কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন

 


(১১)

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো এলে মনে হয় প্যাঁচার কথা। সাদা প্যাঁচা খুব সমাদৃত বাঙালির মধ্যে। আমার মনে হয় বাঙালির ফর্সার প্রতি ঝুঁকে থাকার এটাও আরেকটা দৃষ্টান্ত। যদিও আচার আচরণে সব প্যাঁচাই এক।

পঞ্চাশ বা চল্লিশ বছর আগেও এই রাজ্যের ও সমাজের ছবিটা ভিন্ন ছিল। পিলপিল করে এসে পড়েনি অবাঙালি সম্প্রদায়। পাঞ্জাবি এবং লেক মার্কেট অঞ্চলে কিছু দক্ষিণী পরিবার থাকতেন। পরিবার অনেকটাই তখনও একান্নবর্তী। চাহিদা কম। মানুষের মনোরঞ্জনগুলো ছিল একেবারেই অন্যরকম। প্রতিটি বাড়ির সামনে রক। আর সেখানে আলাদা আলাদা বয়স ভিত্তিক ও সময় ভিত্তিক আড্ডা বসত। ফলে প্রায় সারাদিন রকগুলিতে দেখা যেত হাসিমুখ মানুষ। সেই রক প্রতি সকালে যত্ন করে ধোয়া হতো। এই শহর তখনও পানের পিক ও গুটকাময় হয়ে ওঠেনি। পুরনো বাড়ির টঙে থাকত এজমালির ঠাকুরঘর। আমাদের এন্টালির বাড়িতেও ছিল। সেই ঘরটিতে একটি সাদা পেঁচা বাস করত। ছোটোবেলায় দেখেছি ঠাকুমা পুজো করতেন, বাড়ির শালগ্রামশিলা পুজো করতে আসতেন ঠাকুরমশাই। জানলার এক কোণে বসে থাকত সে। এভাবেই প্যাঁচা আমার খুব প্রিয় পাখি হয়ে গেল। পরে গড়িয়া এসেও সেখানে অনেক বছর পর্যন্তই ছিলো, বন জঙ্গল, পুকুর আর হরেক পাখির আস্তানা। লক্ষ্মী পেঁচা প্রায়ই দেখতাম আমাদের রাঙচিতার বেড়ার ওপর বা কার্নিশে, ছাদে।

পশুপাখি সম্বন্ধে দুর্বলতাটা কাকা জ্যাঠাদের সৌজন্যে। বাড়িতে ছিল দুটি একোয়ারিয়াম। একতলায় দেশি বিদেশি বিলিয়ে তিনটি কুকুর, আমার এক কাকার পাখির শখ ছিল। বিরাট ঘরের মতো খাঁচায় অসংখ্য বদরীপাখি, লাভবার্ড আর সিঁড়িতে খাঁচায় দুটো চন্দনা। আবছা অন্ধকার প্রাচীন কলকাতার সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে চন্দনার চোখ এড়াতো না কেউ। ছোটো কাকার ছিল বাক্সে ভরা সাদা ইঁদুর এমনকি বাবারও ছিল অনেক পায়রা আর গিনিপিগ পোষার নেশা। সব মিলিয়ে যে বাড়িটা একসময় গমগম করত ক্রমে সেই বাড়ির বাসিন্দারা ছড়িয়ে গেলেন সারা কলকাতায় ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে। তবে সেই সময় এমন সব মানুষ ও পাখিসহ একত্র সুখী পরিবার অনেক দেখা যেত।

ছোটোবেলায়  বেড়ে উঠছিলাম সবুজের মধ্য। গড়িয়ার এই অঞ্চলে নিম্নবিত্ত মানুষের বাস বেশি ছিল। কয়েকঘর শহরের লোক সবে বাড়ি করে এসেছেন। বাড়ি ছাড়ালেই পুকুর, বাঁশবন, মাটির বাড়ি, খোড়ো চাল বা টালির চাল বাড়ি।

বার ছিলো না বলে গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে পাড়া ঘুরে লুকোচুরি খেলতাম,রাস্তায় পিট্টু খেলতাম গাছে চড়তাম। বিকেলবেলা গরুর পাল নিয়ে ঘরে ফিরত রাখাল। এখন সেসব রূপকথা মনে হয়।

লালমণি নামের হিন্দুস্থানি ফর্সা বৌটি অনেকটা ঘোমটা দিয়ে লোটা করে দুধ দিয়ে যেত বাড়িতে। কখনও বাবার হাত ধরে খালের ওপারে খাটাল থেকে দুধ আনতে যাওয়া হতো।

চুরিটা ওই সময় করেছিলাম। শিয়ালদহ থেকে ফেরার সময় মা-বাবা কাঁসা পেতলের কোনও বাসন কিনতে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন রকমের বাসন আর বিভিন্ন রকমের বাটখারা কাউন্টারের ওপর ঝকঝক করছে। বছর তিনেক বয়স কাছে গেলে কাউণ্টার অবধি মাথা যায় না। প্রথমবার বাটখারা দেখলাম। আগে কখনো ওই বস্তু দেখিনি। একসময় সবচেয়ে ছোট্ট চকচকে বাটখারাটা এত ভালো লেগে গেল যে সবার অলক্ষ্যে প্যান্টের পকেটে চালান করে দিলুম। কিন্তু ফেরার পথটা বুক ঢিব ঢিব করতে লাগল। শেষে রাতে ঘুম হয় না ভয়ে। না ফেলতে পারি না গিলতে।

পরদিন মাকে বলে ফেললুম।  মনে রাখার মতো প্রহার হয়নি মনে আছে, কিন্তু চুরি করা অপরাধ এবং পুলিশ ধরে একথা জানানো হলো। এরপর বহুদিন ধরে আমার চোখে ভেসে উঠত বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। আমাকে জেলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ঘুম পাড়াতে গিয়ে মা নিজেই ঘুমিয়ে পড়লে পা টিপে টিপে বাগানে চলে যেতাম। আমার একার সাম্রাজ্যে। ওখানে পাশের পুকুরের গায়ে বিশাল যজ্ঞি ডুমুরের গাছ, সজনে গাছ। চেনা মাছরাঙাটা বসে থাকত। চারিদিক শুনশান, বড় ডাহুক পাখিটা আমাকে আমল না দিয়ে ঘোরাঘুরি করত বাগানময়, ছাতারে পাখি এসে উঠোনে গুলতানি করত আর দুটো বেনে বউ কী সব নিঃশব্দে বলাবলি করত। যতক্ষণ না বিকেল বেলা কামারপাড়ার গাবগাছ থেকে হনুমানের একটানা ডাক শুরু হতো।বিকেলের রোদ্দুরও ওই দিকেই তখন।

মানুষ বেশি তৃপ্ত থাকলে অর্থনৈতিক প্রসার শ্লথ হয়ে পড়ে। তাই ক্রমশ মানুষকে অসন্তুষ্ট করে দেওয়া শুরু হলো। রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি তার একটি উপায়। এখনও বিশ্বাস করি মার্কসের তত্ত্ব সঠিক। মনে করি ধন বৈষম্য ক্রমশ উর্দ্ধমূখীনতা, ক্রমশ এই মূল্যবোধের অবক্ষয় ব্যবসায়িক কারণে। ভোগবাদের আগ্রাসন মানুষকে শান্তি দিতে অক্ষম। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক তারা ভ্রষ্টাচার আটকাতে পারবে না।

যাইহোক, যত বড়ো হতে লাগলাম তত পাল্টে যেতে লাগল পরিবেশ। মানুষ ততদিন শান্তি সুখে ছিল যতদিন প্রয়োজনের অতিরিক্ত ও অতিব্যবহার ছিল না প্রাকৃতিক সম্পদের। একান্নবর্তী পরিবার থাকার কারণে ব্যক্তিগত অভাব কম ছিল, সবাই মিলে এক হাঁড়িতে অর্থনৈতিক সুবিধা অনেক ছিল।  ছিল সামাজিক সুরক্ষা।

একটি বাড়িতে অন্তত দুতিন ভাই একইসঙ্গে বসবাস হেতু ছিল না বৃক্ষ নিধন করে এত বহুতল গড়ে তোলার প্রয়োজন। ছিলো না প্রমোটারের দৌরাত্ম্য। তাই বাণিজ্যকরণের নামে আগে ভেঙে দেওয়া হলো সংযুক্ত পরিবার কাঠামো। আজ দেখা যাচ্ছে ছেলে মেয়ে মা বাবা এটুকুও একসঙ্গে থাকতে অসুবিধে হচ্ছে তাদের। সবাই আলাদা বাড়ি আলাদা খাদ্যের আয়োজন আলাদা ফ্রিজ সহ সব, ফলে ব্যবসায়ীরা খুশি। এই উর্দ্ধগামী চাহিদা সামাল দিতে গিয়ে বদলে যাচ্ছে মূল্যবোধ, ব্যবহার, মনের গঠন এমনকি মুখের সৌম্য রূপ আজ দেখা যায় না। কী যেন এক দুশ্চিন্তায় সকলে। এ যে রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র তা বোঝা গেলে হয়ত বিপ্লব একটি কবিতার ফ্যাশনেবল শব্দ মাত্র হয়ে থাকত না।

বর্ণমালার যুক্তাক্ষর শিখতে শিখতে একসময় শৈশব থেকে কৈশোর এসে দাঁড়াল চৌকাঠে।

এমন এক কোজাগরী রাতে জ্যোৎস্না মেখে পাশের পাড়ার মৈনাকদা হারিয়ে গেল। সত্যিই তাকে পাওয়া গেল লাশকাটা ঘরে। আমি ঠিক সেই সময় জীবনানন্দ সেই সময় শেষের কবিতার পাতায় নিজেকে দেখি মগ্ন হয়ে।

(ক্রমশ)


1 কমেন্টস্:

  1. আমার কাছে সুন্দর একটি দেওয়ালি গিফট । মনের খোরাক। বেশ কিছু দিন কেটে যাবে এদের নিয়ে। অকৃত্রিম ভালবাসা জানাই ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পাদক কাজল সেনকে শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও যে কথা রেখেছে । তাই তো প্রকাশ পেল কালিমাটি'র নভেম্বর সংখ্যা।

    উত্তরমুছুন