লিপির সঙ্গে কিছু কল্পগল্প
শূন্যে চিত্রিত কিছু রেখা। ইতঃস্তত। ব্যাকরনহীন। অথবা স্বাধীন, তাই। কেবল সাইলেন্ট মোড-এ। মহাশূন্যে তো শব্দ নেই, তাই। তাই, আমি লিপি, লিপিকা, অসঙ্কোচে লিখে যাই “কালো জমিনে অবিশ্বাস্য কারুকাজ করা / গহিন ঢুকে উথলে উঠছে রাত্রি- /আমি তো রাত্রি চিনি, শরীর চিনি আজন্ম, কোথায় কোন গহনে উথলে ওঠে রাত্রি, টের পাই সেই সব গ্রেসফুল ন্যুডলুক...”।
এই বিচিত্র সঙ্কর সময়ে তো লুকোছাপার অন্ত নেই! কোথাও তেমন অলিন্দ কই, যেখানে ইচ্ছেমতো হেঁটে যেতে যেতে উচ্চারণ করতে পারব “গ্লসি লিপ থেকে ত্রিকোণ প্যাটিসে টুকরো কামড় / আহ্!” তাই তো লিখে ফেলি “এই নগ্ন চোখে ঠোঁটের নিভৃত নিপুণ স্পর্শ / অমৃত-স্রোত নামছে কন্ঠশিরায় শিরায় / শব্দঝালর আড়াল করছে এই নির্জন, / সতেজ ভঙ্গী সব ওঠানামা আরো সাবলীল / মাঝখানে তুমি গভীর জাগছো বসন্তনিশি”।
আমি জানি, এসব লেখার মধ্যে আমি যতটা বেঁচে আছি, যত আমি আমার ইচ্ছাধীন, পরিচিত নবিশি, এসবে তেমন নেই। হয়তো আঙুল টেনে নিয়ে গিয়েছে কোথাও, বহুদূর। যেমন, “মুখর ভালোবাসা হঠাৎ মাথা নিচু করে / এগিয়ে যাচ্ছে। তেমন করে ঠিকঠাক বোঝানো গেল না কিছুই, আসলে সব কিছু বুঝিয়ে বলতে / পারে না সকলে, এত কথা বলে তবু কাজের কথাটা কাছাকাছি বসে বলা হয়ে ওঠে না সকলের”। তাতে কি! আমিও তো গিয়েছি। কিসের পরোয়া! আমি তো জানি, ‘তুমি / রাত তিনটেতে ঘরে ফেরো অথবা পানিফল খাও/ কেউ তা নিয়ে মাথাব্যথা করবে না --। সুতরাং আমি চাইছি সেই ঘটনা / দৃশ্য নিজের মতো করে। যেমন, “ফুলটির কালচে মেটেতে ছুঁয়েছে হাত, / সে হাত আগুন, / সে হাত নৈঃশব্দ,--দাউদাউ জ্বলে / উঠল বন, আর দরজার পাশ থেকে / নীরব ছায়ারা হারিয়ে যাচ্ছে”।
আমি, লিপি, এই আধখানা জীবনে জেনেছি, আমার অশ্রুর জন্য চরাচরে অপেক্ষা আছে, আড়ালে কোথাও। জানি, “এই তো কপালে ফুঁ দিয়ে দিলাম / এবার ঘুমোও”। এমন প্রাপ্তি যেন লৌকিক নয়। এই ছুঁয়ে দিচ্ছি, এই নেই-শরীর। শুধু টের পাই, দাঁড়িয়ে আছে কোথাও এক ‘সুজন’ এমন নামাবলী জড়িয়ে, যিনি বলবেন “কোনোদিন তুমি আচমকা পেয়ে যেতে পারো একটা / নাগকেশরের ফুল অথবা নরম নূপুর ছুঁয়ে থাকা ঘাস...”।
সুতরাং, স্বীকারে তো লজ্বা নেই “কতটুকু জানি একটা সময়কে? একটা মুহূর্তকে?” আমি আমার মতো করে তাই বলব, “হাতের ভঙ্গিমা থেকে বরফগুলো / ঝরে পড়ছে গ্লাসে, গ্লাস থেকে চলকে / নামছে সোনালী - এই তো একটা মুহূর্ত / আর কিছু অনিবার্য শব্দের তীব্র গতির কাঁটা”। এই শরীরে, এই দেখা, ফুলটা ফুটছে, এই তাবৎ ক্রিয়া—আমি নিয়ন্ত্রণ করব। ভেঙে ফেলার জন্য আঙুলে জড়িয়ে নেব কলম। আমার আকাশে তো আমিই স্বরাট। আমি লিখব, ঘন হয়ে এসো, নাভির স্পর্শে সুগন্ধি পাবে, / ঘাসের ডানায় সাদা-গোলাপি -/ টসকানো ফল হাতে তুলে নাও--।
আমার মেধা আছে, স্বপ্ন আছে, এই মহার্ঘ শরীর আছে। আমি-ই শাসন করব আমার সৃষ্টিকে। টসকানো কিংবা পশ্চিমাবায় -- এমন শব্দ ব্যবহারে কেউ কোথাও হয়তো চোখ সরু করবেন, কী এসে গেল তাতে! তাঁরা পড়বেন না। মিটে গেল তাঁদের সমস্যা। আমি এঁকে যাব “...ভাঙা সন্ধ্যেরা ছড়ানো হাসিতে টুকরো পালটা, / ঝাপসা মেঘের আনাচ বেয়ে ফোঁটা টুপটাপ / রঙ চুঁইয়ে নীরব আবছা বরিষ-নামানো মেঘ হাঁটছে-”। যদি কেঊ খেয়াল করেন ঐ ‘টুকরো পালটা’ অথবা ‘মেঘের আনাচ’, যদি একটুও ভালো লাগে তার, মনে হয় যদি তার, বেশ নতুন এক গড়ন প্রাপ্তি হলো, সে ভার তবে তার সমস্যা, আমার কিছু নয়। আমি তো ভাসিয়ে দিয়েছি “গুনগুন করে গান করছিলাম / নাকি গুনগুন... একটা খোলা বারান্দার / এক কোণে শুধু সকাল হচ্ছিল।” বলেই দিয়েছি “সমস্ত ছাঁইপাশ / ছুঁড়ে ফেলে লালমোমবাতি জ্বালিয়ে দিতে / পারো...”। জানিয়ে দিয়েছি সকৌতুকে “—ফ্যান্টম কখনো মোমো খায়নি, গাছবাড়ি তৈরি হলে ফ্যান্টম / আর ডায়না আর তাদের ছেলেপুলে মিলে বংশপরম্পরায় / ক্রমাগত মোমো খাবে...”।
জনৈক পাঠক, তিনি নাকি কবিতা-টবিতাও লিখে থাকেন এক অদ্ভুত আদবে, জানিয়েছেন, তাঁর জন্য এই ‘সাইলেন্ট মোড’-এর কোথাও কোথাও তাঁর চপলাফেরার স্পেস কমিয়ে দিয়েছি আমি। ধুস্! আমি কেন এমন করতে যাব! কারও জন্যই তো এ সব বলিনি আমি। কবিতা কি কথা বলা! কবিতায় কি আমি কোনো বার্তা পৌঁছে দিতে চাই! কার কাছে? ঠিক কার কাছে? ব্যক্তিগত অভিমান কি সে ছলে বড় হয়ে উঠছে? তিনি প্রশ্ন করেছেন, শব্দের বর্ণাঢ্য চলমান শরীর কি সে পথে কেবল দৃশ্যমান? কোথায় যাচ্ছে তবে তারা? সঞ্চয় কি থাকছে কিছু সে প্রয়াসে? আমি নিরুত্তর। অবশ্য এরপরেও তিনি জানিয়েছেন, বেশ কিছু সময়ে তিনি নাকি আমার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকেও পড়তে পেরেছেন সাইলেন্ট জোন-এ। দেখেছেন, “...বিপন্ন আড়ালে একটা শুঁয়োপোকা বুনে / চলেছে মায়াজাল, একদিন ঝাঁক ঝাঁক / প্রজাপতি আর ...”। এমন সম্ভাবনায় তাঁর খুব পুলক হয়েছে। তিনি নাকি এমনভাবে দেখতে চাইবেন আবার তার চারপাশের পুরনো পৃথিবীটাকে। তা তিনি চাইলে, দেখুন। আমার কী বলার আছে! আমি তো বলেছি, “যা কিছু নরম আর সুন্দর তা সব রাখা থাক / বন্ধুর জন্য”। বলেছি, “...হেলিবেরি, এখানে বৃষ্টি পড়ছে, ওখানে / পড়ছে কি? / পড়ছেই তো ক্রমাগত”। জানিয়ে দিয়েছি, “মোমনাভি থেকে পায়ের পাতায় এত স্বরলিপি, / আশ্চর্য সেতারের সুর বেজেই চলেছে”। এমন সুরেই জ্বালাতে চাই বারান্দার নিরালা কোণের আমার ওই নৈঃশব্দ।
( সাইলেন্ট মোড / লিপিকা ঘোষ / কবিতা পাক্ষিক )
শূন্যে চিত্রিত কিছু রেখা। ইতঃস্তত। ব্যাকরনহীন। অথবা স্বাধীন, তাই। কেবল সাইলেন্ট মোড-এ। মহাশূন্যে তো শব্দ নেই, তাই। তাই, আমি লিপি, লিপিকা, অসঙ্কোচে লিখে যাই “কালো জমিনে অবিশ্বাস্য কারুকাজ করা / গহিন ঢুকে উথলে উঠছে রাত্রি- /আমি তো রাত্রি চিনি, শরীর চিনি আজন্ম, কোথায় কোন গহনে উথলে ওঠে রাত্রি, টের পাই সেই সব গ্রেসফুল ন্যুডলুক...”।
এই বিচিত্র সঙ্কর সময়ে তো লুকোছাপার অন্ত নেই! কোথাও তেমন অলিন্দ কই, যেখানে ইচ্ছেমতো হেঁটে যেতে যেতে উচ্চারণ করতে পারব “গ্লসি লিপ থেকে ত্রিকোণ প্যাটিসে টুকরো কামড় / আহ্!” তাই তো লিখে ফেলি “এই নগ্ন চোখে ঠোঁটের নিভৃত নিপুণ স্পর্শ / অমৃত-স্রোত নামছে কন্ঠশিরায় শিরায় / শব্দঝালর আড়াল করছে এই নির্জন, / সতেজ ভঙ্গী সব ওঠানামা আরো সাবলীল / মাঝখানে তুমি গভীর জাগছো বসন্তনিশি”।
আমি জানি, এসব লেখার মধ্যে আমি যতটা বেঁচে আছি, যত আমি আমার ইচ্ছাধীন, পরিচিত নবিশি, এসবে তেমন নেই। হয়তো আঙুল টেনে নিয়ে গিয়েছে কোথাও, বহুদূর। যেমন, “মুখর ভালোবাসা হঠাৎ মাথা নিচু করে / এগিয়ে যাচ্ছে। তেমন করে ঠিকঠাক বোঝানো গেল না কিছুই, আসলে সব কিছু বুঝিয়ে বলতে / পারে না সকলে, এত কথা বলে তবু কাজের কথাটা কাছাকাছি বসে বলা হয়ে ওঠে না সকলের”। তাতে কি! আমিও তো গিয়েছি। কিসের পরোয়া! আমি তো জানি, ‘তুমি / রাত তিনটেতে ঘরে ফেরো অথবা পানিফল খাও/ কেউ তা নিয়ে মাথাব্যথা করবে না --। সুতরাং আমি চাইছি সেই ঘটনা / দৃশ্য নিজের মতো করে। যেমন, “ফুলটির কালচে মেটেতে ছুঁয়েছে হাত, / সে হাত আগুন, / সে হাত নৈঃশব্দ,--দাউদাউ জ্বলে / উঠল বন, আর দরজার পাশ থেকে / নীরব ছায়ারা হারিয়ে যাচ্ছে”।
আমি, লিপি, এই আধখানা জীবনে জেনেছি, আমার অশ্রুর জন্য চরাচরে অপেক্ষা আছে, আড়ালে কোথাও। জানি, “এই তো কপালে ফুঁ দিয়ে দিলাম / এবার ঘুমোও”। এমন প্রাপ্তি যেন লৌকিক নয়। এই ছুঁয়ে দিচ্ছি, এই নেই-শরীর। শুধু টের পাই, দাঁড়িয়ে আছে কোথাও এক ‘সুজন’ এমন নামাবলী জড়িয়ে, যিনি বলবেন “কোনোদিন তুমি আচমকা পেয়ে যেতে পারো একটা / নাগকেশরের ফুল অথবা নরম নূপুর ছুঁয়ে থাকা ঘাস...”।
সুতরাং, স্বীকারে তো লজ্বা নেই “কতটুকু জানি একটা সময়কে? একটা মুহূর্তকে?” আমি আমার মতো করে তাই বলব, “হাতের ভঙ্গিমা থেকে বরফগুলো / ঝরে পড়ছে গ্লাসে, গ্লাস থেকে চলকে / নামছে সোনালী - এই তো একটা মুহূর্ত / আর কিছু অনিবার্য শব্দের তীব্র গতির কাঁটা”। এই শরীরে, এই দেখা, ফুলটা ফুটছে, এই তাবৎ ক্রিয়া—আমি নিয়ন্ত্রণ করব। ভেঙে ফেলার জন্য আঙুলে জড়িয়ে নেব কলম। আমার আকাশে তো আমিই স্বরাট। আমি লিখব, ঘন হয়ে এসো, নাভির স্পর্শে সুগন্ধি পাবে, / ঘাসের ডানায় সাদা-গোলাপি -/ টসকানো ফল হাতে তুলে নাও--।
আমার মেধা আছে, স্বপ্ন আছে, এই মহার্ঘ শরীর আছে। আমি-ই শাসন করব আমার সৃষ্টিকে। টসকানো কিংবা পশ্চিমাবায় -- এমন শব্দ ব্যবহারে কেউ কোথাও হয়তো চোখ সরু করবেন, কী এসে গেল তাতে! তাঁরা পড়বেন না। মিটে গেল তাঁদের সমস্যা। আমি এঁকে যাব “...ভাঙা সন্ধ্যেরা ছড়ানো হাসিতে টুকরো পালটা, / ঝাপসা মেঘের আনাচ বেয়ে ফোঁটা টুপটাপ / রঙ চুঁইয়ে নীরব আবছা বরিষ-নামানো মেঘ হাঁটছে-”। যদি কেঊ খেয়াল করেন ঐ ‘টুকরো পালটা’ অথবা ‘মেঘের আনাচ’, যদি একটুও ভালো লাগে তার, মনে হয় যদি তার, বেশ নতুন এক গড়ন প্রাপ্তি হলো, সে ভার তবে তার সমস্যা, আমার কিছু নয়। আমি তো ভাসিয়ে দিয়েছি “গুনগুন করে গান করছিলাম / নাকি গুনগুন... একটা খোলা বারান্দার / এক কোণে শুধু সকাল হচ্ছিল।” বলেই দিয়েছি “সমস্ত ছাঁইপাশ / ছুঁড়ে ফেলে লালমোমবাতি জ্বালিয়ে দিতে / পারো...”। জানিয়ে দিয়েছি সকৌতুকে “—ফ্যান্টম কখনো মোমো খায়নি, গাছবাড়ি তৈরি হলে ফ্যান্টম / আর ডায়না আর তাদের ছেলেপুলে মিলে বংশপরম্পরায় / ক্রমাগত মোমো খাবে...”।
জনৈক পাঠক, তিনি নাকি কবিতা-টবিতাও লিখে থাকেন এক অদ্ভুত আদবে, জানিয়েছেন, তাঁর জন্য এই ‘সাইলেন্ট মোড’-এর কোথাও কোথাও তাঁর চপলাফেরার স্পেস কমিয়ে দিয়েছি আমি। ধুস্! আমি কেন এমন করতে যাব! কারও জন্যই তো এ সব বলিনি আমি। কবিতা কি কথা বলা! কবিতায় কি আমি কোনো বার্তা পৌঁছে দিতে চাই! কার কাছে? ঠিক কার কাছে? ব্যক্তিগত অভিমান কি সে ছলে বড় হয়ে উঠছে? তিনি প্রশ্ন করেছেন, শব্দের বর্ণাঢ্য চলমান শরীর কি সে পথে কেবল দৃশ্যমান? কোথায় যাচ্ছে তবে তারা? সঞ্চয় কি থাকছে কিছু সে প্রয়াসে? আমি নিরুত্তর। অবশ্য এরপরেও তিনি জানিয়েছেন, বেশ কিছু সময়ে তিনি নাকি আমার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকেও পড়তে পেরেছেন সাইলেন্ট জোন-এ। দেখেছেন, “...বিপন্ন আড়ালে একটা শুঁয়োপোকা বুনে / চলেছে মায়াজাল, একদিন ঝাঁক ঝাঁক / প্রজাপতি আর ...”। এমন সম্ভাবনায় তাঁর খুব পুলক হয়েছে। তিনি নাকি এমনভাবে দেখতে চাইবেন আবার তার চারপাশের পুরনো পৃথিবীটাকে। তা তিনি চাইলে, দেখুন। আমার কী বলার আছে! আমি তো বলেছি, “যা কিছু নরম আর সুন্দর তা সব রাখা থাক / বন্ধুর জন্য”। বলেছি, “...হেলিবেরি, এখানে বৃষ্টি পড়ছে, ওখানে / পড়ছে কি? / পড়ছেই তো ক্রমাগত”। জানিয়ে দিয়েছি, “মোমনাভি থেকে পায়ের পাতায় এত স্বরলিপি, / আশ্চর্য সেতারের সুর বেজেই চলেছে”। এমন সুরেই জ্বালাতে চাই বারান্দার নিরালা কোণের আমার ওই নৈঃশব্দ।
( সাইলেন্ট মোড / লিপিকা ঘোষ / কবিতা পাক্ষিক )
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন