?
ওষুধটার সাইড এফেক্ট কি সেটাই জানে না একটা চিকিৎসা ব্যবস্থা,
না না।
- চারটে চা দিও কমল।
- ও তোমাদের প্রেজুডিস অমিতেশ। তোমরা দেখছ না যে কত রোগ সেরে যাচ্ছে
হোমিওপ্যাথিতে।
- আচ্ছা রথীনদা,
আপনারা ক্ষমতায় এলে তার মানে এটা বেশি করে চালু করবেন তো?
- আমরা মানে কারা
বাবু?
- মানে এই
মাওবাদীরা!
- আমি তো পার্টির
লোক নই, আমি সিম্প্যাথাইজার মাত্র। এর উত্তর আমি দেব কি করে?
- এই বাবু আস্তে!
বাবু
চারপাশ দেখে নেয়। ক'দিন ধরেই কংগ্রেসের ক’টা ছেলে কাছেপিঠে
ঘুরঘুর করছে। এখানে অমিতেশ,
রথীনদাদের দেখলেই কাছে জড়ো হয়ে যায়।
শোনে। তারপরে গিয়ে বোধহয় রিপোর্ট দেয়। সিপিএম যখন ছিল তখন একদিন অমিতেশদের অফিস
যেখানে সেই বাড়িতে বলে এসেছিল যে এরপর থেকে যেন আর বাড়ি ভাড়া না দেওয়া হয়
মানবাধিকার সমিতিকে। সামান্য বলে আসাটুকুই এদের উৎখাত করে দিয়েছে। এখন এই নতুন
জমানাতেও এরা বাড়ি পায়নি। মানবাধিকারের বাড়ি পাওয়া যায় না।
সুনীল
পাশ থেকে আস্তে করে বলে,
- বাড়ি দেওয়া উচিতও
না।
- কেন?
- আলাদা করে মানুষের
অধিকারের কী
আছে?
- কেন নেই?
- আর পাঁচটা প্রাণের
মতো
মানুষও এক প্রাণ মাত্র।
তার আলাদা কিসের অধিকার?
- সে অন্যদের চেয়ে
বুদ্ধিমান না? উন্নত না?
রথীনদার
গলাতে উষ্মার সুর।
- তা'হলে তো আপনাদের বিপ্লবই করতে হতো না। হতো?
- থমকে যাচ্ছে। সেই
থমকে যাওয়া, সেই উদ্বৃত্ত সঞ্চয় কয়েকজনের হাত থেকে ছিনিয়ে
নিতেই তো বিপ্লব।
- প্রকৃতির নিয়ম তো!
সকলেই কি এক হয়? কোনো প্রাণের মধ্যেই হয় না। তাহলে মানুষের
জন্য এত কান্নাকাটি কেন?
- বাকী কোনো
জীব এই পর্যায় অবধি সভ্যতা গড়েনি। আজ আমরা নিজেদের এই গ্রহ ছাড়িয়েও জানছি।
ব্রহ্মান্ড জানছি। নিয়ম আবিষ্কার করছি এই সব
প্রাণ-অপ্রাণের।
- একদিন সব জেনে
যাবেন।
- জানতে চেষ্টা তো
আমরা করছিই। হয়তো যাব।
- বদলে দেবেন তারপর
নিয়ম কানুন? মানুষের সুবিধে অনুযায়ী বদলে নেবেন?
- এ সব কষ্ট কল্পনা।
তবে কিছু ক্ষেত্রে চেষ্টা তো করবই। মানুষের জন্য যা মন্দ তাকে না বদলালে চলবে কেন?
- তাতে যদি অন্যের
জন্য মন্দ হয়? তখন?
- যাতে না হয়
সেভাবেই এগোবো।
আমি
কথার মধ্যে জুড়ে গেলাম। কংগ্রেসের ছেলেগুলো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। ওদের মাথার
উপর দিয়ে যাচ্ছে।
- ডিটারমাইন করবেন কী ভাবে?
- বুঝে শুনে!
- ধরুন বাবা-মা
ভাবছে সন্তানকে ডাক্তার করলে ভালো। তার ডাক্তারি পড়ার মগজও
আছে, আবার ছবি আঁকারও। ছবি আঁকার রোজগার ঠিক নেই। হলে
মিলিয়ন ডলারও, না হলে কান কেটেও লাভ নেই। অথচ ডাক্তারিতে
নিয়মিত আয় আছে। সুবিধে আছে অনেকটা আয় করার। বাপ-মা ডাক্তার করা বাছে। কিন্তু
সন্তান খুব বাজে ডাক্তার হলো। এর চেয়ে ছবি আঁকলে ভা্লো হতো
হয়তো। এই ডিটারমিনিজমের অর্থ কি?
রথীনদা
বলতে শুরু করলেন ওঁরা বিশেষ করে বুঝবেন শিশুর মনস্তত্ব,
তারপরে এগোবেন ইত্যাদি। সুনীল আমাকে ইশারা করে বেরিয়ে গেল। ও এখন
নদীর ধারে যাবে। আমি কিছুক্ষণ ভাবনাটার মধ্যে আটকে রইলাম। মানুষ ব্রহ্মান্ডের
কেন্দ্রবিন্দু এমন ধারণা ছিল প্রাচীন দার্শনিকদের, ধর্মপুরোহিতদের।
বাদ বাকী এত প্রাণী ও অপ্রাণ তাদের কাছে মানুষের চেয়ে নিম্নসারিভুক্ত ছিল। এবারে মানুষ
কাল চলতে চলতে দেখল ব্রহ্মান্ডে আরো অনেক
প্রাণ আছে। সে সম্ভাবনা সব চাইতে স্বাভাবিক। এত লক্ষ কোটি গ্যালাক্সির এত লক্ষ
কোটি গ্রহ নক্ষত্র ইত্যাদির মধ্যে শুধু পৃথিবী নামের এই গ্রহটাতেই প্রাণ আছে এমন
হতেই পারে না। সে সব প্রাণের সঙ্গে একদিন আমাদের দেখা হবে। যখন দেখা হবে যদি দেখা
যায় যে তারা আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত তখন তাদের তৈরি ব্যবস্থার মধ্যেই কি আমরা নিজেদের
সঁপে দেব? আমরা কি নিজেদের নিকৃষ্ট বলে মেনে
নেব? নাকি তাদেরকে আমাদের অধীন করতে চেষ্টা করব?
নাকি তারা আমাদের বহু আগে সব প্রাণ ও অপ্রাণের ব্রহ্মান্ডে অধিকার
সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করে নিয়েছে। আমরা আজ যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি এ
অবস্থার মধ্যে দিয়ে তারা বহু লক্ষ কোটি বছর আগে গিয়েছে, এখন
তাদের অবস্থান আমাদের প্রায় কল্পনার বাইরে।
সুবর্ণরেখার
টলটলে জলে রাতের তারাগুলো ঝকঝক করছে। নদীর নিচের
বালু নদীকে পরিষ্কার রাখে। এখন আমাদের মাথার উপরে এবং
পায়ের নিচে
দুটি আকাশ। আমরা এ আকাশ দেখতে দেখতে একটু জলের সান্নিধ্যে খুঁজে নিচ্ছিলাম দ্রবীভূত
নিঃসঙ্গতার স্পর্শ। যদি ব্রহ্মান্ডের অন্যত্র কেউ না থাকে তাহলে মানুষ কী একা!
প্রাণ কী একা এই পৃথিবীতে! একবার ফুটে উঠে যখন আমাদের এই সূর্য নিভে যাবার দিন
আসবে তখন সে কাকে জানাবে তার আহ্লাদের ইতিহাসগুলো? তার
শোকের পুঁজির বিবরণে কারও কৌতুহল থাকবে না। ভাবতেই একলা লাগে।
- প্রাণ যত
বুদ্ধিমান হবে তত সে জড় হবার দিকে যাবে।
নিমগ্ন
কন্ঠে বলে উঠলো সুনীল।
[ক্রমশ]
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন