প্রবাহ ২
‘তোমার বয়স কত? হে জীবন
তোমার বয়স কত? কত প্রাচীন তুমি? কবে শুরু হয়েছিলে? কবে শেষ? শেষের দিন কি এগিয়ে আসছে
বড় দ্রুত? শেষ কি আছে? শুরুর দিনের সেই সে আবির্ভাব মুহূর্ত কি মনে পড়ে? হে জীবন
মুগ্ধ রেখো, মুগ্ধ করে রেখো আমায়...’
কথা ক’টি মেইল করে দিল
চূর্ণি। কিছুক্ষণ আগেও
পরমেশ্বর একট ফিচার ফিল্মের স্ক্রিপট শোনাচ্ছিল। পরমেশ্বর ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে এতদিন। এটিই ওর প্রথম ফিচার ফিল্ম। হয়তো শেষও। হয়তো নতুন শুরু। কেই বা বলতে
পারে! ও কি জানে ফোনের ওপ্রান্তে যে
মুগ্ধ শ্রোতাটি সেই তার হারিয়ে যাওয়া চূর্ণি নদী! যার সামনে দাঁড়িয়ে একটিবার বাইশ বছরের স্টাইলে ম্যাক বলতে
চায় ‘মাই নেম ইজ ম্যাক, জেমস ম্যাক’। পরমেশ্বর
জানে না ওপ্রান্তে সেই চূর্ণি। প্রতিদিন অপেক্ষা করেছে ও। সেই বাসস্টপে দাঁড়িয়ে
থেকে থেকে। অসংখ্যবার মেইল চেক করে। সার্চ অপশনে বার বার সার্চ করে। নতুন মেইল আইডি ওপেন করে। ওর সঙ্গে কাজ করে শখের ফটোগ্রাফার কৌস্তভ নামের
ছোকরাটিও বলেছে সার্চ করতে। কোথায় কী! মেইল আইডিটিই হয়তো ডিলিট করে দিয়ে হারিয়ে গেছে চূর্ণি। মহাশূন্যে শুধু ভাসমান ক’টি শব্দ ‘ভালো আছেন তো?’
পরমেশ্বর আপন মনে হাসে। কখনো একা ফাঁকা ঘরে হো হো করে দমফাটা হাসি। ওর ভালো থাকা ও জানে না। ওর ভালো থাকা ছিনিয়ে নিয়েছে যোধপুর পার্কের
টিউটোরিয়াল হোম, সেই হলুদ বাড়িটি। ওর ভালো থাকা টুকরো হয়ে হয়ে
ছড়িয়ে আছে দিল্লির ফেলে রেখে আসা কোনো কোনো রাস্তায়। ওর ভালো থাকা ভেঙ্গে তছনছ করে দেয় কানাডা থেকে ভেসে আসা আই এস
ডি কল। ওর ভালো থাকা কেড়ে নিয়ে গেছে
শীত পোশাক বিক্রী করতে আসা ভুটানী মেয়েটির বর্বর স্বামী। কোথায় ওর ভালো থাকা? চূর্ণি নদীটির ধারে হয়তো খুঁজে পাওয়া যেত ম্যাক আর
পরমেশ্বরের ভালো থাকার সর্বশেষ কারণটুকু।
আজ দুপুরে ওর টীমের দল সহ
অফিসে বসে ফিচার নিয়ে নানা কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ মোবাইলে একটা মিসকল। অচেনা
নাম্বার। ক্ষণিক জ্বলেই নিভে গেল। আবার কিছুক্ষণ পর সেই নাম্বারটিই বেজে উঠল। সামনে টেবিলে রাখা ছিল মোবাইলটি। হবে কেউ! পরমেশ্বর কল রিসিভ করে বলল ‘বলছি, বলুন’।
‘হ্যাঁ, আপনিই পরমেশ্বর
গাঙ্গুলি?’ নারীকণ্ঠ।
‘হ্যাঁ’।
‘ওয়েবসাইটে দেওয়া ফোন
নাম্বারটিতে ট্রাই করেছিলাম। আপনাকে পাইনি’।
‘ওটা আমার অ্যাসিসটান্ট-এর কাছে থাকে, এই নাম্বারটা
আপনাকে কে দিল?’
‘কৌস্তভ’।
‘ওহ, ও তো চেন্নাই গেছে’।
‘হ্যাঁ’।
‘কী জন্য ফোন?’
‘আপনি ফিচার ফিল্ম করছেন
হঠাৎ, বিভিন্ন কথা কানে আসছে, বিতর্কিত বিষয় কোনো, নতুন ধরনের উপস্থাপনা’।
‘এটিই প্রথম, হয়তো শেষও’।
‘আমি স্ক্রিপটা শুনতে চাই
আপনার কন্ঠে’।
হা হা করে হেসে ওঠে
পরমেশ্বর। কী অদ্ভুত আবদার! হঠাৎ স্ক্রিপট শুনতে চাই বলে এক অজানা অচেনা নারীকণ্ঠ। বেশ মজাই
লাগল। সহজ ভাবে কোনো ভনিতা ছাড়াই সরাসরি
অনুরোধ, না অনুরোধও যেন নয়, বেশ একটা জোরালো দাবি।
‘এটা কোনো হাসির কথা তো নয়’! ফোনের ওপ্রান্ত বলে।
আবার হা হা করে হাসি
পরমেশ্বরের। অজানা কণ্ঠে তীব্র অভিমানও।
‘কয়েক মাস আগে আপনাকে
দেখলাম, গড়িয়াতে, একটা কফি শপে’। ওপ্রান্ত বলে ওঠে।
‘ওখানেই আমার বাড়ি, আপনিও
কি গড়িয়াতেই থাকেন?’
‘নাহ, এক রাত্রি ছিলাম আমার
এক ভাই-এর ফ্ল্যাটে ব্রহ্মপুরে’।
‘ওহ, কাছেই থাকি’।
এরপর কিছুক্ষণ চুপ ওপ্রান্ত।
‘যোধপুর পার্কের টিউটোরিয়াল
হোমের সামনে কিছুদিন আগে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। একা, চুপচাপ, অনেকক্ষণ। তারপর সন্ধে নেমে এলো। তারপর রাত্রি
নেমে এলো’। ওপ্রান্ত বলে
মৃদু।
ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো শিউরে ওঠে পরমেশ্বর। শিউরে উঠল ম্যাক । এ কে? কে ওর গতবিধি ফলো করে চলেছে?
ওপ্রান্তের জিজ্ঞাসা, ‘ঐ হলুদ
বাড়িটিতে কী এমন আছে?’
অন্ধকার, সারা জীবনের
পুঞ্জীভুত অন্ধকার। ওখানে আমার গ্রহণ লেগে যাওয়া। ওখানে আমার রাহুগ্রাস’। ঘোরের
মাথায় বলে ম্যাক।
ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে
জিজ্ঞেস করে পরমেশ্বর ‘কে তুমি?’
‘এই ফিচার ফিল্ম কি সেই অন্ধকার
থেকে আলোয় ফেরা?’
‘জানি না। আলোর পথযাত্রীটি কবে আমায় হাত ধরে নিয়ে যাবে, জানি না’।
‘আমায় শোনাবেন?’
‘হ্যাঁ, আজ মাঝরাতের পর ফোন
কোরো। তুমি বলে ফেললাম’।
ওপ্রান্ত চুপ।
কিছুক্ষণ পর, ‘আমি ফোন করব, আর শুনব’।
‘বেশ’।
ফোন রেখে দিল ওপ্রান্তের
অজানা মেয়েটি। দাবি, অভিমান, আগ্রহ, তীব্রতা সব যেন মোবাইলের ওপ্রান্তে একত্রিত, পুঞ্জীভুত। কে মেয়েটি? কণ্ঠস্বর কি চেনা? সব
কণ্ঠস্বরই চেনা লাগে পরমেশ্বরের। আবার সব কন্ঠস্বরই অচেনা লাগে।
অন্ধকারের কোনো চেনা অচেনা নেই। ও অন্ধকার প্রাণ এক। আলোর পথযাত্রী কবে আসবে? কবে বয়ে যাবে সেই কমলা পাড় ঢাকাই চূর্ণি নদী? ফিরবে
নিশ্চিত। সব কিছু ধ্বংস হওয়ার ঠিক
শেষ মুহূর্তে অথবা নতুন শুরুর এক অসাধারণ লগ্নে। চূর্ণি ঠিক ফিরবে।
কৌস্তভ ছেলেটাকে একটা ফোন
করে পরমেশ্বর। নট রিচেবল। চেন্নাই গেছে ছোকরা। মগজে বুদ্ধি আছে, শান দেওয়া তীক্ষ্ণ। এজন্যই ওকে পছন্দ করে
পরমেশ্বর। কিছুটা বদবুদ্ধিও আছে। কে জানে হঠাৎ এই মেয়েটিকে কেন ওর
পার্সোনাল নাম্বার দিল! নামধাম কিছুই তো
বলল না!
অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে
পরমেশ্বর। পুরো টীমের সকলে বেশ অবাক। এত তাড়াতাড়ি তো ও বেরোয় না!
‘কী হে, চললে যে?’ সঞ্জীবদা।
হাসে পরমেশ্বর । চোখ টিপে
বলে সঞ্জীবদা, ‘নতুন না পুরনো? ক’দিনের জন্য?’ হা হা করে হাসে পরমেশ্বর ।
এই তো জীবন...’ গেয়ে ওঠে
ফাজিল এক ছোকরা, জ্যোতিপ্রকাশ।
ঘড়ির কাঁটা ১.৫৬ এ এম। মোবাইলে অচেনা মেয়েটির নাম্বার ভেসে ওঠে। একেই কি মাঝরাত পেরোনো বলে! অদ্ভুত তো মেয়েটি! ফোন রিসিভ করে কিছু বলার
আগেই ওপ্রান্ত থেকে বলে, ‘বলুন, শুনব’।
এরকম জোরালো দাবির কাছে আর
হাসি পায় না পরমেশ্বরের।
‘কে তুমি?’
‘নাম থাক, কৌস্তভের কাছে তো
সব জানতে পারবেন’। ওপ্রান্ত।
ম্যাক চমকে ওঠে। মেয়েটি কি ওকে সব সময় দেখতে পাচ্ছে? কৌস্তভের তো ফোন সারাক্ষণ
নট রিচেবল। জানলো কী করে যে ও ফোন করেছিল? মেয়েটি বুদ্ধিমতী, মেয়েটি
তীব্র।
‘বেশ, সবটা পড়া সম্ভব নয় একদিনে। কিছু অংশ পড়ে শোনাই। ভালো
লাগলে জানিও। অন্যদিন আবার শোনাব’। ওপ্রান্ত মনোযোগী, চুপ।
পরমেশ্বর পাঠ শুরু করে। এটি
তার প্রথম ফিচার ফিল্ম, হয়তো শেষও।
এক নাগাড়ে পাঠ করতে থাকে। ওপ্রান্ত নীরব শ্রোতা। মাঝে মাঝে আচমকা বেশ কয়েকবার ফোনটা কেটে যায়। নেট ওয়ার্ক সমস্যা। রূঢ় বাস্তব
যেমন তীব্র চাবুকের কষাঘাতে ঘোর কাটিয়ে দেয় মানুষের। বেঁচে থাকার ঘোর, ভালো লাগার ঘোর, ভালোবাসার ঘোর। নাহ, এবার আর তা হয় না। যতবার কেটে যায় ততবার ফোন করে মেয়েটি, ঠিক যে লাইনে কেটেছে তার
পুরোটা বলে দিয়ে রেশ ধরিয়ে দেয়। ঘোর কাটে না।
এভাবে শোনায় স্ক্রিপ্টের
একটা বিশেষ অংশ। পাঠশেষে ওপ্রান্ত নীরব। তারপর বলে, ‘আপনার বয়স কত? কত প্রাচীন, কত বৃদ্ধ আপনি?’
‘বড় ক্লান্ত’। ফোন রেখে দেয় পরমেশ্বর। চোখ বন্ধ করে যেন দেখতে পায়
চূর্ণিকে। কমলা পাড় সাদা ঢাকাই ভোরের আলো থেকে উঠে আসছে। পরমেশ্বর দেখতে পায় ম্যাককে। চূর্ণির সামনে দাঁড়িয়ে বাইশ বছরের স্টাইলে বলছে, ‘মাই নেম ইজ ম্যাক, জেমস
ম্যাক’। খিল খিল করে হেসে উঠছে চূর্ণি। আহ! আলো...
ওপ্রান্তে চূর্ণি ফোন নামিয়ে রেখে মেইল করে
খুলে আনব্লক করে পরমেশ্বর গাঙ্গুলিকে। মেসেজ টাইপ করর। সাবজেক্ট লেখার অপশনে লেখে, ‘নো সাবজেক্ট’।
টেক্সট টাইপ করে, ‘...হে জীবন মুগ্ধ রেখো, মুগ্ধ করে রেখো আমায়’ : চূর্ণি।
এই গল্পটা হেভি হইছে...
উত্তরমুছুন