চশমার ইতিবৃত্তান্ত
আপনি তো চশমা পরেন!
কিন্তু চশমাকে পড়েছেন কখনও? চশমা মানে একটা ফ্রেমে দুটো কাচ আর দুটো ডাঁটি কানের পিছনে আটকানো। এই
তো? চশমা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায়, এই তো? ধরুন আপনার সন্তান স্কুলে গিয়ে বোর্ডের
লেখা ভালো ভাবে দেখতে পাচ্ছে না, সন্ধ্যে
হলেই মাথা যন্ত্রণা শুরু হচ্ছে। আপনি দুদিন ওর কথায় কান দিলেন না, কিন্তু পরে
ভাবলেন, একজন চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়েই যাই ওকে। গেলেন, আর ডাক্তারবাবু আপনাকে রীতিমত
ধমকে দিয়ে বললেন, এতদিন কী করছিলেন? ছেলের
চোখটা তো গেছে! এইবার আপনার দুধের বাছার চোখে চশমা উঠল। অথবা একদিন আপনি নিজেই
দেখলেন কাগজ পড়তে ছোট লেখা গুলিয়ে যাচ্ছে। কাগজটা একটু দূরে নিয়ে গিয়ে পড়তে শুরু
করলেন কিছুদিন। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। অতএব আবার আপনাকে চোখের ডাক্তারের কাছে
যেতে হলো। আপনার চোখেও উঠে এ্লো চশমা।
আপনি এতক্ষণে জেনে
গেছেন যে আপনার আর আপনার বাচ্চার চশমার মধ্যে কিছু তফাৎ আছে। আপনাকে চালশে ধরেছে।
তাই কাছের জিনিস আপনি দেখতে পান না। সেই জন্য আপনার চোখে উঠেছে বাই ফোকাল চশমা।
অর্থাৎ দুটো দৃষ্টি রয়েছে আপনার চশমায়। রিডিং রেঞ্জের বাইরে যা আপনি দেখবেন সেটাই
আপনার দূরের দৃষ্টি। এর সঙ্গে দূরদৃষ্টির কোনো সম্পর্ক নেই, সেটা মাথায় রাখবেন!
বাই ফোকাল চশমার লেন্সে আপনি নিচের দিকে
উল্টোনো অর্ধ চন্দ্রাকৃতি একটা এলাকা দেখতে পাবেন। ওখান দিয়ে আপনি কাছের জিনিস পরিষ্কার
দেখতে পাবেন। আর ওই এলাকা দিয়ে আপনি দূরের জিনিস দেখতে গেলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবেন,
সেটাও খেয়াল রাখবেন। তাহলে এখন আপনাকে একটা অভ্যেসের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। যেমন
যেমন দেখতে চান, তেমন তেমন চোখকে ওঠানামা করানোটাই এখন আপনার লক্ষ্য জানবেন। এইবার
দেখা গেল, আপনি হয়তো খুব অধৈর্য, বা ওই অর্ধচাঁদ দেখা গেলে অন্যরা যদি বুড়ো ভাবে আপনাকে, তাই লজ্জায় মাথা যাতে না
কাটা যায়, তার জন্য একটা দামী প্রগ্রেসিভ লেন্সের অর্ডার দিয়ে ফেললেন। চশমা এলে
দেখলেন, যাক বাবা, নিশ্চিন্ত, ওই আধা
চাঁদটা আর নেই। পরেও দেখলেন চোখ ওঠানামা করা অনেক সহজ হচ্ছে আপনার কাছে। কাছে আর
দূরের দৃষ্টির মধ্যে যে একটা বর্ডার লাইন ছিল, সেটা আর নেই। তাই আপনি এবার সীমানা
টপকে সহজ হলেন। কিন্তু এই প্রগ্রেসিভ লেন্সের ব্যাপারটা কি? আপনি জানেন? খুব সহজ
কথায় বলতে গেলে, এই প্রগ্রেসিভ লেন্সে শুধু দুটো ভিসন থাকে না, বাই ফোকালের মতো।
ভালো লেন্সে সাতটা পর্যন্ত রেঞ্জ থাকে। আর
সাধারণ যে লেন্স ব্যবহার হয়, সেখানে ট্রাই ফোকাল অর্থাৎ তিনটে রেঞ্জ থাকে। কাছের,
তার পরের এবং তারও পরে আর একটু দূরের। এতে আপনি যেদিকেই তাকান না কেন, সমান ভাবে
দেখতে পাবেন।
এবার আপনার বাচ্চার
কথায় আসি। বা যে চশমা পরা অল্পবয়সী মিস এসে ওকে পড়িয়ে যায়, ওদের তো আর বাইফোকাল
হওয়ার বয়স হয় নি। তাহলে? আপনার বাচ্চাটির দূরের বোর্ড দেখতে অসুবিধে হতো এবং সঙ্গে
মাথার যন্ত্রণাও। তার মানে ডাক্তারবাবু
ওকে দিয়েছেন মাইনাস পাওয়ার। আর যে মেয়েটি ওকে পড়ায়, তাকে একবার ভালো করে দেখুন,
আরে না না, তার চশমার দিকে একবার খরদৃষ্টি দিন। দেখবেন মেয়েটির চোখগুলো লেন্সের মধ্যে দিয়ে একটু
যেন স্বাভাবিকের থেকে বড় দেখাচ্ছে। তার
মানে, ওর প্লাস পাওয়ার। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন আপনার বাই ফোকাল বা প্রগ্রেসিভেও প্লাস
পাওয়ার। কাছের জিনিসকে আপনার দৃষ্টির নাগালে নিয়ে যেতে গেলে ওই প্লাস অর্থাৎ যোগ
করতে হয়েছে। মানে ডাক্তারবাবুরা লিখেছেন অ্যাডিশন +1.00 Dsp. এবার আপনার ছেলের প্রেসকিপশনটার দিকে দেখুন। রাইট
আইয়ের খোপে লেখা আছে -0.75 Dsp
-0.25 Dcyl 90 degree. Left eye
-1.00Dsp. কিছু বুঝলেন কি? ওই ডিএসপির অর্থ বা
ডিসিল-এর অর্থ বা ওই সব শেষে যে ডিগ্রি দেওয়া আছে তারই বা কি অর্থ? এটা বুঝতে গেলে
আপনাকে একটুখানি লেন্সের সম্বন্ধে ধারণা রাখতে হবে। ছোটবেলার ভৌত বিজ্ঞানের ক্লাস
মনে করুন। লেন্স দু'রকম। কনকেভ আর কনভেক্স।
এবার আপনার পাওয়ার যদি মাইনাস হয়, মানে আপনার দূরের দৃষ্টি কমজোরী হয়, তাহলে
মাইনাস পাওয়ার দিয়ে আপনার দূরত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। আর কাছের দৃষ্টির
কথা তো আগেই বলেছি বাইফোকালের সময়ে। কাছের দৃষ্টিচ্যুতি ঘোচাবে প্লাস পাওয়ার।
এইবার ওই ডিএসপি আর
ডিসিল-এর প্রসঙ্গে আসি। D মানে diopter. 0.25 diopter একটি স্কেল। ঠিক যেভাবে টেনিসের পয়েন্ট
গোনা হয়। এসপি মানে স্ফেরিকাল। স্ফিয়ার শব্দটি এসেছে বিশুদ্ধ জ্যামিতি থেকে। আপনার
চোখের ত্রুটি শোধন করার জন্য কতগুলো বক্রতলের প্রয়োজন হয়। স্ফেরিকাল পাওয়ার + বা –
দুইই হতে পারে। যেমন +1.75D বা -0.50D. আর ডিসিলের ডি মানেও সেই ডায়প্টর। সিল
মানে হলো সিলিন্ড্রিকাল। সিলিন্ড্রিকাল পাওয়ারের ক্ষেত্রে
অ্যাক্সিস থাকবেই। 180 ডিগ্রি সরলরেখাকে বেস ধরা হয়। এক্ষেত্রে রুগির টরিক লেন্সের দরকার
পড়ে। এই টরিক লেন্সটি বিভিন্ন অক্ষে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নেওয়া হয় যে কোন
অ্যাক্সিসে এলে রুগির দৃষ্টি সরলরেখায় আসে। অর্থাৎ এতক্ষণ যে কৌণিক ত্রুটি ছিল তার
চোখে, সেটি এই সিলিনড্রিকাল অ্যাক্সিসে ফেলে মুক্ত করা হলো। যথারীতি সিলিনড্রিকাল পাওয়ারও + বা – হতে পারে। যেমন -2.25DCyl 85 degree
বা +1.75DCyl
90degree. আর
লেন্স যেমন কাচের হতে পারে তেমনি ফাইবারেরও হয়। তবে বাজারে এখন ফাইবার লেন্সেরই
জনপ্রিয়তা বেশি।
আপনার চশমা আপনার
চোখের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। অন্তত গায়ে পড়া কন্ট্যাক্ট লেন্সের মতো নয়,
মিনিমাম ডিগনিটি তার আছে। তাই চশমাকেও একটু সমীহ করে চলুন। তাই এবার ভাবুন, যে চশমা ছাড়া
আপনি অচল, তার দেখভাল করেন তো নিয়ম মতো? বাজার চলতি ফ্যাশন অনুযায়ী চশমা তো
পাল্টান, কিন্তু তার যোগ্য মর্যাদা তাকে
আপনি দেন কি? কখনও ভেবে দেখেছেন, যে চশমা ভেঙে গেলে আপনি চোখে অন্ধকার দেখেন, তাকে
সেই নতুন কেনার পর আর সেভাবে দেখেন নি! এবার আপনার ছ’মাস বা এক বছর বয়সী চশমার
দিকে তাকান ভালো করে। কেমন মলিন লাগছে না
ওকে পুরনো প্রেমিকার মতো! এবার চশমাটিকে টেবিলের
ওপর দু ডাঁটি ছড়িয়ে রাখুন। দেখুন দুটো হ্যান্ডেলের শেষ প্রান্ত টেবিলে ঠেকে আছে
কিনা। একবার ওকে চিত করে দেখুন আর একবার উপুড় করে। যদি আপনার চশমার হ্যান্ডেল দুটি টেবিলের পিঠ ছুঁয়ে
না থাকে সমান ভাবে, একটি উঠে বা নেমে রয়েছে দেখেন, তক্ষুনি আপনার ভরসাযোগ্য চশমার
দোকানে গিয়ে সেটিকে ব্যালেন্স
করিয়ে আনুন। এই ব্যালেন্স ঠিক না থাকলে আপনার ভিসনের ওপরে উল্টো প্রভাব পড়ে। তখন
আপনার চশমার লেন্স আপনার দৃষ্টিকে ঠিক করার বদলে বেলাইনে চলে যায় এবং আপনার দৃষ্টি
আরও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ব্যালেন্স ঠিক করিয়ে আনার পর আপনার বস স্বভাব একটু পাল্টান।
যেমন কখনই এক হাতে চশমা খোলা বা পরা করবেন না, আজ থেকেই প্রতিজ্ঞা করুন। দু' হাতে
চশমা খোলা পরা করলে আপনার চশমার ব্যালেন্স সব সময় ঠিক থাকবে, এটা মাথায় রাখুন। আর
ঢিলে হয়ে আপনার নাকের কাছেও নেমে আসবে না। প্রথম চশমা কেনার সময়েও দোকান থেকে এই
ব্যালেন্সটা চেক করে নেবেন। আর চশমার ফ্রেমটি যেন আপনার ভ্রুর সমান্তরালে থাকে,
একদিকে হেলে না যায়।
আপনি তো এই গরমে দু'
তিনবার স্নান করেন গরম থেকে বাঁচবার জন্য; ঘাম থেকে, নোংরা থেকে, ধুলো-ময়লা থেকে বাঁচবার
জন্য। আপনার চশমার পরিষ্কৃতির ব্যাপারে কখনও ভেবেছেন? তবে এটা শুনে
ভুলেও কখনও চশমাকে ডুব-চান করাবেন না। অতটা অবগাহন চশমার সইবে না। একটা সুতির কাপড়
ভিজিয়ে রোজ অন্তত একবার করে ফ্রেম এবং লেন্সটিকে মুছুন। এরপর যেমন আপনি তোয়ালে
দিয়ে গা মোছেন, তেমনি চশমাটিকেও শুকনো কাপড় দিয়ে মুছুন। এই শুকনো কাপড় দিয়ে মোছাটা
সারাদিনে তিন চারবার অন্ততপক্ষে করবেন। ব্যাস্, আপনার চশমা যতদিন না ভাঙছে, ততদিন
নতুন বউয়ের মতো ঝকঝকে থাকবে।
সব শেষে বলি, আজকাল
চশমার ব্যবহার বাড়ছে দ্রুত হারে। বাচ্চাদের সবুজ শাকসব্জী খাওয়ান। আর দুধ বা
দুগ্ধজাত পদার্থ অবশ্যই। বাইরের জিনিস খাওয়াবেন না। দিনে অন্তত দুবার চোখে জলের
ঝাপটা দিন। অনেকক্ষণ যাঁরা কম্পিউটারে কাজ করেন, তাঁরা অবশ্যই অ্যান্টি রিফ্লেকটর কোটিং
দেওয়া লেন্স ব্যবহার করবেন চশমায়। কোনো হাতুড়ে দিয়ে নয়, অভিজ্ঞ অপথ্যালমোলজিস্টের
কাছে গিয়ে আপনার এবং আপনার পরিবারের সকলের
বছরে একবার চোখ পরীক্ষা করান। আপনার চোখ অমূল্য। তার যত্ন নিন। চশমা ব্যবহার করলে
তারও যত্ন নিন।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন