কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

০৩) কাজল সেন

দোলনচাঁপা
কাজল সেন




ত্রিকোণ পার্কের বাঁদিক ঘেষে যে কায়দা মারা বেঞ্চিটি পাতা আছে, তাতে নরহরিকে প্রতিদিন দেখা যায়, শুয়ে আছে। না, রাতে নয়, দিন দুপুরে। সুবলমামা, মানে বাচ্চা থেকে বুঢ্‌ঢা সবারই সুবলমামা, এটা অনেকদিন থেকে লক্ষ্য করেছেন। তবে সুবলমামা সম্পর্কে, মানে কার মামা, কেন মামা, মামার বোন বা দিদিই বা কে, ঠিকঠাক কিছুই জানা নেই কারও। তা সেই সুবলমামাই একদিন আচমকা আবিষ্কার করলেন, নরহরি বেঞ্চিতে বসে আছে। যে মানুষ শুয়ে থাকতে পারে, সে যে বসতেও পারে, এর মধ্যে তো কোনো অলৌকিক ব্যাপার স্যাপার থাকতে পারে না! কিন্ত সুবলমামা দৃশ্যটা দেখে এতটাই অভিভূত ও উত্তেজিত হয়ে পড়লেন যে, তাঁর মনে হলো, এটা কোনো লৌকিক ব্যাপার হতেই পারে না! এটা একটা অলৌকিক ব্যাপার। এবং তাছাড়া এই যে নরহরি প্রতিদিন দুপুরে তার ঘরের বিছানা ছেড়ে এতটা পথ হেঁটে এসে, ত্রিকোণ পার্কের বাঁদিক ঘেষে কায়দা মারা বেঞ্চিটিতে শুয়ে থাকে, এটাও তো কম অলৌকিক নয়! সুবলমামা গভীর ধৈর্য আর গহীন মনোনিবেশ সহকারে বহুদিন লক্ষ্য করেছেন, নরহরির এই হেঁটে আসা ও শুয়ে থাকার প্রত্যেকটি এপিসোড। একটা মানুষ রোজ দুপুরে কেন শুতে আসে ত্রিকোণ পার্কের বেঞ্চিতে? তাও না হয় প্রতিদিন দেখতে দেখতে নরহরির শুয়ে থাকাটা অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছিল সুবলমামার। দু’চোখ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা বলে বসে থাকা! না, এই বসে থাকার দৃশ্যটা দেখতে তাঁর চোখ কখনই অভ্যস্ত নয়। নরহরিকে কখনও বসে থাকতে দেখেননি সুবলমামা। মনে মনে তিনি নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন, এটা অবশ্যই একটা অলৌকিক দৃশ্য।

নরহরির ঘরে বউ আছে। একটাই বউ। একটা মেয়েও আছে। পার্বতী। তবে কাছে থাকে না। কিছুদিন হলো বিয়ে করে বরের সঙ্গে চলে গেছে। বিয়েটা নিয়ে বিস্তর ঝামেলাও হয়েছিল। মেয়ের মা, মানে তার বউ, কিছুতেই রাজী হয়নি মেয়ের পছন্দের ছেলেকে জামাই করতে। আবার ছেলের মা-বাবাও বেঁকে বসেছিল নরহরির মেয়েকে পুত্রবধূ করে ঘরে তুলতে। একমাত্র নরহরি। একমাত্র নরহরিই বিয়েটা দেবার জন্য একেবারে মালকোঁচা মারা ধুতি জোগাড় করে তৈরি হয়ে বসেছিল। মেয়ের পছন্দের ছেলে বলে কথা! তাকে তো সে সাদরে বরণ করে নেবেই! নরহরি না হয় তার নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে পারেনি। দোলনচাঁপার সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি। সে দুঃখে এখনও তার বুক ফেটে যায়। ফুসফুস থেকে কেমন একটানা ঝিঁঝির ডাক উঠে এসে কানে তালা লাগিয়ে দেয়। নরহরির মেয়ে কিন্তু দারুণ এলেমদার। পার্বতী যখন দেখলো, বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি – দু’বাড়িতেই হেভি ঝুট ঝামেলা চলছে, সে আর দেরি করলো না। সে বাপের বাড়িতেও থাকলো না। আবার শ্বশুরবাড়িতেও ঢুকলো না। ছেলেটিকে বগলদাবা করে সটান গেল মন্দিরে। পুরোহিতকে ধমকে বরকে দিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে নিলো। তারপর কোনো ভোজের ব্যবস্থা না করেই সরাসরি উঠলো একটা হোটেলে। সেখানে নিজেই নিজের ফুলশয্যার খাট সাজালো। বরকে আদর করলো। বরের আদর খেলো। আর তার দিন কয়েক পরেই উঠে গেল একটা ভাড়া বাড়িতে। নিজের মা’কে কষে দুষলো – শত্তুর! শ্বশুর-শাশুড়িকে গালাগালি দিলো – দুশমন! বাবাকে বললো – দেখলে তো! নরহরি সব দেখলো। দেখে খুব খুশি হলো। আর সেইসঙ্গে আপশোষ। দোলনচাঁপা কেন তাকে এভাবে বগলদাবা করে নিয়ে যেতে পারলো না?

দোলনচাঁপা চেয়েছিল নরহরি তাকে নিয়ে পালিয়ে যাক। দু’বাড়িতেই যখন সমান আপত্তি, তখন এছাড়া আর উপায় কি! ত্রিকোণ পার্কের এই কায়দা মারা বেঞ্চিতে বসেই তাদের যাবতীয় ভালোবাসার কথা, আলতো করে শরীর ছোঁওয়া, বিয়ের জন্য শপথবাক্য পাঠ করা, সব কিছুই হয়েছিল। এবং শেষপাতে অনেক ভেবেচিন্তে দোলনচাঁপা নরহরিকে পরামর্শ দিয়েছিল, তুমি আমাকে নিয়ে পালাও। পরামর্শ শুনে হকচকিয়ে গেছিল নরহরি। পালাবে! কোথায় পালাবে? কেমন করে পালাবে? দোলনচাঁপা জানিয়েছিল, পরের দিন ঠিক দুপুর দুটো বেজে সাতচল্লিশ মিনিটে সে আসবে। নরহরি তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার জন্য অবশ্যই যেন অপেক্ষা করে।

নরহরি অপেক্ষা করেছিল। ত্রিকোণ পার্কের বাঁদিক ঘেষে পেতে রাখা এই কায়দা মারা বেঞ্চিতে বসেই অপেক্ষা করেছিল। তার হৃৎপিন্ডে তখন হাজার হাতুড়ির দমাদ্দম আওয়াজ। শিরায় ধমনীতে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের ভয়ংকর গতির বান। দোলনচাঁপাকে নিয়ে সে পালাবে। কিন্তু পালিয়ে কোথায় যাবে? কোন্‌ বনবাসে? না, তখনও কিছুই ঠিক করে উঠতে পারেনি নরহরি। তখনও!

তারপর একটু একটু করে সময় বয়ে গেল। সূর্য পশ্চিমে ঢলে গেল। বসে থাকতে থাকতে শ্রান্ত ক্লান্ত নরহরি একসময় সেই বেঞ্চিতেই শুয়ে পড়ল। দোলনচাঁপা এলো না।

নরহরি জানে, সুবলমামা তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে। কী দেখেন সুবলমামা? শুধু তার শুয়ে থাকা দেখেন? নরহরি ভাবে, সুবলমামা যতই তাকে চোখ-পাহারায় রাখুন না কেন, তাকে আর বসে থাকতে কখনও দেখবেন না। ত্রিকোণ পার্কের বাঁদিক ঘেষে পেতে রাখা এই কায়দা মারা বেঞ্চিতে তার বসে থাকার আর যে কোনো সিন্‌ই নেই!

তা প্রতিদিনের মতো সেদিনও যথারীতি নরহরি এসে শুয়েছিল ত্রিকোণ পার্কের সেই কায়দা মারা বেঞ্চিতেই। এদিকে সুবলমামাও যথারীতি দু’চোখ তাক করে রেখেছিলেন নরহরির ওপর। সময় তখন কত হবে? হয়তো দুপুর দুটো সাতচল্লিশের কালো দাগ পেরিয়ে যেতে তখন ঘড়ির কাঁটা খুবই ব্যস্ত। আর ঠিক তখন। আর ঠিক তখনই সেলফোনটা বেজে উঠলো কাঁই কাঁই করে। নরহরি শুয়ে শুয়েই পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করে কানে ঠুসে দিলো। ফোনের অন্য প্রান্তে নরহরির জামাইবাবাজী নিবারণ। নিবারণ সেনশর্মা। নিবারণ জানালো, এই একটু আগে নরহরির কন্যা পার্বতী নিজেই একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেছে। সেইসঙ্গে নিবারণ আরও জানালো, তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কন্যাসন্তানের আশাই করেছিল। আর তাই অনাগত কন্যার নামও তারা ঠিক করে রেখেছিল। এবং আজ সেইমতো নবজাতিকার নাম রাখা হলো দোলনচাঁপা। দোলনচাঁপা সেনশর্মা।

তখনও নরহরি শুয়েই ছিল। কিন্তু হঠাৎ কী যে হলো, নরহরি উঠে বসলো। অনেক, অনেকদিন পর দুপুর ঠিক দুটো সাতচল্লিশ মিনিটে ত্রিকোণ পার্কের বাঁদিক ঘেষে পেতে রাখা কায়দা মারা বেঞ্চিতে এতদিনের শয্যা ছেড়ে উঠে বসলো নরহরি জোয়ারদার।


5 কমেন্টস্:

  1. খুব মায়াময়... মধুর কাহিনী। ঝুরো বটে... আবার মাখো মাখোও। খুব ভালো লাগল দাদা।

    শ্রাবণী দাশগুপ্ত।
    রাঁচি।

    উত্তরমুছুন
  2. 'Dolonchanpa' phire elo, phire aase. Mrittuhin bhalobasai jege uthe prithibi bar-bar. Asamanno lekha. Bhalo laglo Kajalda.


    Sonali Begum
    Ghaziabad

    উত্তরমুছুন
  3. জম্পেশ গল্প। মনে থাকবে এই গল্পের রেশ।

    উত্তরমুছুন
  4. Minakshi Mukherjee · English M.A. from Burdwan University
    ঝুরো গল্প হলেও সমগ্র রূপে পরিপূর্ণ।
    ব্যঞ্জনা দ্বারা অভিব্যক্ত 'ত্রিকোণ পার্কের কায়দা মারা বেঞ্চি ' , সুন্দর ভাবে কায়দা করে অনেক কিছু বলছে। একটা মনস্তত্ত্ব (মনের যর্থাথ অবস্থা ) র দিক, দর্শন ও অতৃপ্তির পূর্ণতা র মধ্যে দিয়ে সার্থক গল্প, পাঠকের হৃদয়গ্রাহী ।
    Reply · Like · Unfollow Post · February 26 at 7:16pm

    উত্তরমুছুন
  5. galpata valo hoyeche sajano gochano bes ar ekta oti sampratik gaaner katha mone porche somlatar gaoya school bus e achena ek mukh sei sukanto galpa..

    উত্তরমুছুন