ধারাবাহিক
উপন্যাস
স্বর্গ এসেছে নেমে
(৮)
জন্মদিন অনঙ্গ সান্যালের। আয়োজক মনস্বিনী। অনঙ্গ সান্যাল নিজের জন্মদিন পালনের পক্ষপাতি নন, কিন্তু মেয়ের আবদারে মেনে নিতে হয়েছে তাকে। ওইদিন আশ্রিত ছেলেদেরও নিমন্ত্রণ থাকে কিন্তু তাদের সরাসরি অনুষ্ঠানে যোগ দেবার অনুমতি নেই। তাদের খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাদের ঘরে। মনস্বিনীর মা মাসী এই অনুষ্ঠানটিকেই বেছে নিলেন তাদের অ্যাকশনের জন্য। প্রতি বছরের মত এবারও খাবার পাঠানো হবে বৈশ্বানর আর দুই আশ্রিতকে। আন্না মাসী যেন খুব বেশী তৎপর খাবার পাঠানোর ব্যাপারে! মনস্বিনীর কেমন যেন সন্দেহ হল। বাবাকে জানাবে নাকি, যাদের দু’চোখে দেখতে পারে না মা মাসী তাদের খাবার পাঠানোর জন্য এত তাড়া কিসের। না, বাবাকে জানালে পরিস্থিতি ঘোরালো হতে পারে এই ভেবে পিছিয়ে গেল, তবে কড়া নজর রাখল মাসীর উপর। খাবার পাঠানো হল শেষ পর্যন্ত। না, ঐ তৎপরতা ছাড়া আর কিছু নজরে পড়ল না তেমন। রাত অনেকটাই বেড়ে গেছে। নিমন্ত্রিত যাঁরা, সকলেই তৃপ্তির উদ্গার তুলে ঘরমুখো। আন্না মাসীও বিদায় নিয়েছে। মনস্বিনী লক্ষ্য করল, কেমন এক অদ্ভূত নীরবতা পালন করছে মা, যা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। মনে একটা অস্বস্তি চেপে শুয়ে পড়ল মনস্বিনী। ভোরের আলো ফোটেনি তখনো। দারোয়ান মারফৎ খবর পৌঁছে গেল অনঙ্গবাবুর কাছে, গত রাত্রে খাবার খেয়ে তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিল বৈশ্বানর কিন্তু এখনো তার ঘুম ভাঙ্গছে না, যা কিনা তার স্বভাববিরুদ্ধ। অনঙ্গবাবু খবর পাবার সাথে সাথেই হাজির। ডাকলেন বৈশ্বানরকে। কোন সাড়া শন্দ নেই। অবাক হলেন তিনি, সকলের মত একই খাবার তো বৈশ্বানরও খেয়েছে তবে এটা কি করে সম্ভব, সকলে সুস্থ অথচ বৈশ্বানর অসুস্থ হয়ে পড়লো। মনস্বিনী কিন্তু একশত ভাগ নিশ্চিত যে এর পেছনে যাদের হাত সক্রিয় তারা তার মা-মাসি ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না, কিন্তু কি করে সম্ভব হল তার সজাগ দৃষ্টি এড়িয়ে। তবে কি সে যখন ব্যস্ত ছিল তার বন্ধুদের আপ্যায়নে সে সময়ের সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে মাসি? এখন এ নিয়ে তদন্ত শুরু করলে অভিযুক্ত যে দুজনকে পাওয়া যাবে তাদের মধ্যে একজন তার একান্ত আপনজন। সে ব্যাপার নিয়ে ভাবনার সময় পরেও পাওয়া যাবে। এখন যেটা করণীয় সে হল বৈশ্বানরকে ডাক্তার দেখানো। আগে তো নিশ্চিত হতে হবে বৈশ্বানরের শরীরে সত্যি বিষক্রিয়া হয়েছে কিনা। অনঙ্গবাবু আর মনস্বিনী দু’জনই বৈশ্বানরকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাবার পক্ষে রায় দিলেন।
ডাক্তারি পরীক্ষায় নিশ্চিত
হওয়া গেল, বিষক্রিয়ার ফলেই এই অচেতন অবস্থা বৈশ্বানরের। পরীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী,
বিষক্রিয়া ঘটেছে অতি সাধারণ কোন বিষাক্ত উদ্ভিদ থেকে সংগৃহীত শিকড় বা পাতার রস থেকে।
এই বিষের প্রভাব মৃত্যু ঘটায় না তবে মস্তিষ্কের ক্ষতি সাধন করতে পারে। চিকিৎসার দ্বারা
অবশ্য রোগীকে পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব তবে তা অন্তত মাসখানেকের ব্যাপার। মনস্বিনীর
ভাবনায় তখন বৈশ্বানরের পরীক্ষা। সে নিজেকেই দায়ী করছে এ জন্য। বৈশ্বানরের সঙ্গে তার
ঘনিষ্টতাই যত অনিষ্টের মূলে। এই সূত্রে মায়ের মনে আশঙ্কার জন্ম আর তারই ফল ভুগতে হচ্ছে
বৈশ্বানরকে। পরীক্ষা দোরগোড়ায়, এ সময়ে শরীর মন সুস্থ রাখার কথা অথচ বৈশ্বানর নার্সিংহোমের
বেডে শুয়ে। ভেবে অবশ্য লাভ নেই কোন। যা ঘটে
গেছে তা নিয়ে না ভেবে দ্রুত আরোগ্যের পথ খুঁজে নেওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। অনঙ্গ
সান্যাল আর মনস্বিনীর তৎপরতায় অনতিবিলম্বে শুরু হল চিকিৎসা সেই পরিচিত নার্সিংহোমে।
দু’একদিনের মধ্যেই ভাল
সাড়াও পাওয়া গেল বৈশ্বানরের দিক থেকে। যাক, ভয়ঙ্কর এক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা তো
পেল সে কিন্তু দু’একদিন যেতে না যেতেই মনস্বিনী লক্ষ্য
করল, তার চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না তো! যে চোখের তীব্র চাউনিতে মনে হয় ভেতরের সব পড়ে ফেলল বুঝি, সে চোখ এখন ভাষাহীন। মণস্বিনী জানালো অনঙ্গবাবুকে
সেকথা এবং বৈশ্বানরকে সাইকিয়াট্রিকের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিল তার সাথে। মনস্বিনীর
কথাটা অনঙ্গবাবু সমীচীন বলেই মনে করলেন। ডাক্তার বললেন, ‘আমার যা করার তা আমি করবো কিন্তু চিকিৎসার সাথে সাথে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয়
যেটা তা হল রোগীকে বুঝতে দিতে হবে সে একা নয়, তার চারদিকে শুভানুধ্যায়ীরা রয়েছে তাকে
সুস্থ করে তোলবার জন্য। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী
চিকিৎসা, পথ্য আর তার সাথে মনস্বিনীর কাউন্সেলিং, এই তিনে মিলে বৈশ্বানরকে সময়ের আগেই চাঙ্গা করে তুলল। নার্সিংহোমের
বিছানায় জাগ্রত বৈশ্বানরের মনে তখন কৃতজ্ঞতার একরাশ ফুল মনস্বিনীর উদ্দেশে অঞ্জলি দেবার
জন্য। মনস্বিনীর চোখের ভাষায় প্রেম দেখতে পায় বৈশ্বানর কিন্তু তার মনে যে কেবল কৃতজ্ঞতা
আর চোখে শ্রদ্ধা ছাড়া কিছুই প্রকাশ করতে পারে না সে!
(৯)
মনে চাপা ক্ষোভ নিয়ে দিন কাটাচ্ছে মনস্বিনী। কি প্রয়োজন ছিল পুরো পরিবারের উপর এমন একটি দুর্যোগ টেনে আনার! রক্ষণশীল মায়ের মন। এক বুক শঙ্কা তার মেয়েকে নিয়ে, এই বুঝি অজাত কুজাতের হাতে পড়ে মেয়েটার জীবন কলঙ্কিত হয়ে যায়। বৈশ্বানরের প্রতি মায়ের যতই ঘৃণা বিতৃষ্ণা থাক না কেন এমন একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কিছুতেই মায়ের পক্ষে সম্ভব হত না যদি না মাসী তাতে ইন্ধন জোগাতো। শুধু কি ইন্ধন, কোন সন্দেহ নেই মাকে শিখণ্ডী খাড়া করে সমস্ত ব্যাপারটাই ঘটিয়েছে মাসী। কিছুতেই কূল কিনারা খুঁজে পায় না মনস্বিনী, তার এত কাছের দু’জন মানুষ এমন একটা জঘন্য অপরাধের সংঘটক! অন্য কোন ঘর হলে হয়তো এতদিনে থানা- পুলিশ হয়ে যেত। কে চায় আপনজনকে, সে যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, পুলিশের হাতে তুলে দিতে! বৈশ্বানর এ ব্যাপারটাকে তার ভাগ্যবিড়ম্বনা বলেই মেনে নিল। সান্যালকাকু আর তার কন্যার কাছে তো সে চিরঋণী। জীবনের যে কোন দুর্যোগে এ দু’জনের সর্বাঙ্গীন সহযোগ ও আশ্বাস তাকে নতুন জীবন দিয়েছে বারবার। মনে মনে শপথ গ্রহণ করে সে, এ পরিবারের যে কোন দুর্যোগে দাঁড়াবে সে প্রহরীর মত। প্রয়োজনে প্রাণ বাজী রাখতেও পিছপা হবে না সে।
মনস্বিনী চিন্তিত বৈশ্বানরের
পরীক্ষার কথা ভেবে। ফাইনাল কিছুদিন পরেই। প্রমিসিং একটা ছেলে, কেবলমাত্র অনঙ্গবাবু
আর মনস্বিনী নয় পুরো কলেজ চেয়ে আছে তার মুখের দিকে কিন্তু শারীরিক মানসিক দু’দিক থেকেই
যে বিপর্যস্ত বৈশ্বানর। বইয়ের সঙ্গে কোন সম্পর্কই নেই তার। আচ্ছা, এমন করলে হয় না,
ভাবছে মনস্বিনী, নার্সিংহোমে আসার সময় একটি করে বই নিয়ে আসবে রোজ আর পড়ে শোনাবে বৈশ্বানরকে!
প্রস্তাবটা রাখল মনস্বিনী বৈশ্বানরের কাছে। বৈশ্বানরের চোখে আবার সেই কৃতজ্ঞতার ভাষা।
মনে মনে আর একবার নত হল মনস্বিনীর কাছে। সম্মতি না জানালে প্রস্তাবককে অসম্মান করা
হবে, আহত হবে শুভাকাঙ্ক্ষীর মন আর সেটা বৈশ্বানর করতে পারে না কখনো। মুখে বলল অবশ্য,
নিজের পড়ার ক্ষতি করে কেন মনস্বিনী তার জন্য সময়ের অপচয় করবে, কিন্তু মনস্বিনীর যুক্তির
কাছে শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতে হল তাকে।
অনঙ্গ সান্যালের ঘরে
এখন অদ্ভুত নীরবতা। কুন্তলা যেন অপরিচিত কোন ব্যক্তি যার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা
থাকতে পারে না। কুন্তলার গলায় সেই পরিচিত ঝাঁঝ নেই। ধরা পড়ে যাওয়া আসামীর মত তার আচরণ।
বড় মায়া হয় মনস্বিনীর মায়ের কথা ভেবে। মা এতদিনেও শহুরে হয়ে উঠতে পারলো না, ভাবে মনস্বিনী।
মায়ের সারাটি মন জুড়ে সেই গ্রামের স্মৃতি। বিয়ের আগে পর্যন্ত যা দেখেছে যা শুনেছে তাই
যেন বেদবাক্য তার কাছে। বাবা আর তার নিজের ভাবনাচিন্তা তাই এত অপছন্দ মায়ের। এই মা
তার বড় অসহায়। এই মাকে কী করে দূরে সরিয়ে রাখবে মনস্বিনী?
ঘটনাটি ঘটে যাবার পর
মেয়ের দিকে আর সোজাসুজি তাকাতে পারে না কুন্তলা। এটুকু অন্তত বোঝার ক্ষমতা আছে তার,
মেয়ের ভাল করতে গিয়ে বড় একটা বিপদ ডেকে এনেছে সে তার সংসারে। মনস্বিনীর নার্সিংহোমে
যাওয়াটা অপছন্দের হলেও বাধা দেবার মত সাহস করে উঠতে পারে না আগের মত। অনঙ্গবাবুও এ
ব্যাপারে জানতে চাননি কিছু কুন্তলার কাছে। কুন্তলার বোনও বিপদ বুঝে গা ঢাকা দিয়েছে।
একদিকে চিকিৎসা আর অন্যদিকে
অনঙ্গবাবু ও মনস্বিনীর মিলিত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ বৈশ্বানর।
পরীক্ষা দোরগোড়ায়। অনেকদিন সে ভাবে পড়াশোনা সম্ভব হয়নি তবে মনস্বিনীর বই পড়ে শোনানোর
ব্যবস্থা খুব কাজ দিয়েছে। এতদিন পড়া বন্ধ থাকার প্রভাব খুব ক্ষতিকর হত। মনস্বিনী বলল,
কেমন লাগল আমার পন্থাটি? দেখবেন, নতুন করে আর পড়া শুরু করতে হবে না আপনাকে। মৃদু হাসি
দেখা গেল ঠোঁটে। যেন বলতে চাইল, আপনার কাছে আর কতভাবে ঋণী হব আমি! মুখে বলল, ‘এমন একজন
টিউটর যে পেয়েছে তার সাফল্য কে আটকায়’। ‘তবে কি মনে হয়, উকিল না হয়ে আমি টিচার হব?
একজন স্কলার যখন আমাকে এতবড় একখানা কমপ্লিমেন্ট দিয়েছে তখন তাকে সম্মান জানাতেই হয়’,
কপট গাম্ভীর্যে কথাগুলো বলল মনস্বিনী। সজোরে মাথা নেড়ে বলল বৈশ্বানর, ‘অসম্ভব! টীচারশিপ
যদিও অতি মর্যাদসম্পন্ন জীবনপথ তবু বলবো আপনার মত স্বচ্ছ দৃষ্টির অধিকারী প্রবল যুক্তিবাদী
একজন মানুষকে নিপীড়িত অসহায় মানুষদের পক্ষে কথা বলার জন্য ভীষণভাবে প্রয়োজন সমাজের।
(ক্রমশ)

0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন